চতুর্থ পর্ব: ঔপনিবেশিক ভারতের সামরিক বাহিনী: কিচেনারের পুনর্গঠন (পর্ব-৪)
বেলজিয়ামের ইপ্রার প্রান্তর ঘিরে রয়েছে মিত্রশক্তি আর অক্ষশক্তি, কেউই কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। কেউ এক পা এগোলে পরদিনই প্রতিপক্ষের আক্রমণে আবারো দুই পা পিছিয়ে যেতে হচ্ছে। এমন অবস্থায় জার্মান জেনারেল ম্যাক্স ফন ফাবেকের নেতৃত্বে পুনরায় আক্রমণ করা শুরু করলো জার্মান বাহিনী।
জার্মানদের আক্রমণে ৩য় ক্যাভালরি রেজিমেন্ট ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছে, যারা বেঁচে গিয়েছে, তারা কোনোমতে ট্রেঞ্চে আশ্রয় নিয়েছে। এদিকে ট্রেঞ্চে পানি আটকে থাকায় আর খোঁড়াও সম্ভব হচ্ছে না। জার্মানদের আটকে রাখার দায়িত্বে আছে ১২৯ নং বেলুচ রেজিমেন্টের ১২ জন, হাতে আছে দুটো ম্যাক্সিম গান, প্রতিটির নিয়ন্ত্রণে মাত্র ৬ জন। এই দুটো ম্যাক্সিম গান দিয়েই জার্মান বাহিনীকে দীর্ঘক্ষণ ঠেকিয়ে রাখলেন তারা। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না, জার্মানদের শেলে রেজিমেন্টের নেতৃত্বে থাকা লেফটেন্যান্ট নর্থ প্রচণ্ডভাবে আহত হলেন, একটি ম্যাক্সিম গান সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়ল। বাকি গানটি দিয়েই ৬ জন পালাক্রমে একাধারে গুলিবর্ষণ করতে থাকলেন, কিন্তু জার্মানদের গুলিতে একে একে মারা পড়লেন ৫ জন, বাকি রইলেন একমাত্র সেপাই খুদাদাদ খান। বেশ কয়েক জায়গায় গুলিবিদ্ধ খুদাদাদ খান সেই অবস্থাতেই ম্যাক্সিম গান চালিয়ে গেলেন গুলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত। তারপর মেশিনগানটি অকেজো করে দিয়ে পড়ে রইলেন মড়ার মতো। জার্মানরা হেঁটে চলে গেল পাশ দিয়ে, তাকে মৃত সৈন্য ভেবেই। রাত আঁধার হতেই হামাগুড়ি দিয়ে নিজের দলের বাকিদের কাছে পৌঁছালেন প্রায় আধমরা অবস্থায়।
এটিই ছিল পাঞ্জাবের চাকওয়াল জেলা থেকে উঠে আসা খুদাদাদ খানের গল্প, যিনি পেয়েছিলেন প্রথম ভারতীয় হিসেবে বীরত্বসূচক ভিক্টোরিয়া পদক। তবে এটি শুধু একজন খুদাদাদ খানের গল্প নয়, এটি তের লক্ষ ভারতীয় সৈন্যের গল্প, যারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজদের প্রয়োজনে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিতে ছিলেন সদা প্রস্তুত। আহত অবস্থা থেকে সেরে ওঠার পর সেপাই খুদাদাদ জমাদার (লেফটেন্যান্ট) হিসেবে, এবং পরবর্তীতে ১৯১৮ সালে সিনিয়র জমাদার হিসেবে পদোন্নতি পান এবং শেষমেশ সুবেদারও (ক্যাপ্টেন) হয়ে যান। ১৯৭১ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে মারা যান ৮২ বছর বয়সী এই বীর।
মহাযুদ্ধের আগে
১৯১৪ সালে ভারতীয় বাহিনীর জনবল ছিল প্রায় দেড় লক্ষ, যেটি ১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসে গিয়ে দাঁড়ায় ৫ লক্ষ ৭৩ হাজারে। ভারতীয় বাহিনী তখন আকারের দিক থেকে ছিল বিশ্বের বৃহত্তম, ১০৭টি সিঙ্গেল-ব্যাটালিয়ন এবং ১১টি ডাবল-ব্যাটালিয়নের পদাতিক বাহিনী, ৩৮টি সওয়ার রেজিমেন্ট, স্যাপার্স-মাইনার্সদের ৩টি রেজিমেন্ট আর ১২টি মাউন্টেইন আর্টিলারি ব্যাটারি মিলিয়ে যোদ্ধাদের সমুদ্রে পরিণত হয়েছিল ভারতীয় ফৌজ।
ভারতীয় বাহিনীকে তখন দুই ভাগে বিভক্ত। আফগানিস্তান সীমান্ত থেকে বাংলা পর্যন্ত দায়িত্বে থাকা নর্দার্ন আর্মির অধীনে ছিল ৫টি ডিভিশন এবং ৩টি ব্রিগেড, অন্যদিকে বেলুচিস্তান থেকে দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত দায়িত্বে থাকা সাউদার্ন আর্মির অধীনে ছিল ৪টি ডিভিশন। এই ৯টি ডিভিশনের প্রতিটি আবার ভাগ করা ছিল ১টি ক্যাভালরি ও ৩টি ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডে। ক্যাভালরি ব্রিগেডে আবার ১টি ব্রিটিশ রেজিমেন্টের বিপরীতে ২টি ভারতীয় রেজিমেন্ট; এবং ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডে ১টি ব্রিটিশ রেজিমেন্টের বিপরীতে ৩টি ভারতীয় রেজিমেন্ট নিয়ে তৈরি।
ভারতীয় বাহিনীর নিয়মিত বাহিনী ছাড়াও দেশীয় রাজাদের বাহিনী এবং ইউরোপীয় ভলান্টিয়ারদের দিয়ে তৈরি অক্সিলিয়ারি ফোর্সও প্রস্তুত ছিল যেকোনো প্রয়োজনে। ইম্পেরিয়াল সার্ভিস ব্রিগেড হিসেবে পরিচিত দেশীয় রাজাদের হাতে তখন মোট ২০টি সওয়ার রেজিমেন্ট আর ১৪টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন, যার মোট সৈন্যসংখ্যা ২২,৬১৩ জন। অন্যদিকে ভারতের মাটিতে থাকা ইউরোপীয়দের নিয়ে গঠিত অক্সিলিয়ারি ফোর্সেও রয়েছে অতিরিক্ত ৪০ হাজার স্বল্প-প্রশিক্ষিত সৈন্য।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই নর্দার্ন আর্মির ৩টি ডিভিশন ব্যস্ত আফগানিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্রে, এবং বিশ্বযুদ্ধের পরে শুরু হওয়া তৃতীয় আফগান যুদ্ধ পর্যন্ত তারা ওখানেই ছিল। এই সময়ে আফগানিস্তানের মোহমান্দ, বুনেরোয়াল, সোয়াতি, মাসুদ, মারি, ক্ষেত্রাসহ বেশ কিছু উপজাতির বিরুদ্ধে একের পর এক অপারেশন চালাতে থাকে ভারতীয় ফৌজের এই কয়টি ডিভিশন। অন্যদিকে বার্মার মিলিটারি পুলিশের সহযোগিতায় আসাম রাইফেলস এবং গুর্খা বাহিনীর বড় একটি অংশ মায়ানমারের কাচিন এবং মিজোরামের কুকিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলো। বাকি ডিভিশনগুলোর মধ্যে ৩টি ডিভিশন (৫ম, ৮ম ও ৯ম) ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার কাজে নিযুক্ত ছিল। তবে এগুলোর মধ্য থেকেও বেশ কিছু ব্রিগেডকে যুদ্ধে অংশ নিতে পাঠানো হয়।
মহাযুদ্ধ
ইরানসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে ইরানের খুজেস্তান প্রদেশে প্রথম তেল আবিষ্কৃত হয়। ইংরেজরা নিজেদের প্রয়োজনে অ্যাংলো-পার্শিয়ান অয়েল কোম্পানি নামে ইরানের সাথে এক হয়ে বাণিজ্যিকভাবে তেল উত্তোলন করা শুরু করে, যার বেশিরভাগ অংশই চলে যেত সাগরে ভাসা ইংরেজ নৌবাহিনীর জাহাজগুলোর চাহিদা মেটাতে। এদিকে শোনা গেল অটোমানরা জার্মানদের সহযোগিতায় এসব তেলক্ষেত্র দখলের উদ্যোগ নিচ্ছে। ইংরেজরা বাড়তি সতর্কতা হিসেবে বোম্বে থেকে একদল সৈন্য পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিল এই তেলক্ষেত্র নিরাপদ রাখার জন্য, তবে তার আগেই ইউরোপ থেকে ডাক আসলো। বিশ্বযুদ্ধের সময় বাইরের দেশে পাঠানো সৈন্যদলকে মোট ৭টি দলে ভাগ করা হয়, এক্সপিডিশনারি ফোর্সেস হিসেবে পরিচিত এই দলগুলোর নামকরণ করা হয় A থেকে G ক্রমানুসারে।
ফোর্স এ (ইউরোপ)
মহাযুদ্ধে পাঠানো প্রথম দল গঠিত এক্সপিডিশনারি ফোর্স A গঠিত হয় দুটো ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন এবং দুটো ক্যাভালরি ডিভিশন নিয়ে, দায়িত্ব দেওয়া হয় জেনারেল স্যার জেমস উইলকক্সের হাতে। ১৯১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এই বাহিনী পৌঁছে যায় ফ্রান্সের মার্শেই বন্দরে এবং সেখান থেকে পাঠানো হয় বেলজিয়ামের ইপ্রা অঞ্চলে। পদাতিক বাহিনীকে প্রথমেই বেশ বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় আর্টিলারির সরঞ্জাম ছাড়াই পাঠিয়ে দেওয়ায়, ফলে অন্য দলের ওপর নির্ভর করে চলতে হচ্ছিলো তাদেরকে। এছাড়াও প্রচণ্ড ঠান্ডা আবহাওয়ায় অনভ্যস্ত ভারতীয় বাহিনীকে শীত মোকাবেলার জন্য পর্যাপ্ত কাপড়-সরঞ্জাম সরবরাহ না করায় তাদের জন্য যুদ্ধক্ষেত্র আরও কঠিন হয়ে পড়ল। তবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর একের পর এক অফিসার মারা যেতে থাকলে অফিসার সংকটে পড়ে গেল পুরো বাহিনী, কারণ ভারতীয়দের ভাষা জানা না থাকায় অন্য ব্যাটালিয়ন-রেজিমেন্ট থেকেও অফিসার নেওয়া যাচ্ছিল না। নেতৃত্ববিহীন অবস্থায় ভারতীয় বাহিনীর অনেকেই এই সময়ে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যায়। শেষমেশ ১৯১৫ সালের অক্টোবরে এই বাহিনীকে পশ্চিম রণাঙ্গন থেকে সরিয়ে মেসোপটেমিয়ায় স্থানান্তর করা হয়, যেখানে তারা অন্য ব্রিটিশ ডিভিশনের সাথে যোগ দেয়।
পদাতিক ডিভিশনকে সরিয়ে ফেলার পর বাকি থাকে ক্যাভালরি ডিভিশন দুটো। অন্য ব্রিটিশ ডিভিশনগুলোর সাথে কাজ করলেও তাদেরকে একেবারে সামনে যেতে দেওয়া হতো না, বরং পরবর্তী আক্রমণের জন্য বরাদ্দ রাখা হতো। এছাড়াও প্রায় সময়েই তারা কাজ করতো পদাতিক বাহিনী হিসেবে, ঘোড়াবিহীন অবস্থায় পরিখার মধ্যে আশ্রয় নিয়ে। ১৯১৮ সালের মার্চ মাসে মিশরে স্থানান্তর করার আগ পর্যন্ত বেশ লম্বা একটা সময় তারা পশ্চিম রণাঙ্গনে কাটিয়েছে, যুদ্ধ করেছে সম, বাজেন্টিন, ফ্লার্স-কোরসেঁ এবং কাম্ব্রাইয়ের যুদ্ধে। পশ্চিম রণাঙ্গন বা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টিয়ারে পাঠানো ১ লক্ষ ৩০ হাজার ভারতীয় সৈন্যের মধ্যে প্রায় ৯ হাজার জন নিহত হন।
ফোর্স বি ও সি (পূর্ব আফ্রিকা)
বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতেই শুধু সাম্রাজ্যগুলো নয়, বরং সাম্রাজ্যগুলোর উপনিবেশে থাকা বাহিনীগুলোর মধ্যেও যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ব্যতিক্রম ঘটেনি আফ্রিকায় থাকা উপনিবেশগুলোর ক্ষেত্রেও। এদিকে জার্মান ইস্ট আফ্রিকায় (বর্তমান রুয়ান্ডা, তাঞ্জানিয়া, বুরুন্ডি) থাকা বাহিনীর সাথে না পেরে ব্রিটিশ ইস্ট আফ্রিকার (বর্তমান কেনিয়া ও উগান্ডা) প্রশাসন সাহায্য চাইলেন। তাদেরকে সাহায্য করতে ভারতীয় বাহিনীর দ্বিতীয় অভিযাত্রী দল অর্থাৎ এক্সপেডিশনার্স ফোর্স বি পাড়ি জমালো পূর্ব আফ্রিকায়। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রিচার্ড ওয়াপশেয়ারের নেতৃত্বে পাঠানো হলো ২৭নং ব্রিগেডকে, সাথে রয়েছে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইকেল টাইঘের নেতৃত্বে থাকা দেশীয় রাজাদের সৈন্যদের দ্বারা তৈরি ইম্পেরিয়াল সার্ভিসের পদাতিক বাহিনীর একটি ব্রিগেড। এছাড়াও পায়োনিয়ার্স ব্যাটালিয়ন, গোলন্দাজ বাহিনী এবং ইঞ্জিনিয়ারদের দলও ছিল।
পূর্ব আফ্রিকায় সৈন্যসংখ্যা অপ্রতুল মনে হওয়ায় বি-এর পর এক্সপেডিশনার্স ফোর্স সি-কেও পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। ২৯নং পাঞ্জাবি রেজিমেন্টের সাথে ছিল জিন্দ (হরিয়ানা), ভরতপুর (রাজস্থান), কাপুরথালা (পাঞ্জাব) এবং রামপুর (উত্তর প্রদেশ) দেশীয় রাজ্যগুলোর অর্ধেক ব্যাটালিয়ন, ২২নং মাউন্টেন ব্যাটারি (গোলন্দাজ বাহিনী), একটি ম্যাক্সিম গান দল এবং ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স দল। এই বাহিনীকে মূলত রক্ষণাত্মক কাজের জন্য ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, বি-এর মতো আক্রমণাত্মক অভিযানের জন্য নয়। উগান্ডার রেলপথ পাহারা দেওয়া কিংবা আফ্রিকান রাইফেলসের সহযোগিতা করার মতো কাজের ভার ছিল তাদের পক্ষে। একমাত্র কিলিমাঞ্জারোর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও জার্মানদের ব্যাপক প্রতিরোধে পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং ব্রিটিশ ইস্ট আফ্রিকায় ফেরত আসে অনেক হতাহত সৈন্যকে পিছনে ফেলে রেখেই। মূলত গোয়েন্দাসূত্রে পাওয়া ভুল তথ্যের কারণেই এই বিপর্যয় ঘটেছিল।
এরকমভাবে পূর্ব আফ্রিকার যুদ্ধক্ষেত্রে মিত্রবাহিনী ও জার্মান বাহিনী পরস্পরের আক্রমণে একবার পিছু হটছিলো, তো কয়েক মাস পরেই পুনরায় রসদ জোগাড় করে প্রতিপক্ষকে পিছু হটতে বাধ্য করছিল। বিশ্বযুদ্ধের পুরোটা সময়েই পূর্ব আফ্রিকাজুড়ে এরকম যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল। এমনকি ইউরোপে যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পরেও আরও ২ দিন যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলো দুই পক্ষ, একমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রে ইউরোপ থেকে আসা যুদ্ধবিরতির খবর আনা টেলিগ্রাম পৌঁছানোর পর দুই পক্ষ যুদ্ধ থামিয়েছিল।
ফোর্স ডি (মেসোপটেমিয়া)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় ফৌজের সবচেয়ে বড় যে বাহিনীটি বাইরে পাঠানো হয়, সেটি হচ্ছে এক্সপেডিশনারি ফোর্স ডি, যেটির গন্তব্য ছিল মেসোপটেমিয়া। ইংরেজদের মালিকানাধীন বসরা এবং এর আশেপাশের তেলখনিগুলো রক্ষা করাই ছিল মূলত এর লক্ষ্য। ১৯১৪-এর নভেম্বরে ৬নং পুনে ডিভিশনকে পাঠানোর মধ্য দিয়ে এই বাহিনীর কাজ শুরু হয়।
অভিযানের শুরুর দিকে অটোমান বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে পারলেও ১৯১৫ সালের নভেম্বর মাসের শেষদিকে টেসিফোনের যুদ্ধে (Battle of Ctesiphon) বেশ ধাক্কা খায় ইংরেজরা। প্রচুর সংখ্যক সেনা হারানোর পর, বিশেষ করে পুনে ডিভিশনের ৪,৬০০ সৈন্য (প্রায় ৪০%) হতাহত হলে, পিছু ফিরে কুট শহরে অবস্থান নিতে বাধ্য হয় তারা। ইংরেজদের পিছু পিছু অটোমানরা কুট শহর অবরোধ করে ফেলে। এদিকে শহরে খাদ্যের অভাব এবং একইসাথে মড়ক ছড়িয়ে পড়লে ৪৫ হাজার সৈন্যের অর্ধেকই হয় রোগে মারা যায়, অথবা অটোমানদের অবরোধ ভেঙে দেওয়ার জন্য পরিচালিত যুদ্ধে হতাহত হয়। এই যুদ্ধে বোঝা যায় যে, ইংরেজদের খাদ্য সরবরাহ কিংবা মেডিক্যাল সাপ্লাই প্রয়োজনের তুলনায় কতটুকু অপ্রতুল ছিল। অনেকেই একে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের সবচেয়ে বাজে হার হিসেবে ধরে থাকেন। দীর্ঘ ৬ মাস অবরোধের পর একপর্যায়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় ইংরেজ বাহিনী এবং ৬ জন জেনারেলসহ প্রায় ১৩ হাজার অফিসার-সৈন্যকে বন্দী করে অটোমানরা।
১৯১৭ সালে নতুন করে নাগাল্যান্ড থেকে আসা সৈন্য নিয়ে টাইগ্রিস কর্পস গঠন করা হয়, যাতে ছিল ৭টি পদাতিক ডিভিশন এবং ১টি ক্যাভালরি ডিভিশন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল মডের নেতৃত্বে এই বাহিনী মেসোপটেমিয়ায় একের পর এক এলাকা দখল করে সামনে আগাতে থাকে এবং মার্চ মাসে বাগদাদের দখল নেয়। এভাবে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত মিত্রবাহিনী এগিয়ে যাওয়ার পর একপর্যায়ে শারকাতের যুদ্ধে অটোমানরা পরাজিত হওয়ার পর মুদ্রোসের অস্ত্রবিরতি চুক্তি অনুযায়ী মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের যুদ্ধ শেষ হয়।
প্রথম মহাযুদ্ধের মেসোপটেমিয়ান ফ্রন্ট ছিল মূলত অটোমান বাহিনী বনাম ভারতীয় বাহিনী, একমাত্র ইংরেজদের ১৩ নং ডিভিশন এবং ভারতীয় বাহিনীতে পোস্টিং হওয়া ইংরেজ অফিসাররা ছাড়া প্রত্যেকেই ছিল ভারতীয়। এই যুদ্ধে প্রায় ২৭ হাজার সৈন্য মারা যায় যুদ্ধে হতাহত হয়ে অথবা রোগে আক্রান্ত হয়ে, ৫২ হাজার সৈন্য আহত হয় এবং আরও সাড়ে ১৩ হাজার সৈন্য বন্দী অবস্থায় (কুটের বন্দী) অথবা নিখোঁজ অবস্থায় থেকে যায়।
ফোর্স ই ও এফ (সিনাই উপত্যকা ও ফিলিস্তিন)
১৯১৫-এর জানুয়ারিতে জার্মানদের পরামর্শে এবং সাহায্য নিয়ে অটোমানরা সুয়েজ খালের দখল নেওয়ার জন্য ব্রিটিশদের অধীনে থাকা সিনাই উপত্যকায় আক্রমণ শুরু করে এবং মিশর-ফিলিস্তিন সীমান্তে মিত্রপক্ষ ও অক্ষশক্তির যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই আক্রমণ সামলাতে ইংরেজরা তাদের সমস্ত ডোমিনিয়ন থেকে সৈন্য জোগাড় করে, ভারতও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ভারতীয় ফৌজের ২২নং লক্ষনৌ ব্রিগেড এবং দেশীয় রাজাদের ১৫নং ইম্পেরিয়াল সার্ভিস ক্যাভালরি ব্রিগেডকে পাঠানো হয় এক্সপিডিশনারি ফোর্স ই-এর অংশ হিসেবে। পরবর্তীতে যুদ্ধের শেষপর্যায়ে ফ্রান্সে থাকা দুটো ক্যাভালরি ব্রিগেড এবং মেসোপটেমিয়া থেকে আরও দুটো পদাতিক ডিভিশনকে এর সাথে যুক্ত করা হয়। এছাড়াও ঐ একই সময়ে প্রতি ব্রিগেডে ইংরেজদের ৩টি ব্যাটালিয়নের বিপরীতে ভারতীয়দের ৩টি ব্যাটালিয়ন নিয়ম রক্ষার জন্য আরও ৩৬টি ব্যাটালিয়ন পাঠানো হয় ভারত থেকে।
অন্যদিকে ফোর্স-এফকেও পাঠানো হয় একই সময়ে, মূলত সুয়েজ খাল রক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য। দুটি পদাতিক ডিভিশন এবং ইম্পেরিয়াল সার্ভিসের একটি ক্যাভালরি ব্রিগেড ছিল এই বাহিনীর অংশ।
যুদ্ধের শুরুর দিকে কিছুটা অঞ্চল দখল করলেও বেশিদূর এগোতে পারেনি অটোমানরা এবং সুয়েজ খাল দখল করার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। ১৯১৭ এর শুরুর দিকে ইংরেজরা তাদের অভিযান শুরু করে এবং একে একে সিনাই, গাজা উপত্যকা, দক্ষিণ ফিলিস্তিন, জাফফা, জেরুজালেম, জর্ডান উপত্যকা, উত্তর ফিলিস্তিন, সিরিয়া ইংরেজদের অধীনে চলে আসে, যাতে অংশ নেয় ভারতীয় বাহিনীর দুই এক্সপিডিশনারি ফোর্স।
ফোর্স জি (গালিপোলি)
অটোমানদের শক্তি খর্ব করার জন্য ইউরোপ ও এশিয়াকে সংযুক্ত করা দুই প্রণালী দখল করার পরিকল্পনা করে আঁতাত শক্তি (ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া), যার ফসল গালিপোলি অভিযান। তুরস্কের ইউরোপীয় অংশই মূলত গালিপোলি উপত্যকা নামে পরিচিত, আঁতাত শক্তি তুরস্কের দুর্বলতর ইউরোপ অংশকে দখল করে এশিয়া অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। এই অভিযান সফল হলে দুই প্রণালীর মাধ্যমে মর্মর সাগর ও কৃষ্ণ সাগরের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার বন্দর পর্যন্ত মিত্রবাহিনীর পথ খুলে যেত।
অটোমানদের সাথে ৩ বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে ১৯১৫ সালের এপ্রিল মাসে ভারতীয় বাহিনীর ২৯নং ব্রিগেডকে পাঠানো হয় ফোর্স-জি হিসেবে। গুর্খাদের ৩ ব্যাটালিয়ন সৈন্য এবং শিখদের ১ ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে তৈরি এই ব্রিগেড প্রথমে মিশরে এবং সেখান থেকে ইংরেজদের ২৯নং ডিভিশনে যুক্ত করা হয় গালিপোলি অভিযানে অংশ নেওয়ার জন্য।
তবে অটোমানদের রক্ষণশীল যুদ্ধ পরিকল্পনার জন্য মিত্রশক্তি খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি। সাগর পাড়ি দিয়ে অটোমানদের মূল ভূখণ্ডে নামার পর খুব বেশিদূর এগোতে পারেনি তারা। এদিকে দুই পক্ষের যুদ্ধে প্রচুর পরিমাণ হতাহত হওয়ায় যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকা সৈন্যদের লাশে বসা মাছি থেকে রোগ ছড়িয়ে পড়ে এবং দুই পক্ষের প্রচুর সৈন্য অসুস্থ হয়ে মারা যায়, বিশেষ করে ডায়রিয়ায়। এদিকে বছর ঘুরে গরম পড়তেই তুরস্কের গরমে টিকতে না পেরে এবং একইসাথে যুদ্ধের অবস্থায় কোনো উন্নতি না হওয়ায় গালিপোলি থেকে সৈন্য সরিয়ে ফেলে মিত্রপক্ষ এবং গালিপোলি অভিযান ব্যর্থভাবে শেষ হয়। ফোর্স-জি-এর ১৬ হাজার সৈন্যের মধ্যে কম করে হলেও দেড় হাজার সৈন্য এই যুদ্ধে মারা যায়।
যুদ্ধে এই ৭টি ফোর্স পাঠানো হলেও এর বাইরেও আরও বেশ কিছু বাহিনী পাঠানো হয়। চীনে থাকা জার্মানির বন্দর শিংটাও-এর দখল নেওয়ার জন্য জাপানের সাথে ইংরেজরাও হাত মেলায়। ইংরেজদের মূল বাহিনীর সাথে ৫০০ সৈন্যের শিখদের একটি রেজিমেন্টও পাঠানো হয়। প্রায় দেড় মাস ধরে চলা অবরোধে ইংরেজ ও ভারতীয় বাহিনীর ১২ জন মারা যায় এবং ৫৩ জন আহত হয়, অন্যদিকে জাপানি সৈন্যদের মধ্যে মারা যায় ৩৬ জন, আহত হয় আরও ১২৮২ জন। জার্মানদের সাপ্লাই নিঃশেষ হয়ে গেলে এক পর্যায়ে আত্মসমর্পণ করে তারা।
বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতীয় বাহিনীর আরেকটি গুরুত্বপুর্ণ ঘটনা হলো সিঙ্গাপুরের বিদ্রোহ। সিঙ্গাপুরে পাঠানো ভারতীয় ফৌজের ৫নং লাইট ইনফ্যান্ট্রি গঠিত ছিল মূলত পাঞ্জাবি মুসলমান এবং পাঠানদেরকে নিয়ে। ঐ সময়েই হঠাৎ গুজব ওঠে যে, তাদেরকে অটোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মেসোপটেমিয়ায় পাঠানো হতে পারে। এদিকে পাঞ্জাবি মুসলমানরা আরেক মুসলমান জাতি অর্থাৎ অটোমানদের সাথে যুদ্ধ করতে নারাজ এবং একপর্যায়ে পাঞ্জাবি মুসলমানদের ৪ কোম্পানি বিদ্রোহ করে বসে। পাঠানদের বাকি ৪ কোম্পানি তখনো বুঝে উঠতে পারছিলো না কোন পক্ষে যোগ দেবে। বিদ্রোহীরা ব্যারাকে থাকা ২ ইংরেজ অফিসারকে হত্যা করার পর সিঙ্গাপুরে বন্দী হিসেবে থাকা জার্মান নাবিকদের পাহারা দেওয়া ১৩ জন পাহারাদারকেও হত্যা করে। এরপর তারা জার্মানদেরকে বিদ্রোহে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানালে জার্মানরা অস্বীকৃতি জানায়। বিদ্রোহীরা এরপর সিঙ্গাপুরের রাস্তায় ইউরোপীয় চেহারার কাউকে পেলেই হত্যা করতে শুরু করে। এভাবে ৫ দিন ধরে চলার পর সিঙ্গাপুরে থাকা সামান্য কিছু ইংরেজ সৈন্য, স্থানীয় লোকজন এবং সাগরে থাকা মিত্রবাহিনীর জাহাজ থেকে আসা সৈন্যদের নিয়ে বিদ্রোহ দমন করা হয়।
কোর্ট-মার্শালের মাধ্যমে ৪৭ জন বিদ্রোহীকে মৃত্যুদণ্ড, ৬৪ জনকে নির্বাসন এবং ৭৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ৫নং লাইট ইনফ্যান্ট্রির বাকি সৈন্যদেরকে দেখা যায় ক্যামেরুন অভিযান, পূর্ব আফ্রিকা ও এডেন বন্দরের অভিযানে।
মহাযুদ্ধের পর
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতীয় বাহিনী যে আগের মতো শান্তিকালীন অবস্থায় ফিরে যাবে, এরকম ব্যাপার ছিল না। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই আফগানিস্তানের উপজাতিদের দমন করা ইংরেজদের সাথে এবার আফগানদের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তৃতীয় আফগান যুদ্ধে দু’পক্ষেই কমবেশি হতাহত হয়। যুদ্ধ শেষমেশ রাওয়ালপিন্ডি চুক্তির মাধ্যমে শেষ হয়, যেখানে ডুরান্ড লাইনকে ব্রিটিশ ভারত ও আফগানিস্তানের সীমানা হিসেবে দুই পক্ষই মেনে নেয়। অন্যদিকে, পাকিস্তানের পাহাড়ি ওয়াজিরিস্তান অঞ্চলের উপজাতিদের দমন করার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত একের পর এক অভিযান চালিয়ে যেতে থাকে ভারতীয় ফৌজ। নয়াদিল্লীর প্রাণকেন্দ্রে ১৯৩১ সালে তৈরি করা ‘ইন্ডিয়া গেট’ মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত ভারতীয়দের স্মরণ করার জন্যই তৈরি করা হয়েছে।
ষষ্ঠ পর্ব: ঔপনিবেশিক ভারতের সামরিক বাহিনী: ভারতীয়করণ (পর্ব-৬)