Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার দিকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশগুলো দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি ভাগকে বলা হয় কেন্দ্রীয় শক্তিধর দেশ- জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এবং ইটালি। আরেকটি ভাগ হচ্ছে মিত্র শক্তি, যা ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং রাশিয়া- এই তিনটি দেশ নিয়ে গঠিত ছিল। প্রত্যেকটি দেশ তাদের সামরিক শক্তিতে সর্বোচ্চ শক্তি অর্জনের দিকে এগোচ্ছিল।

১৯১৪ সালে যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, সেই যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব কিন্তু প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছিলো। কিন্তু কিছু বিশেষ ঘটনা সে সময় ঘটে যাচ্ছিলো, যেটা সাধারণ মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে যে কিছু একটা সামনে ঘটতে যাচ্ছে। আজকে এই বিষয় নিয়েই আমরা আলোচনা করবো।

মিত্রবাহিনীর বিপক্ষে জার্মানির যুদ্ধ ঘোষণা; Source: Sutori.com

১৯০৭ সালে তিন মিত্র দেশ এক হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় এবং তাদের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়, যদিও তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির মতো মজবুত ও দৃঢ় ছিল না। তাই জার্মানির কাইজার তিন দেশের এই মৈত্রীর পর ভেবেছিলেন, চুক্তিটি বেশিদিন টিকবে না।

কিন্তু তার ভাবনা ভুল ছিল। ১৯১৪ সালে যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার আগে দিয়ে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিলো যেগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হওয়ার সংকেত দিচ্ছিল। দুই ভাগ হয়ে যাওয়া দেশগুলো বিভিন্নভাবে একে অপরকে খাটো করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। সামরিক ক্ষমতার অলিখিত প্রতিযোগিতায় নেমেছিল তারা। ইউরোপের এই দেশগুলোর মধ্যে যদি ছোটখাট কোনো ঘটনাও ঘটে যেত, সেটাকেও  বড় করে ভেবে নেয়া হতো এবং মনে করা হতো এই বুঝি বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাবে।

প্রতিটি দেশের সামরিক বাহিনী প্রস্তুতি নিয়ে যাচ্ছিলো। তবে তখন ইউরোপিয়ানদের মনের ভেতর একধরনের অনুভূতি কাজ করছিলো। তাদের কাছে মনে হয়েছিলো, যদি সত্যিই যুদ্ধ হয়, তাহলে সেটা হবে গর্বের, সাহসের এবং বীরোচিত। এমনকি তরুণরাও ১৯১৪ সালের এই যুদ্ধকে সায় দিয়েছিলো। যুদ্ধের দিকে ধাবিত হওয়ার পথে বিশেষ কয়েকটি ঘটনার কথা আজকের লেখায় উল্লেখ করা হচ্ছে।

জার্মানির বিপক্ষে যুক্তরাজ্যের যুদ্ধ ঘোষণা; Source: the frontline trenches

জার্মানি এবং ব্রিটেন তাদের নৌবাহিনীর শক্তিকে যত দ্রুত সম্ভব উন্নত এবং শক্তিশালী করার দিকে ধাবিত হচ্ছিলো। ১৯০৬ সালে ব্রিটেন বিরাট জাহাজ HMS Dreadnought চালু করে। এই যুদ্ধজাহাজ অনেক ভারি ভারি আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতে পারতো এবং অন্য যেকোনো যুদ্ধজাহাজ থেকে অনেক দ্রুত গতিতে ছুটতেও পারতো। এই জাহাজ তৈরির পরে বাকি সব যুদ্ধে ব্যবহৃত জাহাজগুলো পুরনো হয়ে যায়।

ব্রিটেনের এমন পদক্ষেপ নেয়ার প্রায় সাথে সাথেই জার্মানির কাইজার এরকম Dreadnought তৈরির ঘোষণা দিয়ে বসেন, যেটা হবে সম্পূর্ণ জার্মানদের নিজেদের তৈরি এবং আরও বেশি উন্নত। ১৯০৮ সালে জার্মানি থেকে ঘোষণা আসে যে, তারা Dreadnought ধরনের যুদ্ধজাহাজ তৈরি করবে এবং প্রতি বছরে চারটি করে তৈরি করার পরিকল্পনা করছে তারা। সেই থেকে দুই দেশের মধ্যে অস্ত্রভাণ্ডার মজুদ করার এবং নতুন ও শক্তিশালী অস্ত্র তৈরি করার প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। এমনকি জার্মানদের চারটি করে তৈরির ঘোষণা আসার পর ব্রিটেনের সাধারণ মানুষ এটা নিয়ে একধরনের গান বানিয়েছিল যে, “We want eight and we won’t wait”। যুদ্ধের প্রস্তুতি কিন্তু এ সময় থেকেই শুরু হয়ে যায়। কারণ প্রত্যেকেরই নিজেদের ক্ষমতা জাহির করার মনোভাব থাকে। জার্মানি এবং ব্রিটেনও নিজেদের ক্ষমতা জাহির করার মনোভাবের বাইরে ছিল না।

জার্মানি এবং ব্রিটেন তাদের নৌবাহিনীর শক্তিকে যত দ্রুত সম্ভব উন্নত এবং শক্তিশালি করার দিকে ধাবিত হচ্ছিলো। দুই দেশের মধ্যেকার অস্ত্র নিয়ে প্রতিযোগিতা চরমে উঠে গিয়েছিলো

এরপরের বড় সমস্যা ছিল মরক্কো নিয়ে। জার্মানির কাইজার ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের অধীনস্থ সাম্রাজ্য নিয়ে খুশি ছিলেন না। এ নিয়ে একধরনের হিংসাত্মক মনোভাব বিরাজ করতো তার মধ্যে। ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের দখলকৃত এলাকাগুলো নিয়ে তিনি তাদেরকে তিরস্কার করার কোনো সুযোগ হাতছাড়া করতেন না। ১৮৯৯-১৯০২ সালের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকাতে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে বয়েরদের (Boer), যারা কৃষক হিসেবে পরিচিত, একটি যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে জার্মানি বয়েরদেরকে সাহায্য করে।

ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স একমত হয়। এই অঞ্চলে নিজেদের শক্তির দিক দিয়ে পূর্বদিকে শক্তিশালী ছিলো ব্রিটেন এবং পশ্চিমদিকে শক্তিশালী ছিলো ফ্রান্স। এর মানে উত্তর আফ্রিকার প্রায় পুরোটাই ফ্রান্সের দখলে ছিলো, যার মধ্যে মরক্কোও পড়ে। ১৯০৫ সালে কাইজার যখন মরক্কোতে যান, তখন সেখানকার সুলতানকে প্রস্তাব করে যে, তিনি মরক্কো থেকে ফ্রেঞ্চদের বিতাড়িত করতে সাহায্য করতে পারেন। এই ব্যাপার নিয়ে ফ্রান্স, জার্মানি এবং মরক্কো ১৯০৬ সালে স্পেনের আলগেসিরাসে একটি বৈঠক করে। কিন্তু ভূমধ্যসাগর নিয়ে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স একসাথে থাকতে বদ্ধ পরিকর থাকায় জার্মানিকে সেই যাত্রা পিছু হটতে হয়। কিন্তু ১৯১১ সালে জার্মানি মরক্কোর আগাদিরে Panther নামক একটি গানবোট পাঠায় এই আশায় যে, যদি ব্রিটেন এবং ফ্রান্স পিছু হটে এবং তাকে জার্মানির সাম্রাজ্য মধ্য আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তার করতে দেয়। কিন্তু এবারও জার্মানির উদ্দেশ্য সফল হয়নি।

অটোমানদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পরে বলকানদের রাজ্য; Source: Youtube.com

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য এগুলো হয়তো মুল কারণ নয়, কিন্তু নিশ্চিতভাবে দেশগুলোর মধ্যে এই ধরনের ঘটনা ঘটার কারণে অবশ্যই ইউরোপে একটি দুশ্চিন্তার সৃষ্টি হয়। এসব কারণে সবার ভিতর একটা ভাবনা চলে এসেছিলো যে, কিছু একটা সামনে ঘটবেই।

বলকানদের নিয়ে মৌন এবং ঠাণ্ডা বিবাদ বাধে রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির মধ্যে। একসময় অটোমান বা টার্কিশদের অধীনে ছিল এই বলকানরা। ১৯০০ সালের মধ্যে বলকানদের কিছু দেশ, যেমন- গ্রিস, রোমানিয়া বুলগেরিয়া এবং সার্বিয়া- এই চারটি দেশ অটোমানদের থেকে নিজেদের স্বাধীনতা পেয়ে গিয়েছিলো। সেসময় অটোমান সাম্রাজ্যও ছোট হয়ে এসেছিলো। বলকানদের অনেকের আবার রাশিয়ার সঙ্গে সংযোগ ছিল। সার্বিয়ান এবং বুলগেরিয়ানরা ছিল স্লাভ অর্থাৎ পূর্ব-ইউরোপীয় জাতের। তাদের ধর্মও পুরনো দিনের খ্রিস্টানদের মতোও ছিল। কিন্তু অন্যদিকে অস্ট্রিয়ানরা ছিল রোমান ক্যাথলিক। রাশিয়া বলকান দেশগুলোর বিস্তৃতি চাচ্ছিলো। কারণ এরকম যদি হয়, তাহলে বলকান রাষ্ট্রগুলো নিজেরা স্বাধীনভাবে থাকতে পারবে এবং রাশিয়ার প্রতিও তাদের আনুগত্য বজায় থাকবে।

ব্রিটেনের বিরাট জাহাজ HMS Dreadnought; Source: Medium

কিন্তু বলকান ও স্লাভ দেশগুলোর স্বাধীনতা অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির জন্য একটি ভয়ের কারণ ছিল। কারণ যদি বলকানরা স্বাধীন হতে থাকে, তাহলে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির ভেতরে বসবাসরত বলকান স্লাভরাও স্বাধীনতা চাবে। আর যদি এমন হয়, তাহলে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ভেঙ্গে যাবে। তাদের সবচেয়ে বেশি সমস্যা ছিল সার্বিয়ানদের নিয়ে। কারণ সার্বিয়ার ইচ্ছা ছিল যুগোস্লাভিয়া তৈরির, যেটা হবে দক্ষিণ স্লাভ জাতীয় দেশ। পশ্চিমদিকে সার্বিয়ানদের বিস্তৃতি রুখতে অস্ট্রিয়া ১৯০৮ সালে বসনিয়া দখল করে। এই বসনিয়াতে বেশিরভাগ মানুষ ছিল আবার স্লাভ জাতের। এই দখল করে নেয়াটা সার্বিয়ানদের ভালো লাগেনি।

এরপর সার্বিয়াতে বিভিন্ন গুপ্ত সংঘ তৈরি হতে থাকে, যাদের কাজ ছিল বলকান দেশগুলোর ভেতরে বসবাসরত অস্ট্রিয়ানদের বের করে দেয়া। এসব সংঘের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল Black Hand। ১৯১২ সালে গ্রিস, সার্বিয়া, রোমানিয়া এবং বুলগেরিয়া অটোমানদের উপর হামলা করে এবং তাদের প্রায় সমস্ত সাম্রাজ্য দখল করে নেয়। এর ফলে সার্বিয়া আয়তনে বড় হয় এবং স্লাভ জনগণের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য বদ্ধপরিপকর হয়ে ওঠে। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এরকম হয়ে যাওয়ার কারণে ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং সার্বিয়াকে একটি উচিত শিক্ষা দিতে চায়। কিন্তু রাশিয়া সার্বিয়াকে এসময় আঁকড়ে ধরে রাখে।

দক্ষিণ আফ্রিকার বোয়ের, ব্রিটেনের বিপক্ষে যুদ্ধে তারা জার্মানদের সাহায্য পায়; Source: Telegraph

এতসব দুশ্চিন্তার মধ্যে আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ এবং তার স্ত্রী যখন বসনিয়ার সারজেভে যান, তখন সার্বিয়ান গেব্রিল প্রিন্সিপ, যে কিনা Black Hand Organization এর সদস্য ছিল, তাদেরকে হত্যা করে। এরপরে বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাওয়ার জন্য আর কোনো কারণের দরকার পড়েনি। এই হত্যাকান্ডের মাত্র ছয় মাসের মাথায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

উপরের আলোচনা থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে, যুদ্ধের প্রায় দুই যুগ আগেও দেশগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক ভালো ছিল না। বিভিন্ন সময়ে তাদের মধ্যে ছোটখাট বিষয় নিয়ে সমস্যা হয়ে আসছিলো, যেগুলো মদদ দিচ্ছিলো বড় কোনো যুদ্ধের, যার ফলস্বরূপ পরে গিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা পড়ে। শুধুমাত্র ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ক্ষমতার প্রতি লোভের দরুণই এমন করুণ ঘটনার সাক্ষী হয় গোটা বিশ্ব।

তথ্যসূত্র

[১] Making History – World History from 1914 to the Present – Christopher Culpin.

[২] The World Crisis – Winston Churchill

[৩] প্রথম বিশ্বযুদ্ধ- সাহাদত হোসেন খান, আফসার ব্রাদার্স, ঢাকা

ফিচার ইমেজ সোর্স: MilitaryHistoryNow.com

Related Articles