
গত পর্বে বলা হয়েছিল যে, অ্যাডমিরাল ফ্লেচার সন্দেহবশত গোয়েন্দা রিপোর্টের জন্য দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। এরপর পৌনে দুটোর দিকে ইউএসএস সারাটোগার অর্ধেক বিমান (৩৮টি) জাপানি লাইট এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার র্যুজুকে আক্রমণ করতে পাঠান। বাকি বিমানগুলোকে জাপানি ফ্লিট ক্যারিয়ারগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে জমা রাখেন। অন্যদিকে বেলা সাড়ে বারোটার দিকে র্যুজুর বিমানগুলো হেন্ডারসন ফিল্ডের উদ্দেশ্যে উড্ডয়ন শুরু করে। লম্বা ফ্লাইট শেষে আড়াইটার দিকে আক্রমণ শুরু হলে ছয়টি জাপানি ডাইভ বোম্বার ও পনেরোটি এ-৬এম জিরো ফাইটারের বিরুদ্ধে সেখানকার এন্টি এয়ারক্রাফট কামান ও মার্কিন যুদ্ধবিমানগুলো পাল্টা জবাব দিতে শুরু করে। নাগুমোর প্ল্যান অনুযায়ী রাবাউল থেকে দুই ডজন মিতসুবিশি জি-৪এম বোমারু বিমান ও চৌদ্দটি জিরো ফাইটারের বহর হেন্ডারসন ফিল্ডে ঘন্টাখানেক আগেই বোমা ফেলার কথা ছিল। বিমান বিধ্বংসী কামানগুলো ধ্বংস হয়ে গেলে র্যুজুর পাইলটদের কাজ সহজ হয়ে যেত। কিন্তু প্যাসিফিক অঞ্চলের আবহাওয়ার মতিগতির ঠিক নেই। তীব্র ঝড়বৃষ্টির কারণে রাবাউল ঘাঁটি থেকে একটি বিমানও আসতে পারেনি। র্যুজুর বিমানগুলোর হামলায় হেন্ডারসন ফিল্ডের তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ফলে সংক্ষিপ্ত আকাশ যুদ্ধে ছয়টি জাপানি বিমানের বিপরীতে মাত্র তিনটি মার্কিন বিমান ভূপাতিত হয়।
দ্বীপে হামলা চালানোতে ব্যস্ত থাকায় সারাটোগার ৩৮টি বিমানের বহরকে বাধা দেয়ার মতো পর্যাপ্ত বিমান ছিল না র্যুজুর আশেপাশে। মার্কিন পাইলটরা তিনটি এক হাজার পাউন্ডের বোমা ও একটি টর্পেডো হিট করতে সক্ষম হয়। এতে ১২০ জন মারা যায়। জাপানি নাবিকরা দ্রুততার সাথে আগুন নিভিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়। কিন্তু টর্পেডোর কারণে সৃষ্ট ক্ষতিতে জাহাজটি নিচের ডেক প্লাবিত হয়ে ডুবে যেতে থাকে। তখনই মরণকামড় দিতে হেন্ডারসন ফিল্ড থেকে আক্রমণে আসে কয়েকটি বি-১৭ বোমারু বিমান। শেষপর্যন্ত সবাইকে জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দেন অ্যাডমিরাল চুইচি হারা। আকাশে থাকা এক ডজন জাপানি বিমানের তখন কোথাও ল্যান্ড করার জায়গা নেই। র্যুজুর সঙ্গী ডেস্ট্রয়ারগুলো পানিতে ক্রাশ করা বিমানগুলোর পাইলটদের উদ্ধার করে। অন্যদিকে ইউএসএস সারাটোগা আরো দূরে চলে যাওয়ায় মার্কিন পাইলটরা হেন্ডারসন ফিল্ডে ল্যান্ড করেন।

র্যুজুর উপরে হামলা শুরুর কয়েক মিনিট পর নাগুমোর একটি গোয়েন্দা বিমান মার্কিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলোর অবস্থান শনাক্ত করে। কিন্তু রেডিওতে খবরটি পাঠানোর কাজ চলাকালেই তাকে দ্রুততার সাথে ভূপাতিত করে কমব্যাট এয়ার পেট্রোল গ্রুপের একটি ওয়াইল্ডক্যাট ফাইটার। এই বিমানগুলোকে একটু আগেই পালাক্রমে আকাশে রাখার প্রথম সুবিধা পেলেন অ্যাডমিরাল ফ্লেচার। অন্যদিকে নাগুমো দেখলেন যে র্যুজুর উপর আক্রমণকারী বিমানগুলো যেদিক থেকে এসেছে, একই দিকে তার গোয়েন্দা বিমানটি নিখোঁজ হয়েছে। অর্থাৎ মার্কিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলো তার দিকে এগিয়ে আসছে। দেরি না করে নিজের সবগুলো বিমান আকাশে ওড়ানোর জন্য প্রস্তুত করতে নির্দেশ দেন নাগুমো। একইসঙ্গে ভ্যানগার্ড ও অ্যাডভান্স ফোর্সকে ফুল স্পিডে সামনে এগিয়ে যেতে বলেন যেন রাতের বেলা তারা অবশিষ্ট মার্কিন বহরের উপর হামলা চালাতে পারে। উল্লেখ্য, তৎকালে রাতে জাপানিদের সাথে যুদ্ধ করার সক্ষমতার ধারেকাছেও ছিল না মার্কিন নৌবাহিনী।
জাপানি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার দুটো কেবলমাত্র প্রথম ওয়েভের সাতাশটি ডাইভ বোম্বার ও পনেরোটি জিরো ফাইটার একের পর এক ওড়ানো শুরু করেছে। ঠিক তখনই দুটো ডাউন্টলেস ডাইভ বোম্বার জাহাজ দুটোকে শনাক্ত করে ফ্লেচারকে রিপোর্ট পাঠায়। কিন্তু কমিউনিকেশন সমস্যার কারণে সেই রিপোর্ট পৌঁছায়নি। এরপরই দুঃসাহসিক মার্কিন পাইলট দুজন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার শকাকুতে এককভাবে হামলা করার চেষ্টা করে যেন জাপানিদের টেকঅফ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হয়। তাদেরকে পাঁচটি জাপানি বিমান ধাওয়া দিলে তারা পালিয়ে যায়। এই হামলায় নাগুমোর ফ্লিটের তেমন ক্ষতি হয়নি। তবে আশেপাশে আরো মার্কিন বিমান থাকতে পারে– এই সন্দেহ করে তিনি নিজের অবশিষ্ট ‘জিরো’ ফাইটার বিমানগুলোকে আক্রমণে না পাঠিয়ে ফ্লেচারের কৌশলের ন্যায় কমব্যাট এয়ার পেট্রোল শুরু করেন। ফলে প্রথম ওয়েভের জাপানি ডাইভ বোম্বারগুলো প্রয়োজনের চেয়ে কিছুটা কম ফাইটার এসকর্ট নিয়ে মিশনে যেতে বাধ্য হয়। বিকাল চারটা নাগাদ মার্কিন ব্যাটলশিপ নর্থ ক্যারোলিনার সদ্য ইন্সটল করা রাডারে জাপানি বিমান বহর ধরা পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছিল রাডার টেকনোলোজির শৈশবকাল। যুক্তরাষ্ট্রের গুটিকয়েক জাহাজে রাডার থাকলেও জাপানের ছিল না। ফ্লেচারের মুখে তখন সাময়িক স্বস্তির হাসি। কেননা, তার সন্দেহ সত্য বলে প্রকাশ পেয়েছে। আগে থেকেই এন্টারপ্রাইজের পঁচিশটি ওয়াইল্ডক্যাট বিমান আকাশে উড়ছিল। এবার সারাটোগার আরো বিশটি বিমান আকাশে উড়ানো হয়। এরা সামনে এগিয়ে গিয়ে জাপানি বিমান বহরের সবার সামনে থাকা জিরো ফাইটারগুলোর সাথে ডগফাইট (আকাশযুদ্ধ) শুরু করে। ফ্লেচার তার কমব্যাট এয়ার পেট্রোলের দ্বিতীয় সুবিধা পান।

মিডওয়ে যুদ্ধের পর থেকেই মার্কিনীরা তাদের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলোতে অতিরিক্ত এক স্কোয়াড্রন করে যুদ্ধবিমান যোগ করেছিল। ফলে ফ্লেচারের হাতে এখন যথেষ্ট সংখ্যক বিমান আছে। জাপানিরা হামলা শুরুর আগেই ফ্লাইট ডেক খালি করার কাজ শুরু করে মার্কিনীরা। অ্যাডমিরাল ফ্লেচার একই সাথে হামলা ঠেকানো এবং পাল্টা হামলার জন্য একের পর এক বিমান ওড়াচ্ছেন! কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। তৎকালে সব ধরনের রেডিও কমিউনিকেশনের জন্য একটিমাত্র চ্যানেল ব্যবহার হতো। আকাশযুদ্ধে থাকা পাইলটরা কথাবার্তা চালাতে গিয়ে পুরো চ্যানেল ওভারলোড করায় সেটি অকেজো হয়ে যায়। ফলে মার্কিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার দুটোর ফাইটার ডাইরেক্টর অফিসাররা প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিতে পারছিলেন না। এমনকি পাইলটদের রেডিওতে চিৎকার, চেঁচামেচি থামানোর জন্য অ্যাডমিরাল সাহেব নিজেও চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ফলে অনেকটা আন্দাজের উপর ভিত্তি করে মার্কিন ডাইভ বোম্বারদের উত্তরদিকে নাগুমোর খোঁজে পাঠানো হয়। কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত টার্গেট খুঁজে না পেয়ে ফিরে আসে। তবে এদের মধ্যে দুটো বিমান বিচ্ছিন্নভাবে অ্যাডভান্স ফোর্সের সেই সি-প্লেন ক্যারিয়ার জাহাজে হামলা করে সঠিক টার্গেটে বোমা ফেলতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু আর্মার তেমন শক্তিশালী না হওয়ায় সামান্য আঘাতেই বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় জাহাজটি।
আক্রান্ত ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ
ততক্ষণে জাপানি বিমানবহর এসে উপস্থিত। দুই মার্কিন ক্যারিয়ারের ফ্লাইট ডেক প্রায় খালি থাকায় হামলা হলেও বেশি ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি কম। নাহলে ফুয়েল-বোমা ভর্তি একেকটি বিমান নিজেই বোমার মতো কাজ করতো। তুলনামূলক কাছের টার্গেট হওয়ায় জাপানি পাইলটরা এন্টারপ্রাইজকেই হামলার জন্য বেছে নেয়। প্রথম দফায় নয়টি ভ্যাল ডাইভ বোম্বার হামলা চালিয়ে এন্টি এয়ারক্রাফট গানের প্রচন্ড বাঁধার মুখে টার্গেট মিস করে। এদেরকে পেছন থেকে গুলি করে ভূপাতিত করতে মার্কিন ফাইটার পাইলটরাও চেষ্টা করে। ফলে বিপরীত দিক থেকে আসা নিজেদের পক্ষের এন্টি এয়ারক্রাফট মেশিনগানের গুলিতে চারটি ওয়াইল্ডক্যাট ফাইটার ও ভূপাতিত হয়।

কালো ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে; Image Source : U.S. Navy Naval History and Heritage Command
দ্বিতীয় দফার হামলায় দুটি আর্মার পিয়ার্সিং বোমা পড়ে জাহাজে। প্রথমটি পেছনের এলিভেটরে হিট করায় তিনটি ডেক ভেদ করে বিস্ফোরিত হয়। দ্বিতীয় বোমাটি এন্টি এয়ারক্রাফট কামানের গোলার গুদামে হিট করায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে সব মিলিয়ে ৭৪ জন মারা যায়। তৃতীয় দফার হামলায় সামনের দিকের ফ্লাইট ডেকে দশ ফিট ব্যাসের বিরাট গর্ত দেখা দেয়। ব্যাপক আগুন ও ধোঁয়া দেখে জাপানিরা ভাবে যে এন্টারপ্রাইজের আয়ু শেষ। তাই শেষ দফার আক্রমণটি ব্যাটলশিপ নর্থ ক্যারোলিনার উপর করা হয়। কিন্তু উক্ত জাহাজের পাশেই ছিল হেভি ক্রুজার আটলান্টা। দুটো জাহাজের শক্তিশালী এন্টি এয়ারক্রাফট কামানের গোলায় সাতটি ভ্যাল ডাইভ বোম্বারের সবগুলোই ভূপাতিত হয়। সব মিলিয়ে প্রথম ওয়েভে আগত জাপানি স্ট্রাইক ফোর্সের প্রায় ৭৭% শক্তি এই লড়াইয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে!
নাগুমো দুটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্থ করার ভুল তথ্য পান। এন্টারপ্রাইজের সামনে থাকা হেভি ক্রুজার আটলান্টার এন্টি এয়ারক্রাফট কামানগুলো একটানা এত বেশি ফায়ারিং করেছে যে আকাশে থাকা বিমান থেকে দেখে মনে হয়েছে বিশাল জাহাজটি স্রেফ আগুনে পুড়ছে। শুধু জাপানি নন, মার্কিন পাইলটরাও একই ভুল ধারণা করেছিল। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো- এন্টারপ্রাইজ ছাড়া আর কোনো জাহাজই ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। জাহাজটির ড্যামেজ কন্ট্রোল টিম দুই ঘণ্টার মাঝে আগুন নিভিয়ে আবার বিমান ল্যান্ড করার উপযোগী করে তোলে। কিন্তু কাজটি করতে গিয়ে স্টিয়ারিং রুম প্লাবিত হয়ে কন্ট্রোল সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিশাল এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারটি তখন বৃত্তাকার পথে নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে চক্কর খেতে থাকে। এমনও হয়েছে যে সংঘর্ষ এড়াতে সঙ্গী ডেস্ট্রয়ারগুলো পড়িমরি করে দূরে সরতে বাধ্য হয়েছে।
নিচে যে ছবিটি দেখতে পাচ্ছেন সেটি ইউএসএস এন্টারপ্রাইজে বোমা পড়ার ঠিক মুহূর্তে তোলা। আগে ধারণা করা হতো- এটি ক্যামেরায় ধারণ করার পর পরই মারা গিয়েছিলেন ফটোগ্রাফার রবার্ট রেড, যা তাকে পরবর্তীতে বিখ্যাত বানিয়ে দেয়। পরে জানা যায়- ছবিটি আসলে তার সহকর্মী ম্যারিয়ন রাইলির ভিডিও থেকে নেয়া, যেখানে বিশাল মার্কিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারটিকে হামলা ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করতে দেখা যায়।

তবে মন্দেরও ভালো দিক আছে। এর কিছুক্ষণ পড়েই দ্বিতীয় ওয়েভের জাপানি ডাইভ বোম্বারগুলো আক্রমণ করতে আসে। কিন্তু ঘুরতে ঘুরতে এন্টারপ্রাইজ জাপানি পাইলটদের অনুমানকৃত অঞ্চল থেকে অনেক দূরে সরে যায়। ফলে টার্গেট খুঁজে না পেয়ে তারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। জাপানি লগ বিশ্লেষণ করে জানা যায়, ঐ সময় বিমানগুলো এন্টারপ্রাইজ-সারাটোগার মাত্র পঞ্চাশ মাইল দূরে ছিল! এদিকে ফ্লেচারের পাঠানো স্ট্রাইক গ্রুপটি নাগুমোর এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের দেখা না পেয়ে ফিরে আসে। এন্টারপ্রাইজের অবস্থা খারাপ থাকায় সারাটোগা এবং হেন্ডারসন ফিল্ডে বিমানগুলোকে অবতরণ করানো হয়। দুর্ধর্ষ জাপানি সারফেস ফ্লিট যে রাতে আক্রমণের চেষ্টা করবে তা অনুমান করে অ্যাডমিরাল ফ্লেচার তার পুরো নৌবহর দিয়ে আরো দক্ষিণে সরে যান। যথারীতি এবারো তার অনুমান সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। ভ্যানগার্ড ও অ্যাডভান্স ফোর্স ফুল স্পিডে এগিয়ে এসেও মার্কিন নৌবহরের নাগাল না পেয়ে উল্টো পথ ধরে দ্রুত ফিরে যায়। কেননা, পরদিন সকালে আবার এন্টারপ্রাইজ-সারাটোগা হামলা করলে তাদের কোনো উপায় থাকবে না।
এরই মধ্যে রাতের বেলা হেন্ডারসন ফিল্ডে অ্যাডমিরাল মিকাওয়ার পাঁচটি যুদ্ধজাহাজ ‘হিট এন্ড রান’ মিশনে এসে ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে পালিয়ে যায়। পরদিন ভোরে অ্যাডমিরাল তানাকার সেই ট্রান্সপোর্ট গ্রুপ আবারো সেনা নামাতে গুয়াডালক্যানেল উপকূলে ফিরে আসে। কিন্তু রাতের সেই গোলাবর্ষণে হেন্ডারসন বিমান ঘাঁটির তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তাদের ঠেকাতে আকাশে ওড়ে ১৮টি বি-১৭ বোমারু বিমান। এদের এক দফা হামলাতেই একটি সেনা বহনকারী জাহাজ ডুবে যায়। জীবিতদের উদ্ধার অভিযান চলাকালে একটি ডেস্ট্রয়ার পাঁচটি বোমা পড়ে। সাথে সাথেই জাহাজটি ডুবে যায়। ক্ষতিগ্রস্থ হয় আরো বড় দুটি জাহাজ। অ্যাডমিরাল তানাকা আহত হয়ে জ্ঞান হারান। ভূমিতে হামলার উপযোগী বোমারু বিমান দিয়ে নৌবহরের এত বড় ক্ষয়ক্ষতি পুরো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিরল ঘটনা। এর ফলে জাপানিরা সেনা অবতরণ না করেই আবারো পিছু হটতে বাধ্য হয়।

সময় তোলা ছবি সঙ্গী যুদ্ধজাহাজ দুটোকে পালাতে দেখা যাচ্ছে; Image Source : U.S. Navy Naval History and Heritage Command

ক্ষতিগ্রস্থ এন্টি এয়ারক্রাফট কামান; Image Source : U.S. Navy National Museum of Naval Aviation
ক্ষয়ক্ষতি ও যুদ্ধের ফলাফল
অ্যাডমিরাল নাগুমোর জ্বালানী তেল ও বিমান শক্তির পাশাপাশি অভিজ্ঞ পাইলট সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় তিনি পিছু হটতে বাধ্য হন। ইউএসএস ওয়াস্প ফিরতে দেরি হবে বিধায় অ্যাডমিরাল ফ্লেচার ও পিছু হটেন। মার্কিনীদের একটি ফ্লিট ক্যারিয়ার (এন্টারপ্রাইজ) মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাকে মেরামত করতে পার্ল হারবারে পাঠানো হয়। মোট বিশটি মার্কিন বিমান ধ্বংস হয় এবং সব মিলিয়ে ৯০ জন নিহত হয়। অন্যদিকে জাপানীদের একটি লাইট ক্যারিয়ার (র্যুজু) ডুবে যায় এবং মোট ৫১টির বেশি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়। একটি ক্রুজার এবং সি-প্লেন টেন্ডারটি বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সাথে একটি ডেস্ট্রয়ার ছাড়াও একটি ট্রান্সপোর্ট জাহাজ ডুবে যাওয়ায় মোট ২৯০ জনের বেশি মারা গিয়েছিল।
যেকোনো যুদ্ধের ফলাফল হয় দুটি। লড়াই শেষের বিজয় এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব (tactical and strategic victory)। এই যুদ্ধের দুই ফলাফলই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে গিয়েছিল। ইতিহাসবিদ Richard B. Frank বলেন,
“The Battle of the Eastern Solomons was unquestionably an American victory, but it had little long-term result, apart from a further reduction in the corps of trained Japanese carrier aviators. The [Japanese] reinforcements that could not come by slow transport would soon reach Guadalcanal by other means.
পরবর্তীতে ২৯ আগস্ট ল্যান্ডিং শিপের বদলে ডেস্ট্রয়ার জাহাজের মাধ্যমে গুয়াডালক্যানালে ল্যান্ড করে জাপানি সেনারা। কিন্তু ভারী অস্ত্র (মর্টার, মেশিনগান, কামান) আনতে না পারায় পরবর্তী স্থলযুদ্ধগুলোতে তারা দলে দলে মারা পড়তে থাকে। এর আগের দিন আরেকটি জাপানি ডেস্ট্রয়ার ডুবিয়ে দিয়ে হেন্ডারসন ফিল্ডের বিমানগুলো তাদের কার্যকারিতা আবারো প্রমাণ করে।

ইস্টার্ন সলোমন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিহতদের মধ্যে পাইলট-এয়ারক্রু ছিল সাতজন। অন্যদিকে জাপানিদের ছিল ৬১ জন যাদের বেশিরভাগই অতীতের বিভিন্ন যুদ্ধের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ভেটেরান পাইলট। তাদের নতুন পালট ট্রেইনিং প্রোগ্রামের ঘাটতি পরবর্তী প্রতিটি যুদ্ধে প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়েই কামিকাজি (আত্মঘাতী বিমান হামলা) কৌশল বেছে নেয়। অন্যদিকে মার্কিনীরা পাইলট ট্রেনিং প্রোগ্রাম ত্বরান্বিত করা ছাড়াও একাধিক এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার নির্মাণ শুরু করে। সবচেয়ে চমক দেখায় এন্টারপ্রাইজ। ১৫ অক্টোবরের মধ্যে মেরামত শেষে পুনরায় জাপানি ক্যারিয়ার শকাকু-যুইকাকু জুটির মুখোমুখি হয়। ব্যাটল অব সান্তা ক্রুজ আইল্যান্ড নিয়ে পড়তে চোখ রাখুন Roar বাংলায়।