আজ থেকে প্রায় নব্বই বছর আগের কথা। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে মে। নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড টেলিগ্রাম পত্রিকায় কাজের সন্ধান চেয়ে প্রকাশিত হলো একটি বিজ্ঞাপন- “Young man, 18, wishes position in country. Edward Budd, 406 west 15th Street”
বিজ্ঞাপনটি দিয়েছিলেন অ্যালবার্ট এবং ডেলিয়া বাড দম্পতি। পাঁচ সন্তানের বড় এক পরিবার নিয়ে তারা থাকতেন ছোট্ট এক অ্যাপার্টমেন্টে। তাই পরিবারে কিছু বাড়তি আয়ের আশায়, কিছুটা স্বচ্ছলতার মুখ দেখার আশায় তাদের বড় ছেলে এডওয়ার্ড বাডের জন্য চাকরি চেয়ে তারা বিজ্ঞাপনটি দিয়েছিলেন। মনে ক্ষীণ আশা, ‘কেউ যদি তাদের এই যুবক ছেলেটির কথা শুনে একটু এগিয়ে আসে’!
খুব বেশি দিন অবশ্য অপেক্ষা করতে হলো না তাদের। পরদিন বিকেলেই তাদের দরজায় মৃদু কড়া নাড়ার শব্দ এলো। ঘরে আর কেউ না থাকায় দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন ডেলিয়া বাড। দরজা খুলেই অপর পাশে দাঁড়ানো মানুষটিকে এক নজর দেখে নিলেন তিনি। লোকটির বয়স ষাট বছরের মতো হবে। উচ্চতা ৫ ফুট ৫ ইঞ্চির মতো, ওজন ১৩০ পাউন্ডের কাছাকাছি। তার পড়নে ছিলো নেভি ব্লু স্যুট, কালো শার্ট, কালো পশমী হ্যাট এবং পালিশ করা কালো জুতা। লোকটির চুলগুলো ছিলো সাদা কিন্তু চোখগুলো ছিলো নীলাভ। সব মিলিয়ে লোকটিকে বেশ অবস্থাসম্পন্ন বলেই মনে হয়েছিলো ডেলিয়ার। সমস্যা শুধু ছিলো এক জায়গায়, লোকটির দাঁতে। তার দাঁতগুলো ছিলো ভাঙা এবং বিবর্ণ। এমনকি কয়েকটি দাঁত ছিলোই না সেই লোকটির।
লোকটির নাম ফ্রাঙ্ক হাওয়ার্ড, পেশা কৃষিকাজ। তিনি জানালেন যে, পত্রিকায় এডওয়ার্ডের বিজ্ঞাপনটি তিনি দেখেছেন। নিজের খামারে এডওয়ার্ডকে চাকরি দেবার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করলেন তিনি। এতক্ষণ পর ডেলিয়া লোকটির আগমনের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন। তার মন আনন্দে ভরে উঠলো। লোকটিকে ভেতরে বসতে বলে তিনি এডওয়ার্ডকে ডাকতে গেলেন। কিছুক্ষণ পর এডওয়ার্ড আসলো। সে নিজেও লোকটির প্রস্তাবে খুশি মনেই সায় দিলো।
ফ্রাঙ্ক হাওয়ার্ড জানালেন যে, লং আইল্যান্ডের ফার্মিংডেল গ্রামে তার একটি খামার আছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যবসা বেশ ভালো চলায় তার একজন সহকারীর দরকার হয়ে পড়েছে। আর এজন্যই তার এডওয়ার্ডের খোঁজে আসা। প্রতি সপ্তাহে এডওয়ার্ডের জন্য ১৫ ডলার করে মজুরির প্রস্তাব করলেন তিনি। তখনকার সময়ে এটি ছিলো বেশ ভালো অঙ্কেরই এক পারিশ্রমিক। তাই এডওয়ার্ডের পরিবার হাওয়ার্ডের এই প্রস্তাব সানন্দে মেনে নিলো। এডওয়ার্ড জানতে চাইলো সে তার বন্ধু উইলি করম্যানকে সাথে নিতে পারবে কিনা। এডওয়ার্ডের এই প্রস্তাবে হাওয়ার্ড রাজি হলেন। তিনি সেদিনের মতো বাডদের বাড়ি ত্যাগ করলেন। যাওয়ার আগে জানিয়ে গেলেন যে, আসছে শনিবার তিনি এডওয়ার্ড আর তার বন্ধুকে নিয়ে যাবেন। শনিবার আসলো, পরিবারের সবাই সারাদিন ধরে হাওয়ার্ডের জন্য অপেক্ষা করলো। কিন্তু হাওয়ার্ডের টিকিটিরও খোঁজ মিললো না। সেই রাতেই হাওয়ার্ডের কাছ থেকে তাদের কাছে একটি টেলিগ্রাম আসলো। তাতে হাওয়ার্ড জানালেন যে, ব্যবসায়িক এক জরুরি কাজে হঠাৎ করেই তাকে নিউ জার্সিতে যেতে হয়েছিলো। তাই তিনি আসতে পারেননি। আগামীকাল আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টেলিগ্রামের ইতি টানেন তিনি।
পরদিন সকাল এগারোটার দিকে ফ্রাঙ্ক হাওয়ার্ড এডওয়ার্ডদের বাড়িতে উপস্থিত হন। এডওয়ার্ডের মালপত্র তখনও পুরোপুরি গোছানো শেষ হয়নি। তাই হাওয়ার্ড আর বাড দম্পতি তাদের বসার ঘরে আলাপচারিতা চালাতে লাগলেন। এমন সময় সেখানে এসে উপস্থিত হলো দশ বছর বয়সী গ্রেস বাড। মেয়েটি যদি তখনও জানতো যে এই ঘরে আসাটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ হতে যাচ্ছে…
গ্রেসের পড়নে সেদিন ছিলো সুন্দর সাদা একটি জামা। তার গাঢ় বাদামী রঙের চুলগুলো ছোট করে কাটা ছিলো। সেই সাথে ছিলো অসাধারণ সুন্দর, নীলাভ এক জোড়া চোখ। হাওয়ার্ড ছোট্ট পরীর মতো এই মেয়েটির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। মেয়েটি অল্প সময়ের মাঝেই হাওয়ার্ডের সাথে ঘনিষ্ট হয়ে গেলো। দাদুর বয়সী এই লোকটির কোলে বসে নির্ভয়ে সে গল্প জুড়ে দিলো। তিনি মেয়েটির সাথে একটু খেলতে চাইলেন। তাই মেয়েটিকে তিনি তার কাছে কত ডলার আছে সেটি গুণতে দিলেন। মেয়েটিও গুণে দিলো (৯১ ডলার)। তিনি মেয়েটিকে পুরষ্কার হিসেবে কিছু অর্থ দিলেন।
হঠাৎ করে হাওয়ার্ডের মাথায় এক বুদ্ধি আসলো। তিনি বাড দম্পতিকে জানালেন যে, আজ তার এক ভাগ্নির জন্মদিন যে কিনা কলম্বাস এভিনিউতে ১৩৭ নং সড়কে থাকে। তিনি গ্রেসকে নিয়ে তার ভাগ্নির জন্মদিনের অনুষ্ঠান থেকে ঘুরে আসতে চাইলেন। ডেলিয়া বাড এতে আপত্তি জানালেন। কিন্তু স্বামী অ্যালবার্টের জোরাজুরির কাছে হার মানতে বাধ্য হলেন তিনি। ঠিক হলো হাওয়ার্ড গ্রেসকে নিয়ে কয়েক ঘন্টা পর যখন ফিরে আসবেন তখনই তিনি এডওয়ার্ড আর তার বন্ধুকে নিয়ে ফার্মিংডেলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন।
কিছুক্ষণ পরই গ্রেস আর ফ্রাঙ্ক হাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বের হয়ে গেলো। কিন্তু মায়ের মন বলে কথা। ডেলিয়া বাড তাই পরে বলেছিলেন যে, কোনো এক অজানা কারণে গ্রেসকে হাওয়ার্ডের সাথে দিতে তার মন চাইছিলো না। এমনকি মোড় ঘুরবার সময় গ্রেস নাকি চিৎকার করে কিছু একটা বলেছিলো তবে তিনি তা শুনতে পান নি।
বাড দম্পতি সবচেয়ে বড় ভুল কোথায় করেছিলো জানতে চান? আসলে কলম্বাস এভিনিউ শেষ হয়ে গিয়েছিলো ১০৫ নং সড়কেই, ১৩৭ নং সড়কের কোনো অস্তিত্বই তখন ছিলো না! তাহলে? না, আপনি যা ভাবছেন ফ্রাঙ্ক হাওয়ার্ড আসলে তা করতে যাচ্ছেন না। তিনি আসলে এমন কিছু করতে যাচ্ছেন যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষ কখনো কল্পনাও করতে পারবে না।
গ্রেস নিখোঁজ হওয়ার কাছাকাছি সময়েই নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট নিখোঁজ লোকদের সন্ধানের জন্য একটি শাখা খুলেছিলো। গ্রেসের দুর্ঘটনার খবর পাওয়া মাত্রই তারা সেখানে দুজন তদন্তকারী কর্মকর্তা পাঠায়। তাদের মাঝে একজনের নাম ছিলো উইল কিং। কিং ছিলেন কর্কশ স্বরের অধিকারী এক ব্যক্তি। প্রচুর ধূমপানের অভ্যাস ছিলো তার। নিয়ম-নীতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন অবিচল। সেই সাথে কোনো কাজের ব্যাপারে তিনি ছিলেন দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ, একজন গোয়েন্দার জন্য যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক গুণ।
অল্প সময়ের মাঝেই গ্রেসের নিখোঁজ হওয়ার খবরটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। প্রচন্ড চাপের মুখে নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান সংক্রান্ত শাখার প্রধান ৫০ জন গোয়েন্দাকে এই ঘটনার তদন্তে নিয়োজিত করলেন। কিংকে প্রধান করে গঠন করা হলো একটি টাস্কফোর্স।
গ্রেস জীবিত কি মৃত সেটি কিং-এর কাছে এতটা বড় ব্যাপার ছিলো না। কিন্তু একজন লোক সবার সামনে দিয়ে রাস্তায় হেঁটে হেঁটে একটি মেয়েকে নিয়ে একেবারে হাওয়া হয়ে যাবে এই ব্যাপারটি তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই কেসটি সমাধানের যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন তিনি। অন্যান্য গোয়েন্দারাও তাদের কাজ নিষ্ঠার সাথে চালিয়ে যেতে লাগলেন। তারা বাডদের সারা ঘর জুড়ে হাওয়ার্ডের হাতের ছাপ খুঁজে বেড়ালেন। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন থেকে হাওয়ার্ড বাডদের কাছে যে টেলিগ্রামটি পাঠিয়েছিলেন সেই ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। তারা ফার্মিংডেলে গিয়ে খামার মালিকদের সাথেও কথা বললেন। কিন্তু এতকিছুর পরও গ্রেসের কোনো হদিসই তারা খুঁজে পেলেন না। কয়েক মাস পর সবাই অন্যান্য কেস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে গ্রেসের কেসটি আড়ালেই চলে যেতে থাকলো। কিন্তু ব্যাপারটিকে একেবারে আড়ালে চলে যেতে দিলেন না একজন ব্যক্তি, তিনি উইল কিং। অধ্যবসায়ের এক আশ্চর্য স্বাক্ষর রেখে নিয়মিতই তিনি গ্রেসের এই কেসটি নিয়ে তদন্ত চালাতেন। সম্ভাব্য সকল পথই ঘুরে দেখতে চাইছিলেন তিনি।
গ্রেসের খবরটি মিডিয়াতে আসার পরপরই বাড পরিবারের কাছে বিভিন্ন ধরণের চিঠি আসা শুরু করে যার বেশিরভাগই ছিলো সমবেদনায় পূর্ণ। উইল কিং বাডদের জানিয়ে রেখেছিলেন যে, তারা যাতে চিঠি না খুলেই সেগুলো তার কাছে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে কখনোই তারা এমনটি করেন নি। ফলে বাড পরিবারের সাথে ধীরে ধীরে কিং-এর এক ধরণের দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। এভাবে দিন গেলো, মাস গেলো, দেখতে দেখতে ছয়টি বছরও চলে গেলো। তবু ছোট্ট গ্রেসের কোনো সন্ধান মিললো না।
১৯৩৪ সালের শুরুর দিকের কথা। প্রতিদিনই নিত্যনতুন নানা কেসের চাপ, সেই সাথে গ্রেসের কেসটির চাপ সামলাতে না পেরে উইল কিং শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এজন্য তাকে তিন মাস হাসপাতালে কাটাতে হলো। ছাড়ার আগে ডাক্তাররা শরীরের ব্যাপারে তাকে বিশেষ মনোযোগী হতে বললেন। পুলিশ ডিপার্টমেন্টও তাকে ফিল্ড ওয়ার্কের বদলে ডেস্কের সামনে বসিয়ে দিলো। তবুও গ্রেসের কেসটির ব্যাপারে তিনি হাল ছাড়লেন না। যেখানেই সামান্যতম আলোর সন্ধান পেলেন, সেখানেই সমাধানের আশায় ছুটে যেতে লাগলেন তিনি।
অবশেষে আসলো নভেম্বর মাসের ২ তারিখ। ডেলিয়া বাডের কাছ থেকে উইল কিং-এর কাছে একটি টেলিফোন কল আসলো। ডেলিয়া জানালেন যে, এক অজ্ঞাত ব্যক্তির কাছ থেকে তিনি একটি চিঠি পেয়েছেন যা তার কাছে গ্রেস সম্পর্কিত বলে মনে হচ্ছে। এটুকু শোনার পরই কিং-এর আশার আলোটা আবার জ্বলে উঠলো। তিনি বাড পরিবারের বাসায় আসলে এডওয়ার্ড তার কাছে চিঠিটি এনে দেয়। এবারের চিঠিটি কিন্তু আর আগের মতো খোলা ছিলো না! একটু পড়েই বাড বুঝতে পারলেন যে, চিঠিটি সেই ফ্রাঙ্ক হাওয়ার্ডের, ছয় বছর আগে যে কিনা গ্রেস বাডের মতো একটি ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েকে অপহরণ করেছিলো।
কিন্তু কী ছিলো সেই চিঠিতে? পুরো চিঠি জুড়েই গ্রেসকে কীভাবে অপহরণ করা হয়েছিলো এবং পরবর্তীতে তিনি নিষ্পাপ বাচ্চা মেয়েটির সাথে কী রকম পাশবিক আচরণ করেছিলেন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা ছিলো। পাঠকদের কাছে সেই চিঠির কথাগুলো ভালো না-ও লাগতে পারে। তাই শুধু শেষের দুই-তিন লাইন তুলে দিচ্ছি- “তার পুরো শরীরটি খেতে আমার নয় দিন লেগেছিলো। আমি তার সাথে কোনো শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হইনি, যদিও চাইলেই আমি তা পারতাম। সে একজন কুমারী হিসেবেই মারা গেছে…।”
এবার থেকেই উইল কিং যেন তার আসল খেলা দেখানো শুরু করলেন। তিনি খেয়াল করলেন- যে খামে করে চিঠিটি পাঠানো হয়েছে, তাতে কোনো একটা প্রতীক ছিলো, আর প্রেরক সেটি ঘষে তুলে ফেলার চেষ্টা করেছে। তবুও তিনি আলোতে খামটি ধরে বুঝলেন যে সেখানে লেখা ছিলো NYPGBA; ফোন বুক চেক করে জানা গেলো এর পূর্ণ রূপঃ New York Private Chauffeur’s Benevolent Association। এর অবস্থান ছিলো নিউ ইয়র্কের ১২৭ লেক্সিংটন এভিনিউতে। উইল কিং ছুটে গেলেন তাদের হেড কোয়ার্টারে। অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্টকে খুলে বললেন সবকিছু।
সেদিন মাঝরাত পর্যন্ত প্রায় সাত ঘন্টা ধরে কাজ করলেন তিনি। NYPGBA-এর সদস্যপদ লাভের জন্য করা সবগুলো দরখাস্তের হাতের লেখা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন তিনি। কিন্তু তাকে হতাশ হতে হলো। কোনো হাতের লেখাই যে ফ্রাঙ্ক হাওয়ার্ডের সেই হাতের লেখার সাথে মিললো না!
এবার অন্য কৌশল অবলম্বন করলেন তিনি। সমিতির সদস্যদের কাছে তিনি জানতে চাইলেন ইদানীং তারা NYPGBA-এর সীলমোহর যুক্ত কোনো খাম ব্যবহার করেছেন কিনা কিংবা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বাসায় নিয়ে গেছেন কিনা। তিনি তাদের কাছে তার প্রকৃত উদ্দেশ্যটি গোপন রাখলেন। কথাগুলো বলার পর তিনি প্রেসিডেন্টের রুমে অপেক্ষা করছিলেন। এমন সময় লিও সিকোস্কি নামক ছোট, লাল চুলওয়ালা এক লোক ঘরে প্রবেশ করেন। তিনি জানান ৬২২ লেক্সিংটন এভিনিউয়ের একটি বাড়িতে থাকার সময় তিনি কিছু খাম নিয়ে নিজের কাজে ব্যবহার করেছিলেন। আশার আলো দেখতে পেয়ে সেখানে ছুটে গেলেন উইল কিং। কিন্তু না, আবারো তাকে হতাশ হতে হলো। কারণ সিকোস্কি বাড়িটি ছাড়ার পর কেউই আর সেখানে ভাড়াটে হিসেবে আসে নি। প্রতিবেশীদের কেউও হাওয়ার্ডের মতো কাউকে দেখে নি বলেই জানান।
আবারো সিকোস্কির কাছে ছুটে গেলেন তিনি, জানতে চাইলেন সিকোস্কি আর কিছু মনে করতে পারেন কিনা সে সম্পর্কে। সিকোস্কি জানান যে, তারও আগে তিনি ২০০ পূর্ব ৫২ নং সড়কে থাকতেন। সেই বাসায় বিছানার পেছনের শেলফে তিনি একই ধরণের আরো কিছু খাম ফেলে এসেছিলেন। কিং দ্রুত ছুটে গেলেন ৫২ নং সড়কের সেই বাসায়। বাড়ির মালিককে হাওয়ার্ডের চেহারার বর্ণনা দিয়ে কিং জানতে চাইলেন এমন কাউকে তিনি চেনেন কিনা। বাড়ির মালিক তাতে সায়ও দিলেন। তবে সমস্যা বাঁধলো অন্য জায়গায়। বাড়ির মালিকের মতে লোকটির নাম ফ্রাঙ্ক হাওয়ার্ড নয়, অ্যালবার্ট ফিশ! মহিলা জানালেন যে, ঐ লোকটি ৭ নাম্বার রুমে থাকেন। মাঝে মাঝে এসে সিভিলিয়ান কনজার্ভেশন কর্পসে কাজ করা তার ছেলের কাছ থেকে পাঠানো চেক নিয়ে আবার চলে যান। কিং নজর দিলেন রেজিস্টারে অ্যালবার্ট ফিশের হাতের লেখার দিকে। আরে! এ যে ফ্রাঙ্ক হাওয়ার্ডেরই হাতের লেখা! দীর্ঘ ছয় বছর ধরে অনুসন্ধানের পর অবশেষে অপহরণকারীর সন্ধান পেলেন কিং। তবে এখনো কিন্তু তিনি তাকে ধরতে পারেন নি, কেবল অবস্থান শনাক্ত করতে পেরেছেন। পরবর্তীতে জানা যায় লোকটির আসল নাম অ্যালবার্ট ফিশ। তবে অপরাধ করে সহজে যাতে ধরা না পড়েন সেজন্য গ্রেসের বেলায় তিনি ফ্রাঙ্ক হাওয়ার্ড ছদ্মনামটি ব্যবহার করেন।
এবার শুরু হলো কিং-এর অপেক্ষার পালা। কখন ফিশ আসবে, কখন তিনি তাকে পাকড়াও করবেন। তিনি কাছাকাছি একটি বাড়ির সবচেয়ে উপরের ফ্লোরে এসে থাকতে শুরু করলেন যাতে ৫২ নং সড়ক এবং ৩ নং এভিনিউয়ের সংযোগস্থলটা সেখান থেকে সহজেই চোখে পড়ে। ব্যায়াম, ধূমপান, খাওয়া-দাওয়া সবই চলতে লাগলো। সেই সাথে চলতে লাগলো ফিশের খোঁজে তাকিয়ে থাকা। প্রতিদিন প্রায় ২২ ঘন্টা করে জেগে থাকা শুরু করলেন তিনি। তবুও ফিশের দেখা মিললো না। তবে কি কিং-এর গন্ধ পেয়ে ফিশ আগেই সেখান থেকে সটকে পড়েছেন?
না। অবশেষে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত দিন, ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই ডিসেম্বর। প্রতিদিনের ছকে বাঁধা জীবন থেকে একটু অবসরের আশায় বড়দিনের জন্য কেনাকাটা করতে বের হলেন উইল কিং। প্রায় দু’ঘন্টার মতো বাইরে ছিলেন তিনি। যখনই ফিরলেন তার কিছুক্ষণের মাঝেই দরজায় জোরে আঘাতের শব্দ আসলো। দরজা খুলে দেখেন ফিশের বাড়ির মালিক দাঁড়িয়ে। মহিলা জানালেন যে, আধা ঘন্টা আগে ফিশ এসেছেন। তবে তিনি তাকে জানিয়েছেন যে, চেক আসে নি (মিথ্যা কথা)। তাই ফিশ চেকের জন্য অপেক্ষা করছেন।
এতদিন পর শিকার একেবারে হাতের মুঠোয়। পয়েন্ট থার্টি এইট রিভলবারটি কোমরে গুঁজে তিনি বের হলেন ফিশের সন্ধানে। দরজা খুলে দিলেন ফিশই। হাওয়ার্ড আর ফিশ যে একই ব্যক্তি তা এই লোকটিকে দেখে শতভাগ নিশ্চিত হলেন কিং। তিনি নিজেকে পুলিশের লোক হিসেবে পরিচয় দিলেন। জানালেন যে, ফিশের লেখা একটি চিঠি নিয়ে তিনি একটু কথা বলতে চান এবং এজন্য তাকে পুলিশ হেড কোয়ার্টারে যেতে হবে। ফিশ তাতে মৃদু সম্মতি দিলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন দুজনে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় হঠাৎ করে দু’হাতে রেজর নিয়ে ফিশ ঝাঁপিয়ে পড়লেন কিং-এর উপর। কিন্তু কিং-এর সাথে পেরে উঠলেন না তিনি। অল্প সময়ের মাঝেই কিং তাকে পরাজিত করে তার হাতে হাতকড়া লাগিয়ে দেন। দীর্ঘ ছয় বছরের কঠোর পরিশ্রমের পর অবশেষে সফল হলেন উইল কিং, ধরা পড়লেন অ্যালবার্ট ফিশ।
১৯২৪ থেকে ১৯৩২ সাল সময়কালে দশজনেরও বেশি মানুষকে খুন করেছিলেন অ্যালবার্ট ফিশ। ফাঙ্ক হাওয়ার্ড, থমাস এ. স্প্রাগ, রবার্ট হেইডেন ও জন ডব্লিউ. পেল ছদ্মনামগুলো ব্যবহার করতেন তিনি। গ্রেস বাডকে খুনের অভিযোগে ১৯৩৫ সালের ১১ মার্চ ফিশের বিচার কার্য শুরু হয়। এরপর তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো প্রমাণিত হলে ফিশকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ইলেকট্রিক চেয়ারের মাধ্যমে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জানুয়ারি ফিশের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।