কলম ছাড়া আজকের একটি দিন কল্পনা করাও কঠিন, ইলেকট্রনিক সামগ্রীর প্রভাব যতই হোক কলম আমাদের হাতের কাছে খুঁজে পাওয়া যাবেই। তবে গত শতাব্দীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না, কলম ছিল তখনো বিলাসদ্রব্যের তাকে। কলম বানাতে ব্যবহৃত উপাদান আর কালি দুইটারই দাম বেশি হওয়ার কারণে প্রভাবশালী না হলে কারো টেবিলে দুই চারটা কলম থাকবে তা ভাবা ছিল দুষ্কর।
বলপয়েন্ট কলম এই দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে, মানুষের লেখার গতিশীলতা বেড়েছে, বেড়েছে কলমের গতিশীলতা, পকেটে করে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিচ্ছে আজকের কলম। গত শতাব্দীর শুরুতে কালির দোয়াতের ব্যবহার কমে আসতে শুরু করার সাথে সাথে লেখার জন্য পেন্সিল বাদে ‘ফাউন্টেন পেন’ বা ‘ঝর্ণা কলম’ই হয়ে উঠে একমাত্র কলম। সময়ের সাথে সেই ফাউন্টেন পেন বলপয়েন্ট কলমের কাছে জায়গা হারিয়ে এখন আভিজাত্য এবং শৌখিনতার প্রতীক।
ফাউন্টেন পেনের অসুবিধা
ফাউন্টেন কলমে যেহেতু তরল কালি ব্যবহার করা হয় তা শুকাতে সময় লাগে, লেখার জন্য কাগজকে হতে হয় একটু পুরু। আবার লেখার পরে কোনোভাবে যদি এতে হাতের ঘষা লাগে তবে কালি ছড়িয়ে যায়, আরেকটি অসুবিধা হলো তরল কালি ব্যবহারের কারণে একে ধরতে হয় একটু কায়দা করে, এই কলম যারা ব্যবহার করে অভ্যস্ত তারা বলে থাকেন সমতলের সাথে ৪০-৫৫ ডিগ্রী কোণ করে ধরতে। অনেকেই একে ‘Sweet Spot of Fountain Pen’ বলে থাকেন।
কলম, কালি ও হাতের গঠন অনুযায়ী একটু আলাদা হতে পারে এই কোণ, তবে কালির অবিচ্ছিন্নতা বজায় রাখতে হলে একে ধরতে হবে একটু কায়দা করে। হাতে সময় থাকলে শখের বশে এই কলমে ক্যালিগ্রাফি বেশ ভালো করা যায়। তবে পৃথিবীর গতিশীলতা বাড়ার সাথে সাথে ফাউন্টেন পেন ছিটকে পড়তে থাকে কক্ষপথের বাইরে। দ্রুত লিখতে ফাউন্টেন কলম বাদ দিয়ে অনেকেই পেন্সিল ব্যবহার শুরু করেন। তবে পেন্সিলের লেখা দীর্ঘদিনে পরে ঝাপসা হয়ে যায়, তাই কাগজে দ্রুত এবং দীর্ঘস্থায়ীভাবে লেখতে ফাউনন্টেন কলমের বিকল্প কলম নিয়ে অনেকেই চিন্তা করেছেন।
বলপয়েন্ট দেখছে আলোর মুখ
১৮৮৮ সালে বলপয়েন্ট কলমের প্রথম প্যাটেন্ট দাখিল করেছিলেন জন লাউড। আমেরিকান এই আইনজীবী আইনচর্চার পাশাপাশি যন্ত্রাংশের খুঁটিনাটি নিয়ে কাজ করতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতেন। যন্ত্র খুলে ভেঙে নাড়াচাড়া করতে তার পারদর্শিতা ছিল। আইনজীবী হওয়ার সুবাদে ফাউনন্টেন পেন দীর্ঘদিন ব্যবহার করেছেন, কালি চটকেছে কাগজে, বারবার কালির রিফিল খুলতে লাগাতে গিয়ে দেখলেন এর নকশায় আছে ঝামেলা। পাশাপাশি তিনি এমন একটি কলম তৈরি করতে চেয়েছিলেন যা দিয়ে কাঠ, কাগজ, চামড়ায় খুব সহজেই লেখা যাবে।
আমরা এখন যে বলপয়েন্ট কলম ব্যবহার করি, তার মাথায় একটি ছোট স্টিলের বল ঘুরতে থাকে। কাগজে লেখা চালিয়ে যাবার সাথে সাথে এই ঘুরতে থাকা বল কালির সংস্পর্শে এসে নিজেই বারবার কালি বের করে আনতে পারে। এই ডিজাইনটি মূলত জন লাউডের করা। তবে এই ডিজাইনের আরেকটি চমৎকার ব্যবহার আছে, আমরা যে ‘রোল-অন ডিওডোরেন্ট’ ব্যবহার করে থাকি সেটিও এই ডিজাইন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, বলের পেছনে কালির বদলে থাকে তরল ডিওডোরেন্ট। কলমের ক্ষেত্রে ঘুরতে থাকা স্টিল বলের পেছনে থাকবে তরল পদার্থটি, তবে স্টিল বল এবং সকেট এমন মাপের হবে যাতে কালি কোনোভাবে আবার বাইরে ছড়িয়ে না যায়। এই ডিজাইনে কালি খরচাও কমবে।
লাউড প্যাটেন্টে তার কলমকে ফাউন্টেন পেনের একটু উন্নত সংস্করণ হিসেবেই দেখিয়েছিলেন, তার কলমে কালি ছিল ঐ ফাউন্টেন পেনের মতোই তরল। তাই এটি দিয়ে চামড়া কিংবা কাঠে লেখা গেলেও সাধারণ পাতলা কাগজে লেখা কঠিন ছিল। সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের কাজে বা পাতলা কাগজে যেহেতু লেখা যাচ্ছে না, তাই ধীরে ধীরে এই প্যাটেন্ট তার অর্থনৈতিক গুরুত্ব হারায়। তবে এই নকশাকে আরেকটু উন্নত করতে কাজ করেছেন অনেকেই। ১৯৩০ সালে অস্ট্রিয়ান-আর্জেন্টাইন লাজলো বিরো নামের এক সাংবাদিক বলপয়েন্ট কলম নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন। সাংবাদিকতার খাতিরে প্রতিনিয়ত ফাউনন্টেন কলম তিনিও ব্যবহার করে অভ্যস্ত, লাউডের মতো তিনিও চাইতেন এর সমস্যাগুলো সমাধান করতে।
বদলে গেল দৃশ্যপট
তিনি বুঝতে পারলেন, বল পয়েন্ট কলমে যদি ঐ একই তরল কালি ব্যবহার করা হয় তাহলে তার আলাদা কোনো গুরুত্ব থাকবে না। লেখার কাজ একটু সহজ হলেও ঐ একই মোটা কাগজ ব্যবহার করতে হবে এবং কালি ছড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ কলমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কালিকে একটু পরিবর্তন করতে হবে। ঘটনাক্রমে লাজলো বিরোর ভাই ছিলেন একজন দন্ত চিকিৎসক এবং রসায়নবিদ। ভাইয়ের সাথে আলাপ করে বুঝতে পারলেন কালিকে করতে হবে একটু ঘন। অর্থাৎ, রসায়ন মিলিয়ে বললে দাঁড়ায় কালির সান্দ্রতা বাড়াতে হবে।
সান্দ্রতার ব্যাপারটি সহজে বুঝা যাবে পানি আর মধুর উদাহরণ দিয়ে, কাঁচের থালার উপরে পানি সহজে ছড়িয়ে যায় কিন্তু মধু ছড়ায় না সহজে। মধু যে ধর্মের কারণে তরল হয়েও ছড়িয়ে যায়না তা হল তার সান্দ্রতার মাত্রা। সান্দ্রতার মাত্রা যত বেশি তার ছড়িয়ে যাওয়ার মাত্রা তত কম। লাজলো আর তার ভাই মিলে কলমের কালির সান্দ্রতা বাড়ানোর ব্যাপারে চিন্তা শুরু করলেন।
কালির সাথে বিভিন্ন ধরনের আঠা মিশিয়ে এর সান্দ্রতার মাত্রা পরীক্ষা করা হলো। বেশি আঠালো কালি আবার কলমের নিব দিয়ে বের না হয়ে জমাট বেঁধে যায়, আবার বেশিদিন রাখলে কালি শুঁকিয়ে যায়। তাই সান্দ্রতা নিয়ে লাজলো বিরো এবং তার ভাই যে কাজ যুগান্তকারী কাজ শুরু করেছিলেন তা পরবর্তীতে বলপয়েন্ট কলম শিল্পের বড় নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়।
বিরোর কলমে আঠালো কালিকে রাখা হবে একটি নলে, নল থেকে মধ্যাকর্ষণের টানে ধীরে ধীরে কলমের নিবের কাছে এসে জমা হবে। আর বাইরে থাকা চাকার মতো বল কাগজের উপর ঘুরতে থাকবে, ঘুরতে থাকার সময়ে সেই চাকা কালির সংস্পর্শে আসবে। যেহেতু একটু আঠালো ধরনের কালি তা পাতলা কাগজেও লিখে ফেলা মাত্রই শুকিয়ে যাবে, অর্থাৎ ঘষা লেগে ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। লাজলো বিরো এবং তার দন্ত চিকিৎসক ভাইয়ের পুরো কলমের প্যাকেজটি ছিল লাউডের থেকে আলাদা। সুতরাং বিরো তার কাজের জন্য নতুন প্যাটেন্ট নিলেন ১৯৩৮ সালে।
ইউরোপে যুদ্ধের ঘনঘটা
১৯৩৮ সালে প্যাটেন্ট নিলেও এই কলমের বিশালাকার উৎপাদনের কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি দুই ভাইয়ের। ইহুদী হওয়ার কারণে লাজলো বিরো ও তার ভাই নিজ দেশে নিপীড়নের শিকার হয়ে ১৯৪১ সালে আর্জেন্টিনায় পালিয়ে যান। সেখানে তিনি চালু করেন ‘বিরোম’ নামের বলপয়েন্ট কলম। সেই কলম নজর কাড়ে ব্রিটেনের রয়্যাল এয়ার ফোর্সের, অধিক উচ্চতায় যেখানে ফাউন্টেন পেন কাজে আসে না সেখানে পেন্সিলের জায়গা নিতে শুরু করে ‘বিরোম’।
রয়্যাল এয়ার ফোর্সের পক্ষ থেকে ত্রিশ হাজার কপির অর্ডার দেওয়া হয় এই কলমের জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং এর পরে এই বলপয়েন্ট কলম হয়ে উঠে ব্যাপক জনপ্রিয়। লাজলো বিরোর প্যাটেন্টে এক আধটু পরিবর্তন শুরু হয়, কেউ কলমের আকারে, কেউ কালিতে পরিবর্তন আনতে শুরু করেন। সুতরাং এই প্যাটেন্ট নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজনীয়তা কমে আসে, বরং সহজে কম দামে কীভাবে মানুষের কাছে কলম পৌঁছে দেওয়া যায় সেই চিন্তা শুরু হয়। ১৯৪৫ সালে আমেরিকান ব্যবসায়ী মিল্টন রেনল্ডস আমেরিকাতে এই বল পয়েন্ট কলম বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন, পত্রিকায় পত্রিকায় ছাপা হয় কলমের বিজ্ঞাপন। সাড়ে বারো ডলার খরচ করে নতুন এক কলম কিনতে দোকানগুলোর সামনে দেখা যায় লম্বা লাইন। সেই আমলের সাড়ে বারো ডলারকে এখনের হিসাবে নিলে তা দাঁড়াবে একশো আশি ডলারে, অর্থাৎ এই টাকা খরচা করে এখনের দিনে হাজারখানেকের বেশি কলম কিনে ফেলা যাবে।
ফাউন্টেন পেনের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা
একদম প্রথম দিকের বলপয়েন্ট কলম আসলে ফাউন্টেন কলমের ছায়া থেকে খুব একটা বের হয়ে আসতে পারেনি। শুরুতে এটিকে বানানো হতো প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবেই, যেহেতু কলমের দামও বেশি তাই মানুষের কাছে কলমের অন্যতম উপযোগীতা ছিল এর স্থায়িত্ব। তাই টেকসই কলম তৈরিতে ধাতব পদার্থের ব্যবহার ছিল বেশি। রেনল্ডস কোম্পানি তাদের বিজ্ঞাপনেই বলতো, দুইবছর রিফিল করা ছাড়াই যেকোনো স্থানে লিখতে পারবে যে কেউ, ফাউন্টেন পেন বারবার রিফিল করার ঝামেলা তাই এটি এড়িয়ে যেতেও বলপয়েন্ট ভালো সমাধান। ধীরে ধীরে ‘পার্কার’ সহ আরো বিখ্যাত ফাউন্টেন কলম নির্মাতা কোম্পানিও বলপয়েন্ট কলমের বাজারে প্রবেশ করে। কলম যেহেতু দীর্ঘস্থায়ী, তাই একটি কলম কিনে দীর্ঘদিন যাবৎ তার রিফিল কিনে নিলেই হচ্ছে। তাই পঞ্চাশের দশকের মাঝেই দেখা গেলো মানুষ আর কলম না কিনে বরং রিফিল কিনছে, অর্থাৎ কলম কোম্পানির বাজারে দেখা দিল নতুন সংকট।
ফ্রেঞ্চ-ইতালিয়ান ব্যবসায়ী মার্সেল বিক কলমের বাজারকে দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এখনো কলম সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় দ্রব্য হয় উঠলেও এর উচ্চদামের কারণে এটি সে বারবার পরিবর্তন করতে পারছে না। অনেকটা বর্তমান দিনের স্মার্টফোনের মতো, অনেক কাটখড় পুড়িয়ে কেনা একটি স্মার্টফোন যতদিন না বিকল হচ্ছে সে ব্যবহার করছে, কলমই তখন অনেকটা সেরকমই ছিল।
অনেকক্ষেত্রে কলম আভিজাত্যও প্রকাশ করছে। কলমকে যদি আরো সস্তা করা যায়, এবং এর ব্যবহারকাল সীমিতও হয় তাহলেই কলমের বাজারে আসবে পরিবর্তন, এই ভাবনা থেকেই কাজ শুরু করেন মার্সেল বিক। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে সুলভে প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার কলমকে আরো সহজলভ্য করে, বাজার থেকে কাঁচ, ধাতু কিংবা কাঠের কলম হারিয়ে যেতে শুরু করে।
বিকের নির্মিত কলমের অনুসরণ করে দুনিয়াজুড়ে প্রায় সব কলম নির্মাতা কোম্পানি প্লাস্টিকের দিকে ঝুঁকে। বিকের ডিজাইন করা কাঁচের মতো দেখতে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের কলম ‘Cristal’ কে ধরা হয়ে থাকে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ব্যবসা সফল কলম। ২০০৬ সাল নাগাদ এই কলম বিশ্বজুড়ে বিক্রি হয়ে ১০০ বিলিয়ন কপিরও বেশি।
মজার ব্যাপার হলো, স্বচ্ছ হওয়ার কারণে এই কলমের কালি শেষ হয়ে যাবার আগেই দেখা যায় এবং কালি যত নীচের দিকে নামে ততই মানসিকভাবে নতুন কলম কেনার জন্য আগ্রহী হয়ে পড়ে। কলমের রিফিল কিনে ব্যবহারের চেয়ে নতুন কলম কিংবা কলমের পুরো একটি প্যাকেট কিনে ফেলাই হয়ে উঠে সংস্কৃতির অংশ। সত্তরের দশকে এসে প্লাস্টিকের একটি বলপয়েন্ট কলমের দাম দাঁড়ায় পেন্সিলের চেয়ে কমে।
মোটাদাগে বলপয়েন্ট কলমের দাম এত কমে এসেছে যে বিভিন্ন দেশে নামীদামী ব্র্যান্ড তাদের আধিপত্ব হারিয়েছে। কলম নিত্য ব্যবহার্য হয়ে উঠে উঠার সাথে সাথে এর গায়ে কোন কোম্পানির নাম লেখা তা গুরুত্ব হারিয়েছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্থানীয় কলম নির্মাতা কোম্পানিগুলোর কাছে বাজার হারিয়েছে নামীদামী কোম্পানিগুলো। তাই বর্তমানে কলমের বাজারে একক আধিপত্য বিস্তার হয়ে উঠেছে কঠিন, তাই নামীদামী কোম্পানিরা হাঁটছে পুরাতন পথে, কলমে এবার নতুন করে বিলাস দ্রব্য বানানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা।
ফাউন্টেন পেন থেকে বলপয়েন্ট
ফাউন্টেন কলম যখন ব্যবহার করা হতো তখন মানুষের লেখার ধরন ছিল আলাদা, লেখার ধারাটা বজায় রাখার জন্য একটি অক্ষরের সাথে আরেকটি অক্ষরের যুক্ত করে দেওয়ার ব্যপারটি ছিল খুবই সাধারণ। লেখার এই ধরনকে বলা হয়ে থাকে ‘Palmer Method’, এবং লেখালেখির কাজটি ছিল ধীরেসুস্থে করার কাজ। অভিজাত স্কুলগুলোতে বা বাড়িতে শিক্ষকও রেখে অনেকেই এ ধরনের লেখা শিখতেন।
ফাউন্টেন পেনের কালির কারণেই একে এমনভাবে কাগজের সাথে ধরতে হয় যাতে করে এই প্যাচানো লেখার ব্যাপারটি স্বাভাবিকভাবেই অনুপ্রাণিত হত। আর প্রতিষ্ঠানগুলো লেখালেখিতে এই বিশুদ্ধতাকেও একটি আভিজাত্যের কাতারে ফেলে দিত। তবে ইউরোপ আমেরিকায় বলপয়েন্ট কলম আসার সাথে সাথে বরং লেখালেখির স্রোত উল্টোদিকে বইতে শুরু করে। বলপয়েন্টের নিবকে খাতার পৃষ্ঠার সাথে কোণ করে রাখার একান্তই কোনো দরকার নেই, তবে চাইলে কেউ একে ফাউন্টেন পেনের মতোও ব্যবহার করতে পারবেন। কলম উঠিয়ে যেকোনো কোণ থেকে লেখা শুরু করা যায়, অর্থাৎ কলম ব্যবহারের স্বাধীনতা একটু বেড়ে যায়। ফলে লেখালেখিতে এক্ক কয়েকটি স্টাইলের আভিজাত্য উঠে গিয়ে বিচিত্র সব স্টাইলের সৃষ্টি হয়। কোনো চমৎকার উদ্ভাবন সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য হলে তারা পুরো সমাজকেই বদলে দিতে পারে এর একটি উদাহরণ হলো বলপয়েন্ট কলম।
ফেলে দেওয়া কলমে নতুন সমস্যা
পৃথিবীজুড়ে বিশাল কলমের বাজার, এর বিপুল ব্যবহার জন্ম দিয়েছে বেশ কিছু সমস্যার। কোটি কোটি সস্তা কলম যাদের রিফিল করা যায় না তারা জন্ম দিচ্ছে প্রচুর পরিমাণ বর্জ্যের। পৃথিবীজুড়ে প্রতিবছর প্রায় ১০০ বিলিয়ন বলপয়েন্ট কলমের শেষ ঠিকানা হয় বর্জ্যস্তুপে, আর প্লাস্টিক বর্জ্যের বড় অংশের শেষ ঠিকানা সমুদ্রে। সেখানে কলমের প্লাস্টিক অন্যদের মতোই তাপে চাপে ভেঙে ক্ষতিকর ‘মাইক্রো প্লাস্টিক পার্টিকেল’ জন্ম দিচ্ছে। মানুষ এবং সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এই মাইক্রো প্লাস্টিক পার্টিকেল। বিক তাদের কলম বানাতে ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত রিসাইকেল করা প্লাস্টিক ব্যবহার করছে। নিজেদের ব্র্যান্ড মূল্য বাড়াতে অনেক বড় কোম্পানিই এই কাজ করছে, তবে বেশিরভাগ কোম্পানিই সমস্যার মূলে যেতে চায় না।
অর্থাৎ, রিসাইকেল করা প্লাস্টিক ব্যবহার করে এমন কলম বানাচ্ছে যা এক সপ্তাহ পুরোদমে ব্যবহারের পর বর্জ্য হিসেবে আবার ছুঁড়ে ফেলতে হবে। তাই পরিবেশ সচেতন আর গবেষকরা বলছেন ভোক্তাদের সচেতন হওয়া জরুরী, দীর্ঘদিন ধরে আমরা ব্যবহারের পর কলম ফেলে দিতে অভ্যস্ত। কিংবা একসাথে ডজন ডজন কলম কিনতে অভ্যস্ত। সেই অভ্যাস বাদ দিয়ে রিফিল করে বারবার ব্যবহার করা যায় এমন কলম ব্যবহার করা জরুরী। বর্তমান কলমের বাজারে কলমের আয়ুষ্কাল কম, পাশাপাশি এর রিফিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাই সাধারণ ভোক্তারা চাপ না দিলে সেই রিফিলও বাজারে যে সহসাই চলে আসবে তা ভাবা কঠিন। তাই বারবার ব্যবহার করা যায় এমন কলম হতে পারে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমাতে একটি ছোট সচেতন পদক্ষেপ, বিশ্বজুড়ে লক্ষ কোটি মানুষ যদি নিজেদের কলম থেকেই এই পরিবর্তন শুরু করতে পারেন।