
আর্সেনিককে খুনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা দুর্ধর্ষ নারীদের নিয়ে গতকাল প্রথম পর্বে আমরা আলোচনা করেছিলাম পাঁচজনকে নিয়ে। আজ থাকছে এ সিরিজের শেষ পর্ব।
জুডিয়াস বুইনোয়ানো
শৈশবে পরিচিতজনদের কাছে শারীরিক লাঞ্চনার শিকার জুডিয়াস বুইনোয়ানো ১৯৬২ সালে যখন বিমান বাহিনীর অফিসার জেমস গুডইয়ারকে বিয়ে করেন, তখন আগে থেকেই তার ছিলো এক সন্তান। এ দম্পতির ঘর আলো করে পরবর্তীতে আরো দু’সন্তান আসে। ফ্লোরিডাতে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছিলেন তারা। একসময় ভিয়েতনাম যুদ্ধে যোগ দিতে চলে যান জেমস। যুদ্ধ শেষে একসময় সুস্থ শরীরে ফিরেও আসেন তিনি। কিন্তু বাড়ি ফিরে আসার মাত্র তিন মাসের মাথায় ১৯৭১ সালে এক রহস্যজনক অসুস্থতায় মারা যান তিনি। জেমসের মৃত্যুতে জীবন বীমার অর্থ লাভ করেন জুডিয়াস।

জুডিয়াস বুইনোয়ানো
১৯৭৩ সালে নতুন মনের মানুষ জুটিয়ে ফেলেন জুডিয়াস, নাম ববি জো মরিস। সন্তানদের নিয়ে মরিসের সাথে ১৯৭৭ সালে কলোরাডোতে গিয়ে থাকা শুরু করেন তিনি। আবারো ঘটে সেই একই ঘটনা। ১৯৭৮ সালে রহস্যজনকভাবে মারা যান ববিও। তার মৃত্যুতেও জীবন বীমা থেকে বেশ কিছু অর্থ হস্তগত করেন জুডিয়াস।
১৯৭৯ সালের কথা, বড় ছেলে মাইকেল দেখা করতে এসেছিলো তার মা জুডিয়াসের সাথে। কিন্তু এসে কিছুদিনের মাঝেই ক্ষারধাতুর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয় সে। এরপর সে চলাফেরার শক্তি একেবারেই হারিয়ে ফেলে। অবশেষে ১৯৮০ সালে এক নৌকা ভ্রমণের সময় পানিতে ডুবে মারা যায় মাইকেল। আগের দু’বারের মতো এবারও জীবন বীমার অর্থ পান জুডিয়াস।
এর কিছুদিন পর জন গেন্ট্রি নামে আরেক লোকের সাথে ঘোরাফেরা করতে দেখা যেতে থাকে জুডিয়াসকে। একপর্যায়ে জনকে দিয়েও একটি জীবন বীমা করিয়ে নেন তিনি। এর কিছুদিন পরই আবারো আগের মানুষগুলোর মতো অসুস্থ হয়ে যান জন। তবে তিনি সময়মতো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ায় বেঁচে যান সেই যাত্রায়। ১৯৮৩ সালে গাড়িতে বিষ্ফোরণ ঘটলে আবারো হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় জনকে।
এবার টনক নড়ে পুলিশের। জনও সকল প্রকারের তথ্য দিয়েই সাহায্য করেন তাদের। সেখানেই বেরিয়ে আসে একটি ভিটামিন ট্যাবলেটের কথা যা জুডিয়াস তাকে আগেরবার অসুখের সময় খেতে দিয়েছিলেন। সেই ওষুধ বানাতে ব্যবহার করা হয়েছিলো প্যারাফরমাল্ডিহাইড ও আর্সেনিক। কবর থেকে জেমস ও ববির লাশ উত্তোলন করে সেগুলো পরীক্ষা করে আর্সেনিকের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হয় পুলিশ।
এরপর গ্রেফতার করা হয় জুডিয়াসকে। প্রথমে যাবজ্জীবন সাজা দিলেও পরবর্তীতে তার মৃত্যুদন্ডের রায় দেয়া হয়। ১৯৯৮ সালে ফ্লোরিডায় কার্যকর করা হয় জুডিয়াস বুইনোয়ানোর মৃত্যুদন্ড।
ভেল্মা বারফিল্ড
দুর্ঘটনাবশত ঘরে আগুন লেগে মারা যান যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ভেল্মা বারফিল্ডের প্রথম স্বামী থমাস বার্ক। ১৯৭০ সালে তিনি বিয়ে করেন জেনিংস বারফিল্ডকে। কিন্তু বিয়ের মাত্র এক বছরের মাথায় মারা যান তার দ্বিতীয় স্বামী জেনিংসও।
১৯৭৬ সালে ডলি ও মন্টোগোমারি এডওয়ার্ডস দম্পতির সাথে তাদের সেবিকা হিসেবে থাকা শুরু করেন ভেল্মা। ১৯৭৭ সালে মারা যান তারা দুজনই। তার সেবায় থাকা পরবর্তী প্রবীণ ব্যক্তি জন হেনরি লী-ও একই বছর মারা যান।

ভেল্মা বারফিল্ড
এরপর বারফিল্ডকে দেখা যেতে থাকলো তার নতুন সঙ্গী স্টুয়ার্ট টেইলরের সাথে। কিছুদিন পর রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে স্টুয়ার্টেরও। তার মৃতদেহের ময়নাতদন্ত শেষে আর্সেনিক শনাক্ত করে তদন্তকারী দলটি। এরপরই গ্রেফতার করা হয় ভেল্মাকে। জেনিংস বারফিল্ডের মৃতদেহ পরীক্ষার জন্য তুলে আনা হয় কবর থেকে। সেখানেও একই ফলাফল মেলে। অবশেষে নিজের সকল খুনের কথা স্বীকার করেন ভেল্মা।
১৯৮৪ সালে প্রাণঘাতী ইঞ্জেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয় ভেল্মার। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রাণঘাতী ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়া প্রথম নারী তিনিই।
ন্যান্সি হ্যাজল
ষোল বছর বয়সী ন্যান্সি হ্যাজল ১৯২১ সালে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন চার্লি ব্র্যাগসকে। এ দম্পতির ঘরে জন্ম নেয় চার কন্যাসন্তান। ১৯২৭ সালে দ্বিতীয় ও তৃতীয় কন্যার রহস্যজনক মৃত্যুর পর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় দুজনের।
এরপর ন্যান্সি বিয়ে করেন ফ্রাঙ্ক হ্যারেলসন নামে এক লোককে। তাদের বিয়ের সালটা নিয়ে অবশ্য মতভেদ আছে। ১৯২৯, ১৯৩৭ ও ১৯৪৫ এ তিন সালের যেকোনো একটিতে এক ছাদের নিচে এসে থাকা শুরু করেন তারা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৪৫ সালে ইঁদুরের বিষ খাইয়ে খুন করা হয় ফ্রাঙ্ককে।

ন্যান্সি হ্যাজল
১৯৪৭ সালে তৃতীয় বিয়ে করেন ন্যান্সি, স্বামী আর্লি ল্যানিং। আগে কখনো হৃদরোগের সমস্যা না থাকলেও ১৯৫২ সালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান ল্যানিং। এর কিছুদিন পরই রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে ল্যানিংয়ের মা এবং ন্যান্সির এক বোনের।
এবার চতুর্থ স্বামীর সন্ধান শুরু করে দেন ন্যান্সি। ১৯৫২ সালেই রিচার্ড মর্টনের সাথে বিয়ে হয় তার। ওদিকে স্বামীর মৃত্যুর পর ন্যান্সির মা লুইজা হ্যাজল ১৯৫৩ সালে মেয়ের সাথে এসে থাকা শুরু করেন। কিন্তু মাত্র কয়েকদিনের মাথায় মৃত্যু হয় তারও। এর মাস তিনেক পর মৃত্যু হয় রিচার্ডেরও।
এরপর পঞ্চম স্বামীর খোঁজে বেরিয়ে পড়েন ন্যান্সি। ১৯৫৩ সালে স্যাম ডসের সাথে বিয়ে হয় তার। কয়েক মাসের মাথায় তিনিও বিচিত্র অসুখ নিয়ে ভর্তি হন হাসপাতালে। কিন্তু ভাগ্য ভালো থাকায় সেই যাত্রায় বেঁচে যান তিনি, অক্টোবরের ৫ তারিখে ফিরে আসেন বাড়িতে। এ ফিরে আসাই কাল হল বেচারার। সেই রাতেই মৃত্যু ঘটে তার।
একজন সুস্থ-সবল মানুষ, যাকে কিনা সেদিনই হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, সে কীভাবে এমন করে মারা যায় তা বুঝতে পারলেন না স্যামের ডাক্তার। সন্দেহ নিরসনে তাই স্যামের মৃতদেহ ময়নাতদন্তের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। আর আগের ঘটনাগুলোর মতো এবারও সন্ধান মেলে আর্সেনিকের। এরপরই পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ন্যান্সি। নিজের চার স্বামী, একজন শাশুড়ি, নিজের মা, বোন ও এক নাতিকে খুনের কথা স্বীকার করে নেন ন্যান্সি।
যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত এ সিরিয়াল কিলার ১৯৬৫ সালে জেলে থাকা অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করেন।
টিলি ক্লাইম্যাক
শিকাগোর বাসিন্দা টিলি ক্লাইম্যাককে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী বলেই মনে করতো তার পরিচিতজনেরা। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, একবার তিনি তার এলাকার কুকুরগুলো কবে মারা যাবে সেই ব্যাপারে একেবারে নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ১৯১৪ সালে ক্লাইম্যাক তার প্রথম স্বামী জন মিটকিউইটজের মৃত্যুর ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। আশ্চর্যজনকভাবে এর মাত্র তিন সপ্তাহের মাথায় মারা যান জন।
জনের জীবন বীমা থেকে প্রাপ্ত অর্থ সংগ্রহ করে ক্লাইম্যাক যান একজন ঘটকের কাছে, উদ্দেশ্য দ্বিতীয় বিয়ে করা। তার দ্বিতীয় স্বামীর নাম ছিলো জন রাস্কোওস্কি। তিনি বিয়ের মাত্র তিন মাসের মাঝে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এমনটা যে ঘটতে যাচ্ছে তা আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন ক্লাইম্যাক।

টিলি ক্লাইম্যাক
এরপর তৃতীয় বিয়ে করেন ক্লাইম্যাক, স্বামী ফ্রাঙ্ক কাপচ্জিক। স্ত্রীর ভবিষ্যদ্বাণীকে নির্ভুল প্রমাণিত করে বছরখানেকের মাঝে মারা যান তিনিও। এভাবে একে একে চলতে থাকে ক্লাইম্যাকের ভবিষ্যদ্বাণী করতে থাকা এবং নির্ভুলভাবে সেগুলো বাস্তবায়িত হওয়া।
ক্লাইম্যাকের এক প্রতিবেশী তার স্বামীদের এমন অদ্ভুত মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলে ক্লাইম্যাক তার মৃত্যু নিয়েও ভবিষ্যদ্বাণী করেন। অনুমিতভাবে সেটি ফলেও যায়। একটি পরিবারের সাথে কিছু ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা চলছিলো ক্লাইম্যাকের। তিনি সেই পরিবারের তিন শিশুর মৃত্যুর ব্যাপারে আগে থেকেই বলে দিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মারা যায় সেই তিন শিশুও।
১৯২১ সালে অ্যান্টন ক্লাইম্যাক নামক এক ব্যক্তিকে নিজের চতুর্থ স্বামী হিসেবে বরণ করে নেন টিলি ক্লাইম্যাক। সুযোগ বুঝে অ্যান্টনেরও জীবন বীমা করিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। এর কিছুদিন পরে আত্মীয়রা তাদের বাসায় বেড়াতে এলে অ্যান্টনকে অসুস্থাবস্থায় দেখতে পায়। ডাক্তারি পরীক্ষানিরীক্ষা শেষে তার খাবারে আর্সেনিকের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেলে এর পেছনের হোতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয় সবাই।
অ্যান্টনকে খুনের চেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় তার স্ত্রী টিলি ক্লাইম্যাককে। যাবজ্জীবন কারাদন্ডের সাজা দেয়া হয় তাকে। অবশ্য তার বিরুদ্ধে আনা আগের খুনের অভিযোগগুলো নিয়ে কোনো এক রহস্যজনক কারণে তদন্ত করা হয় নি। ক্লাইম্যাককে কারাগারে যেসব শর্ত মেনে চলতে হতো তার মাঝে একটি এমন ছিলো- তিনি কখনোই কারাগারে তার অন্যান্য সঙ্গীদের জন্য রান্না করতে পারবেন না।
প্রথম পর্বঃ আর্সেনিক-খুনী নারীদের কাহিনী