১৮১৫ সালের ১৫ এপ্রিল বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার সুমবাওয়া দ্বীপে তামবোরা আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণ আর উদগিরিত লাভার ফলে তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যুবরণ করে ১০ হাজার মানুষ। একই সাথে তখন আঘাত হানে সুনামি। প্রায় তিন মাস ধরে চলেছিল এই অগ্ন্যুৎপাত। পরবর্তীতে খাদ্য সংকট ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে স্থানীয় দ্বীপগুলোতে আরও অন্তত আশি হাজার মানুষ মারা যায়। বলা হয় পৃথিবীর ইতিহাসে বিগত ১০ হাজার বছরের মধ্যে এটি ছিল বৃহৎতম অগ্ন্যুৎপাত। সুমবাওয়া দ্বীপের মর্মান্তিক পরিণতি সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বৈশ্বিকভাবেও পরিলক্ষিত হয়েছিল এর প্রভাব।
তামবোরার ঘটনার মাসখানেকের মধ্যেই ওয়াটারলুতে নেপোলিয়নের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। বাকি জীবন তাকে কাটাতে হয় নির্বাসনে। পরের বছরই বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় তীব্র খাদ্য সংকট। আমেরিকার ভার্মন্টে সজারু আর সেদ্ধ বিছুটি পাতা খেয়ে দিন কাটাতে থাকে গ্রামবাসীরা। চীনের ইউনান প্রদেশের কৃষকরা খাদ্যাভাবে বাধ্য হয় হোয়াইট ক্লে বা চীনামাটি চাটতে। ফ্রান্সের গ্রীষ্মকালীন পর্যটকেরা নাকি ভিখারিদের লাইনকে সৈন্যদের মার্চ ভেবে বিভ্রান্ত হয়েছিল। এরকমই আরেক পর্যটকের দল সেবার সুইজারল্যান্ডে ছুটি কাটাতে গিয়ে খারাপ আবহাওয়ায় বাড়িতে আটকে আয়োজন করে এক গল্প লেখা প্রতিযোগিতা। তাদের সৃষ্টি করা রচনায় বদলে যায় বিশ্ব সাহিত্যের ধারা। তবে শুধু ইউরোপ, আমেরিকা আর পূর্ব এশিয়াই নয়, প্রকৃতির হাত থেকে রেহাই পায়নি বাংলার মানুষও। ১৮১৭ তে যশোর জেলায় দেখা দেয় কলেরার প্রাদুর্ভাব। সময়ের সাথে তা রূপ নেয় এক ভয়ঙ্কর মহামারিতে।
উপরের সবগুলো ঘটনাই তামবোরা অগ্নুৎপাতের সাথে এক সূত্রে গাঁথা। উনিশ শতকের সেই সময়টিতে মানুষ পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, তামবোরার প্রভাব থেকে রক্ষা পায়নি। জলবায়ু বিপর্যয় যে পুরো বিশ্বকে ধাক্কা দিতে পারে এর চাইতে ভালো উদাহরণ সম্ভবত নেই। একদিকে সৃষ্টি করেছে দুর্ভিক্ষ ও মহামারি, অন্যদিকে পালটে দিয়েছে শিল্প ও সাহিত্য থেকে শুরু করে পরিবহন ব্যবস্থা। তামবোরা সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হল-
১৮১৬, যে বছর ছিল না কোনো গ্রীষ্মকাল
১৮১৬ সাল ছিল বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম সংকটপূর্ণ কাল। তীব্র শীতে ফসল উৎপাদন কমে যাওয়ায় উত্তর গোলার্ধে দেখা দিয়েছিল চরম খাদ্য সংকট। মজার ব্যাপার হল ১৮১৫ সালের তামবোরা বিস্ফোরণের সাথে এ ঘটনার সম্পৃক্ততা বিজ্ঞানীরা প্রায় একশ বছর পর খুঁজে পায়।
কিন্তু কীভাবে ঘটল এই বিপর্যয়? তামবোরা হতে নির্গত ধোঁয়া, ছাই ও ক্ষুদ্র কণা বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোফিয়ার অঞ্চলে পৌঁছে যায়। সেখান থেকে সারা বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এদিকে অগ্নুৎপাতে নিঃসৃত সালফেট গ্যাস বিশাল এক এরোসল মেঘের সৃষ্টি করে। পুরো পশ্চিম-ভারতীয় অঞ্চলে নেমে আসে অন্ধকার। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বিষুবীয় অঞ্চল ধরে এই মেঘ ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বে। এরপর ক্রমশ মেরু অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে। সালফেট এরোসলের এই স্তরটি সূর্যরশ্মি মহাকাশে বিকিরিত করে পৃথিবীতে আসার পথে বাধার সৃষ্টি করে। ফলে হঠাৎ করেই আবহাওয়ায় আসে এক বিশাল পরিবর্তন। বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস নেমে যায়। প্রধান চারটি ঋতুর প্রকৃতি বদলাতে থাকে।
১৮১৬ সালে অবস্থা চরম রূপ নেয়। জুন, জুলাই আর আগস্ট মাস জুড়েও সমস্ত উত্তর গোলার্ধ বরফে ছেয়ে যায়। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একদিন হয়তো তাপমাত্রা বেড়ে ৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে উঠে, আবার পরদিনই শুরু হয় তুষারপাত। গ্রীষ্মকালেও ইতালি আর হাঙ্গেরিতে দেখা যায় বাদামি, হলুদ আর লাল রঙের রঙিন তুষারপাত। এরকম বিরূপ আবহাওয়ায় ব্যাহত হয় ফসল উৎপাদন। দাম বেড়ে যায় খাদ্যের। ইতিহাসবিদ জন ডি পোস্টের মতে এই দুর্যোগ ছিল পশ্চিমা বিশ্বের অস্তিত্বের জন্য সর্বশেষ সংকট। নিউ ইংল্যান্ডে ১৮১৬ সাল ‘এইটিন হান্ড্রেড এন্ড ফ্লোজ টু ডেথ’ বা আঠারোশর বরফ জমা মৃত্যু নামে পরিচিত। অন্যদিকে জার্মানরা ১৮১৭ সালকে বলে ‘ভিখারিদের বছর’।
বাংলার কলেরা মহামারি
তামবোরা নিঃসৃত সালফেট গ্যাসের প্রভাব পড়ে বাংলার মৌসুমেও। ১৮১৫ সালের গ্রীষ্মকাল স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী ছিল। ফলে অচিরেই দেখা দেয় খরা। এদিকে বর্ষাকাল দেরিতে আসায় শুরু হয় অসময়ের বন্যা। ১৮১৬ আর ১৮১৭ সালেও একই অবস্থা। খরা আর বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এরমধ্যে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে।
বাংলায় চিরকাল ধরে কলেরা ও বিভিন্ন পেটের অসুখ সাধারণ রোগ-বালাই হিসেবে পরিচিত। কলেরার জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া ভিব্রিও কলেরির মূল আবাসস্থল উপকূলীয় অঞ্চল ও নদীর অববাহিকাসমূহ। এই ব্যাকটেরিয়া পরিবর্তিত জলীয় পরিবেশ ও তাপমাত্রার প্রতি সংবেদনশীল। ১৮১৫ সালের পর হঠাৎ করেই জলবায়ুতে পরিবর্তন আসায় ব্যাকটেরিয়াটি বিবর্তন ঘটিয়ে দ্রুত অভিযোজিত হয়। ভিব্রিও কলেরির জিনগত গঠনে আসে পরিবর্তন। আগমন ঘটে মহামারি সৃষ্টিকারী নতুন এক ভয়াবহ স্ট্রেইনের। প্রথমে সংক্রমিত পানি ও খাদ্য থেকে মানুষের মাঝে ছড়ায় এই ব্যাকটেরিয়া। এরপর শুরু হয় মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ। ১৮১৭ থেকে ১৮২৪ সাল পর্যন্ত মহামারি ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগর সন্নিহিত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। সমগ্র ভারতে প্রায় ২০ লাখ লোক মারা যায়। ইতিহাসে এই মহামারি ‘এশিয়াটিক কলেরা’ বা ‘প্রথম কলেরা মহামারি’ নামে পরিচিত।
নেপোলিয়নের পরাজয়
এ তো গেল প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মহামারির কথা। কিন্তু নেপোলিয়নের ওয়াটারলু যুদ্ধে হেরে যাওয়ার সাথে তামবোরা অগ্নুৎপাতের সম্পর্ক কোথায়? ওয়াটারলুতে নেপোলিয়নের হারের কারণ হিসেবে ইতিহাসবিদগণ অনেক ধরনের তত্ত্ব দিয়েছেন। তবে এর মধ্যে অন্যতম একটি তত্ত্ব হল যুদ্ধের আগের রাতের প্রবল বৃষ্টিপাত। কাদাপানির কারণে নেপোলিয়ন তার সৈন্যদের অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিতে বিলম্ব করেন। আর সে সুযোগে প্রুশিয়ান বাহিনী এসে যোগ দেয় ইংরেজদের সাথে। ইংরেজ ও প্রুশিয়ানদের মিলিত বাহিনীর কাছে কোনঠাসা হয়ে পড়ে নেপোলিয়নের সৈন্যদল। নেপোলিয়নকে বন্দী হয়ে চলে যেতে হয় নির্বাসনে।
তবে সেদিনের সেই মুষলধারে বৃষ্টিপাত মৌসুমী কোনো সাধারণ বৃষ্টি ছিল না। সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণায় দেখা গেছে ১৭ জুন, ১৮১৫ সালের সেই প্রচণ্ড বৃষ্টির পেছনে হাত ছিল তামবোরা সৃষ্ট আবহাওয়া বিপর্যয়ের। বেলজিয়াম থেকে সাত হাজার মাইল দূরে অবস্থিত ইন্দোনেশিয়ায় বিস্ফোরিত সেই আগ্নেয়গিরির কারণেই দুইমাস পর ওয়াটারলুতে সেই ঘন মেঘের সৃষ্টি হয়েছিল। সে রাতে বৃষ্টি না হলে নেপোলিয়নের শক্তিশালী বাহিনীর কাছে ইংরেজদের হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আর নেপোলিয়ন জিতে গেলে তার বিশ্ব জয়ের ইচ্ছার কারণে ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশকে রক্তক্ষয়ী আরো বহু যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হতো।
বাইসাইকেল উদ্ভাবন
তবে তামবোরার সব স্মৃতিই যে খারাপ তা না। এর সাথে জড়িয়ে আছে বাইসাইকেল উদ্ভাবনের ইতিহাস। ১৮ শতকে ইউরোপজুড়ে ঘোড়া ছিল পরিবহনের মূল মাধ্যম। কিন্তু ১৮১৬ সালে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হলে শুরু হয় খাদ্য সংকট। ফলস্বরূপ পশুখাদ্যের দামও বেড়ে যায়। যাতায়াত ব্যবস্থা ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। জার্মান রাজ কর্মচারী কার্ল ভন ড্রেইজ বহুদিন ধরেই চার চাকার গাড়ি নিয়ে গবেষণা করছিলেন। দুর্যোগের সময় তার প্রিয় ঘোড়াটিও মারা যায়। ১৮১৭ সালে ড্রেইজ দু’টো কাঠের চাকার সাথে কাঠের ফ্রেম যুক্ত করে তৈরি করেন দুই চাকার বাহন। ড্রেইজের নাম অনুসারে এর নাম হয় ড্রেইজিন। তবে তা ডান্ডি হর্স বা হবি হর্স নামেই বেশি পরিচিত ছিল। বাহনটির প্যাডেল, চেইন বা ব্রেক কিছুই ছিল না। ডান্ডি হর্সেরই আধুনিক সংস্করণ আজকের বাইসাইকেল। দুই বছরের মধ্যেই ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে এই বাইসাইকেল ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
দানবের জন্ম
জুন, ১৮১৬। সুইজারল্যান্ডের লেক জেনেভার ধারে এক ভিলায় বন্ধুরা মিলিত হলো গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটাতে। কিন্তু সে বছর গ্রীষ্ম বলে আদৌ কিছু ছিল না। দলে ছিল পার্সি বিশী শেলি, প্রেমিকা মেরি, কবি লর্ড বায়রন, মেরির সৎ বোন ক্লেয়ার ক্লেয়ারমন্ট আর বায়রনের ডাক্তার জন পলিডরি। ব্যক্তিগত জীবনে প্রত্যেকেই নানা সমস্যায় জর্জরিত। মন হালকা করতে ছুটিতে আসা। কিন্তু আবহাওয়া এতটাই খারাপ যে বাইরে বেরোনোর জো নেই।
স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া, বিষণ্ণ আকাশ আর অনবরত বৃষ্টির কারণে শেষ পর্যন্ত গৃহবন্দী হয়েই থাকতে হলো। সময় কাটাতে আসর বসল গল্প পাঠের। এমন আবহাওয়ার সাথে ভৌতিক গল্পই মানানসই। এদিকে আসরের প্রায় সবাই কমবেশি লেখালেখির সাথে জড়িত। লর্ড বায়রন তাই প্রস্তাব দিলেন ভৌতিক গল্প লেখা প্রতিযোগিতার। পার্সি ঘোষণা দিলেন বিচারক হবার। প্রকৃতির রূপকে কলমে তুলে আনতে সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠল। আঠারো বছরের মেরি লিখে ফেললেন ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন: অর, আ মডার্ন প্রমিথিউস’। সূর্যবিহীন গ্রীষ্মে ভিলা ডিওডাটিতে জন্ম নিলো ভয়ংকর এক দানব। দু’শো বছর ধরে আজও চলছে যার ত্রাসের রাজত্ব। এক দানবের জন্ম দিয়ে মেরি শেলি পাঠকের মনে স্থায়ী জায়গা গড়ে নিলেন। ওদিকে জন পলিডরিও ভ্যাম্পায়ার নিয়ে গল্প লিখলেন। প্রতিযোগিতায় মেরি জিতে গেলেও পলিডরি তার গল্পের জন্য হয়ে গেলেন ভ্যাম্পায়ার জনরার প্রবর্তক। পলিডরির রচিত ‘দ্য ভ্যাম্পায়ার’ এখন পর্যন্ত রক্তচোষাদের নিয়ে প্রকাশিত প্রথম গল্প হিসেবে বিবেচিত হয়।
ওদিকে প্রকৃতির বিষণ্ণ রূপ লর্ড বায়রনের মনেও গাঢ় প্রভাব ফেলেছিল। ছুটিতে বসেই তিনি রচনা করলেন ‘ডার্কনেস’। ব্যক্ত করলেন আধো ঘুম, আধো জাগরণে দেখা এক পৃথিবীর কথা। কবিতাটির প্রথম লাইন ছিল এরকম-
“আমি এক স্বপ্ন দেখেছি। যাকে পুরোপুরি স্বপ্নও বলা চলে না।
জ্বলজ্বলে সূর্যটা নিভে গিয়েছিল…”