Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

৬টি জাতীয় সঙ্গীতের যত বিচিত্র পটভূমি

জাতীয় সঙ্গীত যেকোনো জাতির কাছেই আবেগের একটি জায়গা, অনুপ্রেরণার সীমাহীন আধার। সেই জাতীয় সঙ্গীতের পটভূমি নিয়ে বিচিত্র কিছু ঘটনা ছড়িয়ে আছে বিশ্বময়, জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে শরীরের রোমে আবেগের শিহরণ তুলবার আগে যে ঘটনাগুলো আপনার ভ্রুকুঞ্চনের কারণ হতে পারে কিংবা অক্ষীগোলক স্ফীত হবার কারণ হতে পারে বা নির্দোষ হাসির কারণ হতে পারে। আজ জানানো হবে তেমনই ৬টি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের মজার সব পটভূমি।

১) মালয়েশিয়া: ক্ষণিকের এক ভুলে

১৮৮৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশীয় মালয়েশিয়ার পেরাক প্রদেশের সুলতান আব্দুল্লাহ মাহমুদ শাহ রানী ভিক্টোরিয়ার আমন্ত্রণে ব্রিটেনে একটি রাজসম্মেলনে উপস্থিত হন। ঐ সম্মেলনের নিয়মানুযায়ী আগত সকল রাজ্যনায়কদের নিজ নিজ রাজ্যের জাতীয় সঙ্গীত বাজাতে হতো। সেই মতো পেরাকের সুলতানের সহকারীর কাছে তাদের জাতীয় সঙ্গীতের কপি চাওয়া হলো। হুট করেই হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন সেই সহকারী, কেননা তাদের নিজেদের কোনো জাতীয় সঙ্গীতই ছিলো না। তবুও ভিক্টোরিয়ার কাছে সুলতানকে বিব্রত করতে চাইলেন না তিনি। তাই তাৎক্ষণিকভাবে মাথায় খেলে যাওয়া তার প্রিয় একটি গানকে চালিয়ে দিলেন জাতীয় সঙ্গীত বলে। গানটি ছিলো দক্ষিণ ইউরোপীয় সিশেলস উপদ্বীপের ফরাসি ঘরানার গান ‘লা রোজালিয়ে’, যার সুরকার ছিলেন পিয়েরে জিন বেরাঞ্জার।

পেরাকের সুলতান আব্দুল্লাহ; source: geographia.com

পরবর্তীতে পেরাকের রাজা যখন পুরো ঘটনাটি জানলেন, উনি গানের কথাগুলো বদলে সে গানটিকেই স্থায়ীভাবে পেরাকের জাতীয় সঙ্গীত বানিয়ে দিলেন। স্বাধীনতার পর টেঙ্কু আবদুর রহমানের নেতৃত্বে ১১ প্রদেশওয়ালা মালয়েশিয়ার জন্য একটি অভিন্ন জাতীয় সঙ্গীত খোঁজা হচ্ছিলো। বেঞ্জামিন ব্রিটেন, জুবির সাইদ, জিয়ান কার্লো মেনত্তির মতো বাঘা বাঘা সুরকারদের সুরসহ মোট ৫৭৪টি এন্ট্রিকে পিছে ফেলে নির্বাচিত হয় সেই পেরাকের জাতীয় সঙ্গীতই। পরবর্তীতে গানের কথায় পরিবর্তন এনে সেটিকেই করা হলো স্বাধীন মালয়েশিয়ার জাতীয় সঙ্গীত – ‘নাগারাকু’ (আমাদের দেশ)।

২) মেক্সিকো: ভাগ্যিস কবির প্রেমিকা জেদ ধরেছিলেন

১৮৫৩ সালে মেক্সিকোতে আয়োজন করা হলো এক অভিনব প্রতিযোগিতার – কে কত অনুপ্রেরণাদায়ী দেশপ্রেমমূলক গান লিখতে পারে সেই প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা থেকেই নির্বাচন করা হতো তাদের জাতীয় সঙ্গীত।

মেক্সিকোর সেই কবি বোকানেগ্রা; source: pinterest.com

মেক্সিকোর এক প্রতিভাধর কবি ছিলেন ফ্রান্সিস্কো গঞ্জালেস বোকানেগ্রা। প্রতিযোগিতার কথা শুনে কবির প্রেমিকা কবিকে এতে অংশ নেয়ার জন্য করতে শুরু করলেন জোরাজুরি। ওদিকে কেন যেন কবি রাজি হচ্ছিলেন না কিছুতেই। শেষে প্রেমিকা যা করলেন তা হলো, প্রেমিককে তার বাবার বাড়ির একটি রুমে আটকে রাখলেন যেখানে মেক্সিকোর ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে অসংখ্য ছবি সাঁটানো ছিলো। সাফ জানিয়ে দিলেন, গান না লিখলে মিলবে না মুক্তি! অবশেষে প্রেমিকার জেদের কাছে হার মেনে দরজার নিচ দিয়ে ১০ লাইনের কবিতা লিখে প্রেমিক বন্দীদশা থেকে রেহাই পান। পরবর্তীতে সেই গানই প্রতিযোগিতায় জিতে হয়ে যায় মেক্সিকোর জাতীয় সঙ্গীত। উল্লেখ্য, কবি পরবর্তীতে সেই ‘জেদী’ প্রেমিকাকেই বিয়ে করেছিলেন।

৩) যুক্তরাষ্ট্র: মদ্যপানের গান হলো জাতীয় সঙ্গীত!

সব থেকে মজার ব্যাপারটি হচ্ছে, জাতীয় সঙ্গীত ‘স্টার স্প্যাঙ্গেলড ব্যানার’ এর মেলোডি কোনো আমেরিকান সুর থেকে আসেনি, এসেছে ব্রিটিশ গান ‘অ্যানাক্রেওন ইন হ্যাভেন’ থেকে। শুধু সাবেক ঔপনিবেশিকের গান বলেই নয়, আরো মজার ব্যাপারটি হচ্ছে গানটি গাওয়া হতো শুরাসঙ্গীত হিসেবে। পরবর্তীতে ‘ইংরেজের গান’ আমেরিকান রূপ পাওয়ার পরও গানটি বাজানো হতো কেবল বেসবল মাঠে।

১৯৩১ সালের আগে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো জাতীয় সঙ্গীত ছিলো না। ১৯২৯ সালে রবার্ট রিপ্লি তার বিখ্যাত ‘রিপ্লি’স বিলিভ ইট অর নট’ শিরোনামের ব্যঙ্গচিত্রে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত না থাকা নিয়ে ভালোরকম মজা করেছিলেন। এরপরই যেন টনক নড়লো দেশপ্রেমিকদের, রবার্ট রিপ্লির কাছে অসংখ্য চিঠি আসতে থাকলো জাতীয় সঙ্গীতের দাবিতে। তিনি সকলকে বললেন, তাকে চিঠি না পাঠিয়ে কংগ্রেসম্যানদের পাঠাতে। সেই পথ ধরেই ৫০ লক্ষাধিক স্বাক্ষর সম্বলিত পিটিশন কংগ্রেসের কাছে দাখিল করা হয় জাতীয় সঙ্গীতের জন্য। সেই আবেদন গ্রাহ্য করে ১৯৩১ সালে ‘স্টার স্প্যাঙ্গেল্ড ব্যানার’-কে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত করা হয়।

বিখ্যাত রবার্ট রিপ্লি; source: stowevintage.com

আরো একটি মজার ব্যাপার হচ্ছে, যেকোনো দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে কোনো সাধারণ গানকে বেছে নেওয়া হলে শুরুতেই তার যে সংশোধনী দেওয়া হয় তা হলো, সেই গানটিতে কোরাস ও কুচকাওয়াজ উপযোগী ছন্দ-তাল-লয় আরোপ করা হয়। অথচ ‘স্টার স্প্যাঙ্গেল্ড’ ব্যানারকে দিনকে দিন ‘সলো’ গানে পরিণত করে ফেলা হয়েছে; তা আর কোরাস গাইবার অবস্থায় নেই, এমনকি কিছু নোট এতই বেশি চড়া যে, ‘সলো’ গায়কের পক্ষে গাওয়াও হয়ে যায় দুরূহ ব্যাপার।

৪) ফ্রান্স: ‘রক্তমাখা’ গানের কথা

কী মনে হয় দেশটির নাম শুনলে? এক নজরে কী ভেসে আসে চোখে? রুচিশীলতা, শিল্পবোধ বা সাহিত্য? সেগুলো মনে আসাই স্বাভাবিক, কেননা ফরাসিদের শিল্পগুণ বিশ্ববিদিত। এই দেশটির জাতীয় সঙ্গীত থেকেও কি আপনি তেমন কিছুই আশা করবেন? এই ধরুন, প্রাণ-প্রকৃতির খুব উচ্চমার্গীয় স্তুতিমূলক বর্ণনা? কিংবা দেশপ্রেমের বা অতীত শৌর্যের গৌরবমাখা গভীরতা সম্পন্ন গানের কথা? যদি এসব আশা করেন, তো ভুল করছেন।

লা মার্সেইলেজ; source: univie.ac.at

একটি দেশের অতীত ইতিহাস যতই সহিংস হোক, জাতীয় সঙ্গীতে সবসময়ই কোথায় যেন একটা সৌম্য-ভাব বজায় থাকে, কিংবা সহিংস ইতিহাসকে আড়াল করে সেটিকে ‘বীরত্ব’ সংজ্ঞায়িত করবার একটা প্রবণতা থাকে। কিন্তু ফরাসিরা এসব ভনিতার ধার ধারেনি। অতীত ইতিহাসের সহিংসতা ভালোভাবেই টের পাওয়া যায় তাদের জাতীয় সঙ্গীতে। ‘লা মার্সেইলেজ‘ গানটির সম্পূর্ণ সংস্করণ শুনলে সেটি বোঝা যায়, যেখানে বলা হয়েছে রক্তে সিক্ত-জবজবে পতাকার কথা, সৈনিকদের বিদীর্ণ গলার কথা। বলা হয়, রূপক বাঘেদের কথা, যাদের কেড়ে নেওয়া হয়েছিলো মায়ের কাছ থেকে দুগ্ধপানরত অবস্থায়। গানটিতে আরও বলা হয়, ফরাসি ভূমি উর্বর হয়েছে শত্রুর তাজা রক্তের দ্বারাই! সহিংসতার এ স্বরূপই তাদের জাতিগত গরিমা-যশকে তুলে ধরে বলে ফরাসিরা মনে করে।

৫) দক্ষিণ আফ্রিকা: এক সঙ্গীতেই পাঁচ ভাষা!

দক্ষিণ আফ্রিকায় জাতিগত দাঙ্গা অবসানের আগপর্যন্ত জাতীয় সঙ্গীত ছিলো ‘দাই স্তেম ভ্যান সুইদ-আফ্রিকা’। অন্যদিকে আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেস ও জাতিবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলনের প্রেরণাসঙ্গীত ছিলো ‘নিকোসি সিকোলেই ইআফ্রিকা’, যেটি কিনা তাঞ্জানিয়া ও জাম্বিয়ারও জাতীয় সঙ্গীত

দক্ষিণ আফ্রিকার পতাকা; source: withmaliceandforethough.com

১৯৭৭ সালে জাতিগত ঝামেলার সকল পাট চুকিয়ে যখন নতুন দেশ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ শুরু করা হলো, সত্যিকারের ‘রংধনু’ রাষ্ট্র গঠনের বাসনায় দুটো গানকেও একত্রে জুড়ে দেওয়া হলো। শুধু তা-ই নয়, সাথে আরও তিনটি ভাষায় লিরিক যোগ করে গানটিকে পঞ্চভাষীয় জাতীয় সঙ্গীতের রূপ দেওয়া হলো। গানটির প্রথম দুই চরণ ঝোসা ভাষায়, তৃতীয় ও চতুর্থ চরণ জুলু ভাষায়, পঞ্চম থেকে অষ্টম চরণ সোসোথো ভাষায়, নবম থেকে দ্বাদশ চরণ আফ্রিকান এবং ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ চরণ ইংরেজি ভাষায় লিখিত।

এতগুলো ভাষা নিয়ে একটি জাতীয় সঙ্গীত পৃথিবীতে বিরল। সেই বিরল কৃতিত্ব অর্জন করতে গিয়ে কিছু ভজকট তো পেকেছেই, কেননা সঙ্গীতটির প্রথম অংশের কি-নোটের সাথে শেষ অংশের কি-নোটের আকাশপাতাল ব্যবধান। তো যা-ই হোক, গানটির শিরোনাম ‘নিকোসি সিকোলেই ইআফ্রিকা’ অর্থাৎ ঈশ্বর আফ্রিকার মঙ্গল করুন।

৬) এন্ডোরা: এক রাজকন্যার গল্প

প্রায় সকল জাতীয় সঙ্গীতেই দেশকে এক বিমূর্ত স্নেহময় সত্ত্বা কল্পনা করে তাঁর স্তুতি গাওয়া হয় এবং নিজেদেরকে সেই অভিন্ন সত্ত্বার সন্তান হিসেবে ‘আমরা’ সম্বোধন করা হয়। গানের কথক (Narrator) থাকে জনগণ অর্থাৎ দেশ এখানে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পুরুষ (Person)।

এন্ডোরার পতাকা;source:webflags.com

অথচ এন্ডোরাতে বিষয়টি পুরো উল্টো। এখানে কথক হচ্ছে ‘দেশ’ স্বয়ং, অর্থাৎ দেশ হচ্ছে প্রথম পুরুষ। এই গানে দেশ স্বয়ং বলে তাঁর প্রতি নিবেদিত তাঁরই জনগণের কথা। জাতীয় সঙ্গীতে আলঙ্করিক অর্থে এন্ডোরাকে বলা হয় ‘রাজকন্যা’, আর তাঁর সুরক্ষায় নিবেদিত জনগণ হলো ‘রাজপুত্র”। গানের কথা শুনলে ব্যাপারটি আরো স্পষ্ট বোঝা যাবে-

আমার পিতা, মহান চার্লম্যাগন সারাকেন্সদের থেকে মুক্ত করেছিলেন আমায়
আর স্বর্গ থেকে তিনি আমায় দিয়েছিলেন মহান মাতা মেরিতজেলের জীবন।
আমি এক রাজকন্যা জন্মেছিলাম দু’জাতির মধ্যখানে অকলুষিত-অনির্ণেয়া হয়ে।
আমিই হলাম ক্যারোলিঙ্গিয়ান সাম্রাজ্যের সর্বন্ত্য কন্যা।

ফিচার ইমেজ- South African History Online

Related Articles