পকেটে কিংবা ব্যাগে কিছু টাকা-পয়সা ছাড়া বের হওয়ার কথা কেউ ভুলেও চিন্তা করে না। এর মাঝে টাকা তৈরি হয় মূলত কাগজ দিয়ে, অন্যদিকে পয়সা বানানো হয় বিভিন্ন ধাতব পদার্থ ব্যবহার করে। এককালে যখন মানুষ এসব কাগুজে নোট কিংবা ধাতব মুদ্রার ব্যবহার শেখে নি, তখন কি তাহলে তারা জিনিসপত্র লেনদেনের জন্য কোনো মুদ্রা ব্যবস্থার উপর নির্ভর করতো না? অবশ্যই করতো। আর সেসব জিনিস এতটাই বিচিত্র ছিলো যা জানলে আশ্চর্য হওয়া ছাড়া উপায় নেই। এমনকি এর কিছু কিছু এখনও চালু আছে।
টাকা-পয়সার পরিবর্তে মানব ইতিহাসে বিভিন্ন সময় যেসব জিনিস মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলোকে নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের পুরো লেখা।
লবণ
শুরু করা যাক আমাদের হাতের নাগালে থাকা লবণকে দিয়েই।
বেতনের ইংরেজি ‘Salary’ এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘স্যালারিয়াম (Salarium)’ থেকে। এই স্যালারিয়ামের উৎপত্তি আবার আরেক ল্যাটিন শব্দ ‘স্যাল (Sal)’ থেকে যার অর্থ লবণ। প্রাচীন রোমে লবণের উৎপাদন ও পরিবহনকে ঘিরে ছিলো এক জমজমাট ব্যবসা। লবণের চাহিদা সবসময় লেগেই থাকতো। এমনকি কখনো কখনো যুদ্ধের খরচ মেটাতে লবণের দাম বাড়িয়ে দেয়ার নজিরও আছে। রোমান সৈনিকদের বিভিন্ন সময়ই লবণের উৎসের খোঁজে যুদ্ধ করতে হতো। সল্ট রোড (Via Salaria) ধরে রোমে আসা লবণের চালান পাহারার দায়িত্বও থাকতো তাদের কাঁধে। প্লিনি দ্য এল্ডার লিখেছিলেন যে, এসব সেনারা মাসিক বেতন হিসেবেও লবণই পেতেন। সেভাবেই Sal থেকে Salarium এবং কালক্রমে Salary। অবশ্য এ মতবাদের সত্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশকারীর সংখ্যাও নেহায়েত মন্দ না।
লবণ নিয়ে আরেকটা মজার ইতিহাস শোনাচ্ছি। এককালে আফ্রিকান রাজ্যগুলোর মাঝে ঘানা ছিলো বেশ বিখ্যাত। এর কারণ ঘানা তার দেশের সীমার বাইরে উত্তর ও দক্ষিণের বণিকদের মাঝে চমৎকার এক যোগসূত্র হিসেবে কাজ করতো। উত্তরে ছিলো লবণের খনি, আর দক্ষিণে স্বর্ণের খনি। খেতে গেলে লবণ আমাদের লাগবেই, অন্যদিকে স্বর্ণও বেশ মূল্যবান। তাই ভৌগলিক এ অবস্থানকে মারাত্মক কাজে লাগিয়েছিলেন ঘানার রাজা। উত্তর ও দক্ষিণের মাঝে অবস্থিত ঘানার এ দুটোর কোনো খনি না থাকলেও তার ছিলো শক্তিশালী সেনাবাহিনী। এ সেনাবাহিনী বণিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারটি নিশ্চিত করতো। বিনিময়ে বণিকদেরও ফি দিতে হতো। এখনকার মতো টাকা-পয়সার প্রচলন তখনও সেখানে শুরু হয় নি। তাই বণিকেরা এক আউন্স লবণের বদলে এক আউন্স স্বর্ণ কেনাবেচা করতে পারতেন। এভাবে শুধু লবণ ও স্বর্ণের বাণিজ্য পরিচালানার মাধ্যমেই দেশটির অর্থনীতি বেশ ফুলে-ফেঁপে উঠেছিলো।
ছুরি
খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-২০০ অব্দ পর্যন্ত চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কাই প্রদেশে অর্থ হিসেবে ব্যবহার করা হতো ছুরি ও কোদাল! তবে স্বস্তির বিষয় হলো- সেগুলো আসল ছুরি থাকতো না। কেবলই আসলটির একটি রেপ্লিকাকে তারা অর্থ আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলো। সম্রাট কিন শি হুয়াং এসে ছুরি-কোদাল ভিত্তিক এ অর্থ ব্যবস্থার অবসান ঘটান।
চা
সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠেই গরম গরম এক কাপ চা দিনটাকে চমৎকার করে তুলতে যথেষ্ট। ভালো করে বানানো এক কাপ চায়ে চুমুকের পর যে অসাধারণ অনুভুতি আসে, তা চায়ের সত্যিকারের ভক্তমাত্রই অনুভব করতে পারবেন একেবারে হৃদয় দিয়ে! মজার ব্যাপার হলো এককালে এই চা-ও ছিলো মুদ্রা ব্যবস্থার একটি অংশ। নবম থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত চীন, মঙ্গোলিয়া, সাইবেরিয়া, তিব্বত, তুর্কমেনিস্তানে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা হতো চা পাতা থেকে বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করে বানানো এক ধরনের ইট।
সাপ
ঘানার লোবি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সদস্যরা বিশ্বাস করে যে, অনেক প্রাণী এবং বস্তুরই বিশেষ কিছু আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে। সাপের বেলাতেও তাদের এমন একটি বিশ্বাস আছে। তবে স্বস্তির ব্যাপার হলো- সেটি আসল সাপ না, লোহার তৈরি সাপ। তারা বিশ্বাস করে যে, লোহার তৈরি সাপ বিভিন্ন বিপদ-আপদ থেকে তাদের সুরক্ষা দিতে পারবে। এজন্য তাদের গোষ্ঠীতে এসব সাপ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। নিজেদের মাঝে বিভিন্ন জিনিসের কেনাবেচায় তারা এসব সাপকে অর্থের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।
তিমির দাঁত
একসময় ফিজির লোকেরা অর্থ বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলো তিমির দাঁতকে। তাদের কাছে সেসব দাঁত এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো যে, সরকার যখন কাগুজে নোটের প্রচলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, তখন জনগণকে বুঝ দিতে সব নোটেই তিমির দাঁতের ছবি ব্যবহার করা হয়েছিলো।
লৌহদণ্ড
বেশ কয়েক বছর আগেও পশ্চিম আফ্রিকার অনেক অঞ্চলেই এসব লোহার দণ্ডই ব্যবহৃত হতো অর্থ বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে। যদি কোনো কারণে একটি দণ্ড ভেঙে যেতো, তাহলে তা একেবারেই মূল্যহীন হয়ে যেতো। তখন বেশ জাঁকজমক অনুষ্ঠান করে একজন জাদুকর সেই ভাঙা দন্ডটির হারানো মূল্য ফিরিয়ে আনতেন।
হরিণের চামড়া
অর্থ হিসেবে হরিণের চামড়াও এককালে বেশ জনপ্রিয় ছিলো। কাপড়, কম্বল ইত্যাদি অতি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো তৈরিতে হরিণের চামড়ার ব্যবহারই একে এত মূল্যবান করে তুলেছিলো।
রাই পাথর
পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত দ্বীপরাষ্ট্র পালাউয়ের দেখা মেলে চাকার মতো এসব পাথরের। এগুলোকে কাঙ্ক্ষিত আকৃতি দেয়া হতো পালাউয়ে। পরবর্তীতে ডিঙি নৌকায় করে সেটিকে নিয়ে যাওয়া হতো ইয়াপ দ্বীপে। কিছু কিছু পাথর হতো মাত্র কয়েক ইঞ্চি ব্যাসের। আবার কিছু পাথর ছিলো ১২ ইঞ্চি ব্যাস ও প্রায় ৯,০০০ পাউন্ড ভর বিশিষ্ট। আশ্চর্জনক ব্যাপার হলো- এসব পাথরের মূল্য নির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো সেগুলোর অতীত ইতিহাস। যেসব পাথর আনা-নেয়া করতে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যেতো, সেসব পাথরই হতো সর্বাধিক মূল্যবান।
গোলমরিচ
রোমানরা যেমন লবণকে বেছে নিয়েছিলো অর্থ আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসেবে, তেমনি এককালে বিভিন্ন অঞ্চল এ উদ্দেশ্যে বেছে নিয়েছিলো গোলমরিচকে। পঞ্চম শতকের হান শাসক আতিলার কথাই ধরা যাক। তার রাজত্বকালে পূর্ব ও পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের কাছে তিনি ছিলেন এক ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। রোম অবরোধের পর মুক্তিপণ হিসেবে তিনি এক টনের বেশি গোলমরিচ দাবি করেছিলেন।
বীভারের চামড়া
আমেরিকার আদিবাসী ও ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের মাঝে এককালে অর্থ হিসেবে ব্যবহৃত হতো বীভারের চামড়া।
পুঁতি
পুঁতির মালা নেড়েচেড়ে দেখতে কমবেশি আমাদের সবারই ভালো লাগে। হরেক রঙের খেলা দেখে মাঝে মাঝে মনটাও রঙিন হয়ে যায়। কথিত আছে যে, ডাচ ঔপনিবেশিকেরা ম্যানহাটন দ্বীপটি এর আদিবাসীদের কাছ থেকে পুঁতির বিনিময়ে কিনে নিয়েছিলো। বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ী সেসব পুঁতির দাম হবে সাকুল্যে ১,০০০ ইউএস ডলার!
বোতলের ক্যাপ
বোতলের ক্যাপকেও যে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে এমন বুদ্ধি সর্বপ্রথম এসেছিলো আফ্রিকানদের মাথায়। আরো ভালো করে বলতে গেলে আফ্রিকান কিছু মদ প্রস্তুকারকদের মাথায় এসেছিলো এ অদ্ভুত পরিকল্পনা। কোকাকোলাকে নকল করে তারাও যখন বোতলের ক্যাপের ভেতরের অংশে বোনাস পুরষ্কারের প্রথা চালু করে, তখন থেকেই মূলত আফ্রিকার কিছু কিছু এলাকায় এমন অদ্ভুত প্রথার উদ্ভব ঘটে।
কোকেন
কলম্বিয়ার গুয়েরিমা গ্রামের লোকজন মুদ্রা হিসেবে টাকা-পয়সার পরিবর্তে ব্যবহার করে কোকেন। এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ১ গ্রাম কোকেনের পরিবর্তে সেখানে ১ বোতল কোকাকোলা মিলবে!
পে-ফোনের টোকেন
মুদ্রাস্ফীতি একটা দেশকে কতটা ভোগাতে পারে তার সার্থক নমুনা হয়ে আমাদের সামনে রয়েছে জিম্বাবুয়ে। একসময় দেশটিতে এক টুকরো পাউরুটির দাম হয়ে গিয়েছিলো ২৫০ ট্রিলিয়ন জিম্বাবুইয়ান ডলার! ২০০৮ সালে দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি ৮৯.৭ সেক্সটিলিয়ন হারে গিয়ে পৌঁছায়। সেই সময় ১০০ ট্রিলিয়ন ডলারের নোটও ছাপাতে বাধ্য হয়েছিলো জিম্বাবুয়ের সরকার।
এ ঝামেলা থেকে বাঁচতে দেশটির নাগরিকেরা একসময় মুদ্রা হিসেবে পে-ফোনের টোকেন ব্যবহার শুরু করেছিলো। প্রতিটি টোকেনের সাহায্যে ১ মিনিট কথা বলা যেতো, আমেরিকান ডলারের হিসেবে যেগুলোর মূল্যমান ছিলো ২০ সেন্ট।
এসব ছাড়াও বিভিন্ন পশু, ঝিনুক খোলস, শঙ্খ, কড়ি, কম্বল, চাল, তামা, মাছ, বার্লি ইত্যাদিও মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বিভিন্ন সময়।