কার আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেতো?
এই কথাটা এতবার শোনা হয়েছে, চিন্তার আগেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে- শায়েস্তা খাঁ! এবং বিপরীতক্রমে, শায়েস্তা খাঁর নাম শুনলে আমার মাথায় এমন একটা চিত্র আসে- বুড়িগঙ্গার তীরে বস্তার পর বস্তা চাল রাখা আছে, আর লোকেরা পকেট থেকে ফটাস করে একটা টাকা ফেলে আটটা করে বস্তা নিয়ে যাচ্ছে।
যদিও প্রকৃত অবস্থাটা এমন ছিল না। প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে এক টাকার মূল্য যথেষ্টই ছিল, সবার পকেটে তো না-ই, অনেকের ঘরেও একটা টাকা থাকতো না। এবং তখনও আধপেটে খাওয়া হাড্ডিসার মানুষ রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াতো। দুর্ভিক্ষ হত, ওরা মরে যেত। ওরা তো রাজা ছিল না, ওদের মৃত্যুর হিসেবও কোথাও থাকে না।
তবে রাজারা কী করেছিল, তার কিছু কিছু হিসাব পাওয়া যায় বটে! এবং শায়েস্তা খাঁর কথা যদি ধরি, তাঁকে সম্ভবত বাংলার সফলতম সুবাদারই বলতে হবে। যদিও তাঁকে ঢাকায় বদলি করা হয়েছিল ‘শাস্তি’ হিসেবে।
শুনতে অদ্ভুত লাগছে না? তিনশো বছর আগে ঢাকা খানিকটা জঙ্গলই ছিল বলতে হবে, এখানে বদলি হওয়াটা হয়তো দুর্ভাগ্য হিসেবেই দেখা হত। শায়েস্তা খাঁর দুর্ভাগ্যের কারণ ধরা হয় তাঁর এক রাতের অসতর্ক মুহূর্তকে। তিনি যখন পুনের দায়িত্বে ছিলেন, গভীর রাতে বরযাত্রীর ছদ্মবেশে এক দল ডাকাত হই হই করে পুনেতে ঢুকে পড়ে। তাদের সাথে যুদ্ধে নেমে শায়েস্তা খাঁ একটা আঙুল হারান, আর তাঁর ছেলে হয় নিহত।
এতে অবশ্য মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ক্রুদ্ধ হওয়া এড়ানো যায়নি। তিনি দ্রুত শায়েস্তা খাঁকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। বলতে খুব ইচ্ছে করছে, শায়েস্তা খাঁ সম্পর্কে আওরঙ্গজেবের মামা হতেন, অর্থাৎ শায়েস্তা খাঁর বোন হলেন মমতাজ মহল, যার সমাধি ‘তাজমহল’ নামে ভুবনখ্যাত।
শায়েস্তা খাঁ ঢাকার সুবাদার হয়ে আসেন ১৬৬৪ সালে। মাঝখানে দু’বছর বাদ দিয়ে ১৬৮৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা শাসন করে গেছেন। এই সময়টাকে মোটামুটি বাংলার স্বর্ণযুগ ধরা হয়। তবু শায়েস্তা খাঁর মতো অদ্ভুত চরিত্র বাংলার ইতিহাসে খুব বেশি নেই। কিংবা কে জানে, রাজামাত্রই হয়তো অদ্ভুত হয়ে থাকে। ফলে লোকে বলে, জীবনের শেষদিকে এসে শায়েস্তা খাঁ বিষণ্ন হয়ে পড়েন, ঢাকা শাসনের ওপর থেকে তাঁর মন উঠে যায়।
কিন্তু এর পূর্ব পর্যন্ত শায়েস্তা খাঁ প্রবল বিক্রমে বাংলা শাসন করে গেছেন। তিনি যে সময়টায় বাংলায় আসেন, তখন এ অঞ্চলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা খুব একটা শক্তিশালী ছিল না। প্রায়ই আরাকান থেকে দস্যুরা এসে আক্রমণ চালাতো। এই দস্যুদের থেকে বাংলাকে রক্ষা করতে শায়েস্তা খাঁ যেই ব্যবস্থা নেন সেটা শুনতে খুবই উদ্ভট শোনাবে, কিন্তু কাজে দিয়েছিল। বঙ্গোপসাগরে যেসব জলদস্যু ঘুরে বেড়াতো, তাদেরকে ধরে শায়েস্তা খাঁ সরাসরি মোঘল সেনাবাহিনীতে ঢুকিয়ে দেন, বেশি বেতনের লোভ দেখিয়ে। ফলে মোঘল সেনাবাহিনীর শক্তি অনেকখানি বেড়ে যায়, এবং দীর্ঘ কোনো যুদ্ধ ছাড়াই বাংলাকে মোটামুটি দস্যুদের আক্রমণ থেকে নিরাপদ করে ফেলা যায়।
শায়েস্তা খাঁকে হয়তো ঐতিহাসিকরা সামরিক দক্ষতার কারণেই বেশি সম্মান দেবেন। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষেরা যেটা সহজে দেখতে আর বুঝতে পারি সেটা হচ্ছে- সেই আমলের স্থাপত্য। ঢাকায় মোঘল আমলের যে স্থাপনাগুলো দেখা যায়, সেটার একটা বড় অংশ শায়েস্তা খাঁর সময়ে তৈরি। এই রীতিটা বর্তমানে “শায়েস্তা খাঁর স্থাপত্যরীতি” নামেই পরিচিতি পেয়েছে। যেমন- পুরান ঢাকার ছোট কাটরা! যদিও এটার অস্তিত্ব এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন। চারদিকে দোকানপাট-ঘরবাড়ি এমনভাবে ঘিরে ধরেছে যে, এর ভেতরে যে “কিছু একটা” আছে—সেটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। অথচ ১৯৪০ সালেরও একটা ফটোগ্রাফ পাওয়া যায়, যেখানে ছোট কাটরা রীতিমত রাজকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
আর আছে মোহাম্মাদপুরের সাত গম্বুজ মসজিদ। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করায় এই মসজিদ অবশ্য বেশ ভালো দশাতেই আছে। কেবল এটাই আশ্চর্য লাগে যে, শায়েস্তা খাঁর আমলে এই মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল বুড়িগঙ্গার ধার ঘেঁষে। এই তথ্য জানার পর কারো আগ্রহ থাকলে সাত গম্বুজ মসজিদ দেখে বুড়িগঙ্গার দিকে হাঁটা দিতে পারে- সেটা একটা অভিজ্ঞতা হবে বটে!
তবে স্থাপত্যের কথাই যদি বলতে হয়, সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করতে হবে লালবাগ দুর্গের নাম, যেটা মোটামুটি ঢাকা শহরের আইকন ছবিগুলোর মধ্যে একটা। এই দুর্গের সাথে শায়েস্তা খাঁর নাম রীতিমত সিল মেরে লাগিয়ে দেয়া আছে। যদিও লালবাগ দুর্গের কাজ তিনি শুরু করেননি। এবং এই দুর্গের কাজ তিনি শেষও করেননি, বস্তুত কেউই, কখনই লালবাগ দুর্গের কাজ শেষ করেনি, তিনশো বছরেরও বেশি সময় ধরে এটা একটা অসমাপ্ত দুর্গ হিসেবে পড়ে আছে।
মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ছেলে শাহজাদা আজম শখের বশে এই দুর্গটা নির্মাণ করতে শুরু করেন। কিন্তু মাঝপথেই তাকে ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে হয়, এবং চলে যাওয়ার আগে তিনি শায়েস্তা খাঁকে অনুরোধ করে যান যেন দুর্গটার কাজ শায়েস্তা শেষ করেন। লোকশ্রুতি আছে, এই শাহজাদা আজমের সাথে শায়েস্তা খাঁর মেয়ের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। শাহজাদা আজম চলে যাওয়ার কিছুকাল পরেই শায়েস্তা খাঁর মেয়ে মারা যায়, এবং এই ঘটনায় শায়েস্তা বড় ধরনের ধাক্কা খান। লালবাগ দুর্গের ভেতর তিনি মেয়ের সমাধি নির্মাণ করেন, কিন্তু দুর্গের কাজ শেষ করার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। দুর্গের ভেতর সেই সমাধিটা এখন পরী বিবির সমাধি নামে পরিচিত।
একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। মিটফোর্ড হাসপাতালের (এখন যেটা স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) পেছনদিকে একটা মসজিদ আছে, যেটার নাম শায়েস্তা খাঁর মসজিদ। অনেক পুরনো স্থাপত্য, দেখলে বিশ্বাস হয় এটা শায়েস্তা খাঁর আমলের হতে পারে। একদিন মসজিদের ওখানে হাঁটতে গিয়ে আমি রীতিমত ধাক্কা খেলাম। দেখি একটা দরজার ওপরে সাইনবোর্ড ঝুলছে- “শায়েস্তা খাঁ মসজিদ ও কবরস্থান”। দরজার ওপাশে জঙ্গলমতো জায়গা, খানিক অন্ধকার। চিন্তিত হয়ে ভাবছিলাম, শায়েস্তা খাঁর কবর যে ঢাকাতেই আছে, আর এমন অযত্নে পড়ে আছে- এই কথা তো কোথাও শুনিনি? আমাকে দেখে পাশে বসে থাকা এক ফলওয়ালা বললেন, যাও ভেতরে, কবর আছে। আমি চোখ কপালে তুলে ভেতরে গিয়ে দেখি, ঝোপঝাড়ের ওপাশে আরেকটা ছোট দরজা, ওটাও বন্ধ।
– ফিরে এসে ফলওয়ালা মামাকে বললাম, দরজার ওপাশেই কি শায়েস্তা খাঁর কবর?
– তিনি বললেন, হ্যাঁ!
– আমি বললাম, কিন্তু কবরের দরজা তো বন্ধ!
– তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, নক করো, ভেতর থেকে খুলে দিবে।
এই শুনে আমার মাথার চুল খাড়া হয়ে গিয়েছিল! পরে সাহস করে নকও করেছিলাম অবশ্য, দরজা খুলে দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক বেরিয়েও এসেছিলেন, যিনি অবশ্যই শায়েস্তা খাঁ নন। তবে তিনি যেখান থেকে বেরিয়েছিলেন, তার সামনে দুটো কবর ছিল। ভদ্রলোক দাবি করলেন, এর কোনোটাই শায়েস্তা খাঁর না। কবরের পাশেই একটা ছোট বাসা-বাচ্চাকাচ্চা-জামাকাপড় দেখে মনে হলো ওখানে পরিবার নিয়ে মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিন সাহেবরা থাকেন, ফলে ভদ্রতার খাতিরেই ভেতরে ঢুকে দেখতে পারিনি কবরের গায়ে কিছু লেখা আছে কি না।
মনের মধ্যে খুব খচখচ করছিল। শেষে বইপত্র ঘেঁটে জানলাম, শায়েস্তা খাঁ মারা যাবার বেশ কয়েক বছর আগেই ঢাকা ছেড়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যু হয় আগ্রায়।