সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্যাজোট্রনে রাডার বিশেষজ্ঞ হিসেবে চাকরি করতেন অ্যাডলফ তোলকাচেভ। কিন্তু সোভিয়েত সরকারের নিপীড়নের শিকার হয়ে স্ত্রী নাতাশার বাবা-মায়ের পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার ঘটনায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে যান নিজের কর্মস্থল ও রাষ্ট্রের প্রতি। বনে যান সিআইএ-এর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ট; যার কাছে থেকে সিআইএ পেয়েছিল সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ সব নথিপত্র। তোলকাচেভের সাধারণ প্রকৌশলী থেকে অসাধারণ এক গোয়েন্দা হওয়ার সত্য ঘটনার চার পর্বের সিরিজের আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব।
অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পূর্ব পরিকল্পনা
তোলকাচেভকে নিয়ে সিআইএ যখন অভিযান শুরু করেছিল, তখন থেকেই তাদের ভাবতে হয়, তারা কীভাবে এই অভিযান শেষ করবে। তারা শুরু থেকেই তোলকাচেভের পরিবারকে যুক্তরাষ্ট্রে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে রেখেছিল। কিন্তু সেসময় যেসব তথ্য সোভিয়েত এজেন্ট সিআইএ-কে দিচ্ছিল, তার গুরুত্বও অনেক। সে কারণে তারা ঝুঁকি নিয়ে তাদের অভিযানকে দীর্ঘ করার চেষ্টা করছিল।
তোলকাচেভও তার অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত ছিল। তিনি জানতেন, যেকোনো সময় সিআইএ-এর সাথে তার সম্পর্ক শেষ হয়ে যেতে পারে কিংবা তিনি কেজিবির হাতে ধরা পড়তে পারেন৷ এ কারণে তিনি সিআইএ-এর কাছে বিষের বড়ি চেয়েছিলেন। যদি কখনো কেজিবির হাতে ধরা পড়েন, তাহলে তা খেয়ে আত্মহত্যা করবেন।
কিন্তু তার এই অনুরোধ সিআইএ রাখেনি। তারা তাকে বিষের বড়ি দিতে অসম্মতি জানায়। তোলকাচেভের ধারণা ছিল, যেকোনো মুহূর্তে কেজিবি বুঝতে পারবে যে, তাদের তথ্য পাচার হচ্ছে৷ আর যদি এমন হয়, তখন সন্দেহের তালিকায় প্রথম দিকে থাকবেন তিনি। তখন তার অ্যাপার্টমেন্ট তল্লাশি করা হবে। আর তা করলেই তিনি ধরা পড়ে যাবেন।
কারণ তিনি যেসব তথ্য তার পরিবারের কাছে থেকে লুকিয়েছিলেন, তা কেজিবির কাছে লুকানো সম্ভব ছিল না। তিনি তার সকল গোয়েন্দা সরঞ্জাম রান্নাঘরের এমন জায়গায় রাখতেন, যেখানে তার স্ত্রী নাগাল পাবেন না। কারণ তার স্ত্রী নাতাশার উচ্চতা তুলনামূলক কম ছিল।
তোলকাচেভ তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়ে খু্বই উদ্বিগ্ন ছিলেন। এ কারণে তিনি সিআইএ-কে ১৯৮০ সালের জুন মাসে অনুরোধ করেন, দ্রুত তাদের যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে। কিন্তু তখন তা সম্ভব হয়নি। কারণ তোলকাচেভের তথ্য পাচারের বিষয়টি তখনো সোভিয়েত সরকারের কোনো বাহিনী সামান্য পরিমাণও বুঝতে পারেননি। অন্যদিকে তোলকাচেভের পরিবার তার গোয়েন্দাগিরি সম্পর্কে জানতেন না। তাই তাদের রাজি করাও বেশ কঠিন ছিল।
কেস অফিসারের পরিবর্তন এবং অভিনব পন্থায় যোগাযোগ
তোলকাচেভের প্রথম কেস অফিসার জন গুলিশার শুরু থেকেই তার সাথে একটি ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে পেরেছিলেন এবং তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করতেও সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু তাকে পেশাগত কারণেই মস্কো ছেড়ে যেতে হয়। যার কারণে সিআইএ তাদের এজেন্টকে পরিচালনা করার জন্য নতুন কেস অফিসার হিসেবে ডেভিড রোলফকে নিয়োগ করে। তাদের ধারণা ছিল, তোলকাচেভ বিষয়টি ভালোভাবে গ্রহণ করবেন না। কিন্তু ১৯৮০ সালের ১৪ অক্টোবর, নতুন কেস অফিসারের প্রথম সাক্ষাতেই তিনি ভাব জমান।
সেদিন তোলকাচেভ তার নতুন কেনা গাড়িতে সাক্ষাত করেন। রাস্তায় হেঁটে কথার বলার চেয়ে শীতের মধ্যে গাড়ির ভেতরের গরমে বসে কথা বলা সন্দেহের তেমন কিছু ছিল না। যদিও কেজিবির পক্ষে গাড়ির নম্বর প্লেট থেকে বুঝতে অসুবিধা হতো না যে, এই গাড়ি কেমন ব্যক্তির হতে পারে। তবে সিআইএ-এর কেস অফিসার যখনই তোলকাচেভের সাথে দেখা করতেন, তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের বেশ ধরে যেতেন, যাতে তাকে কেউ সন্দেহ না করে।
১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে সিআইএ হেডকোয়ার্টার থেকে শর্ট রেঞ্জ এজেন্ট কমিউনিকেশন (এসআরএসি) পদ্ধতিতে তোলকাচেভের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তোলকাচেভ যদি কখনো জরুরিভাবে দেখা করতে চান অথবা ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাত না করেই কোনো নথি আদান-প্রদান করতে চান, তাহলে এই পদ্ধতিতে যোগাযোগ করা সম্ভব হবে।
সিআইএ হেডকোয়ার্টার থেকে সবচেয়ে উন্নত এসআরএসি প্রযুক্তি সরবরাহ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে যোগাযোগ করার জন্য এজেন্ট ও কেস অফিসারকে একই ধরনের দুইটি বিশেষ যন্ত্র দেওয়া হয়। যেগুলো আকারে দুইটি সিগারেটের প্যাকেট একত্রিত করলে যতটুকু হয়, ঠিক ততটুকু। এর সাথে বিচ্ছিন্ন করা যায় এমন অ্যান্টেনা, রুশ অথবা ইংরেজি লেখার কি-বোর্ড, ব্যাটারি, ব্যাটারির প্যাকেট, চার্জার ও নির্দেশাবলি দেওয়া ছিল।
তারা কখনো যোগাযোগ করতে চাইলে, এজেন্ট ও কেস অফিসার- উভয়কে নির্দিষ্ট একটি বোতাম চেপে বার্তা পাঠাতে হতো। সেটি আবার পরিবর্তিত হয়ে অসংখ্য শব্দ তৈরি করত, যা সেই যন্ত্রের স্ক্রিন দিয়ে স্ক্রল হয়ে যেত এবং মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরেই মুছে যেত।
এই পদ্ধতিতে যোগাযোগ করার জন্য প্রথমে তোলকাচেভ রাস্তার আশেপাশে কোথাও চক দিয়ে সংকেত দিয়ে রাখতেন। এরপর তা কেস অফিসার দেখলে তাদের আগে থেকে নির্ধারণ করা সময়ে ইলেকট্রনিক বার্তা পাঠানোর স্থানে চলে যেতেন। সেখানে তারা দুজন খুব বেশি দূরে থাকতেন না, তবে তাদের দুজনকে দেখা যেত না। ভালোভাবে বার্তা পাঠানো যায়- এমন দূরত্বে তারা অবস্থান করতেন।
এরপর তারা যখন বার্তা আদান প্রদান করতেন, তখন সেটি যথাযথভাবে পৌঁছেছে কিনা- সে বিষয়েও নিশ্চিত হতেন। এর জন্য তারা বিশেষ কায়দায় গাড়ি পার্ক করে রাখতেন। তবে তোলকাচেভের সাথে সরাসরি সাক্ষাতের পরিবর্তে আরো অনেকগুলো ভিন্ন উপায়ে যোগাযোগ করা হতো।
১৯৮১ সালের নভেম্বরে তোলকাচেভকে একটি শর্ট ওয়েভ রেডিও এবং দুইটি ওয়ান টাইম প্যাড দেওয়া হয়। এটি ছিল ‘ইন্টারাম-ওয়ান-ওয়ে-লিঙ্ক’ পদ্ধতিতে যোগাযোগ। এর সাথে তাকে একটি ডিমড্যুলেটর দেওয়া হয়, যেটি শর্টওয়েভ রেডিওর সাথে লাগিয়ে কেস অফিসারের পাঠানো বার্তাগুলো গ্রহণ করতেন।
নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট সময়ে মাত্র ১০ মিনিটের জন্য শর্টওয়েভ রেডিওতে বার্তা পাঠানো হতো। এর সাথে যুক্ত ডিমড্যুলেটরের লাগিয়ে তোলকাচেভ সেসব বার্তা গ্রহণ করতেন। এরপর ডিমড্যুলেটরের স্কিন থেকে সেসব বার্তা বিশ্লেষণ করতেন।
প্রথমে পাঠানো হতো তিন অঙ্কের একটি সংকেত, যার অর্থ- তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পাঠানো হয়েছে৷ এরপর পাঠানো হতো পাঁচ অঙ্কের সংকেত, যার অর্থ তিনি ওয়ান টাইম প্যাডের সহায়তায় বের করতেন। এভাবে একবারে তাকে ৪০০ কিংবা তারও বেশি পাঁচ অঙ্কের সংকেত পাঠানো হতো।
কিন্তু এই পদ্ধতিতে যোগাযোগ করা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ তার অ্যাপার্টমেন্ট তার বিশেষ কোনো কক্ষ ছিল না। এ কারণে তাকে এসব কাজ তার স্ত্রী কিংবা সন্তানের সামনে করতে হবে, যা অসম্ভব! তার স্ত্রী ও সন্তান তারও পরে ঘুমাতেন। ফলে রাত জেগে এই পদ্ধতিতে তিনি যে যোগাযোগ করবেন- সেটিও সম্ভব ছিল না।
পরে সময় পরিবর্তন করে অফিসের দিনগুলোর সকালের দিকে আনা হয়। কিন্তু এর মধ্যে তোলকাচেভের অফিসে নিয়ম করা হয় যে, লিখিত কোনো কারণ দর্শানো ছাড়া অফিস চলাকালীন কেউ বাইরে যেতে পারবেন না। ফলে তাকে বাধ্য হয়ে সব যন্ত্রপাতি ফেরত দিতে হয়৷
এরপর তারা আবারো সরাসরি দেখা করার মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করতেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তোলকাচেভ ও তার কেস অফিসার মোট ১০ বার দেখা করেন। যদিও এর মধ্যে কেজিবি মস্কোতে তাদের নজরদারি অনেক বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে কেস অফিসারে দেখা করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। তখন তারা আরো একটি অভিনব পদ্ধতির ব্যবহার করেন। যে পদ্ধতির নাম ছিল ‘জ্যাক-ইন-দ্য বক্স’ বা ‘জিব’।
জিব হচ্ছে এক ধরনের পপআপ ডিভাইস, যা দেখতে একজন মানুষের উপরিভাগের আকৃতির মতো। স্বাভাবিকভাবে জিব দেখতে একটি বড় প্যাকেটের মতো। যখন এটি সচল করা হতো, তখন তা মানুষের আকৃতি ধারণ করত। জিব ব্যবহার করে সিআইএ এর কেস অফিসার কেজিবির কঠোর নজরদারি মধ্যেও তোলকাচেভের সাথে দেখা করতেন।
তোলকাচেভের সাথে বৈঠক আগে থেকে ঠিক করার পর তার কেস অফিসার ও সিআইএ এর আরো কিছু সদস্য জিব নিয়ে গাড়িতে উঠতেন। এরপর পূর্বপরিকল্পিত রাস্তা দিয়ে গাড়ি নিয়ে যেতেন। যদি তাদের কোনো গাড়ি অনুসরণ করে, তাহলে কেস অফিসারের গাড়ির চালক অল্প সময়ের মধ্যে অনেকগুলো বাঁক দিয়ে কেজিবির গাড়ির আড়ালে চলে যেতেন।
এরপর গাড়ির গতি কমিয়ে আনা হতো। তখন কেস অফিসার দ্রুত গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে কোথাও লুকিয়ে পড়তেন। এরপর গাড়ির মধ্যে জিব সচল করে দেওয়া হতো। তখন গাড়ির পেছন থেকে মনে হতো ভেতরে কেউ বসে আছেন। এরপর সেই গাড়ি কোনো কর্মকর্তার বাড়ির সামনে গিয়ে থামতো। আর জিব আবারো প্যাকেট হয়ে গাড়ি থেকে বের হতো।
এদিকে কেস অফিসার গাড়ির মধ্যেই রাশিয়ান কোট ও টুপি পড়ে স্থানীয় কোনো লোকের বেশ ধরে গণপরিবহনে উঠে তোলকাচেভের সাথে দেখা করার স্থানে চলে যেতেন৷ তবে এর আগে নিশ্চিত হতেন, তাকে এখনো নজরদারি করা হচ্ছে কিনা। এরপর কাজ শেষ করে তিনি আবারো গণপরিবহনে করে দূতাবাসে ফিরতেন।
তবে এই পদ্ধতি খুব বেশি ব্যবহার করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কারণ অনেক সময় দেখা যেত, কেজিবি সদস্যরা সন্দেহজনক গাড়ীর রাস্তা আটকে দিত, আবার কখনো চাকা ফুটো করে দেওয়া হতো। পাশাপাশি সেসব গাড়ি ও তার মধ্যে থাকা লোকজনের ওপর নজরদারি আরো জোরদার করা হতো।
আরো বেশি অর্থ দাবি
ধীরে ধীরে তোলকাচেভ তার কাজের জন্য পারিশ্রমিক বাড়াতে থাকেন। এর আগে তাকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বার্ষিক বেতনের সমান অর্থ বন্ড আকারে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সেই সাথে তার উপর ৮.৫ শতাংশ হারে মুনাফা। ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে তিনি সিআইএকে জানান তাকে এই মুনাফার অর্থ প্রতি বছরের শেষে দিতে হবে। তখন নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকার পরও সিআইএ তার প্রস্তাবে রাজি হয়।
১৯৮১ সালের নভেম্বরে তাকে মুনাফা হিসেবে ৪০ হাজার ডলার দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তোলকাচেভ সিআইএ-কে লেখা এক চিঠিতে বলেন, বন্ডের সুদের হারের টাকা তাকে মস্কোর কালো বাজারের হারে দিতে হবে; যা তাকে আগে দেওয়া অর্থের চারগুণ বেশি ছিল। কিন্তু সিআইএ-এর রাজি হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। কারণ তোলকাচেভ যেসব তথ্য দিচ্ছেন, তার অর্থমূল্য ছিল কয়েক বিলিয়ন ডলার।
তবে সিআইএ এত বিপুল অর্থ দিতে রাজি থাকলেও, তোলকাচেভের নিরাপত্তা নিয়ে সন্দিহান ছিল। কারণ তিনি যদি হঠাৎ করে এত অর্থ ব্যয় করতে শুরু করেন, তাহলে যে কারো নজরে পড়ে যাবেন। এর চেয়ে মূল্যবান কোনো গহনা অথবা সোনার মুদ্রা নিরাপদ ছিল। বিষয়টি তোলকাচেভকে জানানো হলে তিনি রাজি হন। তবে তার একটি দাবি ছিল। তা হলো তাকে ঊনিশ শতক অথবা বিশ শতকের শুরুর দিকের রাশিয়ায় তৈরি দামি গহনা দিতে হবে।
কিন্তু এরপরও ১৯৮২ সালের ডিসেম্বরে তোলকাচেভ বড় অঙ্কের অর্থ জমানোর কথা ভাবেন। তার ভাবনা ছিল, তিনি যদি কখনো ধরা পড়েন তাহলে সেই অর্থ ঘুষ হিসেবে দেবেন। কিন্তু তার এই পরিকল্পনা সিআইএ পছন্দ করেনি৷ যার কারণে তারা তোলকাচেভের এই প্রস্তাব নাকচ করে দেন।
তবে তোলকাচেভ শুধু অর্থই দাবি করেননি। মাঝে মাঝে কিছু ব্যক্তিগত জিনিসপত্রও চেয়ে বসতেন। তিনি তার ছেলে ওলেগকে খুব ভালোবাসতেন। ওলেগ আবার পশ্চিমা রক অ্যান্ড রোল গান পছন্দ করতেন। ১৯৮০ সালের অক্টোবরে তোলকাচেভ তার ছেলের জন্য কিছু জনপ্রিয় রক অ্যান্ড রোল গানের ক্যাসেট ও একটি স্টেরিও দেওয়ার অনুরোধ করেন সিআইএ-কে।
১৯৮১ সালে মার্চে, সিআইএ সেসব তাকে দেন। তবে তারা এসব ক্যাসেট নিয়ে অস্বস্তি বোধ করছিলেন। তোলকাচেভ তাদের আশ্বস্ত করেন যে, এসব ক্যাসেট মস্কোর কালোবাজারে পাওয়া যায়। এরপর তিনি স্টেরিওতে গান শোনার জন্য একটি হেডফোনও দিতে বলেন। আবার কখনো তিনি ছেলের জন্য পেন্সিল, বই থেকে শুরু করে বিদেশী রেজার ব্লেড পর্যন্তও চেয়ে বসতেন। নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদেই সিআইএ তোলকাচেভের এসব আবদার পূরণ করতো।
সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর তথ্যের নিরাপত্তা জোরদার
তোলকাচেভের অফিসে ১৯৮০ সালে বাতিল করা নিয়ম ১৯৮১ সালের নভেম্বরে আবারো চালু করা হয়। তখন আবারো নথিপত্র দেখতে হলে তাকে তার অফিসের পাস কার্ড জমা দিতে হবে। এরপর যখন তিনি সেসব ফেরত দেবেন, তখনই পাস কার্ড নিয়ে বাইরে যেতে পারবেন। এ কারণে ডিসেম্বরে তিনি হঠাৎ করে সিআইএ-কে তলব করেন৷ কেস অফিসারের জরুরী বৈঠক করে তাকে নতুন করে ভুয়া পাস কার্ড তৈরি করে দিতে বলেন। কারণ আগের ভুয়া কার্ডের রং আসল কার্ডের সাথে মিলছিল না।
তোলকাচেভ তখন তার আসল পাস কার্ডটি কেস অফিসারকে দেন। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির ছুটির সময় তার এই কার্ডের প্রয়োজন ছিল না। এই সময়ের মধ্যে আরেকটি ভুয়া পাস কার্ড তৈরি করে দিতে বলেন। কিন্তু কেস অফিসার তাকে নিশ্চয়তা দিতে পারছিলেন না। কারণ কাজটি খুবই জটিল ছিল। যদিও তারা শেষ পর্যন্ত আরেকটি ভুয়া পাস কার্ড তৈরি করে দেন।
কিন্তু এর আগেই তোলকাচেভ বিভিন্ন কৌশলে অফিসের নথি বাসায় নিয়ে সেসবের ছবি তুলতেন। গ্রন্থাগারে বলতেন তিনি যেসব কাগজের নিয়েছেন, সেসব তার বস দেখছেন। এরপর সেখান থেকে তার পাস কার্ড ও নথিপত্র নিয়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে ছবি তুলে আবার ফিরে আসতেন৷ এভাবে তিনি ডিসেম্বর ও ফেব্রুয়ারিতে কয়েক ডজন ফিল্ম তিনি সিআইএ-কে দেন।
এরপর তার অফিস থেকে নিয়ম করা হয় যে, কোনো কর্মী তাদের বসের স্বাক্ষর করা চিরকুট ছাড়া অফিস চলাকালীন বাইরে যেতে পারবেন না। তবে দুপুরের খাবারের সময় এই নিয়ম প্রযোজ্য ছিল না। এই নিয়মের ফলে সিআইএ-এর সাথে শর্টওয়েভ রেডিওর মাধ্যমে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ তখন তিনি সকালে আর বাসায় যেতে পারতেন না।
এই খবর শোনার পর সিআইএ বুঝতে পারে যে, সোভিয়েত সরকার হয়তো কোনো কিছু টের পেয়ে গেছে। এ কারণে তারা দিনদিন এত কঠোর হচ্ছে। সেই সময় তোলকাচেভ আবার তাকে বিশেষ ক্যামেরা দিতে বলেন, যাতে তিনি অফিসে বিভিন্ন নথিপত্রের ছবি তুলতে পারেন। কিন্তু সিআইএ এই কাজকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছিল।
ফেব্রুয়ারি ও মার্চে তোলকাচেভ এবং তার কেস অফিসার দেখা করে আলোচনা করে যে, অফিসের কঠোর নিয়মকানুনের মধ্যেও কীভাবে তারা কাজ চালিয়ে যেতে পারেন। সেসময় কেস অফিসারকে অবাক করে দিয়ে তোলকাচেভ এক ডজনের বেশি ফিল্ম দেন। যেগুলো তিনি ৩৫ মিলিমিটার ক্যামেরা দিয়ে তুলেছেন এবং তার অফিসেই কাজটি করেছেন। কেস অফিসারের চোখ ছানাবড়া হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা!
তোলকাচেভ তখন বলেন, তিনি টানা তিনদিন অফিসে লুকিয়ে এই ক্যামেরা নিয়ে গেছেন। তখন সিআইএ তাকে তৃতীয় প্রজন্মের নতুন স্পাই ক্যামেরা দেয়। কারণ তার পক্ষে অফিস থেকে নথিপত্র বাসায় নিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন ছিল। ফলে তাকে গোপনে অফিসেই এই কাজ করে যেতে হয়।
পরিবার নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা
সিআইএ শুরু থেকে তোলকাচেভ ও তার পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে এসেছে। এ কারণে তারা তোলকাচেভের পরিবারকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছিল। যদি কখনো তারা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হন, তাহলে সাথে সাথে তাদের যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
১৯৭৯ সালেই তোলকাচেভকে দেশত্যাগের প্রস্তাব দিয়েছিল সিআইএ। কিন্তু তিনি তখন জানান, তার সোভিয়েত ইউনিয়ন ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছা নেই। কিন্তু যদি তার ছেলে ও স্ত্রী সেখানে যেতে রাজি হয়, তাহলে তিনি যেতে রাজি। কিন্তু সমস্যা হলো তোলকাচেভের স্ত্রী ও ছেলে তার গোয়েন্দাগিরির কাজ সম্পর্কে জানতেন না। ফলে সিআইএ-কে বাধ্য হয়েই উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
১৯৮৩ সালের জানুয়ারিতে যখন তোলকাচেভের অফিসের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়, তখন তার ধারণা হয়েছিল যে, হয়তো তথ্য ফাঁসের বিষয়টি সরকার জেনে গেছে। তখন সিআইএ তাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ইসরায়েল, এরপর সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন।
কিন্তু তোলকাচেভের পরিবারের কোনো সদস্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ছেড়ে চিরদিনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যেতে রাজি ছিলেন না৷ তার স্ত্রী ও সন্তানকে কৌশলে জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিন্তু তাদের দুজনের কেউই রাজি না হওয়ায় তাকে আরো অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়৷ কিন্তু তার সেই অপেক্ষা আর শেষ হয়নি। তোলকাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়ন ছেড়ে যেতে পারেননি৷ তার আগেই তিনি আটক হন। কিন্তু কীভাবে? সেটি জানতে পড়ুন সিরিজটির চতুর্থ ও শেষ কিস্তি।
একুশে বইমেলা ‘২০ উপলক্ষে রোর বাংলা থেকে প্রকাশিত বইগুলো কিনতে এখনই ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে-
১) ইহুদী জাতির ইতিহাস
২) সাচিকো – নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক শিশুর সত্য ঘটনা
৩) অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে