
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাসে জার্মানির ভূমিকার আড়ালে চাপা পড়ে আছে অন্য দেশগুলোর নৃশংসতা। বিজয়ীরাই সব জায়গায় ইতিহাস রচনা করে। স্রোতের বিপরীতে তাই বিজয়ীদের অপরাধ প্রকাশিত হয় না।
কিন্তু সত্য চাপা থাকে না। বহু বছর অস্বীকার করার পর ১৯৯০ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে সোভিয়েত সেনাবাহিনী দ্বারা কেটিন বনাঞ্চলে পোলিশ সেনাদের উপর চালানো হত্যার দায় স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। এই দায় স্বীকার ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ নেতা মিখাইল গর্বাচভের উদারীকরণ নীতিরই একটি প্রতিফলন।

১৯৩৯ সালে পোল্যান্ডকে মলটভন-রিবেনট্রপ চুক্তি অনুসারে দুই ভাগে ভাগ করে নিয়েছিল জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। চুক্তিটি জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরস্পরের মিত্রে পরিণত করে। এ সময় পোল্যান্ডের পশ্চিমাঞ্চল ছিল নাৎসি জার্মান বাহিনীর দখলে, আর পূর্বাঞ্চল ছিল সোভিয়েত সেনা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।
১৯৪০ এর বসন্তের কোনো এক সময় হাজার হাজার পোলিশ সেনা অফিসার, সৈন্য ও সাধারণ নাগরিককে সোভিয়েত সিক্রেট পুলিশ সার্ভিসের সদস্যরা নিয়ে যায় স্মলয়েঙ্কের বাইরে কেটিনের বনাঞ্চলে। সেখানে গণহারে পোলিশ সেনা অফিসার ও সৈন্যদের হত্যা করে কবর দেওয়া হয়। যদিও কেটিন ম্যাসাকার নামে হত্যাকান্ডটি ইতিহাসে পরিচিত, তবে কেটিনের পাশাপাশি অন্যান্য ক্যাম্পে রাখা পোলিশ বন্দীদেরও এ সময় হত্যা করা হয়। ধারণা করা হয়, প্রায় ২৮,০০০ পোলিশ সেনা অফিসার, সৈন্য ও সাধারণ নাগরিককে কেটিন হত্যাকান্ডের সময় হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয়েছিল। কেটিনের পাশাপাশি এ সময় আশেপাশের ক্যাম্প ও শহরে স্ট্যালিনের হুকুমে এ পাইকারী হত্যা চালিয়েছিল সোভিয়েত গুপ্ত পুলিশ (এনকেভিডি)।

১৯৩৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত রেড আর্মির সদস্যরা পোল্যান্ডে প্রবেশ করলে তাদের হাতে আড়াই থেকে সাড়ে চার লাখ পোলিশ সেনাসদস্য বন্দী হয়। জার্মানির পোল্যান্ডে প্রবেশের মাত্র তিন সপ্তাহ পরই মলটভ-রিবেনট্রপ চুক্তি অনুসারে সোভিয়েতরা পশ্চিম পোল্যান্ড দখল করে নিয়েছিল। ১৯ সেপ্টেম্বর এই বন্দীদের এনকেভিডির কাছে হস্তান্তর করা হয়। এনকেভিডি পশ্চিম সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেন ও বেলারুশের বিভিন্ন অংশের ক্যাম্পে বন্দীদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়। এসব ক্যাম্পে বন্দীদের উপর নেমে আসে নির্যাতন। বিশেষ সাক্ষাৎকার ও নানা প্রলোভন দেখিয়ে কারা ভবিষ্যৎ এ সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলদারীত্বের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে তার একটি তালিকা এ সময় তৈরি করা হয়। ১৯৪০ সালের ৫ মার্চ স্ট্যালিন তালিকা অনুসারে বন্দীদের হত্যার নির্দেশ দেয়। ১৯৪০ সালের ৩রা এপ্রিল থেকে ১৯ মে পর্যন্ত প্রায় ২২,০০০ হাজার বন্দীকে সোভিয়েতরা হত্যা করে।
১৯৫৬ সালের কেজিবির এক চিঠি থেকে জানা যায়, কেটিন হত্যাকান্ডে সব মিলিয়ে ২১,২৫৭ জন বন্দীকে হত্যা করা হয়েছিল, যার ভেতর কেটিন ক্যাম্পের ছিল ৪,৪২১ জন, স্টারঅবলেস্ক ক্যাম্পের ৩,৮২০ জন, অস্টাসকোভ ক্যাম্পের ৬,৩১১ জন এবং অন্যান্য ক্যাম্পের ছিল ৭,৩০৫ জন। কেটিনে যাদের হত্যা করা হয় তাদের ভেতর ছিল একজন অ্যাডমিরাল, দুজন জেনারেল, ২৪ জন কর্নেল, ৭৯ জন লেফটেন্যান্ট কনের্ল, ২৫৮ জন মেজর, ৬৫৪ জন ক্যাপ্টেন, ১৭ জন নেভাল ক্যাপ্টেন, ২০০ জন পাইলট, ৩,৪২০ জন এনওসির সাথে ছিল তিনজন জমিদার, একজন রাজপুত্র, ২০ জন প্রফেসর, ৪৩ জন বেসরকারী কর্মকর্তা, ৩০০ চিকিৎসক সহ কয়েকশ আইনজীবী, প্রকৌশলী, সাংবাদিক ও লেখক।

এ হত্যাকান্ডের সময় এনকেভিডি পোলিশ সেনাবাহিনীর অধের্কের বেশি অফিসারদের হত্যা করে। প্রায় সব ক্যাম্পেই বন্দীকে এক নির্জন ঘরে নিয়ে মাথার পেছনে গুলি করে হত্যা করা হয়। গুলির শব্দ যেন অন্যরা শুনতে না পায় সেজন্য জোরালো আওয়াজ তৈরি করা হত।
১৯৪১ সালে জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করলে মলটভ-রিবেনট্রপ চুক্তি শেষ হয়ে যায় এবং জার্মানি পোল্যান্ড থেকে সোভিয়েতদের বিতাড়িত করে সোভিয়েতের ভেতরে প্রবেশ করে। এ সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও প্রবাসী পোলিশ সরকারের মধ্যে চুক্তি হয়। চুক্তি অনুসারে সোভিয়েতের মাটিতে পোল্যান্ডের সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠন করার কথা বলা হয়। এ সময় সোভিয়েত ইউনিয়েনের কাছে বন্দী পোলিশ সেনা অফিসারদের সর্ম্পকে জানতে চাওয়া হলে স্ট্যালিন জানান, তাদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে। অনেকে মুক্তির আগেই পালিয়ে গেছে। যদিও এটা একটা ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
১৯৪৩ সালের এপ্রিলে জার্মান বাহিনী কেটিনের গোট হিলের কাছে পোলিশ অফিসারদের গণকবর আবিষ্কার করে এবং বিশ্ববাসীকে তা জানিয়ে দেয়। বার্লিন রেডিওর ভাষায় গণকবরটি ছিল ২৮ মিটার লম্বা ও ১৬ মিটার চওড়া, যেখানে ১২টি স্তরে তিন হাজার পোলিশ সেনা অফিসারের লাশ মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। তবে বিষয়টি তারা এমন সময় প্রচার করে যখন তারা রাশিয়ায় নাস্তানাবুদ হয়ে পিছু হটতে শুরু করেছে।
জার্মানির এ ঘোষণার পর লন্ডনে অবস্থিত প্রবাসী পোলিশ সরকারের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়েনের টানাপোড়েন শুরু হয়। বিশ্বযুদ্ধের পট ততদিনে অনেক পাল্টে গেছে। সত্য প্রকাশ করে সোভিয়েত ইউনিয়নকে চটানোর ঝুঁকি আমেরিকান বা ব্রিটিশ সরকার নিতে অনিচ্ছুক ছিল। প্রবাসী পোলিশ সরকার যেন সোভিয়েতদের দায়ী না করে সেজন্য আমেরিকা ও ব্রিটেন পোলিশদের উপর চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করে। তারা আশংকা করেছিল সত্যটা প্রকাশ পেলে সোভিয়েত সরকারের সাথে তাদের কূটনৈতিক যোগাযোগ ও মৈত্রী ব্যহত হতে পারে। তারা অনুরোধ করলো সত্যটা যেন কখনোই প্রকাশ করা না হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে জার্মান প্রচারযন্ত্র বারবার কেটিন গণহত্যার কথা প্রচার করে সোভিয়েতদের দায়ী করতে থাকে। সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্ট্যালিন অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করে উল্টো কেটিন হত্যাকান্ডের দায় জার্মানদের উপরই চাপিয়ে দেন। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নের ইচ্ছায় নুরেমবার্গ ট্রায়ালে কেটিন হত্যাকান্ডে জার্মানদের জড়িত থাকার জন্য বিচারেরও আয়োজন করা হয়।

১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন কেটিন হত্যাকান্ডে নিজেদের অপরাধ সর্ম্পকে পূর্ববর্তী অবস্থান পরিবর্তন করে, যার পেছনে মূল কারণ ছিল দুটি। প্রথমত, সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচভের উদার রাজনৈতিক অবস্থান। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন ঘটনা, সমস্যা চেপে রাখার পরিবর্তে সেই সম্পর্ক উদার আলোচনা এবং ইতিহাস, বিশেষ করে স্ট্যালিনের সময়কার নিষ্ঠুরতাগুলো প্রকাশ করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে উঠেন। দ্বিতীয়ত, সোভিয়েত-পোল্যান্ড সম্পর্কের তৎকালীন অবস্থান। সোভিয়েত ইউনিয়ন সে সময় পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উপর থেকে তাদের প্রভাব হারিয়ে ফেলছিল। নিজেদের আশেপাশের প্রতিবেশী দেশগুলোতে তাদের সমর্থিত সরকারগুলোর পতন তখন ঠেকানো যাচ্ছিলো না। পোল্যান্ডে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে সবরকম চেষ্টাই রাশিয়ানরা করেছে।
পোল্যান্ডে তৎকালীন সময়ে লিচ ওয়ালেসার সলিডারিটি মুভমেন্ট বেশ জনপ্রিয়। লিচ ওয়ালেসার কারণে ১৯৮৯ এর এক গোলটেবিল বৈঠক থেকে অবাধ ও নিরপেক্ষ এক পার্লামেন্টারি নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। তার সলিডারিটি মুভমেন্টের কাছে পোলিশ কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থা ততদিনে বেশ দুর্বল হয়ে পড়ায় রাশিয়ানরা ঠিক করে তারা কেটিন হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করবে। এই ইস্যুটি দীর্ঘ চার যুগ ধরে সোভিয়েত ও পোলিশ সর্ম্পকে একধরনের তিক্ততা তৈরি করে রেখেছিল। সোভিয়েত কর্মকর্তারা মনে করলেন, সোজাসাপ্টা স্বীকারোক্তি ও ক্ষমা চাওয়া হলে তা সম্পর্ক উন্নত করবে এবং পোলিশ কমিউনিস্ট পার্টিও এর সুফল ভোগ করবে। দু’দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক উত্তেজনাও এতে হ্রাস পাবে। সোভিয়েত সরকার ১৯৯০ সালের ১৩ এপ্রিল কেটিন গণকবর আবিষ্কারের ৪৭ বছর পর এ হত্যাকান্ডে সোভিয়েত ইউনিয়নের জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে, সোভিয়েত সরকার কেটিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য গভীরভাবে অনুতপ্ত এবং বিশ্বাস করে এটি স্ট্যালিনের নিদের্শে ঘটানো একটি অন্যতম জঘন্য কর্মকান্ড।

তবে চার যুগ পর সোভিয়েতদের এমন স্বীকারোক্তি পোল্যান্ডে তাদের প্রভাব ধরে রাখতে খুব একটা কাজে আসেনি। শীঘ্রই পোল্যান্ডে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তী রাশিয়ান সরকার এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করে। তবে এ তদন্ত আন্তর্জাতিক রাজনীতির মারপ্যাঁচে খুব একটা কাজে আসেনি। ২০০৫ সালে রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ কাউকে দোষী সাব্যস্ত না করেই তদন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত ঘোষণা করে। রাশিয়ান তদন্ত অনুসারে কেটিন হত্যাকান্ড কোনো গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ কিংবা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অন্তর্ভূক্ত নয়। তারা একে একটি সামরিক অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে এবং ৫০ বছর পর এ অপরাধকে কোনো বিচারিক ধারায় সংজ্ঞায়িত করার বিরোধিতা করে পুরো ব্যাপারকে সমাপ্ত বলে ঘোষণা করে।
এর পরপরই এ হত্যাকান্ড নিয়ে রাশিয়া ও পোল্যান্ডের সকল যৌথ কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। পোল্যান্ড তাদের নিজেদের মতো করে তদন্ত কাজ চালিয়ে যেতে থাকে এবং একপর্যায়ে কেটিন হত্যাকান্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকার করার জন্য রাশিয়ার প্রতি আহবান জানায়। তবে রাশিয়া এ ব্যাপারে নিজেদের অবস্থানের পরিবর্তন না করে একে নিষ্পন্ন হয়ে যাওয়া বিষয় বলে মনে করে।