ব্যাটল অফ স্যাভো আইল্যান্ড (শেষ পর্ব): নৌযুদ্ধে জিতেও যে কারণে হারল জাপান

আগের পর্বে সদ্য কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠে ক্যাপ্টেন হাওয়ার্ড বোডের ভুল সিদ্ধান্তের কথা আমরা জেনেছি। আসলে জাপানি এডমিরাল মিকাওয়া যখন আক্রমণ করেন সাউদার্ন ফোর্সের তিন মার্কিন ক্রুজারের ক্যাপ্টেনই ঘুমে ছিলেন। জাহাজের প্রধান ব্যক্তি নিজেও একজন মানুষ, তারও বিশ্রাম প্রয়োজন। তবে ঘুমানোর সময় জাহাজের স্বাভাবিক কার্যক্রম চলমান রাখার যে প্রক্রিয়া সেটি তারা যথাযথভাবে অনুসরণ করেনি। ফলে জরুরি মুহূর্তে কমান্ড সংক্রান্ত বেশ কিছু ঝামেলার সৃষ্টি হয়।

আক্রমণকারী জাহাজগুলো ১০ নট (১৯ কি.মি./ঘন্টা) গতিতে চলছিল। সাউদার্ন ফোর্সের ক্রুরা ইউএসএস প্যাটারসনের রেডিও সতর্কবার্তা ও নর্দান ফোর্সের উপর শত্রুর কামান দাগানোর শব্দ শুনছিল। তাছাড়া জাপানি সি-প্লেনের ফ্লেয়ারের কল্যাণে নর্দান ফোর্সের জাহাজগুলো প্রায় দিনের মতো আলোকিত হয়ে গেছে যা দক্ষিণ পাশ থেকেও দেখা যাচ্ছে। এতসব ঘটনার পর কন্ডিশন ২ থেকে কন্ডিশন ১ (ফুল এলার্ট) অবস্থায় যেতে বেশি সময় ব্যয় করে ফেলেছে তারা। যার খেসারত পরবর্তীতে চরমভাবে দিতে হয়েছে।

যুদ্ধে অংশ নেয়া মার্কিন-জাপানি যুদ্ধজাহাজগুলো; Image Source : slideserve.com

 

রাত ১:৪৪ মিনিটে সাউদার্ন ফোর্সের দিকে টর্পেডো ফায়ারিং শুরু করে জাপানিরা। এর ছয় মিনিট পর মিকাওয়ার জাহাজ ‘চকাই’ শক্তিশালী সার্চলাইট জ্বালিয়ে শুরুতেই ইউএসএস এস্টোরিয়ার নেভাল গান টার্গেটিং সাইটের উপর কামান দাগানো শুরু করে। পাল্টা জবাব দিতে শুরু করে মার্কিনিরা। ক্যাপ্টেন তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে উঠে এসে কিছু না বুঝেই সিজফায়ার নির্দেশ দেন। তার ধারণা ছিল যে ভুলক্রমে নিজেদের পক্ষের যুদ্ধজাহাজ লক্ষ্য করে পাল্টা কামান দাগাচ্ছে তার ক্রুরা।

ঘটনা কী সেটা বুঝতেই প্রায় এক মিনিট লাগিয়ে ফেলেন। তিনি যখন আবার ফায়ারিংয়ের নির্দেশ দেন তখনই ‘চকাই’ প্রথমবারের মতো টার্গেটে শেল হিট করাতে সক্ষম হয়। রাত দুটোর সময় ‘চকাই’ এর সাথে আক্রমণে যোগ দেয় অপর জাপানি ক্রুজার আওবা, কিনুগাসা ও কাকো। মুহূর্তের মধ্যে একাধিক শেল ইউএসএস এস্টোরিয়াতে আঘাত করে। ইঞ্জিনরুম ধ্বংস হয়ে জাহাজটি অচল হয়ে পড়ে। সোয়া দুইটায় এস্টোরিয়ার টিকে থাকা একমাত্র কামান থেকে কিনুগাসার সার্চলাইট বরাবর ফায়ার করা হয়। কিন্তু গোলাটি টার্গেট মিস করলেও সৌভাগ্যক্রমে এটি চকাইয়ের সামনের টারেট উড়িয়ে দেয়।

১৯৪২ সালের ৮ জুলাই (বামে) ও ৮ আগস্ট যুদ্ধের দিন তোলা ইউএসএস এস্টোরিয়া (ডানে); Image Source : U.S. Naval History and Heritage Command

 

এদিকে ইউএসএস কুইন্সির ক্রুরা এস্টোরিয়ার থেকেও কাজে ধীরগতির ছিল। ক্যাপ্টেন স্যামুয়েল মুর হন্তদন্ত হয়ে ঘুম থেকে উঠে এসে জেনারেল কোয়ার্টার (সকল নাবিকদের যার যার ব্যাটল স্টেশনে যাওয়ার নির্দেশ) জারি করলেও এস্টোরিয়াতে যখন হামলা শুরু হয় কুইন্সির ক্রুরা কামান দাগানোর জন্য প্রস্তুত হয়নি। ফলে কুইন্সির ক্যাপ্টেন মুর সময়মতো আওবার উপর ফায়ারিংয়ের নির্দেশ দিয়েও সুফল পাননি, বরং ফায়ার করে উল্টো বিপদে পড়েন।

অপরপাশ দিয়ে ফুরুতাকা ও টেনরায়ু যখন হামলা শুরু করে তখন নিজের বিপদ টের পেয়ে এস্টোরিয়ার পাশাপাশি কুইন্সির উপরও কামান দাগানো শুরু করে আওবা। ফলে দুই পাশ থেকে ক্রসফায়ারে পড়ে যায় যুদ্ধজাহাজটি। দিশেহারা ক্যাপ্টেন জাপানিদের জাহাজ দিয়ে গুঁতো মারতে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন! মতলব টের পেয়ে টেনরায়ু দুটো টর্পেডো ফায়ার করে পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেয়। তখনই আবারো দুর্ভাগ্যের শিকার হয় এডমিরাল মিকাওয়ার জাহাজ ‘চকাই’। কুইন্সি সেই গোলাটি কাকে ফায়ার করেছিল তা জানা যায় না, তবে জাহাজটির টার্গেট সাইটে জাপানি ক্রুজার ‘চকাই’ ছিল না। তারপরও ইউএসএস কুইন্সির একটি লক্ষভ্রষ্ট গোলা উড়ে গিয়ে ‘চকাই’ এর কমান্ড এন্ড নেভিগেশন রুম উড়িয়ে দেয়। এতে ৩৬ জন আহত-নিহত হয়। ২০ ফুট দূরে থাকা এডমিরাল মিকাওয়া অল্পের জন্য বেঁচে যান।

নিজেদের ফ্ল্যাগশিপ হামলার শিকার হয়েছে দেখে এবার কুইন্সির ব্রিজ (যেখান থেকে জাহাজ চালানো হয়) উড়িয়ে দেয় জাপানিরা। এতে মার্কিন যুদ্ধজাহাজটির ক্যাপ্টেন স্যামুয়েল মুরসহ বেশিরভাগ কমান্ডিং স্টাফ মারা যায়। রাত সোয়া দুটোয় আওবার টর্পেডো হজম করার পর জাহাজটির কামানগুলো নীরব হয়ে যায়। কুইন্সির এসিস্ট্যান্ট গানারি অফিসার নির্দেশনা জানতে ব্রিজে গিয়ে যা দেখেন তার বর্ণনা তার মুখেই শুনুন,

“When I reached the bridge level, I found it a shambles of dead bodies with only three or four people still standing. In the Pilot House itself the only person standing was the signalman at the wheel who was vainly endeavoring to check the ship’s swing to starboard to bring her to port. On questioning him I found out that the Captain, who at that time was laying [sic] near the wheel, had instructed him to beach the ship and he was trying to head for Savo Island, distant some four miles (6 km) on the port quarter. I stepped to the port side of the Pilot House, and looked out to find the island and noted that the ship was heeling rapidly to port, sinking by the bow. At that instant the Captain straightened up and fell back, apparently dead, without having uttered any sound other than a moan”

ইউএসএস কুইন্সি শেষ পর্যন্ত স্যাভো আইল্যান্ডের বিচে পৌঁছানোর আগেই রাত ২:৩৮ মিনিটে ডুবে যায়।

সকালের বিমান হামলার সময় একটি জাপানি বিমান ভুপাতিত করার মুহূর্তে ইউএসএস কুইন্সি (ডানে-উপরে)।
জাপানি সার্চলাইটের আলোতে আলোকিত অবস্থায় জাহাজটি (ডানে-নিচে); Image Source : warhistoryonline.com

 

এস্টোরিয়ার ক্যাপ্টেনের মতোই একই ভুল করেছিলেন অপর ক্রুজার ইউএসএস ভিনসেনেসের সদ্য ঘুম থেকে উঠে আসা ক্যাপ্টেন। জাহাজটি সাউদার্ন ফোর্সে হামলার খবর সবার আগেই টের পেয়েছিল। রাত ১:৫০ মিনিটে ভিনসেনেসের উপর সার্চলাইট জ্বালানো জাপানি যুদ্ধজাহাজের বিরুদ্ধে ফায়ারিং শুরু করতে ক্যাপ্টেন ফ্রেডরিখ ইতস্তত বোধ করেন। তিনি ভেবেছিলেন জাহাজটি নিজেদের পক্ষের জাহাজ! কিন্তু তার মাথায় আসেনি যে সিগন্যাল কমিউনিকেশন লাইট, রেডিও কমিউনিকেশন ডিভাইস থাকার পরও যোগাযোগ ছাড়া নিজেদের জাহাজ সার্চলাইট জ্বালাবে কেন?

জাপানি ক্রুজার ‘কাকো’ ফায়ারিং শুরু করলে ভিনসেনেস যেন সৎবিত ফিরে পায়। তারাও পাল্টা জবাব দিতে শুরু করে। ক্যাপ্টেন ফ্রেডরিখ টর্পেডো হামলা থেকে বাঁচতে স্পিড বাড়িয়ে ২৫ নট (৪৬ কি.মি./ঘন্টা) করেন। কিন্তু মিকাওয়া তার কৌশল ধরে ফেলেন। চকাইয়ের ফায়ার করা দুটো টর্পেডো ভিনসেনেসকে আঘাত করে এবং গতি কমিয়ে দেয়। কাকোর সাথে হামলায় যোগ দেয় কিনুগাসা। কিন্তু জাহাজটি ভিনসেনেস পাল্টা হামলায় স্টিয়ারিং ক্ষমতা হারায়ে পিছিয়ে পড়ে। তাই কাকোর সাহায্যে এগিয়ে আসে অন্যান্য জাপানি যুদ্ধজাহাজ। সব মিলিয়ে ৭৪টি গোলা আঘাত করে ইউএসএস ভিনসেনেসে। রাত ২:০৩ মিনিটে অপর জাহাজ ইউবারির ছোড়া টর্পেডোর বিস্ফোরণে সবগুলো বয়লার রুম ধ্বংস হয়ে জাহাজটি থেমে যায়। সোয়া দুটোয় ক্যাপ্টেন ফ্রেডরিখ জাহাজ নাবিকদের ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। রাত ২:৫০ মিনিটে ইউএসএস ভিনসেনেস ডুবে যায়।

১৯৩৮ সালে পানামা খালে (বামে) ও ১৯৪২ সালে সলোমন আইল্যান্ডে যাওয়ার পথে ইউএসএস ভিনসেনেস (ডানে)  
Image Source : U.S. Naval History and Heritage Command

এই যুদ্ধে মার্কিন ডেস্ট্রয়ার হেলম ও উইলসন জাপানিদের খুঁজে পেতে বেগ পাচ্ছিল। বহু কষ্টে তারা ‘চকাই’য়ের উপর হামলা চালায়, মিকাওয়া পাল্টা জবাব দেন। কিন্তু দুজনের হামলাই ব্যর্থ হয়। রাত সোয়া দুইটায় নর্দান ফোর্সের উপর হামলাকারী জাপানিজ কলাম ফায়ারিং বন্ধ করে স্যাভো দ্বীপের উত্তর দিকে সরে আসে। পুঁচকে ডেস্ট্রয়ার রালফ ট্যালবট পেট্রোলিং বাদ দিয়ে ফুরুতাকা, টেনরায়ু ও ইউবারির উপর হামলা চালায়। পাল্টা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পালিয়ে যায়, জাপানিরা তার পিছু ধাওয়া করেনি।

শিল্পীর চোখে কুইন্সির ডুবে যাওয়ার মুহূর্ত; Image source : slideserve.com

 

মিকাওয়ার কৌশলগত ভুল সিদ্ধান্ত

এডমিরাল গুনিচি মিকাওয়ার হাতে তখন দুটো অপশন। হয় মিত্রবাহিনীর ট্রান্সপোর্ট গ্রুপের জাহাজগুলোকে খুঁজে বের করে ধ্বংস করা অথবা বাড়ির পথ ধরা। ফুয়েল যা আছে তাতে সমস্যা নেই। প্রধান সমস্যা হলো মিত্রবাহিনীর রসদবাহী জাহাজগুলোর দুই গ্রুপ চ্যানেলের দুই মাথায়। একদল ফ্লোরিডা আইল্যান্ডে (সাউদার্ন গ্রুপের এরিয়ায়), আরেকদল গুয়াডালক্যানেল আইল্যান্ডে (নর্দান গ্রুপের এরিয়ায়)। দুই গ্রুপে ব্যাপক হামলার পরও মিত্রবাহিনীর এখনও কী পরিমাণ জাহাজ টিকে আছে জানা নেই। তাছাড়া ট্রান্সপোর্ট গ্রুপের প্রতিরক্ষায় আলাদা কোনো যুদ্ধজাহাজ আছে কিনা সেটিও জানা নেই।

ফুয়েল শেষে ফেরত আসা সি-প্লেনগুলোকে আবার ওড়ানো যাবে না। এর বাইরে জাপানিদের টর্পেডো টিউব, নেভাল গান ম্যাগাজিন রিলোড করতে কিছুটা সময় প্রয়োজন। ব্যাপক হারে কামান দাগানোর কারণে এমুনিয়েশন স্টোরেজ ৪০% এ নেমে এসেছে। তার চেয়েও বড় কথা হলো এখন আবার আক্রমণে গেলে গুয়াডালক্যানেল এলাকা ত্যাগ করতে করতে পরদিন সকাল হয়ে যাবে। মিকাওয়ার বিশ্বাস ছিল আমেরিকান এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার আশেপাশেই আছে। এর হামলা থেকে বাঁচার জন্য এয়ার কাভার তার ছিল না। তাই যা করার রাতের অন্ধকারেই করতে হবে। অন্যদিকে জাপানের প্রোডাকশনে এখন কোনো ক্রুজার নেই যে তার বহরের ক্ষতিগ্রস্ত/পুরাতন ক্রুজার ডুবলেও তেমন ক্ষতি হবে না। এসব কারণে স্টাফদের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও এডমিরাল মিকাওয়া ০২.২০ মিনিটে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগের নির্দেশ দেন। বিকালে ফ্লেচারের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের এলাকা ত্যাগের বিষয়টি জানলে হয়তো তিনি এই সিদ্ধান্ত নিতেন না।

স্যাভো আইল্যান্ড যুদ্ধে এডমিরাল মিকাওয়ার এন্টার এন্ড এক্সিট রুট; Image Source : armyupress.army.mil

ফলাফল

ভোর চারটায় ইউএসএস প্যাটারসন ও ইউএসএস ব্লু মিলে জ্বলন্ত এইচএমএএস ক্যানবেরার আগুন নেভাতে সাহায্য করে ও ক্রুদের উদ্ধার করে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও এডমিরাল টার্নার জাহাজটি ডুবিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। কেননা তার নির্দেশ ছিল সম্ভাব্য জাপানিজ বিমান হামলার আশঙ্কায় সাড়ে ছয়টার মধ্যে ফায়ার ফাইটার শিপসহ সকল জাহাজকে গুয়াডালক্যানেল ত্যাগ করতে হবে। ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস সেলফ্রিজ ও ইউএসএস এলেট মিলে ৩০০ শেল ও ৫টি টর্পেডো ফায়ার করে ডুবিয়ে দেয়া হয়।

এটি ডোবানোর পরপরই জেনারেল আলেকজান্ডার টার্নারকে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন। কেননা তার রসদ আনলোড করতে আরো সময় প্রয়োজন। দুপুর সোয়া বারোটায় ইউএসএস এস্টোরিয়া ডুবে যাওয়ার পর বুগেনভাইল দ্বীপে থাকা অস্ট্রেলিয়ান কোস্টওয়াচার (শত্রুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণে নিয়োজিত উপকূলীয় নৌ-গোয়েন্দা দল) রেডিও মারফত জানায় যে এই মাত্র রাবাউল থেকে আসা জাপানি বিমানবহর তাদের অতিক্রম করেছে! এডমিরাল টার্নার তড়িঘড়ি করে ট্রান্সপোর্ট গ্রুপের জাহাজের আনলোড বন্ধ করে জাহাজগুলোকে নিয়ে খোলা সাগরে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু প্রত্যাশিত আক্রমণ আর আসলো না। জাপানি পাইলটরা স্যাভো আইল্যান্ড পর্যন্ত না এসে মাঝপথে ইউএসএস জার্ভিসকে একলা পেয়ে তাকে আক্রমণ করে ডুবিয়ে দেয় যা গত পর্বে বলা হয়েছে। সন্ধ্যার আগেই এডমিরাল টার্নার পুনরায় ক্রুজারের হামলার আশঙ্কায় এলাকা ত্যাগ করেন। এই খবর পেয়ে মিকাওয়া তার বহরের অন্তর্গত ক্রুজার ডিভিশন সিক্স এর চার জাহাজকে নিজেদের ঘাঁটি ক্যাভিয়েংয়ে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে নিজের ঘাঁটি রাবাউলে ফিরে যাওয়ার পথ ধরেন।

ক্ষতিগ্রস্ত মিত্রবাহিনীর জাহাজ; Image source : warhistoryonline.com

 

১০ আগস্ট সকালে ক্যাভিয়েং নৌ ঘাঁটির ১১০ কি.মি. দূরে ওৎ পেতে থাকে মার্কিন সাবমেরিন ইউএসএস এস-৪৪ এর টর্পেডো হামলায় ক্রুজার কাকো ডুবে যায়। এটি স্যাভো আইল্যান্ড যুদ্ধের বাইরের ঘটনা। এই ঘটনা বাদে পুরো যুদ্ধ ছিল একতরফা জাপানি সাফল্য। মিডওয়েতে চরমভাবে ধরা খাওয়া ফ্লিট এডমিরাল ইয়ামামোতো মিকাওয়ার সাফল্য দেখে শুভেচ্ছা জানান। তার পত্রে লেখা ছিল,

“Appreciate the courageous and hard fighting of every man of your organization. I expect you to expand your exploits and you will make every effort to support the land forces of the Imperial army which are now engaged in a desperate struggle.”

কিন্তু মিকাওয়া মিত্রবাহিনীর ট্রান্সপোর্ট গ্রুপকে হাতের কাছে পেয়েও ধ্বংস না করায় এত বড় সাফল্য সত্ত্বেও তার ব্যাপক সমালোচনা হয়। পরবর্তীতে দিনের বেলা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ও হেন্ডারসন ফিল্ড থেকে আগত এসকর্ট ফাইটারের প্রটেকশন নিয়ে ছোট ছোট কনভয় এর সমন্বয়ে গুয়াডালক্যানেলে রসদ সাপ্লাই দেয়া হয়। এসব কারণে দ্বীপটি দখলে পরিচালিত বেশ কয়েকটি জাপানি আক্রমণের সময় মিত্রবাহিনী অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য রসদের অভাবে বেকায়দায় পড়লেও তাদেরকে পুরোপুরি পরাজিত করতে পারেনি জাপানিরা। তাই স্যাভো আইল্যান্ড যুদ্ধে জাপান ট্যাক্টিক্যালি জিতলেও ছয় মাস যুদ্ধ করে গুয়াডালক্যানেল ক্যাম্পেইনে শেষ পর্যন্ত হেরে যায়। ফলে স্ট্র্যাটেজিকভাবে স্যাভো আইল্যান্ডের প্রথম যুদ্ধে বিজয়ী কিন্তু মিত্রবাহিনীই। তবে এই যুদ্ধে তারা যত নাবিক হারিয়েছে (১,০৭৭ জন), পুরো গুয়াডালক্যানেল নৌযুদ্ধেও এতজন মারা যায়নি! এই যুদ্ধে জাপানের ১২৯ জন নিহত ও দুটি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে মিত্রবাহিনীর তিনটি জাহাজ ডুবে যায়, তিনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও একটি ডুবিয়ে দেয়া হয়। এজন্য মিত্রবাহিনীর ভেটেরানদের কাছে এই যুদ্ধ Battle of the Five Sitting Ducks নামে পরিচিতি পেয়েছে। জাপানিরা হাঁস শিকারের মতোই জাহাজ ডুবিয়েছে।

যুদ্ধের পর হেপবার্ন তদন্ত কমিশন এই যুদ্ধের ব্যর্থতার তদন্ত করে। তবে এডমিরাল টার্নার, ভিক্টর, ফ্লেচার, ম্যাককেইন, ও তাদের ব্যর্থতার জন্য পর পেয়ে গেলেও ক্যাপ্টেন ফ্রেডরিখ ও হাওয়ার্ড বোডের কোর্ট মার্শাল হয়। ফ্রেডরিখকে আর কখনো জাহাজের নেতৃত্ব দেয়া হয়নি। ক্যাপ্টেন বোড সাজা হওয়ার আগেই আত্মহত্যা করেন। এডমিরাল টার্নার স্যাভো আইল্যান্ড যুদ্ধ সম্পর্কে কমিশনকে বলেন,

“The Navy was still obsessed with a strong feeling of technical and mental superiority over the enemy. In spite of ample evidence as to enemy capabilities, most of our officers and men despised the enemy and felt themselves sure victors in all encounters under any circumstances. The net result of all this was a fatal lethargy of mind which induced a confidence without readiness, and a routine acceptance of outworn peacetime standards of conduct. I believe that this psychological factor, as a cause of our defeat, was even more important than the element of surprise”

ইতিহাসবিদ রিচার্ড ফ্রাঙ্কের মতে, স্যাভো আইল্যান্ড যুদ্ধে লজ্জাজনক পরাজয়ের ফলে মার্কিন নৌবাহিনীর গর্ব প্রবলভাবে ঝাঁকুনি খায় যা তাদের নতুন করে কৌশল প্রণয়ন করতে বাধ্য করে। এই পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে প্যাসিফিক থিয়েটারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জিতেছিল যুক্তরাষ্ট্র।

(সমাপ্ত) 

এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বসমূহ

১) ব্যাটল অফ স্যাভো আইল্যান্ড (পর্ব-১): সাফল্যে মোড়ানো ভয়াবহ মার্কিন গোয়েন্দা ব্যর্থতা

২) ব্যাটল অফ স্যাভো আইল্যান্ড (পর্ব-২): যুক্তরাষ্ট্রের নৌযুদ্ধের ইতিহাসের ভয়াবহতম পরাজয়

Related Articles

Exit mobile version