১৯৪৪ সাল; জার্মানদের অপরাজেয় খেতাব ম্লান হতে শুরু হয়েছে। স্তালিনগ্রাদে পরাজয়ের পর প্রতিদিনই জার্মানদের ধাওয়া করে আসছে সোভিয়েতরা। পশ্চিমের অবস্থাও খুব সুবিধার না। দুঃসংবাদ আসছে আফ্রিকা থেকেও। সব মিলিয়ে টালমাটাল অবস্থা অক্ষশক্তির।
কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা ঠিকই বুঝতে পারলেন, এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন পর বার্লিনে মিত্রবাহিনীর পতাকা উড়বে। সময় থাকতেই রাইখের নীতি নির্ধারণকারীদের নতুন করে ভাবা উচিত। কিন্তু বাস্তবে নির্ধারণকারীদের দিয়ে কোনো নীতি ঠিক হয় না। সমস্ত নীতির মূলেই একজন- অ্যাডলফ হিটলার। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদদের একটি বড় অংশই বিরক্ত মহামান্য ফ্যুয়েরারের উপর। কিন্তু এত সাহস কার! সাহস করে মুখ ফুটে বললেও হিটলার সে কথা শুনলে তো!
অনেকবারই হিটলারকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে এবং প্রত্যেকবারই তিনি সেটা অগ্রাহ্য করেছেন। বার্লিনে তখন এমন কিছু সামরিক অফিসার এবং রাজনীতিবিদ ছিল, যাদের মনে হয়েছিল, দেশের জনগণকে রক্ষা করতে যুদ্ধের লাগাম টেনে ধরা জরুরি। শাসনতন্ত্রে পরিবর্তন আনা ভীষণ দরকারি। কিন্তু এজন্য ফ্যুয়েরার এবং তার বাধ্যগত কিছু লোকজনকে দৃশ্যপট থেকে সরাতে হবে। নাৎসিদের নজরদারি উপেক্ষা করে খুব গোপনে শুরু হলো এক পরিকল্পনা।
বিভিন্ন পদের সামরিক অফিসার থেকে শুরু করে কয়েকজন রাজনৈতিক একটি বিষয়ে একমত ছিলেন। শাসনতন্ত্রে পরিবর্তনের জন্য হিটলারকে সরাতে হবে। আর হিটলারকে ক্ষমতাচ্যুত করার একমাত্র রাস্তা হত্যা। হেনিং ট্রেসকো, উইন ফন জ্লেবিন, ফ্রেডরিক অলব্রিচট, হ্যান্স অসটার, কার্ল হেনরিক, এরিক ফেলজিবল,হেলমুথ স্টিফের মতো জেনারেলরা সরাসরি পরিকল্পনার সাথে যুক্ত ছিলেন। কালজয়ী সেনানায়ক ফিল্ড মার্শাল রোমেলও সমর্থন জানিয়েছিলেন। সরাসরি যুক্ত না থেকে এই পরিকল্পনায় কয়েকশত সামরিক অফিসার সায় দিয়েছিলেন।
জার্মানদের পূর্বনির্ধারিত একটি পরিকল্পনা ছিল অপারেশন ভ্যালকাইরি। যদি কোনো কারণে হিটলার নিহত হন, তাহলে দেশের প্রশাসন সচল রাখার দায়িত্ব নেবে টেরিটরিয়াল রিজার্ভ আর্মি অফ জার্মানির স্থানীয় ইউনিট। শত্রুদের হাতে হিটলার নিহত হলে করণীয় ভেবে এই অপারেশনটি ঠিক করে রাখা ছিল, কিন্তু হিটলার এবং তার অতি অনুগত এসএস বাহিনীকে এই অপারেশন দিয়েই ঘায়েল করার সিদ্ধান্ত হয়।
অপারেশন ভ্যালকাইরি নামের এই অপারেশনের জন্য ৪ ধাপে পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
১) হিটলারকে হত্যা করতে হবে
রেডিও বার্তায় সারা দেশে জানাতে হবে, নাৎসি পার্টির ঊর্ধ্বতন নেতারা এবং এসএস বাহিনী ক্ষমতার দখল নিয়ে বিরোধে জড়িয়েছেন। উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলায় এবং দেশের আইন প্রশাসন ঠিক রাখতে অপারেশন ভ্যালকাইরি শুরু হবে।
২) বিশেষ সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকার নিম্নলিখিতদের উপর কর্তৃত্ব অর্জন করবে।
সামরিক বাহিনী, প্রশাসন, দখলকৃত অঞ্চলের গভর্নর/সরকার, এসএস বাহিনী, রাইখ লেবার সার্ভিস এবং সামরিক প্রকৌশল ইউনিট “ওটি”।
৩) নাৎসি পার্টির সামরিক শাখা ওয়াফেন এসএস বাহিনীকে মূল সামরিক বাহিনীর সাথে একত্রীকরণ করা হবে। গুরুতর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ছিল এই কুখ্যাত বাহিনীর বিরুদ্ধে। ঊর্ধ্বতন এসএস কর্মকর্তারা গ্রেফতার হবেন।
৪) নতুন সরকার দেশের জানমাল ও নিরাপত্তা রক্ষার দায়ভার নেবে এবং আরেক কুখ্যাত বাহিনী Sicherheitsdienst-কে বিলুপ্ত করা হবে
ডক্টর গোয়েডিলারকে নতুন ফ্যুয়েরার ঘোষণা করা হবে। যারা নতুন শাসকদের বিরোধিতা করবে তাদের দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। জার্মানির প্রশাসনিক দখল নিশ্চিত করবে টেরিটরিয়াল রিজার্ভ আর্মি অফ জার্মানি। এই বাহিনী কোনো সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিত না। তাদের কাজ ছিল মূল জার্মান ভূখণ্ড এবং নিকটবর্তী দখলকৃত এলাকার প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা। প্রশাসনিক দখল নিশ্চিত করার পর কুখ্যাত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে। তারপর যত দ্রুত সম্ভব মিত্রবাহিনীর সাথে আলোচনায় বসতে হবে।
রিজার্ভ আর্মির প্রধান ফ্রেডরিক ফ্রম বিদ্রোহে সায় না দিলেও বিরোধিতাও করেননি। এমনকি সব কিছু জানার পরেও তিনি হিটলারকে কিছুই জানাননি। সব কিছুর সমন্বয়কারীর ভূমিকায় ছিলেন জেনারেল হেনিং ট্রেসকো।
অপারেশন ভ্যালকাইরির আগেও অন্তত ৬ বার হিটলারকে হত্যা চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু কোনোবারই সফলতার ধারেকাছেও পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ১৯৪৪ সালের ২০ জুলাই আরেকটি সুযোগ এসে পড়ে।
সেদিন দখলকৃত পোল্যান্ডের উল্ভস লেয়ারে হিটলারের এক বৈঠক ছিল। হিটলারকে উৎখাত করতে চাওয়া কর্নেল ক্লস ভন স্তাফেনবার্গের সেখানে উপস্থিত থাকার কথা ছিল। এই সুযোগ নিয়েই অপারেশন ভ্যালকাইরি সফল করার পরিকল্পনা শুরু হয়।
সাড়ে ছয় বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত কমপ্লেক্সটি ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দপ্তর ছিল। অপারেশন বারবারোসা এখান থেকেই পরিচালিত হতো। জায়গাটি ছিল মূল শহর এবং বসতি থেকে অনেকটাই দূরে। জনবিচ্ছিন্ন এই স্থানে কী হচ্ছে সেটা বাইরে থেকে বোঝা কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। এমনকি সোভিয়েত পদাতিক বাহিনী এসে পৌঁছানোর আগে এই জায়গা নিয়ে মিত্রবাহিনীরও ভালো ধারণা ছিল না। এসব বিবেচনা করে এই স্থানেই হিটলারকে ঘায়েল করার ছক কাঁটা হয়।
১২:৩০ এ স্তাফেনবার্গ মিটিং শুরুর ঠিক আগমুহূর্তে টয়লেটে যান। প্রথম বোমায় ফিউজ লাগিয়ে স্বয়ংক্রিয় করার পরই দরজার টোকা দেয় কেউ। মিটিং শুরু হয়ে যাচ্ছে দেখে গার্ড তাড়া দিতে এসেছিল। তাড়াহুড়োতে তিনি দ্বিতীয় বোমাটি তার সহকারীর কাছে রেখে আসেন। মিটিংয়ের সময় ব্রিফকেসটি হিটলারের পাশে রেখে তিনি একটু দূরে এসে দাঁড়ান। একটু পরেই গার্ড এসে জানায়, স্তাফেনবার্গের জরুরি ফোন এসেছে। এই ফোনটি আসলে তারই কোনো সাহায্যকারীর ছিল। এদিকে মিটিংয়ে কথা বলতে বলতে হিটলার খানিকটা দূরে হেঁটে গিয়েছিলেন।
১২:৪৫ মিনিটে বোমা বিস্ফোরিত হয়। স্তাফেনবার্গ স্বচক্ষে বিস্ফোরণ দেখেন এবং ধরে নেন হিটলার নিহত হয়েছেন। উল্ভস লেয়ারের যোগাযোগ ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকা জেনারেল ফেলজিবল পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সবরকম রেডিও যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এই এলাকা।
স্তাফেনবার্গ তার সহকারীকে নিয়ে ৯ মাইল দূরের রানওয়েতে চলে যান। রানওয়ের গেট খোলার অনুমতি না থাকলেও তিনি সেখানে থাকা সৈনিককে ভয় দেখিয়ে ঢুকে পড়েন রানওয়েতে। বিমান নিয়ে রওনা দেন বার্লিনের দিকে।
বার্লিনে তখন অভ্যুত্থানকারীদের মধ্যে ধোঁয়াশা বিরাজ করছে। হিটলার কি সত্যিই মারা গিয়েছেন? স্তাফেনবার্গ কোনো কিছু জানাতে পারেননি। জেনারেল ফ্রেডরিক ওলব্রিক্ট নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অপারেশন ভ্যালকাইরি শুরু করতে চাননি। কিন্তু কর্নেল কুইআর্নহাইমের চাপে তিনি ভ্যালকাইরি শুরু করেন। এদিকে স্তাফেনবার্গও বার্লিনে নেমে জানান, হিটলার মারা গেছেন।
রিজার্ভ আর্মির জেনারেল ফ্রমকে গ্রেফতার করা হয়। চিফ অব স্টাফ হবার পর স্তাফেনবার্গ অপারেশন ভ্যালকাইরিতে কিছু পরিবর্তন এনেছিলেন, যার ফলে রিজার্ভ আর্মিকে জেনারেল ফ্রমের আদেশ ছাড়াও কার্যকর করা যাবে। এমনকি এই আদেশে হিটলারের স্বাক্ষরও ছিল।
বার্লিন এবং অন্য সব প্রদেশের সরকারি অফিস, বাসবভন, এসএস সদরদপ্তর দখলে নিতে শুরু করে রিজার্ভ আর্মি। গ্রেফতার হয় এসএস সদস্যরা। হিটলারের জার্মানিকে রক্ষার ডাক দেয়া হয় জনগণকে।
কিন্তু চমকে দেয়ার মতো খবর আসে বিকালে। উল্ভস লেয়ারের যোগাযোগ ঠিক হতেই জানানো হয়, হিটলার নিহত হননি। রিজার্ভ আর্মির এক কমান্ডারের সাথে হিটলার নিজে কথা বলেন। পরে বেতারে ভাষণ দিয়ে জানান, তিনি জীবিত আছেন! এবার অভ্যুত্থানকারীরা গ্রেফতার হতে শুরু করে। রাতের মধ্যেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে নাৎসিরা।
বিস্ফোরণের সময় হিটলার একটু দূরেই ছিলেন। এছাড়াও বোমাভর্তি ব্যাগের সামনে টেবিলের পা ছিল। ফলে বিস্ফোরণ অনেকটাই ঐ টেবিলের উপর দিয়ে যায়। বিস্ফোরণে ৩ জন অফিসার এবং ১ জন টাইপরাইটার নিহত হলেও বেঁচে যান হিটলার। বিস্ফোরণের শক ওয়েভ লাগা এবং প্যান্টে ছোট্ট একটু ছেড়া ব্যতীত হিটলারের আর কিছুই হয়নি। হিটলারের আঘাত এতটাই কম ছিল যে, তিনি বিকালে একই স্থানে মুসোলিনির সাথে বৈঠকও বহাল রাখেন এবং বিস্ফোরণের স্থানটি মুসোলিনিকে দেখান।
পরিকল্পনায় কোনো ত্রুটি ছিল না, কিন্তু ছোট ছোট কিছু কারণে ব্যর্থ হয় অপারেশনটি।
প্রথমত, উল্ভস লেয়ারের রিইনফোর্সমেন্ট বাংকারে বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও বৈঠক হয় কনফারেন্স রুমে। পুরু দেয়াল দিয়ে ঘেরা রিইনফোর্সমেন্ট বাংকার এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল, যাতে ভয়াবহ বিমান হামলা বা কামানের গোলাও ভেতরের মানুষদের ক্ষতি না করতে পারে। ছোট এই বাংকারের ভেতরে সামান্য শক্তির কোনো বোমা বিস্ফোরিত হলে বোমার টুকরোগুলো দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে আবার ফিরে আসতো, যার ফলে বোমার শক্তি বেড়ে যেত। ভেতরের বদ্ধ পরিবেশের ফলে বায়ুচাপ বেশি ছিল, যেটা বোমার শক্তি বাড়িয়ে দিত। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বৈঠক হয় কনফারেন্স রুমে। বেশ বড় কক্ষে বোমা বিস্ফোরিত হবার পর বোমার শক্তি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়ত, দুটি বোমা ব্যাবহার করার কথা থাকলেও একটি ব্যবহৃত হয়েছিল।
তৃতীয়ত, হিটলার বোমা থেকে বেশ দূরে ছিলেন। কাছে থাকলে তিনি নিহত হতেও পারতেন।
এই অপারেশন ব্যর্থ হবার পর পরিকল্পনাকারীদের অন্তত ২০০ জনকে ফায়ারিং স্কোয়াডে বা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার দৃশ্য ভিডিও করা হয়েছিল এবং হিটলার সেগুলো অবসরে দেখে সময় কাটাতেন! নিস্ক্রিয় থাকার অভিযোগে জেনারেল ফ্রমকেও হত্যা করা হয় পরে।
সরাসরি হত্যা ছাড়াও আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয় অনেক সেনা অফিসারকে। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা রোমেলকে ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠালে জনমনে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিত। সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন রোমেল। সরকার আত্মহত্যার কারণ চেপে যায় এবং সামরিক মর্যাদায় রোমেলকে সমাহিত করে। ধারণা করা হয়, শাস্তিস্বরুপ হিটলার ৭ হাজার মানুষকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকেই মারা যান।
ভ্যালকাইরির ব্যর্থতার দরুণ জার্মানিতে মারাত্মক দুটি প্রভাব পড়ে।
১) হিটলার কাউকে তোয়াক্কা না করে আরো খামখেয়ালি আচরণ করতে শুরু করেন।
২) দুর্দান্ত সামরিক অফিসারদের হারিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনেক দুর্বল হয়ে যায়। হয়তো রোমেল জীবিত থাকলে শেষ মুহূর্তে কোনো ঝলক দেখিয়ে আত্মসমর্পণের বদলে যুদ্ধবিরতির অবস্থা সৃষ্টি করতে পারতেন।
অপারেশন ভ্যালকাইরি এমন সময়ে ঘটা এক ঘটনা, যখন বিশ্বের মানুষ জার্মানি বলতে হত্যা, নির্যাতন আর ধর্ষণকেই বুঝতো। কিছু অভ্যুত্থানকারী এর মধ্যেই বিশ্বকে দেখাতে চেয়েছিলেন, সমগ্র জার্মানিই এক নয়। এই অপারেশন সফল হলে ইতিহাসের চেহারা আজকে অন্যরকম হতে পারতো। হয়তো বার্লিনে উড়তো না সোভিয়েতদের পতাকা, হয়তো জার্মানি দুই ভাগও হতো না!
এই ঘটনা নিয়ে বেশ কিছু সিনেমা আছে। Valkyrie (টম ক্রুজ অভিনীত), Stauffenberg, The Night of the Generals (1967) সবগুলোই অসাধারণ।