২৪ জুন, ২০০৭। সেদিন সকালে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অবস্থিত লাল মসজিদ থেকে সেখানকার ‘নৈতিক পুলিশে’র একটি দল ইসলামাবাদের সমৃদ্ধ ‘এফ–৮’ সেক্টরে অবস্থিত একটি চীনা ম্যাসাজ পার্লার ও আকুপাঙ্কচার ক্লিনিকে হানা দেয়। এই দলটিতে ১০ জন নারীও ছিল, যারা লাঠি বহন করছিল। তারা পার্লারের তিনজন পাকিস্তানি রক্ষীকে ঘায়েল করে এবং পার্লারের ভেতরে প্রবেশ করে সেখানকার কর্মীদেরকে তাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য আদেশ করে। সেসময় পার্লারটিতে সাতজন চীনা নারী কর্মী ও দুইজন পাকিস্তানি গ্রাহক ছিল। তারা মসজিদ থেকে আগত ব্যক্তিদের নির্দেশ মানতে অস্বীকৃতি জানায়।
এরপর তাদেরকে মারধোর করা হয় এবং অপহরণ করে ক্লিনিক থেকে অদূরে অবস্থিত জামিয়া হাফসা মাদ্রাসায় নিয়ে যায়। সেখানে অপহরণকারীদের একজন মুখপাত্র স্থানীয় প্রচারমাধ্যমকে জানায়, পার্লারটি ছিল কার্যত একটি পতিতালয়, এবং তাদের সতর্কবাণী সত্ত্বেও প্রশাসন এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। এজন্য তারা নিজেরাই এসব বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে।
লাল মসজিদের দলটি এর আগেও এ ধরনের ‘অভিযান’ চালিয়েছিল। কয়েক মাস আগের একটি ঘটনাতেই তারা আরেকটি পতিতালয়ে হানা দিয়ে চারজন পুলিশকে অপহরণ করেছিল। কিন্তু এবারের ঘটনা তাদের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, কারণ এই ঘটনায় চীনা নাগরিকরা জড়িত ছিল। শুধু লাল মসজিদের দলটির জন্যই নয়, সমগ্র পাকিস্তানের জন্য এই ঘটনাটির ফলাফল ছিল অত্যন্ত নেতিবাচক।
২০০৭ সালের প্রথম দিকে পাকিস্তানের জন্য অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক পরিস্থিতি ছিল আশাব্যঞ্জক। দেশটি বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি ছিল, কিন্তু সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছিল বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছিলেন। সেসময় পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৭%। বিগত তিন বছরে দেশটিতে বিদেশি বিনিয়োগ দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল, এবং করাচি স্টক এক্সচেঞ্জ পরিণত হয়েছিল বিশ্বের শীর্ষ স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর একটিতে।
প্রায় তিন বছর ধরে ভারতের সঙ্গে গোপন আলোচনার পর কাশ্মীর নিয়ে রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে একটি সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল। তদুপরি, ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আফগানিস্তান আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে (যেটিতে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন করতে বাধ্য হয়েছিল) পাকিস্তানি ‘প্রক্সি’ তালিবানের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ফলে পাকিস্তানিরা যে কৌশলগত ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়েছিল, সেই পরিস্থিতিতে পরিবর্তন ঘটছিল, কারণ তালিবান দক্ষিণ ও পূর্ব আফগানিস্তানের বিরাট এক অংশ দখল করে নিয়েছিল।
শুধু তাই নয়, যদিও পাকিস্তান তালিবানকে অস্ত্র সরবরাহ ও অর্থায়ন অব্যাহত রেখেছিল এবং কার্যত পাকিস্তান থেকেই তালিবান তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছিল, তবুও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সুদৃঢ় সম্পর্ক বজায় ছিল।
লাল মসজিদের ঘটনার কিছুদিন আগেই পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান পারভেজ মুশাররফ যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছিলেন এবং সেখানে তাকে রীতিমতো ঈর্ষনীয় সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। মুশাররফ পাকিস্তানকে মার্কিন–নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক সন্ত্রাদবাদবিরোধী যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ‘নির্ভরযোগ্য মিত্র’ হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন, এবং তার এই নীতির পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে শত শত কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা প্রদান ও পাকিস্তানের কাছে অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম হস্তান্তর করছিল।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের জন্য এই ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরিতে চীনেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। প্রধানত চীনা অর্থায়নে চীনা কোম্পানিগুলো কর্তৃক নির্মিত গোয়াদর বন্দর কিছুদিন আগেই উদ্বোধন করা হয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছিল, এটি মাকরান উপকূলে ‘পরবর্তী দুবাই’য়ে পরিণত হবে এবং আরব সাগর থেকে চীনের সমৃদ্ধ শহরগুলো পর্যন্ত একটি জ্বালানি সরবরাহ করিডোর হিসেবে কাজ করবে।
তদুপরি, সেসময় উত্তর–পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তর–পশ্চিম চীনের সংযোগ স্থাপনকারী কারাকোরাম মহাসড়ক বর্ধিত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল এবং পাকিস্তানের টেলিযোগাযোগ ও খনিজ সম্পদ খাতে চীন প্রচুর বিনিয়োগ করছিল। এজন্য পাকিস্তানিরা আশা করছিল, পাকিস্তানের ভাগ্য চীনের অনন্যসাধারণ অর্থনৈতিক বিস্তৃতির সঙ্গেই সংযুক্ত থাকবে।
তাছাড়া, ২০০৫ সালে ঘোষিত মার্কিন–ভারতীয় বেসামরিক পরমাণু চুক্তির ফলে পাকিস্তান যে কৌশলগত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল, সেটির দূরীকরণেও চীনের ভূমিকা ছিল। মার্কিন–ভারতীয় চুক্তির বিপরীতে চীন পাকিস্তানের চাশমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বর্ধিত করার প্রস্তাব দিচ্ছিল, এবং দক্ষিণ এশীয় দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার যতটুকু আগ্রহ চীনের ছিল, মার্কিন–ভারতীয় চুক্তির ফলে সেই আগ্রহ বিলীন হয়ে গিয়েছিল বললেই চলে। এর ফলে ভারতের ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে চীন পাকিস্তানের পরিবর্তে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে, পাকিস্তানের এই আশঙ্কা তো দূরীভূত হয়েছিলই, তার ওপর চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি নতুন অক্ষ গড়ে উঠছিল।
কিন্তু এ সময় পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের কেন্দ্রস্থলেই ছিল একটি টাইম বোমা, যেটিযে কোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারত। এই টাইম বোমা ছিল লাল মসজিদ ও জামিয়া হাফসা মাদ্রাসা। এই দুইটি স্থাপনা ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে মাত্র কয়েক ব্লক দূরে, এবং পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘ইন্টার–সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সে’র (আইএসআই) সদর দপ্তরের আরো কাছে।
১৯৬০–এর দশকে পাকিস্তানের রাজধানী যখন করাচি থেকে ইসলামাবাদে স্থানান্তরিত করা হয়, তখন ইসলামাবাদে স্থাপিত প্রথম মসজিদ ছিল লাল মসজিদ। ইসলামাবাদের সিনিয়র জেনারেল ও রাজনীতিবিদরা প্রায় এই মসজিদে যাতায়াত করতেন। কিন্তু ২০০৭ সালের পূর্ববর্তী বছরগুলোতে এই মসজিদটি পাকিস্তানি সরকারের সঙ্গে মিলিট্যান্টদের দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একদিকে এই মিলিট্যান্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল, আবার অন্যদিকে তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে ভয়ও পেত। তারা অংশত এই মিলিট্যান্টদের নিয়ন্ত্রণ করত, কিন্তু ক্রমশ তাদের পক্ষে এই মিলিট্যান্টদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে উঠছিল।
ধর্মভিত্তিক মিলিট্যান্টদের সঙ্গে লাল মসজিদের সম্পর্ক ছিল বেশ পুরনো, কিন্তু অতীতে এই সম্পর্ক ছিল মূলত রাষ্ট্রীয় সমর্থনপুষ্ট। ১৯৮০–এর দশকে এই মসজিদটি আফগানিস্তানে চলমান সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য যোদ্ধা নিয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। আফগানিস্তান ও ভারতীয়–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে পাকিস্তানি–সমর্থিত ‘জিহাদে’ অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্য এটি ছিল একটি ট্রানজিট পয়েন্ট।
১৯৯০–এর দশকে মসজিদটির সঙ্গে তালিবান ও আল–কায়েদার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ গাজী ১৯৯৮ সালে তালিবান নেতা মোল্লা ওমরকে ‘সম্মান জ্ঞাপনে’র উদ্দেশ্যে কান্দাহার সফর করেন এবং সেখানে আল–কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। তিনি লাদেনকে তার আদর্শ ব্যক্তিত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এর কয়েক মাসের মধ্যেই অবশ্য আব্দুল্লাহ গাজী খুন হন।
এরপর তার দুই ছেলে আব্দুল আজিজ ও আব্দুল রাশিদ লাল মসজিদ পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেন। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং পাকিস্তানি সামরিক সরকার এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেয়। লাল মসজিদের নেতারা এই আক্রমণ ও আক্রমণের প্রতি পাকিস্তানি সমর্থনের তীব্র নিন্দা জানান। কিন্তু তা সত্ত্বেও লাল মসজিদ ও পাকিস্তানি সরকারের মধ্যে একধরনের সূক্ষ্ম সম্পর্ক বজায় ছিল। কিন্তু ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তানি সামরিক অভিযান এই সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটায়।
উল্লেখ্য, ওয়াজিরিস্তান পাকিস্তানের পশতুন জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে অবস্থিত, এবং আফগানিস্তানে মার্কিন আক্রমণের পর তালিবান ও আল–কায়েদা যোদ্ধারা এই অঞ্চলে পালিয়ে এসেছিল। এর ফলে অঞ্চলটি মিলিট্যান্টদের একটি কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয় এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেখানে মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে।
এদিকে লাল মসজিদ ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসাগুলোর প্রায় ৭০% ছাত্রই তদানীন্তন পশতুন–অধ্যুষিত ‘কেন্দ্রশাসিত ট্রাইবাল অঞ্চল’ (Federally-Administered Tribal Areas) এবং উত্তর–পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (বর্তমানে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশ) থেকে এসেছিল, এবং তাদের অনেকেই ছিল কট্টরপন্থী মিলিট্যান্ট।
ওয়াজিরিস্তানে যে বিদ্রোহ চলছিল, সেই বিদ্রোহের নেতাদের সঙ্গে লাল মসজিদের নেতা আব্দুল রাশিদ গাজীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এজন্য তিনি ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তানি সামরিক অভিযানের তীব্র বিরোধিতা করেন এবং এর বিরুদ্ধে একটি ফতোয়া জারি করেন। এই ফতোয়ায় বলা হয়েছিল, পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যারা নিহত হবে, তারা শহিদের মর্যাদা লাভ করবে।
এই ঘটনার পরে পাকিস্তানি সরকার আব্দুল রাশিদ গাজীকে গ্রেপ্তার করে এবং তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি ভবন, আইনসভা ও সেনা সদর দপ্তর উড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ উত্থাপন করে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ধর্মমন্ত্রী এজাজুল হক, যিনি ছিলেন প্রাক্তন পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউল হকের ছেলে এবং লাল মসজিদের একজন পৃষ্ঠপোষক, আব্দুল রাশিদের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছেন। এই সমঝোতা অনুযায়ী আব্দুল রাশিদ রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত না হওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন, বিনিময়ে তাকে মুক্তি প্রদান করা হয়। কিন্তু এই সমঝোতা খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
২০০৭ সালের মধ্যে লাল মসজিদ কার্যত একটি তালিবানপন্থী ও প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত প্রায় বিদ্রোহী ঘাঁটিতে পরিণত হয়। মসজিদটির নিজস্ব শরিয়া আদালত এবং ‘নৈতিক পুলিশ’ দল ছিল। তারা ইসলামাবাদের বিভিন্ন গান ও ডিভিডির দোকানগুলোতে আক্রমণ চালায়। এই ‘নৈতিক পুলিশে’র ঘোষিত লক্ষ্য ছিল শহরে বিদ্যমান ‘অনৈতিক’ কার্যকলাপের অবসান ঘটানো। এই উদ্দেশ্যেই তারা উক্ত ম্যাসাজ পার্লার থেকে চীনা নারীদের অপহরণ করেছিল।
কিন্তু পাকিস্তান ও চীন উভয়ের জন্যই এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে পরিণত হয়। এ সময় বিদেশে অবস্থানরত চীনা নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা চীনা সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক মর্যাদার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানে চীনা নাগরিকদের অপহরণের ঘটনাটিকে চীনা জনসাধারণের সরব অংশ চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ‘মেরুদণ্ড’ কতটুকু শক্ত সেটার পরীক্ষা হিসেবে বিবেচনা করে, এবং চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ব্যঙ্গ করে তাদের কাছে ‘ক্যালসিয়ামের বড়ি’র প্যাকেজ পাঠায়।
পাকিস্তান চীনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র, এবং সেই মিত্ররাষ্ট্রের প্রধান সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অতি নিকটে সাতজন চীনা নাগরিকের অপহরণ ছিল চীন ও পাকিস্তান উভয়ের জন্যই অত্যন্ত লজ্জাজনক। অপহরণের পরবর্তী ১৭ ঘণ্টায় চীনা রাষ্ট্রপতি হু জিনতাও পাকিস্তানে অবস্থানরত চীনা কূটনীতিবিদদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতে থাকেন।
পাকিস্তানে নবনিযুক্ত তরুণ ও আত্মবিশ্বাসী চীনা রাষ্ট্রদূত লুও ঝাওহুই পরবর্তী ঘটনাগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। অপহৃত চীনা নাগরিকদের মুক্ত করার দায়িত্ব পুরোপুরি পাকিস্তানি সরকারের হাতে ছেড়ে না দিয়ে তিনি পাকিস্তানের যেসব শীর্ষ রাজনৈতিক নেতার আব্দুল রাশিদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল, তাদের প্রভাব ব্যবহার করে জিম্মিদের মুক্ত করার চেষ্টা চালান। তিনি পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী শওকত আজিজের সঙ্গে কথা বলেন, এবং বিরোধী দলীয় নেতা মাওলানা ফজলুর রহমান এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও পারভেজ মুশাররফের দল ‘পিএমএল–কিউ’ প্রধান শুজাত হুসেইনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জিম্মিদের মুক্ত করার জন্য তাদের সহায়তা চান।
রহমান এ ধরনের আলোচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন, কিন্তু হুসেইন ছিলেন এই ঘটনায় লাল মসজিদের নেতাদের সঙ্গে প্রধান আলোচনাকারী। বলা হয়ে থাকে, হুসেইন নিজেই ঐ চীনা পার্লারের একজন গ্রাহক ছিলেন। তিনিই আব্দুল রাশিদের সঙ্গে চীনা রাষ্ট্রদূতের ফোনালাপের ব্যবস্থা করে দেন।
চতুর আব্দুল রাশিদ দক্ষতার সঙ্গে প্রচারমাধ্যমের সঙ্গে সংযোগ রাখেন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষকে সেটিই বলেন যেটি তারা শুনতে চাচ্ছিল। তিনি চীনা রাষ্ট্রদূতকে আশ্বস্ত করেন যে, শীঘ্রই চীনা জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হবে, এবং তিনি জিম্মিদেরকে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলারও সুযোগ করে দেন। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতির পরও পাঁচ ঘণ্টা যাবৎ শীর্ষ পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে লাল মসজিদের নেতাদের আলোচনা চলে। পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি মুশাররফ লাহোর থেকে এবং প্রধানমন্ত্রী আজিজ ইসলামাবাদ থেকে আলোচনার প্রতিটি মুহূর্ত পর্যবেক্ষণ করেন।
কার্যত ইসলামাবাদের ডেপুটি কমিশনার চৌধুরী মুহাম্মাদ আলী এবং পুলিশের সিনিয়র সুপারিন্টেন্ডেন্ট জাফর ইকবাল জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার জন্য লাল মসজিদের নেতাদের কাছে অনুনয়-বিনয় করেন এবং ভবিষ্যতে নারী–পুরুষ মিশ্র পার্লারগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন। অবশেষে আব্দুল রাশিদ জিম্মিদের মুক্তি দিতে রাজি হন, এবং জিম্মি চীনা নারীদেরকে বোরকা পরিয়ে মুক্তি দেওয়া হয়।
চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে এই ‘প্রায় কূটনৈতিক বিপর্যয়ে’র ঘটনা এখানেই সমাপ্ত হয়নি। এই অপহরণের ঘটনার অব্যবহিত পরেই ২০০৮ সালে চীনে অনুষ্ঠিতব্য গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমসের প্রস্তুতি অংশ হিসেবে পাকিস্তানি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেইজিং সফর করেন। তাকে সতর্ক করে দেওয়ার পাশাপাশি ২৭ জুন চীনা জননিরাপত্তা মন্ত্রী ঝাও ইয়ংকাং প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, তারা আশা করেন, পাকিস্তান যতদ্রুত সম্ভব চীনা নাগরিকদের ওপর আক্রমণ পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি মুশাররফের সঙ্গে একটি ফোনালাপের সময় চীনা রাষ্ট্রপতি হু জিনতাও অনুরূপ বক্তব্য রাখেন, এবং চীনা সশস্ত্রবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারাও একই ধরনের বক্তব্য প্রদান করেন।
শুধু তাই নয়, লাল মসজিদে চীনের জিনজিয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল থেকে আগত কিছু উইঘুর মিলিট্যান্ট অবস্থান করছিল, এবং খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, চীনা সরকার ইসলামাবাদে চীনা নাগরিকদের অপহরণের জন্য এই উইঘুর মিলিট্যান্টদের উস্কানিকেই দায়ী করছে। এর মধ্য দিয়ে চীন পাকিস্তানের মাটিতে অবস্থানরত চীনা নাগরিকদের নিরাপত্তার প্রতি অবহেলা করার পাশাপাশি চীনের মূল ভূখণ্ডের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম চালানোর সুযোগ দেওয়ার দায়েও পাকিস্তানকে পরোক্ষভাবে অভিযুক্ত করে।
এরপর পাকিস্তানি সরকার লাল মসজিদে সামরিক অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিছু কিছু বিশ্লেষকের মতে, চীনের চাপেই পাকিস্তান এই অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আবার কিছু কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, মুশাররফ ও তার সহযোগীরা বহু আগে থেকেই লাল মসজিদে অভিযান চালাতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু এক্ষেত্রে তীব্র বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। এজন্য চীনাদের উদ্বেগকে তারা অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করেন। বাস্তবতা যাই হোক না কেন, অভিযানের পর ২০০৭ সালের নভেম্বরে প্রদত্ত একটি ভাষণে মুশাররফ এই অভিযানের মূল কারণ হিসেবে চীনা নাগরিকদের জিম্মির বিষয়টিকেই তুলে ধরেন।
২০০৭ সালের ৩ জুলাই প্রায় ৬,০০০ পাকিস্তানি সৈন্য, কমান্ডো ও রেঞ্জার লাল মসজিদ কমপ্লেক্স ঘিরে ফেলে এবং সেটি অবরোধ করে। লাল মসজিদের মিলিট্যান্টদের আত্মসমর্পণের জন্য বেশ কয়েকটি সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়, কিন্তু তারা আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। অবশ্য এর মধ্যে অন্তত কয়েক শত মিলিট্যান্ট নিজ উদ্যোগে আত্মসমর্পণ করে। অবশেষে সাত দিনব্যাপী অবরোধের পর ১০ জুলাই ভোর ৪টায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ‘স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ’ (এসএসজি) কমান্ডোরা মসজিদ কম্পাউন্ডের ভেতরে প্রবেশ করে এবং আক্রমণ শুরু করে। ইসলামাবাদে ইতিপূর্বে কখনো এত ভয়াবহ যুদ্ধ হয়নি, এবং বিস্ফোরণের শব্দে শহরটি কেঁপে ওঠে।
মসজিদ কমপ্লেক্সের ভেতরে প্রায় ১,৩০০ ছাত্র ছিল, যাদের অনেকেই ছিল ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। কমপ্লেক্সটির বেজমেন্ট, বাঙ্কার ও টানেলগুলো ‘পরিষ্কার’ করতে পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রায় ২০ ঘণ্টা সময় লাগে। এই অভিযানে ১১ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত ও ৪৪ জন আহত হয়। অন্যদিকে, কমপক্ষে ৮৪ জন মিলিট্যান্ট এই সংঘর্ষে নিহত হয় এবং আরো প্রায় ৫০ জন গ্রেপ্তার হয়। নিহতদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল রাশিদ গাজী স্বয়ং। নিহত হওয়ার অল্প কিছুক্ষণ আগেই তিনি পাকিস্তানি টেলিভিশন চ্যানেল ‘জিও টিভি’কে টেলিফোনে তার শেষ সাক্ষাৎকার প্রদান করেন।
উল্লেখ্য, নিহত মিলিট্যান্টদের মধ্যে ১৫ জন ছিল পাকিস্তান ও আফগানিস্তান বাদে অন্যান্য দেশ থেকে আগত, এবং এদের মধ্যে ১২ জনই ছিল উইঘুর। গ্রেপ্তারকৃত মিলিট্যান্টদের মধ্যে ছিল তাজিক, উজবেক ও চেচেন জাতিভুক্ত বেশকিছু মিলিট্যান্ট। এছাড়া, এই অভিযান চলাকালে ১৪ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত এবং ২০৪ জন আহত হয়। অবশ্য, কিছু কিছু সূত্রের মতে, এই অভিযানে নিহতদের সংখ্যা ছিল অন্তত কয়েক শত।
চীনাদের জন্য এই অভিযানের পরিণতি ভালো হয়নি। লাল মসজিদ অবরোধ চালাকালেই পেশোয়ারে বন্দুকধারীরা একটি অটো–রিক্সা কারখানায় কর্মরত তিনজন চীনা প্রকৌশলীকে খুন করে। ইতিপূর্বে বালুচ মিলিট্যান্টরা গোয়াদর বন্দর নির্মাণে চীনের ভূমিকার জন্য চীনা নাগরিকদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল, কিন্তু ধর্মভিত্তিক মিলিট্যান্টরা আগে চীনা নাগরিকদের কখনো লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেনি।
এমতাবস্থায় দেরিতে হলেও চীনা সরকার একটি বিবৃতিতে জানায় যে, লাল মসজিদে অভিযান চালানোর জন্য তারা পাকিস্তানকে চাপ দেয়নি, এবং চীন কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। কিন্তু চীনের এই দাবি প্রায় কেউই বিশ্বাস করেনি। উল্টো চীনা রাষ্ট্রদূত লুও ঝাওহুই পর্যন্ত তালিবানের ‘হিটলিস্টে’ চলে আসেন। পাকিস্তান ক্রমশ চীনা নাগরিকদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
কিন্তু চীনের জন্য এরচেয়ে বেশি শঙ্কার বিষয় ছিল লাল মসজিদ অভিযানের পর পাকিস্তানের পরিণতি। এই অভিযানের ফলে এতদিন পাকিস্তানি সরকার মিলিট্যান্টদের সঙ্গে যে সূক্ষ্ম সম্পর্ক বজায় রেখেছিল, সেটি ভেঙে পড়ে এবং পাকিস্তানি সরকার ও মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলোর মধ্যে খোলাখুলি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। লাল মসজিদের ওপর আক্রমণ পাকিস্তানি মিলিট্যান্টদের সরকারের বিরুদ্ধে একত্রিত করে, এবং তাদের মনে হতে থাকে যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী (মিলিট্যান্টদের প্রাক্তন পৃষ্ঠপোষক) তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এর ফলে পাকিস্তানের বড় বড় শহরগুলোতে সহিংসতা ও বোমা হামলার ঘটনা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
২০০৭ সালের জুলাইয়ে লাল মসজিদ অভিযানের আগে পাকিস্তানে সব মিলিয়ে মাত্র ৪২টি আত্মঘাতী হামলা সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু ২০০৭ সালের বাকি মাসগুলোতেই ৪৭টির বেশি আত্মঘাতী হামলা সংঘটিত হয়। অবরোধের পরবর্তী এক বছরে এ রকম হামলায় ১,১৮৮ জন পাকিস্তানি নাগরিক নিহত এবং ৩,২০৯ জন আহত হয়। আল–কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনার জন্য আহ্বান জানান।
যেসব মিলিট্যান্টের জন্য মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল আফগানিস্তান, তারা এখন সেখান থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে তাদের এককালীন পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তানের দিকে দৃষ্টি দেয়। কেন্দ্রশাসিত ট্রাইবাল অঞ্চলের মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলো পাকিস্তানি সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তি বাতিল ঘোষণা করে, এবং সম্মিলিতভাবে ‘তেহরিক–ই–তালিবান পাকিস্তান’ নামক একটি সংগঠন গড়ে তুলে পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। লাল মসজিদ অবরোধের দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে মিলিট্যান্টরা পাকিস্তানের বিস্তৃত অঞ্চল দখল করে নেয় এবং ইসলামাবাদের ৬০ মাইলের ভেতরে এসে পৌঁছায়।
পাকিস্তানি সরকার চীন ও পাকিস্তানের মধ্যবর্তী মূল স্থল সংযোগ কারাকোরাম মহাসড়কের সুরক্ষার জন্য সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি ক্র্যাক কোরকে মোতায়েন করে, কারণ ধারণা করা হচ্ছিল, মিলিট্যান্টরা এখানে আক্রমণ চালাতে পারে। এই যুদ্ধাবস্থার কারণে পাকিস্তানি অর্থনীতি ও স্টক এক্সচেঞ্জ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পাকিস্তানে বিদেশি বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। এরপর থেকে পাকিস্তানি অর্থনীতি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
শুধু তাই নয়, লাল মসজিদ অবরোধ ও এর পরবর্তী পরিস্থিতি রাষ্ট্রপতি মুশাররফের জন্যও অশনিসংকেত নিয়ে আসে। কিছুদিনের মধ্যেই মুশাররফ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন, এবং ‘পাকিস্তান পিপলস পার্টি’র আসিফ আলী জারদারি পাকিস্তানের নতুন রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। জারদারি মুশাররফের মতো চীনপন্থী ছিলেন না, এজন্য বেশ কয়েক বছরের জন্য চীন ও পাকিস্তানের সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে কম উষ্ণতা বিরাজ করে। সর্বোপরি, এখন পর্যন্ত উত্তর–পশ্চিম পাকিস্তানে মিলিট্যান্টদের সঙ্গে পাকিস্তানি সরকারি বাহিনীর যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে।