
কোনো দেশে আইনের শাসন দুর্বল হলে, বিদেশী শক্তির মদদ থাকলে আর সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মারাত্মক দুর্বল হলে কী হয়? একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান। আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোর ভাগ্য এমনই খারাপ। স্বাধীনতার পর থেকেই দেশগুলোতে জেঁকে বসেছে একের পর এক সামরিক শাসক। এখানে আফ্রিকা অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত একনায়কদের নিয়ে আলোচনা করা হলো। বহুল পরিচিত মুয়াম্মার গাদ্দাফী, রবার্ট মুগাবে, ইদি আমিন কিংবা বেন আলীর মতো শাসকদেরকে এই তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে। তাদের নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে লেখা হবে পরবর্তীতে।
সিয়াদ বারে
দেশ: সোমালিয়া
শাসনকাল: ৩২ বছর
১৯৬৯ সালে সিয়াদ বারে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সোমালিয়ার ক্ষমতা দখল করেন। ১৯১৯ সালে ইথিওপিয়ার সোমালি অধ্যুষিত অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করা সিয়াদ জীবনের শুরু দিকের বছরগুলি কাটিয়েছিলেন ইতালি নিয়ন্ত্রিত সোমালিল্যান্ডে। ষাটের দশকে সামরিক বাহিনীতে থাকাকালে সোভিয়েত সামরিক উপদেষ্টাদের বদৌলতে সিয়াদ সমাজতান্ত্রিক মতবাদের পথে ঝুঁকে পড়েন। সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট শেরমার্কে মারা গেলে সিয়াদ ক্ষমতা দখল করেন। সিয়াদের শাসনকালে সোমালিয়া সমাজতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসরণ করে, সরকারি নিয়ন্ত্রণে যৌথ খামার জাতীয় প্রকল্প চালু হয়। সোমালিয়ার মানুষ শিক্ষা বা স্বাস্থ্য খাতেও উল্লেখযোগ্য সাফল্য পায়।

সিয়াদ বারে; Source: Guardian
তবে আর দশজন একনায়কের মতো সিয়াদও প্রতিপক্ষের ওপর ভয়ানক দমন-পীড়ন চালাতেন। এছাড়া তার ঘনিষ্ঠ লোকদের দুর্নীতি আর অত্যাচারেও তিনি লাগাম পরাতে ব্যর্থ হন। গোত্র ভিত্তিক সোমালি সমাজ সিয়াদের আধুনিক শাসন মেনে নিতে পারলো না শেষপর্যন্ত। ১৯৯১ সালে বিরোধী গোষ্ঠীগুলির সামরিক মদতে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। সিয়াদ ১৯৯৫ সালে নাইজেরিয়াতে নির্বাসিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
চার্লস টেইলর
দেশ: লাইবেরিয়া
শাসনকাল: ৮ বছর
যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বেন্টলি কলেজ থেকে পড়াশোনা শিখে এসে চার্লস টেইলর লাইবেরিয়ার সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। একসময় তহবিল তছরুপের দায়ে তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি লিবিয়াতে যান। পরে মুয়াম্মার গাদ্দাফির আর্থিক সহায়তায় ন্যাশনাল প্যাট্রিওটিক ফ্রন্ট গঠন করেন। এরপর লাইবেরিয়াতে গৃহযুদ্ধ বেধে যায়।

চার্লস টেইলর; Source: BBC
১৯৯৬ সালে টেইলরের দল দেশের অধিকাংশ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। পরের বছর নির্বাচনে জিতে তিনি দেশের ২২তম প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেন। তবে পরিস্থিতি সুস্থির ছিল না। ১৯৯৯ সালে আরেক দফা গৃহযুদ্ধ বেধে যায় সেখানে। এটা ছিল প্রতিবেশী সিয়েরা লিয়নের গৃহযুদ্ধের স্পিল ওভার ইফেক্ট। ২০০৩ সালে ক্ষমতাচ্যুত হলে তিনি নাইজেরিয়াতে পালিয়ে যান। পরে সিয়েরা লিয়ন থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। আন্তর্জাতিক আদালত তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে ৫০ বছরের কারাদন্ড দেয়।
চার্লস টেইলরের বাহিনী দুই গৃহযুদ্ধেই গণহত্যা, ধর্ষণ বা অঙ্গচ্ছেদের মতো অপরাধ করেছিলেন। লাইবেরিয়ার কাঠ এবং অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ পাচার করে প্রচুর অর্থ কামিয়েছিলেন তিনি।
জ্যঁ বোকাসা
দেশ: মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র
শাসনকাল: ১৩ বছর
তিনি ছিলেন মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলে। একসময় ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৪ সাল ব্যাপী ইন্দোচীনের যুদ্ধে দারুণ বীরত্ব দেখান। একপর্যায়ে সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন খেতাব অর্জন করেন। ১৯৬০ সালে তারই দূরসম্পর্কের আত্মীয় ডেভিড ডেকো মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রকে ফরাসী শাসন থেকে মুক্ত করেন। এরপর তিনি ডেকোর সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে যোগ দেন। ছয় বছর পরে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতা দখল করে নেন। এদিকে ডেকো ফ্রান্সে পালিয়ে যান।

সম্রাট বোকাসা; source: Irish Times
বোকাসা ছিলেন অত্যাচারী, দুর্নীতিবাজ এবং পাগলাটে প্রকৃতির শাসক। ১৯৭৬ সালে তিনি নেপোলিয়নের আদতে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রকে রাজতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেন। এ ঘোষণা উৎসব উদযাপনে তিনি খরচ করেন ২ কোটি মার্কিন ডলার। গরিব দেশটি আক্ষরিক অর্থেই দেউলিয়া হয়ে যায় এর ফলে। হীরক খচিত মুকুটটির মূল্যই ছিল ৫০ লক্ষ মার্কিন ডলার। শাসনকালের শুরুর দিকে অবশ্য তিনি দেশে অনেক সামাজিক সংস্কার করেছিলেন কিন্তু কোনোটাই স্থায়ী হয়নি।
১৯৭৯ সালে ফ্রান্স সমর্থিত এক সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর ডেকো পুনরায় সরকার গঠন করেন। বোকাসাকে প্রথমে মৃত্যুদণ্ড ও পরে আজীবন কারাবাসের শাস্তি দেওয়া হলেও ১৯৯৩ সালে মাত্র ছয় বছর কারাবাসের পর তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তিন বছর পর স্বদেশের রাজধানী বাঙ্গুইতে তিনি মারা যান।
বোকাসার শাসনকাল ছিল খ্যাপাটে এবং অত্যাচারী কর্মকান্ডে ভরপুর। তার সময় দুই বার চুরি করে ধরা পড়লে মানুষের কান কেটে নেওয়া হতো। তিনবার চুরি করলে কাটা পড়তো হাত। স্ত্রীর প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিক্রয়কৃত ইউনিফর্ম পরতে রাজি না হওয়ায় একবার তার নেতৃত্বে ১০০ স্কুল শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়।
মোবুতু সেসে সেকো
দেশ: কঙ্গো
শাসনকাল: ৩২ বছর
জর্জ ফোরম্যান আর মোহাম্মদ আলীর ঐতিহাসিক ‘রাম্বল ইন দ্য জাঙ্গল’ এর কথা মনে আছে? বিখ্যাত বক্সিং ম্যাচটি আয়োজিত হয়েছিল কঙ্গোতে, মোবুতু সেসে সেকোর শাসনামলে। তখন অবশ্য দেশটির নাম ছিল জায়ারে। ১৯৬০ সালে কঙ্গোতে ব্যাপক দাঙ্গা হাঙ্গামা বেধে যায়। একদিকে ছিলেন জাতীয়তাবাদী নেতা প্যাট্রিস লুমুম্বা আর আরেকদিকে বেলজিয়ান সরকার এবং তাদের তাবেদার গোষ্ঠী। মোবুতু ছিলেন এই গোষ্ঠীর নেতা। লুমুম্বাকে ১৯৬১ সালে হত্যা করা হয়। মোবুতু ক্ষমতা দখল করেন ১৯৬৫ সালে।

মোবুতু; Source: Youtube
মোবুতুর শাসনকাল ছিল দমন পীড়ন এবং দুর্নীতিতে ভরপুর। প্রায় ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার তিনি নিজের পকেটে ভরেছিলেন। বিলাসবহুল কনকর্ড বিমানে চড়ে তিনি প্যারিসে কেনাকাটা করতে যেতেন। মেয়ের বিয়েতে গহনাই কিনেছিলেন প্রায় ৩০ লাখ মার্কিন ডলার সমমূল্যের। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন খড়গহস্ত, কাজেই চীন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে খুবই তোয়াজ তুষ্টি করতো। তিনি ছিলেন জায়ারের ‘জাতির পিতা’, ‘বিপ্লবের অগ্রদূত’, ‘প্রতিষ্ঠাতা নেতা’, ‘জনগণের ত্রাতা’ ইত্যাদি। দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতিতে আকন্ঠ ডুবে থাকায় জায়ারের মানুষের বিশেষ কোনো উন্নতিসাধন তার আমলে হয়নি।
প্রথম কঙ্গো যুদ্ধের সময় লরাঁ কাবিলার নেতৃত্বে তাকে ১৯৯৭ সালে উচ্ছেদ করা হয়। ১৯৬৫ সালে চে গুয়েভারা কঙ্গোতে এলে এই কাবিলার সাথে জোট বেধেছিলেন কঙ্গোতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করবার জন্য।
ওমর বঙ্গো
দেশ: গ্যাবন
শাসনকাল: ৪২ বছর
১৯৬৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ঝাড়া ৪২ বছর ধরে গ্যাবন শাসন করেছেন ওমর বঙ্গো। তেল সম্পদে সমৃদ্ধ দেশটির হর্তাকর্তা হয়েও তিনি উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি আনতে পারেননি। তিনি ছিলেন ফ্রান্সের সেরা বন্ধুদের একজন। ফরাসি সরকার তাকে বিপুল অর্থ আর অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিত। গ্যাবনে ফরাসী সৈন্যদের ঘাঁটি গড়বার অনুমতি দিয়ে তিনি ফ্রান্সকে কৃতার্থ করে দিয়েছিলেন। অবশ্য এতে তার নিজের স্বার্থও ছিল। ফরাসী সেনারা তাকে একবার এক সামরিক অভ্যুত্থান থেকে বাঁচিয়েছিল।

ওমর বঙ্গো; source: Daily Mail
বঙ্গোর শাসনামলে গ্যাবন আর ফ্রান্সের মধ্যে রীতিমত হার্দিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। গ্যাবনের ইউরেনিয়াম দিয়ে ফরাসী পরমাণু বোমা বানানো হতো। তিনি সস্তায় তেল রপ্তানি করতেন ফ্রান্সে। বঙ্গোর ভাষ্যমতে, ফ্রান্স ছাড়া গ্যাবন হচ্ছে চালকবিহীন গাড়ির মতো। আর গ্যাবন ছাড়া ফ্রান্স হচ্ছে তেলবিহীন গাড়ি। তা গাড়ি ঠিকমত চলার জন্য বঙ্গো আর ফ্রান্স দুই পক্ষেরই চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না।
প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ গ্যাবনে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারবার কৃতিত্ব দেওয়া হয় বঙ্গোকে। তবে এটাও সত্যি যে তার ৪২ বছরের শাসনামলে গ্যাবনে বিশেষ কোনো উন্নতি সাধিত হয়নি। দেশটির মাথাপিছু আয় আফ্রিকার অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় অনেক বেশি হলেও সিংহভাগ জনগণ দরিদ্রই রয়ে গিয়েছে। ২০০৯ সালে ওমর বঙ্গোর মৃত্যু হলে তার ছেলে আলী বঙ্গো ক্ষমতায় বসেন। অদ্যাবধি তিনিই গ্যাবন শাসন করছেন।
ওমর আল বশির
দেশ: সুদান
শাসনকাল: ২৯ বছর (চলমান)
মিশরের মিলিটারি অ্যাকাডেমির ছাত্র ওমর আল বশির ১৯৮৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। তারপর থেকেই তিনি সুদানের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে বসে আছেন। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সুদানের গৃহযুদ্ধ তার শাসনামলকে বাধাগ্রস্থ করেছে বারবার। ২০১১ সালে দক্ষিণ সুদান নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়। তবে সুদানবাসীদের পক্ষে আর শান্তি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। ২০০৩ সাল থেকে চলে আসা দারফুরের যুদ্ধ এখনো চলমান। ওমর আল বশিরের সেনাবাহিনীর হত্যা নির্যাতন অঞ্চলটিকে বিধ্বস্ত করে ফেলেছে।

যুদ্ধক্ষেত্রে ওমর আল বশির; source: CNN
২০০৯ সালে ওমর আল বশিরের বিরুদ্ধে গণহত্যা, নির্যাতন ইত্যাদি নানা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। তবে তিনি এখনো বহাল তবিয়তে সুদান শাসন করে চলেছেন।
ফিচার ইমেজ- iNews