প্রাচীন পৃথিবীর দক্ষিণ এশিয়ায় গড়ে ওঠা সিন্ধু সভ্যতা এক অপার বিস্ময়ের নাম। আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বে যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত ইউরোপের মানুষজন গুহায় বসবাস করত, ঠিক সে-সময়ে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে প্রাচীন ভারতবর্ষে গড়ে উঠেছিল এক সুসংগঠিত সভ্যতা। উন্নত জীবনযাপনের পাশাপাশি তারা ব্যবসা-বাণিজ্যেও যোজন যোজন ক্রোশ এগিয়ে গিয়েছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রকৌশলবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে তারা দৈনন্দিন জীবনযাপনকে করে তুলেছিল অধিকতর সহজ ও সাবলীল। যার প্রমাণ বয়ে বেড়াচ্ছে সিন্ধু সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্নসম্পদ।
স্থাপত্য, নগর পরিকল্পনা এবং পুরকৌশল
সুনিপুণ পরিকল্পনায় নির্মাণ করা হয়েছিল সিন্ধু সভ্যতার কিছু শহর ও নগর। মহেঞ্জোদারো শহরের নগর পরিকল্পনা ও প্রকৌশলের কাঠামোর কথা বিবেচনা করলে, তা তৎকালীন বিশ্বের যেকোনো শহরকে টেক্কা দেওয়া ক্ষমতা রাখত। মহেঞ্জোদারোতে ছিল বিশাল এক শস্যাগার। গম আর যব ছিল এখানকার প্রধান কৃষিজ ফসল। গ্রামাঞ্চল থেকে গরুর গাড়িতে করে শস্য এনে এই শস্যভাণ্ডারে তা সংরক্ষণ করে রাখা হতো। খাদ্যশস্য যেন অনেকদিন পর্যন্ত ভালো অবস্থায় থাকে, সেজন্য শস্যভাণ্ডারে বাতাস চলাচলের জন্যও উপযুক্ত ব্যবস্থা ছিল। মহাশস্যাগারের পাশাপাশি এখানে বিশাল এক স্নানাগারের অস্তিত্ব ছিল। বাড়িঘর নির্মাণ করা হতো পোড়া মাটির ইট দিয়ে এবং অধিকাংশই ছিল দোতলা। বৃহৎ স্নানাগারের পাশাপাশি কয়েকটি বাড়িতে নিজস্ব স্নানাগারও ছিল। মহেঞ্জোদারোর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল বর্তমানের মতো আধুনিক। প্রত্যেক বাড়ির ময়লা যাতে শহরের নর্দমায় গিয়ে মিলিত হতে পারে, সে ব্যবস্থা করা হয়েছিল তখন।
শহরের রাস্তাগুলোও কিন্তু এলোপাথাড়ি তৈরি করা হয়নি, হয়েছে গাণিতিক নিয়ম মেনে। হরপ্পায় রাস্তার পাশে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে সড়ক বাতির পাশাপাশি শহরের প্রধান রাস্তাগুলোর পাশে মূল নর্দমাগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। তারা প্রতিরক্ষাকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিত বলে গড়ে তুলেছিল প্রাচীর। প্রাচীরের সামনে আবার খনন করা হয়েছিল গভীর পরিখা। সিন্ধু সভ্যতার সময়কার এক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হিসেবে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে ‘লোথাল’। এখানে পাকা স্নানাগার, নোংরা জল ও ময়লা নিষ্কাশনের জন্য নর্দমা, পানীয় জলের কূপ, গুদামঘর অবস্থিত ছিল। জোয়ার-ভাটা ও স্রোত সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ছিল সিন্ধু সভ্যতার মানুষজনের।
যাতায়াত ব্যবস্থা
যাতায়াত ব্যবস্থায় দারুণ উন্নত ছিল সিন্ধু সভ্যতা। বিজ্ঞান ও প্রকৌশলবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে গরুর গাড়ি এবং নৌকা তৈরি করেছিল তারা। নৌকাগুলো আকারে ছিল ছোট এবং চালানো পালের সাহায্যে, বাতাসকে কাজে লাগিয়ে। প্রাচীন বন্দর হিসেবে অতীতে লোথাল বন্দরের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। অনুমান করা হচ্ছে এটি একটি আন্তঃবন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হতো, তাই স্বাভাবিকভাবে এখানে ছোট ছোট নৌকাই নোঙর করতো। এটি ক্ষুদ্র একটি নৌ-বন্দর হিসেবে ব্যবহার করা হলেও, এর থেকে আরও দূরে সমুদ্রের নিকটে বড় বন্দর ছিল। সেই বন্দরে দূর থেকে আগত নাবিকেরা তাদের বড় বড় জাহাজ ভেড়াত। সিন্ধু সভ্যতার সময়ে ব্রোঞ্জ যুগের একটি মানচিত্র থেকে অনুমান করা হচ্ছে, লোথাল সমুদ্রের নিকটবর্তী এক স্থানে অবস্থিত ছিল। বিশেষ কোনো ছোট নদীর সাথে লোথালের সংযোগ ছিল।
জলসেচ ব্যবস্থা
জার্নাল অভ আর্কিওলজিক্যাল সায়েন্সে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র দ্বারা জানা যায়, ভিন্ন ঋতুতে ভিন্ন ফসল ফলাত হরপ্পাবাসী। গ্রীষ্মকালীন ফসল হিসেবে ধান, ভুট্টা, শিম, এবং শীতকালে গম, বার্লি, ডাল চাষের নিয়ম জানত তারা। গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, প্রাচীনকালে দক্ষিণ এশিয়ায় সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের বুনো প্রজাতির এক ধান উৎপাদন করা হতো, যার বৈজ্ঞানিক নাম ‘Origa niva’। ভারতের নিজস্ব ধানের জাত ‘Oryza sativa indica’ থেকে প্রাকৃতিক পদ্ধতি অনুসরণ করেই এই সংকর জাত সৃষ্টি করেছিল সিন্ধু সভ্যতার মানুষেরা। অথচ, আধুনিক জীবপ্রযুক্তি কিংবা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কে আজ থেকে ৫০০০ বছর আগের মানুষের কোনো ধারণাই ছিল না। নদীমাতৃক সভ্যতা হওয়ায় উন্নত সেচ প্রক্রিয়ার উদ্ভাবন ঘটিয়েছিল তারা। ফসল উৎপাদনের এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের উদ্দেশ্যে তারা কৃত্রিম খাল খননের পদ্ধতিও অনুসরণ করত।
ধাতুবিদ্যা
তৎকালীন পৃথিবীর কথা চিন্তা করলে, ধাতুবিদ্যায় হরপ্পাবাসীর জ্ঞান ছিল প্রখর। তারা নির্দিষ্ট ওজন ও আকৃতির পোড়ামাটির ইট বানাতে পারত। তুলা ব্যবহারের নিয়মও ভালোভাবে জানা ছিল তাদের। প্রত্নস্থল থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, তারা গয়না হিসেবে সোনা, রূপা, তামা, লাপিস লাজুলি, নীলকান্তমণি, পান্না, শ্বেতস্ফটিক ইত্যাদি ব্যবহার করত। তারা চুনকে প্লাস্টার হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি তাপ-প্রকৌশলকে ব্যবহার করে চুনকে গলাতে পারত।
মেহেরগড় সভ্যতা থেকে তামা আকরিক, বিটুমেন নির্মিত পাত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। তারা স্বর্ণনির্মিত অলংকার যেমন কঙ্কণ, বালা, কানের দুল ইত্যাদি পরিধান করত। তবে অলংকার হিসেবে পুঁতির বেশ কদর ছিল এই সভ্যতায়। নারী-পুরুষ উভয়েই মুক্তা সদৃশ পুঁতি তাদের চুল সাজানোর কাজে ব্যবহার করত। এইসব পুঁতির সাধারণ ব্যাস ছিল ১ মিলিমিটার। পুঁতি সূক্ষ্মভাবে কাটা, ছিদ্র, এবং পালিশ করাতে তারা ছিল বেশ দক্ষ। তারা তামা, পিতল, সীসা, টিনসহ বিভিন্ন ধাতু নিষ্কাশনের নতুন কিছু পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। হরপ্পার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে স্বর্ণমোড়ানো এক পাথর পাওয়া গেছে। গবেষকদের ধারণা অনুযায়ী, সেটা স্বর্ণের বিশুদ্ধতা পরিমাপের জন্য কষ্টিপাথর হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
মৃৎশিল্প
কাদামাটির শিল্প হলো পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন শিল্প। সিন্ধু সভ্যতার কুমারেরা মাটির পাত্র তৈরি করত চাকার সাহায্যে। বিভিন্ন আকার ও আকৃতির মাটির তৈজসপত্র তৈরি হতো সেখানে। এদের উপর আঁকা থাকত বিভিন্ন চিত্রকল্প। সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলে খননকার্য চালিয়ে প্রচুর মাটির তৈজসপত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
পরিমাপ এবং মাপজোখ
সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা আয়তন, ভর, সময়ের হিসেব নিখুঁতভাবে বের করার ক্ষেত্রে দারুণ সফলতা লাভ করেছিল। অধিক সূক্ষ্ম ও ত্রুটিহীন হিসাবের জন্য তারাই সর্বপ্রথম স্কেল আবিষ্কার করেছিল। লোথালে হাতির দাঁতের একটি স্কেলের সন্ধান পাওয়া গেছে যেটা দিয়ে ১.৬ মিলিমিটার পর্যন্ত মাপা যেত। এটি বর্তমানে ব্রোঞ্জ যুগের পাওয়া সবচেয়ে ক্ষুদ্র পরিমাপকের স্থান দখল করে আছে। হরপ্পার প্রকৌশলীরা সকল ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক কাজের জন্য দশমিকের হিসাব ব্যবহার করত।
সিন্ধু সভ্যতায় ওজন পরিমাপের জন্য বাটখারার প্রচলনও ছিল। ৫ঃ২ঃ১ অনুপাতে ০.০৫, ০.১, ০.৫, ১, ২, ৫, ১০, ২০, ৫০, ১০০, ২০০ এবং ৫০০ একক পরিমাপের নিয়ম জানত তারা। তবে, সিন্ধু সভ্যতার সকল শহর ও নগর ওজন পরিমাপের জন্য এক নিয়ম ব্যবহার করত না, তা অঞ্চলভেদে ছিল ভিন্ন। প্রাচীন লোথাল যে নিয়মের ওজন পরিমাপ করত, সেই একই নিয়মের উল্লেখ পাওয়া গেছে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে (খ্রি.পূ. ৪০০ অব্দ)। গণিতেও দক্ষ ছিল হরপ্পাবাসী। যে সংখ্যা পদ্ধতির উদ্ভাবন তারা ঘটিয়েছিল, তাতে আধুনিক গণিতের সংখ্যা ছাড়াও যোগ, গুন এবং নানা প্রতীকের অস্তিত্ব ছিল।
চিকিৎসাবিজ্ঞান
রোগবালাই সারাতে সিন্ধু সভ্যতার বাসিন্দারা বিভিন্ন ঔষধি এবং ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহার জানত। উদাহরণস্বরূপ, তারা ট্রেফিনেশন নামে এক চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করত। মস্তিষ্কের ব্যাধি ও খুলির অসুখ সারানোর জন্য খুলি ছেদ করে তাতে চিকিৎসা চালানোই হলো ‘ট্রেফিনেশন’। ট্র্যাকশন নামক এক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রমাণও লোথাল, কালিবাঙানের কংকাল থেকে পাওয়া গেছে।
২০০১ সালের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রাক-হরপ্পা সভ্যতার লোকেরা আদি দন্তচিকিৎসা সম্পর্কে জানতো। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এই গবেষণা চালিয়েছিল মূলত মেহেরগড় সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত দুজনের দেহাবশেষ নিয়ে।
২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে বৈজ্ঞানিক জার্নাল নেচার-এ একটি আর্টিকেল পাবলিশ করা হয়, যেটাতে উল্লেখ আছে, সেই প্রারম্ভিক নব্যপ্রস্তরযুগেই মানুষের দাঁত বাঁধানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে মেহেরগড় সভ্যতায়। প্রাচীন মেহেরগড়ের এক সমাধিস্থল থেকে আবিষ্কৃত নয়জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির এগারোটি বাঁধানো দন্ত-মুকুটের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যা আনুমানিক ৫,৫০০ থেকে ৯,০০০ বছর আগের হতে পারে।