ট্যুরসের রণক্ষেত্র ঠিক কোথায় তা নিয়ে মতভেদ আছে। তবে ঐতিহাসিকেরা একমত বর্তমান ফ্রান্সের ট্যুরস আর পঁয়তিয়ের্সের মধ্যেই কোথাও সংঘটিত হয়েছিল এই লড়াই। এজন্য অনেকে একে ব্যাটল অব পঁয়তিয়ের্সও বলতে চান। তবে ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের মধ্যকার ভিন্ন এক সংঘর্ষের জন্য এই নাম অধিক জনপ্রিয়।
ইউরোপীয়দের বিবরণ
বলা হয়, আব্দ আল-রহমান তার সেনাদের নিয়ে ট্যুরস শহর লুণ্ঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন। খুব সম্ভব সেটাই ছিল তার মুখ্য উদ্দেশ্য। ট্যুরসের সেইন্ট মার্টিন গির্জায় (Church of St. Martin) প্রচুর ধন-সম্পদ রাখা ছিল। আল-রহমান সেসব ছিনিয়ে নিতে চাইছিলেন।
ইউরোপীয় লেখকদের বর্ণনা অনুযায়ী, মুসলিম বাহিনীকে ঠেকাতে খ্রিষ্টীয় শক্তির নেতা হিসেবে এগিয়ে যান চার্লস। তার হাতে নিহত হয় কাতারে কাতারে সেনা। উমাইয়া সেনাপতি আল-রহমানকেও হত্যা করেন তিনি। মূলত এরপর থেকেই তার উপাধি হয় মার্টেল, বা হাতুড়ি (hammer)।
রাত পর্যন্ত ভয়াবহ লড়াইয়ের পর দুই পক্ষ যার যার শিবিরে ফিরে যায়। চার্লসের চরেরা খবরাখবর নিতে গিয়ে দেখতে পেল শত্রুদের সব তাঁবু খালি। আঁধারে গা ঢাকা দিয়ে দেশে ফিরে গেছে উমাইয়া সেনারা। তারপরেও কয়েকদিন চার্লস নিজের অবস্থান ধরে রাখেন। শেষ পর্যন্ত তিনি নিশ্চিত হন সহসা নতুন কোনো আক্রমণ হবে না।
মুসলিম বিবরণ
সমসাময়িক বিভিন্ন মুসলিম লেখকদের লেখা অনুযায়ী আল-রহমান প্রবল প্রতাপে শত্রু অঞ্চলে ঢুকে পড়েছিলেন। বহু দুর্গ আর নগরী মাথা নোয়ায় উমাইয়া বাহিনীর সামনে। তার সামনে কাঁপছিল স্থানীয় শাসকরা। ফলে তারা ফ্রাঙ্কিশ জেনারেল চার্লসের কাছে সহায়তা প্রার্থনা করে। তিনি বিশাল এক সেনাদল নিয়ে হাজির হন।
আল-রহমানের বাহিনী তখন যুব্ধলব্ধ মালামালের ভারে ন্যুব্জ। তেমন কোনো বাধা না পেয়ে সৈন্যরাও অতি-আত্মবিশ্বাসী। চার্লসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে যে ধরনের শৃঙ্খলা প্রয়োজন তার ছিটেফোটাও নেই তাদের। আল-রহমান এবং তার অফিসারেরা বিষয়টি বুঝেছিলেন বটে। কিন্তু তারা জানতেন পিছিয়ে যাবার কথা বললে সেনারা ক্ষেপে গিয়ে উল্টো বিদ্রোহ করে বসতে পারে। লুট করা মালামালও তাদের দ্রুত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করছিল, কিন্তু সেসব ফেলে যেতেও কেউ রাজি হবে এই আশা আল-রহমানের ছিল না। ফলে বিশৃঙ্খল অবস্থাতেই তার সেনারা চার্লসের মুখোমুখি হয়। জায়গাটা নাকি ছিল লইর (Loire) নদীর অনতিদূরে।
সারদিন প্রবল যুদ্ধ হয়েছিল সেটা নিয়ে দ্বিমত নেই আরব ঐতিহাসিকদেরও। তবে তাদের মতে, রাতের বেলা পালিয়ে যায়নি উমাইয়া সেনারা, বরং পরদিন ফিরে এসেছিল রণক্ষেত্রে। তাদের অশ্বারোহীরা একপর্যায়ে চার্লসের ব্যুহের মধ্যভাগ ভেদ করে ফেলে। কিন্তু তারা তাঁবুতে রেখে আসা লুণ্ঠিত মালামাল নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল, এবং যখন গুজব ছড়িয়ে পরে যে ইউরোপীয় একদল সেনা পেছন থেকে তাদের তাঁবুতে হামলা করেছে তখন তাড়াহুড়ো করে সেদিকে চলে যায় অশ্বারোহীদের সিংহভাগ। এই পরিস্থিতিতে অসহায় হয়ে পড়ে পদাতিকেরা। আল-রহমান তাদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেন, কিন্তু ফ্রাঙ্কদের হাতে নিহত হন তিনি। এরপর ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় তার সেনারা।
ঠিক কী ঘটেছিল?
বিভিন্ন বর্ণনা একত্র করে আধুনিক গবেষকরা মনে করেন চার্লস আর আল-রহমান প্রায় সাত দিন পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে বসে ছিলেন। কেউই নিজেদের সুরক্ষিত অবস্থান ছেড়ে বিপদে পড়তে চায়নি। চার্লস ছিলেন উচ্চভূমিতে, চারপাশে গাছপালা ঢাকা রুক্ষ ভূমি তার পার্শ্বভাগকে নিরাপদ রেখেছিল। তিনি তেড়ে গেলে সেই সুবিধা হারাতে হতো, কারণ তখন দু’পাশ থেকে উমাইয়া অশ্বারোহীরা তাকে নাজেহাল করে ফেলত। ঠিক এই কারণেই আল-রহমান অপেক্ষা করছিলেন। তিনি চাইছিলেন ফ্রাঙ্করাই আক্রমণ করুক, তাহলে ঘোড়সওয়ারদের সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারবেন তিনি।
যুদ্ধের তারিখ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। ৭৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ অক্টোবর আল-রহমান যেকোনো কারণেই হোক নিজেই হামলা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। তার মোকাবেলায় প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করেন চার্লস। বড় একটি চতুষ্কোণের আকারে সাজানো হয় ফ্রাঙ্কদের। মূল লক্ষ্য অশ্বারোহীদের আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়া।
চার্লস যেমন ভেবেছিলেন, ঠিক সেভাবেই অশ্বারোহীদের ব্যবহার করেন আল-রহমান। সারাদিন ধরে একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে যায় তারা। কিন্তু একবারের জন্যও ফ্রাঙ্কদের ব্যুহে ফাটল ধরেনি।
এমন সময় সম্ভবত চার্লসের একদল সেনা উমাইয়া শিবিরের পেছনে উপস্থিত হয়। আগের সাতদিন দুই পক্ষই পরস্পরের ওপর নজর রাখতে ছোট ছোট দল পাঠিয়েছিল। মনে করা হয়, ফ্রাঙ্কদের একটি দল লড়াই আরম্ভ হবার সময়েও মূল বাহিনীর সাথে যোগ দেয়নি, রয়ে গিয়েছিল পেছনে। তারা তাঁবুর প্রহরীদের হটিয়ে থাকা মালামাল লুটে নিতে শুরু করে। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে রণক্ষেত্র থেকে অতিরিক্ত সেনা ডেকে আনা হলো। কিন্তু যুদ্ধের ডামাডোলে সব সৈনিক পুরো খবর জানতে পারেনি। তারা যখন অশ্বারোহীদের চলে যেতে দেখল তখন ধরে নিল হয়তো পিছিয়ে আসার আদেশ জারি হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন চার্লসের একদল সেনা উমাইয়ে ব্যুহে বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে শিবিরে প্রবেশ করে। অনেক সেনার পরিবার পরিজন ছিল তাঁবুতে, তারা খবর পেয়ে কোনো আদেশের তোয়াক্কা না করেই ছুটে যায় সেদিকে।
যা-ই হোক; মুসলিম বাহিনীতে এমন ধারণার সৃষ্টি হয় যে কোনো কারণে পিছু হটছে তারা। ফলে রণক্ষেত্র থেকে সরে যেতে আরম্ভ করে সেনারা। এই পরিস্থিতিতে আল-রহমান নিজে চেষ্টা করেন তাদের ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু মূল বাহিনী ততক্ষণে ফিরে গেছে, ফলে অনেকটা একা হয়ে পড়েন তিনি। তখনই শত্রুরা হত্যা করে তাকে। তার সহকারী সেনাপতির দায়িত্ব নেন।
দুই পক্ষেই হতাহত হয়েছিল হাজারের ওপর। সেদিন রাতে উমাইয়া সেনাদল শিবির ত্যাগ করে পিছিয়ে যায়। একটি বাদে সকল সূত্র থেকে জানা যায় চার্লস তাদের ধাওয়া করেননি। যে একটি সূত্র দ্বিমত পোষণ করে তার উৎস জানা যায় না। তবে এই সূত্রমতে নার্বোন অবধি শত্রুদের পিছু নিয়েছিলেন চার্লস। তবে উমাইয়ারা অবশিষ্ট সেনাদল অক্ষত রেখেই দেশে ফিরতে পেরেছিল।
তাৎপর্য
ট্যুরসের যুদ্ধে নিঃসন্দেহে জয়ী চার্লস মার্টেল। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী কোনো প্রভাব ছিল কি?
সমসাময়িক ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরা ট্যুরসকে মুসলিম শক্তির বিপক্ষে খ্রিষ্টীয় রাজ্যের ফলাফল নির্ধারণী লড়াই বলে উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে, ট্যুরসের যুদ্ধের ফলেই আন্দালুসিয়া থেকে ফ্রান্সে বিস্তৃত হয়নি মুসলিম সাম্রাজ্য। তাহলে ধরে নিতে হবে চার্লস উমাইয়াদের আক্রমণাত্মক যুদ্ধের ক্ষমতা নষ্ট করে দিয়েছিলেন, অথবা এমন ভীতি ধরিয়ে দিয়েছিলেন যে আর এমুখো হয়নি তারা।
ইতিহাস কিন্তু এই দুই মতের কোনোটিই সমর্থন করে না। ট্যুরসের যুদ্ধের প্রভাব, আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে, একেবারেই কম। কারণ ট্যুরসের কারণে উমাইয়া অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফ্রান্সে অনুপ্রবেশের চেষ্টায় ক্ষান্ত দেননি তারা, ফ্রাঙ্করাও ধরে নেয়নি যে সব শেষ হয়ে গেছে। এরপরেও সেখানে অনেকবার অভিযান চালানো হয়েছে মুসলিম স্পেন থেকে।
চার্লসের জন্যেও খুব বেশি অর্থবহ ছিল না এই বিজয়। তিনি ওডোকে সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হন বটে, কিন্তু ওডোর মৃত্যুর পর তার ছেলে হুনাল্ড (Hunald) স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। চার্লস সসৈন্যে বোর্দোর সামনে উপস্থিত হলে অ্যাকুয়াটাইন আপাতত শান্ত হয়, কিন্তু ৭৮১ খ্রিষ্টাব্দের আগপর্যন্ত একে মুঠোয় নিতে পারেনি ফ্রাঙ্করা। সেই কাজ সম্পাদন করেন চার্লসের নাতি শার্লেম্যাইন (Charlemagne)।
পরবর্তী অভিযানসমূহ
ট্যুরসের যুদ্ধের পর সীমান্তে চলতে থাকে দুই পক্ষের সংঘাত। অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সেনাবাহিনীতে কিছু পরিবর্তন করেন উমাইয়া জেনারেলরা। ফ্রাঙ্কদের পদাতিক বাহিনীর সাথে অশ্বারোহীদের সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়ে যান তারা।
৭৩৪/৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দে আন্দালুসিয়ার গভর্নর উকবা ইবন আল-হাজ্জাজ (Uqba ibn al-Ḥajjāj) অ্যাকুয়াটাইনে নতুন অভিযানের পরিকল্পনা করেন। নার্বোনের শাসক ইউসুফের সাথে মিলে ধুকে পড়েন রোন উপত্যকা (Uqba ibn al-Ḥajjāj) দিয়ে। নিমস আর কারকাসোন (Carcassonne) নগরী দখল করেন ইউসুফ। উকবা ছিনিয়ে নেন বারগ্যান্ডি আর ডফিন (Dauphiné) অঞ্চলের শহর ভ্যালেন্স আর লিঁও। ভিয়েনের (Vienne) এলাকা তছনছ করে দেয় তার সেনারা।
ফ্রান্সের প্রভেন্সের ডিউক মাউরোন্টাসের (Maurontus) সাথে চুক্তি করেন ইউসুফ। তিনি তাদের স্বাগত জানালেন তার অঞ্চল অ্যাভিনিয়নে (Avignon)। চার্লস মার্টেল তখন ফ্রাইজিয়াতে ব্যস্ত। ৭৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পুরো শক্তি নিয়ে এগিয়ে এলেন। অ্যাভিনিয়নের লড়াইতে পিছু হটে যান ইউসুফ। কিন্তু তাকে নার্বোন থেকে সরাতে ব্যর্থ হয় ফ্রাঙ্করা।
৭৩৯-৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে ইউসুফ আর উকবা দ্বিতীয়বার হামলা চালান ফ্রাঙ্কিশ সাম্রাজ্যে। এবার চার্লস বেকায়দায় ছিলেন। তিনি ইতালিতে লম্বার্ড জাতির রাজার কাছে সাহায্য চান। সম্মিলিত বাহিনীর সামনে আবার ধাক্কা খায় উমাইয়ারা। চার্লস এরপর মাউরোন্টাসের থেকে প্রভেন্স ছিনিয়ে নেন।
ফ্রান্সে অভিযানের অবসান
কোনো যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে ফ্রান্সে অভিযান বন্ধ করেনি উমাইয়ারা। আসল কারণ ক্ষমতার পটপরিবর্তন। ইউসুফ আর উকবার দ্বিতীয় হামলার সময়েই উত্তর আফ্রিকায় বার্বার বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। সেদিকে নজর দিতে গিয়ে অভিযান অব্যাহত রাখতে পারেনি তারা। ওদিকে খিলাফত নিয়ে আরম্ভ হয় উমাইয়া আর আব্বাসীয়দের দ্বন্দ্ব। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে আব্বাসীয়রা উমাইয়াদের সরিয়ে বাগদাদকেন্দ্রিক খেলাফতের পত্তন করে। তারা সামরিক অভিযানের থেকে বেশি জোর দেয় ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর। পশ্চিম ইউরোপ তাদের থেকে বহুদূর, এবং এখানে রক্তপাতের কোনো সুফল দেখতে পায়নি আব্বাসীয়রা।
চার্লস মার্টেল মারা যান ৭৪১ খ্রিষ্টাব্দে। ফ্রান্সে তখন মুসলিম অভিযান স্থগিত, কিন্তু সীমান্ত নিয়ে ছোটখাট সংঘাত লেগেই থাকত। আরো ৬০ বছর পর শার্লেম্যাইন বার্সেলোনা দখল করে নেন। তিনি মুসলিম স্পেনের সাথে বাফার জোন হিসেবে বার্সেলোনা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলকে ব্যবহার করেন, যার নাম হয় স্প্যানিশ মার্চ (Spanish March)। এখান থেকেই মূলত সূচনা হয় রিকনকুইস্তা (Reconquista), যেখানে স্পেনে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় খ্রিষ্টীয় আধিপত্য। তবে সেই গল্প অন্য কোনোদিন করা যাবে।