সিনেমায় হরহামেশাই এমন চরিত্রের দেখা মিলে যারা খল-চরিত্র থেকে হয়ে ওঠেন মধ্যমণি। শত্রুর শত বাধা উপেক্ষা করে নায়কের রাজমুকুট নিয়ে ঘরে ফেরে কেউ কেউ। বাস্তব জীবনে এমনই একজন হলেন আন্দ্রে দিমিত্রিভিচ শাখারভ।
মানব ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা হিসেবে পরিচিত ‘হাইড্রোজেন বোমা’র জনক শাখারভ। কিন্তু তার জীবনের মোড়ে মোড়ে লুকিয়ে আছে রহস্য, মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে অসীম অনুশোচনা।
আন্দ্রে শাখারভের জীবনটা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বিনি সুতোর মালার মতোই গেঁথে আছে , ১৯২১ সালে তার জন্মের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিত্তি রচিত হয়েছে আর ১৯৮৯ সালে যখন মারা যান, তখন সোভিয়েতের খুঁটি নড়তে শুরু করেছে।
আন্দ্রে শাখারভের পিতা দিমিত্রি শাখারভ ছিলেন পদার্থবিদ্যার শিক্ষক, দাদা ইভান শাখারভের ছিলো আইনজীবী হিসেবে খ্যাতি, সামাজিক সচেতনতা আর মানবাধিকার বিষয়ে কাজের জন্য ইভান শাখারভের বেশ খ্যাতি ছিল।
রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর বলশেভিকদের হাতে ক্ষমতা আসার পর থেকেই শিক্ষাদীক্ষায়, বিশেষ করে বিজ্ঞানের মৌলিক শাখাগুলোতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। আন্দ্রে শাখারভের পড়াশোনা শুরু হয় বাড়িতেই। বাবা পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে পদার্থবিদ্যা আর গণিতের হাতেখড়ি তারই কাছে।
বাড়িতে রাখা রেডিওতে তখন শাখারভ একদিকে হিটলারের ন্যুরেমবার্গ কংগ্রেসের খববরাখবর অন্যদিকে স্টালিনের বক্তৃতা আর পুশকিনের মৃত্যুবার্ষিকীর একশো বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে নানা অনুষ্ঠান শোনে।
১৯৩৭ সালে বেশ ঘটা করে সোভিয়েত ইউনিয়নে পুশকিনের মৃত্যুর একশ’ বছর পালন করা হয়, রেডিওতে ঘটা করে পুশকিনের কবিতার অনুষ্ঠান চলতে থাকে। আর সেই রেডিওতেই পুশকিনের কবিতা শুনতে শুরু করেন শাখারভের। পরিণত জীবনে শাখারভ পুশকিনের ভীষণ ভক্ত ছিলেন।
শাখারভ বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখেন ১৯৩৮ সালে, সোভিয়েতসহ সারা বিশ্বেই তখন চলছে রাজনৈতিক তোলপাড়। তবে বিশ্ব আর দেশের রাজনীতি যতই জটিল থাকুক, বিশ্ববিদ্যালয়-জীবন ছিল ঝলমলে। মস্কো স্টেইট বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ঝলমলে দিনগুলোতে পদার্থবিদ্যায় তিনি ছিলেন অসাধারণ মনোযোগী।
বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে বেশ আত্মকেন্দ্রিক ছিলেন শাখারভ, বন্ধুবান্ধবের বালাই ছিল না তার, নিজের মধ্যেই কেমন গুটিয়ে থাকতেন। তার অনেক সহপাঠী তার পুশকিনের ভক্ত হওয়ার কথাও জানত না।
তার পড়াশোনার মাঝে ছেদ ঘটায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধ চলাকালে তরুণ শাখারভ দেশের হাজারো শিক্ষার্থীর সেনাদের সহায়তায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, তবে তার প্রজন্মের অন্য অনেকের মতোই তার প্রত্যক্ষ যুদ্ধের সুযোগ হয়নি।
তার বিভাগ পদার্থবিজ্ঞানের অনেক শিক্ষার্থীই যোগ দিয়েছিলেন বিমানবাহিনীতে, কিন্তু স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ায় শাখারভের বিমানবাহিনীতে যাওয়া হয়নি। শাখারভ কাজ করেছিলেন মস্কোর ‘কার্তুজ’ বানানোর কারখানায়।
তবে ১৯৪১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থেকে যাওয়া শিক্ষার্থীদেরকে মধ্য এশিয়ায় (বর্তমান তুর্কমেনিস্তানে) সরিয়ে নেওয়া শুরু হয়। অনেক বিভাগের পড়াশোনার সময়সীমা একবছর কমিয়ে দেওয়া হয়, কিছু কোর্সের শিক্ষার্থীদেরকে পাশ করিয়ে দেওয়া হয়।
এরই মাঝে শাখারভ ১৯৪২ সালের গ্রীষ্মে গ্রাজুয়েশন শেষ করেন। যুদ্ধ চলাকালে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ায় নিজের মধ্যেই অনুশোচনা হচ্ছিল, তাই সামরিক কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন। দু’বছর সেখানে কাজের পর ১৯৪৪ সালের জুলাইয়ে ‘ফিজিক্যাল ইস্টিটিটিউট অফ থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স’ এর পরিচালকের কাছে ভর্তির আবেদন করে চিঠি পাঠান।
যেহেতু যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শাখারভ সামরিক কারখানার কর্মরত ছিলেন, তাই সেখান থেকে আবার গবেষণা কিংবা পড়ালেখায় ফিরতে পরিচালকের আমন্ত্রণপত্র দরকার ছিল। তাই পরিচালক সামরিক কারখানা থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন জানালেন।
পড়াশোনা আবার শুরু করেছিলেন আপেক্ষিকতা আর কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে। তবে ১৯৪৫ সালের ৭ আগস্ট সংবাদপত্রের স্ট্যান্ডে ঝুলতে থাকা একটি খবর দেখে বিস্ময়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে যান শাখারভ। গতদিন, অর্থাৎ ৬ আগস্ট জাপানে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে, যার একটির ক্ষমতা বিশ হাজার টন টিএনটির সমান।
সেদিন থেকেই আরো অনেকের মতোই জীবন বদলে যায় শাখারভের, এর ভেতরের বিজ্ঞান আর বিপুল শক্তিকে খুঁজতে শুরু করেন তিনি। পত্রিকার পাতা থেকে নতুন সব গবেষণাপত্রে যা কিছুই আসছে, সব নিমেষেই শুষে নিতে শুরু করলেন শাখারভ।
বিজ্ঞানী ইগর ট্যামের (যিনি পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে পাভেল চেরেঙ্কভের সাথে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছিলেন) সাহচর্য পেয়ে নিজেকে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন শাখারভ।
ট্যাম একবার শাখারভকে পরীক্ষায় ‘বি’ গ্রেড দিয়েছিলেন। শাখারভ দাবী করে বসলেন তার ব্যাখ্যাই ঠিক, তাই পুরো নম্বর অর্থাৎ ‘এ’ গ্রেড-ই দিতে হবে তাকে! আর এই কাজ করতে ট্যামের সাথে দীর্ঘ আলাপের মাধ্যমে তাকে বুঝিয়েই ক্ষান্ত হননি, পরের দিন ট্যামের বাসায় চলে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত ট্যাম খুশি মনেই শাখারভকে ‘এ’ গ্রেড দিয়েছিলেন।
শাখারভের সেই সময়টাতে আর্থিক টানাপোড়েনে ভুগছিলেন। মেধাবী পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতি ছিলো তার, অন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সুযোগ এসেছিল হাতের সামনে। কিন্তু সবকিছুর পরেও শাখারভ তার গুরু ট্যামকে ছেড়ে যেতে চাননি।
এসবের জন্য যে পরবর্তীতে খুব একটা পস্তাতে হয়েছিল শাখারভকে, তা নয়। ট্যামের অধীনে তাকে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তার ডক্টরাল থিসিস সম্পন্ন করার পরেই।
হিরোশিমার ঘটনার দুই সপ্তাহ পর থেকেই সোভিয়েত হর্তাকর্তাদের মাথায় চাপে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ভূত। যুদ্ধ শেষে বিশ্ব রাজনীতিতে স্নায়ুযুদ্ধের হাওয়া বইতে শুরু করে তখনই স্টালিনের সরাসরি তত্ত্বাবধানে মার্শাল বেরিয়ার নেতৃত্বে বিশেষ কমিটি গঠন করা হয় পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপারটি দেখভালের জন্য।
পুরো দেশজুড়ে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করা ব্যক্তি আর ছাত্রদের বাছাই করে তালিকা করা হয়। তাদের অনেকের কাজের ওপর নজরদারি শুরু হয়, গবেষণাপত্রে কোন তথ্যটি প্রকাশ হবে আর কোন তথ্যটি জাতীয় স্বার্থে গোপন রাখা হবে- এই নিয়ে কাজ শুরু করে সোভিয়েত গোয়েন্দা মহল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞানী মহলের কাছে প্রথম বাধাটি ছিল পারমাণবিক বোমা বানানোতে ইউরেনিয়াম যোগাড় এবং বিশুদ্ধকরণ। তবে ইউরেনিয়াম বাদ দিয়ে যদি সহজলভ্য কোনো কিছু দিয়ে শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা বানানো যায়, তবে ব্যাপারটি কেমন হবে?
ইতোমধ্যেই সূর্যের শক্তির রহস্য আবিষ্কার হয়েছে, সূর্য ফিউশন প্রক্রিয়ায় শক্তি তৈরি করে। সেই প্রক্রিয়াটি গবেষণাগারে ব্যবহার করা গেলে হাইড্রোজেন বোমার মতোই শক্তিশালী জিনিস বানানো সম্ভব। সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা নিজেরা তো এই নিয়ে কাজ করছিলেনই, পাশাপাশি আমেরিকার পারমাণবিক গবেষণা থেকে নানা তথ্য বের করে নিয়ে আসতে শুরু করে সোভিয়েত গোয়েন্দারা। বিজ্ঞানীদের হাতে পৌঁছেও দেওয়া হয় সেইসব তথ্য।
শাখারভের কাজ শুরু হয় তখন থেকেই, শাখারভ থার্মোনিউক্লিয়ার ফিউশন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। গবেষণাগারে ছোট আকারে তা উৎপন্ন করা এবং এর ফলে উৎপন্ন শক্তির পরিমাণ নিয়ে তাত্ত্বিক হিসাবনিকাশ শুরু করেন। তিনি নতুন করে হাইড্রোজেন বোমার ডিজাইন শুরু করেন। এই ব্যাপারটিকে তার সহকর্মীরা ‘শাখারাইজেশন’ হিসেবে নাম দিয়েছিল।
হাইড্রোজেন বোমা নির্মাণের জন্য বিশেষভাবে একটি ডিজাইন করেন, যেটি ‘স্লোয়কা’ (Sloyka) নামে পরিচিত ছিল। যদিও কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই গিনজবার্গ নামে আরেক বিজ্ঞানী একে আরো উন্নত করেন। শাখারভের সাথে এইসময় কাজ করেছেন তার শিক্ষক ইগোর ট্যাম, ইয়াকভ জেলডোভিচ, ইগোর কুর্তাচেভ সহ সোভিয়েত রাশিয়ার খ্যাতনামা সব নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানীরা।
১৯৫০ সালের মার্চে শাখারভকে খুব নিরাপত্তার সাথে ‘সারোভ’ শহরে পাঠানো হয়, যার সাংকেতিক নাম ছিলো আরজামাস-১৬, শাখারভ তার বেঁচে থাকা সময়ে অনেক তথ্য দিয়ে গেলেও আরজামাস যে সারোভ শহর, তা কোথাও কখনো ফাঁস করেননি।
পারমাণবিক অস্ত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রত্যন্ত এলাকা সারোভ শহরকে বেছে নিয়ে সব ম্যাপ থেকে বাদ দেওয়া শুরু করা হয় খুব চতুরভাবে, সারোভের অধিবাসী বাদে কাউকে সেখানে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়, নির্মাণ করা সামরিক প্রহরা। সোভিয়েত আমলে তো বটেই, এরপরেও সারোভ দীর্ঘদিন ছিল সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লুকায়িত।
সারোভ শহরে শাখারভের সাথে সোভিয়েতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিজ্ঞানীদের এনে জড়ো করা হয়, যাদের একত্র করে হাইড্রোজেন বোমার কাজকে ত্বরাণ্বিত করাই ছিল মূল লক্ষ্য। শাখারভসহ অনেক বিজ্ঞানী যারা সারোভে একত্র হয়েছিলেন, তাদের অনেকেই শুধুমাত্র বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা আর কাজ করার অসীম সুযোগ পেয়ে এখানে চলে এসেছিলেন।
সোভিয়েত পত্রিকা, সরকার আর বিজ্ঞানীমহল থেকে হঠাৎ করেই একটু বেশি মনোযোগ পেতে শুরু করেন এই তরুণ বিজ্ঞানীরা। তবে তাদের অলক্ষেই তারা সোভিয়েত সরকারের হাতে তুলে দিচ্ছিলেন এই ব্যাপক শক্তিশালী বোমা তৈরির সব সরঞ্জাম।
স্নায়ুযুদ্ধের দ্বৈরথ যখন তুঙ্গে, তখন সোভিয়েতের এই গোপনীয়তার চাদর ভেদ করেও সংবাদ পৌঁছে যেতে শুরু করে আমেরিকার হাতে। প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান পর্যন্ত খবর পৌঁছায় সোভিয়েত তাদের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা নিরীক্ষার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে একটু একটু করে।
শাখারভের অধীনে একদল গণিতবিদ সূক্ষ্ম হিসাবনিকাশ করতে শুরু করেন পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে। প্রতিটি হিসাব নিকাশ বারবার পরীক্ষা করা হতে থাকে, কারণ পারমাণবিক অস্ত্রের কাঁচামাল এবং পরীক্ষা নিরীক্ষা ভীষণ ব্যয়বহুল, তাই প্রতিটি ধাপ হতে হবে নিখুঁত।
আন্দ্রে তিখনভের মতো গণিতবিদরা অনেকটা হাতে কলমেই কঠিন কঠিন গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে শুরু করেন, যার সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক বোমার স্বপ্নকেও বাঁচিয়ে রেখেছিলো।
১৯৫৩ সালে ‘স্লোয়কা’র কথা সোভিয়েত পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে সাড়া ফেলে, খুব দ্রুতই সোভিয়েত রাশিয়ার হাতে হাইড্রোজেন বোমা আসতে যাচ্ছে, যেটি আমেরিকার পারমাণবিক বোমার চেয়েও শক্তিশালী। এই ঘটনা শাখারভকে করে তুলে ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু।
১৯৫৩ সালের আগস্ট মাসে যখন শাখারভ হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ দেখতে গিয়েছিলেন, তখনই এই বিস্ফোরণ তার মনে দাগ কাটে। এই পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের ফলে যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা তৈরি হবে, তা সাধারণ মানুষের কী কী ক্ষয়ক্ষতি করতে পারে- তা নিয়ে তখন থেকেই চিন্তা শুরু করেন শাখারভ।
প্রতিটি পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার পর শতশত পাখি মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটতে থাকে আশেপাশের এলাকায়। যদিও ১৯৫৩ সালে ‘স্লোয়কা’র পরে সোভিয়েত তাদের বড় ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে পরীক্ষা ভূমির ওপরে আর চালায়নি।
সোভিয়েত আর আমেরিকার পারমাণবিক অস্ত্রের এই দ্বৈরথ বিজ্ঞানীদের অনেকেরই মনে নাড়া দেয়। অনেক পরমাণু পদার্থবিদ যাদের তত্ত্ব আর গবেষণার উপর এই বোমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তারাও আন্দোলন শুরু করেন। আইনস্টাইন নিজেও পারমাণবিক অস্ত্রের মহড়া বন্ধে সবাইকে অনুরোধ করেন।
শাখারভও বিভিন্ন মহলে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষা, মানবজাতির জন্য এটি কী বিপদ বয়ে আনতে পারে- তা নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। সোভিয়েত পারমাণবিক বোমার জনকদের একজন হওয়ার সুবাদে তার খ্যাতি তাকে সহায়তা করেছে একটু হলেও।
সোভিয়েত ইউনিয়নে তখন স্টালিন যুগের অবসান হয়েছে, শাখারভের ভাষ্য অনুসারে ক্রুশ্চেভ স্টালিনের চেয়ে একটু বেশি সহনশীল আচরণ করেছিলেন বিজ্ঞানীদের প্রতি। তবে শাখারভকে একটু একটু করে দূরে সরিয়ে রাখা হয় সামরিক গবেষণা, পরমাণু বিজ্ঞান থেকে।
শাখারভ এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টা পরে ‘আংশিক পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি’ নিয়ে মস্কোতে আলাপ আলোচনা শুরু হয়। উন্মুক্তভাবে পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর ফলে বায়ুমন্ডল এবং প্রাণীজগতের ক্ষতির কথা চিন্তা করে বিশ্বনেতারা উন্মুক্ত পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধে সম্মত হয়।
ষাট আর সত্তরের দশকের শুরুতে শাখারভ পুরোপুরি পারমাণবিক গবেষণা থেকে সরে এসে মহাকাশবিজ্ঞান নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে শাখারভের প্রথম মহাকাশবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়।
১৯৬৮ সালে শাখারভ ‘উন্নতি, পারস্পরিক সহাবস্থান আর মনোজাগতিক মুক্তি’ শিরোনামে প্রবন্ধ লিখেন। এন্টি-ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার সমালোচনা করেন। সোভিয়েত রাশিয়ার বাইরে ইউরোপ আর আমেরিকার সচেতন সমাজে শাখারভের লেখা আর চিন্তা প্রভাব ফেলতে শুরু করে।
তবে দেশে তাকে কোণঠাসা করে রাখা হয়। তাকে সকল প্রকার পারমাণবিক গবেষণা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। মস্কোতে সোভিয়েত প্রশাসনের সমালোচনা করে ভিন্ন মতাদর্শী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন সোভিয়েতের জনগণের কাছে।
১৯৬৯ সালে শাখারভের প্রথম স্ত্রী ক্লাভদিয়ার মৃত্যুর পরে শাখারভ বেশ ভেঙে পড়েছিলেন। বন্ধুর পথে তার দীর্ঘ যাত্রার সঙ্গী ছিলেন তার স্ত্রী। তবে শাখারভের জীবন বেশ অদ্ভুত বলা চলে, তার স্ত্রী কিংবা যেকোনো আত্মীয়-পরিজনের চেয়ে গোয়েন্দারা তার বেশি খোঁজখবর রেখেছে।
সোভিয়েত রাশিয়ার পারমাণবিক বোমার শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন বলে নানা রাষ্ট্রীয় গোপনীয় তথ্যের ভাণ্ডার হয়ে উঠেছিলেন শাখারভ, পাশাপাশি দেশজুড়ে খ্যাতি পাওয়া এই বিজ্ঞানী সোভিয়েত প্রশাসনের খোলাখুলি বিরোধিতায় নেমেছেন।
১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ শাখারভের দীর্ঘ সংগ্রাম চলতে থাকে, পুরোদস্তুর পরমাণু বিজ্ঞানী থেকে নিজ দেশে মুক্তভাবে চিন্তা আর স্বাধীনতা চর্চার জন্য তৎপর হয়ে উঠেন এই মানুষটি। মানবাধিকার রক্ষায় একটি সংগঠন করার চিন্তা শুরু করেন শাখারভ, যা তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রাশিয়ায় সেটি চিন্তার বাইরে ছিল অনেকের জন্যই।
এই সংস্থা গঠন করতে গিয়ে সোভিয়েত প্রশাসনের চাপের মুখে পড়েন শাখারভ। রাষ্ট্রীয় চাপ, একাকীত্ব আর গোয়েন্দা নজরদারির মাঝেও মানবাধিকারের কাজে নেমেই পরিচয় হয় এলেনা বোনারের সাথে, যার সাথে শাখারভের বাকি জীবনের পথচলা।
১৯৭৫ সালে শাখারভ প্রথম রাশিয়ান ব্যক্তি হিসেবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। সোভিয়েত সরকারের দৃষ্টি এড়িয়ে শাখারভ সেই পুরস্কার গ্রহণ করতে পারেননি, তার দেশ ছাড়বার কোনো অনুমতিই ছিলো না। তবে তার পক্ষ থেকে এলেনা বোনার সেই পুরস্কার গ্রহণ করেন। রেডিওতে সেই অনুষ্ঠানটি শোনা ছাড়া কিছুই করার ছিল না শাখারভের।
নোবেলের মঞ্চ থেকেই শাখারভ হয়ে ওঠেন বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের মনের আকুতি প্রকাশের প্রতীক। পৃথিবীর দেশগুলোর মাঝে রাজনৈতিক সংঘাত আর লড়াইয়ে লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটায় যে অস্ত্র সেই অস্ত্র নিয়ে পরীক্ষা বন্ধ হোক, শাখারভের এই মূলমন্ত্র সারা বিশ্বজুড়ে উচ্চারিত হয়েছে। তবে তার এই পুরস্কার সোভিয়েত রাশিয়ার প্রশাসন ভালো চোখে দেখেনি!
ঘরের শত্রু বিভীষণের মতোই তাকে দেখতে থাকে কেজিবি, ১৯৭৬ সালে তাকে দেশের ‘পয়লা নম্বর শত্রু’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। ১৯৭৭ সালের ২০ জানুয়ারী শাখারভ তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর পূর্ব ইউরোপের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে চিঠি লেখেন।
১৯৮০ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নামেন তিনি, জানুয়ারির ২২ তারিখ তাকে একটি সেমিনার থেকে গ্রেফতার করে গোর্কি শহরে (গোর্কির জন্মস্থান হওয়ায় এই নামকরণ করা হয়েছিল, যেটি বর্তমানে ‘নিযনি নভোগ্রড’ নামেও পরিচিত) নির্বাসন দেওয়া হয়।
সোভিয়েত প্রশাসনের এমন আচরণে পশ্চিমা বিশ্বে বেশ শোরগোল হয়। ১৯৮৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান ১৯৮৩ সালের ২১ মে ‘জাতীয় শাখারভ দিবস’ পালন করার ঘোষণা দেন। সোভিয়েত প্রশাসনের কাছে তার মুক্তির দাবী জানান তিনি।
নির্বাসন, গোয়েন্দা নজরদারী আর গৃহবন্দী অবস্থায় শাখারভ তার স্মৃতিকথা, ভাবনা চিন্তা আর সোভিয়েত সমাজ আর সমস্যা নিয়ে লিখতে শুরু করেন। পরমাণু বিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে পারমাণবিক বোমা বিশ্বের জন্য কী বয়ে আনতে পারে- তা ফুটে ওঠে তার লেখায়।
১৯৮৩ সালে তার ‘The Danger of Thermonuclear War’ পশ্চিমা বিশ্বে প্রকাশের পর তার ওপর আবারো সোভিয়েত প্রশাসনের স্টিমরোলার নেমে আসে। তার স্ত্রী এলেনা বোনারকে গ্রেফতার করা হয়। প্রতিবাদে অনশনে বসেন শাখারভ। তার অসুস্থ স্ত্রীকে অতি দ্রুত মুক্তি দিয়ে চিকিৎসার দাবী জানান তিনি।
এলেনা বোনারের মুক্তি দূরে থাক, শাখারভকে জোর করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, সেখানে তাকে অনশন ভাঙতেও বাধ্য করা হয়। ইতোমধ্যেই, এলেনা বোনারকে ৫ বছরের নির্বাসনের রায় দিয়ে গোর্কি যেতে বলা হয়। এর প্রতিবাদ করে যেতে থাকেন শাখারভ। তাই শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে ১৯৮৫ সালে এলেনা বোনারকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে হৃদযন্ত্রে সার্জারি করে আসার অনুমতি দেওয়া হয়।
সোভিয়েতের মসনদে একদিকে তখন গর্ভাচেভ, অন্যদিকে পারমাণবিক বিজ্ঞানের ধ্রুবতারা শাখারভ ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। গোর্কির নির্বাসন জীবন থেকে মস্কোর কোলাহলে ফিরতে মরিয়া তিনি, বিশ্বকে এখনো তার অনেক কিছু বলার বাকি!
১৯৮৬ সালের ডিসেম্বরে গর্ভাচেভ শাখারভকে মস্কোতে ফেরার অনুমতি দেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে গর্ভাচেভ তখন বিশাল বিশাল পরিবর্তন আনছেন, ১৯৮৯ সালে সোভিয়েতের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যদিও সেটি সবার ভোট দেওয়ার জন্য উন্মুক্ত ছিল না।
সেই নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে শাখারভ বিজয়ী হয়েছিলেন। যদিও কাজ করার সুযোগ ছিল সীমাবদ্ধ। তারপরও সেই সীমিত ক্ষমতার জায়গা থেকেই শাখারভ দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নের দাবী তোলেন আর একদলীয় শাসনের বিরোধিতা করেন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের ঘন্টা যখন বাজছে ঠিক তখনই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন আন্দ্রে শাখারভ। সোভিয়েত রাশিয়ায় হাইড্রোজেন বোমা যার হাত ধরে ডানা মেলেছিল, ঠিক তারই হাত ধরে সেখানে ভিন্নমতের চর্চা শুরু হয়।
যুদ্ধবাজ সরকারদের হাতে পারমাণবিক বোমা তুলে দেওয়ার ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরেছিলেন তিনি দেরিতে, তাই বাকিটা জীবনে অনুশোচনার আগুনে পুড়ে নিজেকে খাঁটি করে নিয়েছেন। শাখারভ তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন,
আমি মনে করেছিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র এই হাইড্রোজেন বোমা, তাই জনগণের জন্য এই বোমা তৈরি করেছিলাম। তবে শেষ বেলায় এসে উপলব্ধি করতে পেরেছি, বোমা নয় বরং সততা আর মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতাই সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
হাইড্রোজেন বোমা বানিয়ে রাজনৈতিক মহলে খ্যাতি তো ছিলই, সোভিয়েত শাসনের ক্ষমতার উত্তাপে নিজেকে উষ্ণ রাখতে চাইলে তাকে বাধা দেওয়ার মতো কেউই ছিল না। কিন্তু শাখারভ বেছে নিয়েছিলেন কঠিন পথ, যে পথে হেঁটে তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেছেন মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা কত জরুরী। সোনার খাঁচায় সহজে দানাপানি খেয়ে পাখি বেঁচে থাকে, কিন্তু মুক্ত আকাশ দেখার জন্য যার জন্ম, তাকে খাঁচায় আটকানো কঠিন।
রাশিয়ায় পেরিয়ে গেছে অনেক সময়, শাসক বদলেছে, এখনো রাশিয়ায় শাখারভকে স্মরণ করার খুব একটা বালাই নেই। হয়তো তার এপিটাফে লেখা কথাটাই সত্যি;
আমি যা করেছি, কিংবা যা করিনি এর কোনোটাই বিস্ময়ের কোনো ব্যাপার নয়, জীবন সংসারের এই প্রাকৃতিক গতিই আমাকে সব বলে দিয়েছে, কখন কী করতে হবে।