Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার ম্যানহাটন প্রজেক্ট এবং পারমাণবিক অস্ত্র যুগের সূচনা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’ এর আড়ালে লুকিয়ে আছে মানবজাতির জন্য এক বীভৎস ও কলঙ্কময় অধ্যায়। প্রায়ই যে প্রশ্ন শোনা যায়, তা হলো- বিজ্ঞান মানুষের জন্য আশীর্বাদ না কি অভিশাপ? ম্যানহাটন প্রজেক্টটি বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেয়- বিজ্ঞান যখন অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়, এর পরিণাম হয় অচিন্ত্যনীয়। এই প্রকল্পের বাস্তব রূপ দেখতে পাওয়া যায় ১৯৪৫ সালে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আমেরিকার পারমাণবিক বোমা ক্ষেপণের মধ্য দিয়ে।

১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে যে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তা শেষ হয় ১৯৪৫ সালের ৬ এবং ৯ আগস্ট জাপানের ওপর আমেরিকার পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে। হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার ধ্বংসলীলা চমকে দিয়েছিল পুরো বিশ্বকে। অথচ হামলার ৭২ বছর পরেও মার্কিনীদের মাঝে এই বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে নেই কোনো অনুতাপ। সবার আগে আমেরিকা, ধীরে ধীরে তারা এই উগ্র জাতীয়তাবাদের দিকেই এগোচ্ছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর দিকে মিত্রবাহিনীর কাছে খবর পৌঁছে- হিটলারের নাৎসি বাহিনীর বিজ্ঞানীরা ইউরেনিয়ামের মত তেজস্ক্রিয় পরমাণু কণার ভাঙ্গন প্রক্রিয়া আবিষ্কার করে ফেলেছেন। এই খবর তাদের বিচলিত করে তোলে। কারণ তাদের ভয় হিটলারের মতো মানুষ যেকোনো সময় যে কারো ওপর এই বিধ্বংসী অস্ত্র দিয়ে হামলা চালাতে পারে। আর এই সম্ভাবনা যদি সত্য হয়, তাহলে আমেরিকা খুব শীঘ্রই এক মহাবিপদের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে।

যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগে পরমাণু অস্ত্র নিয়ে গবেষণার ব্যাপারে আমেরিকান সরকার এবং অধিকাংশ আমেরিকান বিজ্ঞানী খুব একটা ইচ্ছুক ছিল না। ব্রিটেন ইতিমধ্যে কানাডার সহায়তায় পারমাণবিক অস্ত্র গবেষণাকে এগিয়ে নিতে ১৯৪১ সালে Tube Alloys নামক সংস্থা গঠন করে। কিন্তু আমেরিকার জন্য প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হতে খুব একটা সময় লাগেনি। পার্ল হারবারে জাপানীদের হঠাৎ আক্রমণে আমেরিকান সরকারের মনোভাবে আমূল পরিবর্তন ঘটে। ব্রিটেন, জার্মানি, জাপান ও আমেরিকার মধ্যে যুদ্ধে আর্থিকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ আমেরিকা এগিয়ে চলল পারমাণবিক বোমার দিকে। ফলে ১৯৪২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ম্যানহাটন প্রজেক্ট। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, এনরিকো ফার্মি এবং লিও শিলার্ড এর মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের সহায়তায় এই প্রকল্প সামনে এগোতে থাকে। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী এনরিকো ফার্মির আবিষ্কৃত তেজস্ক্রিয় ফিশন বিক্রিয়ার মূলনীতির ওপর ভিত্তি করেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি হয়।

ম্যানহাটন প্রকল্পের কয়েকজন বিজ্ঞানী: বাম থেকে ডানে- বিজ্ঞানী বোর, ওপেনহাইমার, ফাইনম্যান এবং ফার্মি; source: mrmouatmwh2011

১৯৩৮ সালে তিনি নিউট্রন দিয়ে সৃষ্ট কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তার জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ঠিক সেই সময় ফ্যাসিস্ট ইতালি ইহুদি বিরোধী আইন প্রবর্তন করে। এই পুরস্কার গ্রহণের জন্য ফার্মি ও তার পরিবার ভাগ্যক্রমে ইতালি থেকে বের হয়ে সুইডেনে যেতে পেরেছিলেন। আর তা না হলে হয়তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারানো ৬০ লাখ ইউরোপিয়ান ইহুদিদের মধ্যে তাদেরও নাম থাকত। ফার্মি ও তার পরিবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার আশ্রয়ে ছিলেন। পরবর্তীতে আমেরিকার হয়ে এই প্রকল্পেও যোগদান করেন।

শুরু হয় ম্যানহাটন প্রজেক্ট

ব্রিটেনের পরমাণু কর্মসূচি যে কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে, তা হলো দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অভাব এবং তীব্র আর্থিক সংকট। এই প্রজেক্ট চালিয়ে নেওয়ার মতো যে বিপুল পরিমাণ অর্থের দরকার ছিল, তা যোগান দেওয়া আমেরিকার পক্ষে অসম্ভব ছিল না। যেহেতু যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম, তাই ২০০ কোটি ইউএস ডলার এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করতে তারা সক্ষম ছিল। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এর আদেশে গড়ে ওঠে বিভিন্ন সংস্থা, যাদের কাজ ছিল ইউরেনিয়াম নামক তেজস্ক্রিয় বস্তু নিয়ে। এই সংস্থাগুলোই কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ফার্মি এবং লিওয়ের গবেষণার পেছনে অকুণ্ঠভাবে অর্থ ঢেলে গেছে।

লস অ্যালামসে গড়ে ওঠা পারমাণবিক জাদুঘরের ভেতরে; source: ladailypost

এবার শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে তারা ইউরেনিয়াম থেকে কীভাবে আইসোটোপ ইউরেনিয়াম- ২৩৫ আলাদা করা যায়, তা নিয়ে কাজ করছিলেন। অন্যদিকে বিজ্ঞানী গ্লেন সিবোর্গ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন প্লুটোনিয়ামকে কীভাবে পারমাণবিক বিক্রিয়ক হিসাবে ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে। কানাডিয়ান সরকার এবং মার্কিন সামরিক বাহিনী এক হয়ে খোঁজ করে চলছেন এমন স্থানের যেখানে তাদের তৈরী বোমা সরেজমিনে পরীক্ষা করে দেখতে পারবেন নিজেদের কোনো প্রকার ক্ষতি করা ছাড়া।

অবশেষে ১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো ধারাবাহিক পারমাণবিক বিক্রিয়া (Nuclear Chain Reaction) এর সফল পরীক্ষার পর  অন্য উচ্চতায় উঠে যায় মার্কিন পরমাণু কর্মসূচী। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এর অনুমোদনে বিভিন্ন গবেষণালব্ধ ফলাফল নিয়ে ২৮ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রকল্প আরম্ভ হয় এবং বরাদ্দ করা সরকারি অনুদানে উপচে পড়ে তহবিল। একের পর এক পরমাণুকেন্দ্র গড়ে উঠতে থাকে ওয়াশিংটন, টেনেসি, নিউ মেক্সিকোর লস অ্যালামসে এবং এই প্রকল্পে সক্রিয় কর্মীর সংখ্যা ছিল ১,২৫,৩১০ জন।

রবার্ট ওপেনহাইমার ও প্রজেক্ট Y

তাত্ত্বিক পদার্থবিদ রবার্ট ওপেনহাইমারকে ১৯৪৩ সালে লস অ্যালামসে পরীক্ষাগারের পরিচালক হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। তার ওপর দায়িত্ব ছিল পরীক্ষাগারটিকে পারমাণবিক অস্ত্র গবেষণায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা। এই প্রকল্পের সাংকেতিক নাম দেওয়া হয় প্রজেক্ট Y।

অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর অবশেষে ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই আমেরিকা তাদের আবিষ্কৃত পারমাণবিক বিস্ফোরক নিয়ে সরেজমিনে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়। প্রথম পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার প্রকল্পের নাম দেয়া হয়েছিল ‘ট্রিনিটি’। নিউ মেক্সিকোর অ্যালামোগোরডের কাছে মরুভূমিতে অবস্থিত মার্কিন বিমান বাহিনীর বেসকে এই পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত স্থান হিসাবে অনুমোদন করলেন জেনারেল লেসলি গ্রোভস। বোমাটি বিস্ফোরণ করা হয়েছিল একটি ইস্পাত টাওয়ারের ওপরে। বিস্ফোরণের সাথে সাথে তীব্র আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো গোটা মরুভূমি। পারমাণবিক বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন প্রচণ্ড  উত্তাপে মুহূর্তেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় টাওয়ারটি। মনে হল যেন আগুনের একটি বিশাল বল আকাশ ফুঁড়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে এবং একই সাথে ৪০,০০০ ফুট মাশরুমের মতো মেঘে ছেয়ে যায় চারপাশ।

২১,০০০ টন টি.এন.টি বিস্ফোরকের সমতুল্য  বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমা সফলভাবে বিস্ফোরিত হয়। জনসাধারণের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য প্রচার করা হয় বানোয়াট কাহিনী যে, বিমান বেসে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের এক মজুদে দুর্ঘটনাবশত ঘটেছে ভয়াবহ এই বিস্ফোরণ।

দ্য ফ্যাট ম্যান অ্যান্ড দ্য লিটল বয়

প্রথম পরীক্ষায় সাফল্যের পরে ওপেনহাইমারের অধীনে কাজ করা বিজ্ঞানীরা মনোযোগ দেয় আরো দুটি বিস্ফোরক বানাতে। প্রথমটি ছিল ইউরেনিয়াম ভিত্তিক বোমা, যার সাংকেতিক নাম ছিল The Little Boy এবং প্লুটোনিয়াম ভিত্তিক দ্বিতীয়টির নাম দেওয়া হয় The Fat Man। নামকরণ থেকেই বোঝা যায় যে ম্যানহাটন প্রকল্পের কর্ণধার জেনারেল লেসলি গ্রোভস ও তার অধীনস্থদের মানবিক অন্যসব গুণের ঘাটতি থাক, কিন্তু রসবোধের অভাব ছিল না।

ওপরে লিটল বয় এবং নিচে ফ্যাটম্যান; source: sutori

যুদ্ধে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির কারণে জার্মানি আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ওদিকে জাপান তখনও রাজি নয় হার মেনে নিতে। জার্মানির পসটডাম শহরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে পৃথিবীর তিনটি ক্ষমতাবান দেশের সরকার প্রধান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান, সোভিয়েত সরকারপ্রধান স্তালিন ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী চার্চিল একত্রিত হয়ে জাপানকে তাদের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী আত্মসমর্পণের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেন। এই ঘোষণাপত্রে জাপানের সম্রাটের জন্য কোনো ভূমিকা প্রদান না করায় জাপান শর্তগুলো মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। এই শহরে বসেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান সেই ঐতিহাসিক ধংসাত্মক সিদ্ধান্ত- ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলার সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন।

বোমারু বিমান ইনোলা গে এর সদস্যরা ; source: getty image

হিরোশিমা-নাগাসাকি

জাপান তখনও আত্মসমর্পণ করেনি। তাই ম্যানহাটন প্রকল্পে দায়িত্বরত সামরিক বাহিনী হিরোশিমাকে তাদের প্রথম লক্ষ্য হিসাবে নির্ধারণ করে। যেহেতু এই শহরে কোনো মার্কিন নাগরিক বন্দী ছিল না, তাই এই শহরেই ৬ আগস্ট ছুঁড়ে মারলো ‘লিটল বয়’ এবং মুহূর্তেই লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল সবকিছু। ধ্বংসলীলায় পরিণত হল গোটা শহর।

নাগাসাকিতে বোমা বিস্ফোরণের পর খুঁজে পাওয়া ছবির অ্যালবাম; source: getty image

৯ আগস্ট, ১৯৪৫। নাগাসাকি ছিল পারমাণবিক বোমা হামলার দ্বিতীয় লক্ষ্য। তিনদিন পরে এখনও  জাপান বশ্যতা স্বীকার করেনি। পুনরায় ‘ফ্যাট ম্যান’ নিয়ে হামলা করা হয় নাগাসাকিতে। দুটি বোমায় সম্মিলিতভাবে ১ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়,  মাটির সাথে মিশে যায় শহর দুটি। অবশেষে ১০ আগস্ট জাপান ওয়াশিংটনে খবর পাঠায়, তারা আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত এবং ১৪ আগস্ট তাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের।

জাপানের আত্মসমর্পণের সময় তোলা ছবি; source: edition.cnn

আইনস্টাইনকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার হতে পারে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন,

“তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে জানি না, তবে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ যে লাঠি এবং পাথর দিয়ে হবে তা বলতে পারি।”

পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথে শেষ হলেও পারত। কিন্তু এখন বিশ্বের বৃহৎ পরাশক্তি ছাড়া সামরিক ও পারমাণবিক শক্তিতে এগিয়ে যাওয়া মাঝারি শক্তির বেশ কয়েকটি দেশও আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত। আধিপত্য বিস্তারের এই খেলা থেকে দূরে সরে না এলে যেকোনো সময় বড় ধরনের যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। আর সেই যুদ্ধে যে পারমাণবিক বোমার রসদ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে দেশগুলো, তা নিয়ে আসলে অনুমান করারও প্রয়োজন নেই।

ফিচার ইমেজ : history.com

Related Articles