১
১৫৫৬ সালের ২৪ জানুয়ারি নিজের ব্যক্তিগত লাইব্রেরির সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে সম্রাট হুমায়ুন মারাত্মকভাবে আহত হন এবং এর দুদিন পরে অর্থাৎ, ২৬ জানুয়ারি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে তিনি আল্লাহর কাছে চলে যান। হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধার করেই তিনি আকবরকে নিজের উত্তরাধিকারী এবং মুঘল মসনদের একমাত্র দাবীদার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু, হঠাৎ উদ্ভুত এই পরিস্থিতি কিছুতেই বালক আকবরের অনুকূলে যেত না। কারণ, বয়স অল্প হওয়ায় মুঘলদের মাঝে অনেকেরই আকবরকে উৎখাত করে মসনদ দখল করে নেয়ার সম্ভাবনা ছিলো।
সবদিক বিবেচনা করে সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর ঘটনা বেশ কয়েকদিন গোপন রাখা হয়। সম্রাটের মৃত্যুর ১৭ দিন পর তার মৃত্যুর ঘটনা প্রকাশ করা হয়, এবং সেদিনই দিল্লির মসজিদে আকবরের নামে খুতবা পাঠ করে তাকে মুঘল সালতানাতের উত্তরাধীকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
মজার ব্যাপার হলো, এসময় আকবর দিল্লিতে ছিলেন না। তিনি ছিলেন দিল্লি থেকে বহুদূরে কালানৌরে আফগানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত অবস্থায়। সাথে ছিলেন হুমায়ুনের বিশ্বস্ত আমির ও খান-ই-খানান বৈরাম খান। বৈরাম খান যখন সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যু সংবাদ পান, দ্রুত তিনি আকবরের অভিষেকের ব্যবস্থা করেন।
দিল্লিতে আকবরের নামে খুতবা পড়ানোর চতুর্থ দিন, অর্থাৎ, ১৫৫৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সম্রাট হিসেবে আকবরের অভিষেক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্রাটের দায়িত্ব বুঝে নেন। এরপর তিনি তারদি বেগকে দিল্লির গভর্নর নিযুক্ত করে ৫,০০০ সৈন্যসহ দিল্লি পাঠিয়ে দেন। অন্যদিকে, সম্রাট আকবর নিজে আফগানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। জুনে প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হলে সেনাবাহিনীসহ তিনি জলন্ধরের দিকে সরে যান।
এদিকে আগ্রা, দিল্লি আর মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশ নিয়ে তখন চলছে চতুর্মুখী খেলা। সম্রাট হুমায়ুন এখন আর নেই, মুঘল মসনদে তার বালকপুত্র আকবর। এই ছেলে আর কী-ই বা করতে পারবে? এখনই তো সময় মুঘলদের হিন্দুস্তান থেকে ঝাড়ে-বংশে সাফ করে ফেলার!
২
সম্রাট হুমায়ুন হিন্দুস্তান থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর হিন্দুস্তানের উপর দিয়ে অনেক ঝড়ই বয়ে যায়। আফগান নেতা শের শাহ যতদিন হিন্দুস্তান শাসন করেছিলেন, ততদিন হিন্দুস্তান বেশ শক্তপোক্ত ভিত্তির উপরেই দাঁড়িয়ে ছিলো, হিন্দুস্তানের সার্বিক অবস্থাও বেশ ভালো ছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তিনি বেশিদিন শাসন করতে পারেননি। শের শাহের মৃত্যুর প্রায় পর পরই আফগানরা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে হিন্দুস্তানে মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকা আফগান শাসন টলে যায়। শের শাহের দুর্বল উত্তরাধিকারীদের ক্ষমতালিপ্সার কারণে পুরো সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক স্থবিরতার মুখে দাঁড়িয়ে যায় হিন্দুস্তান। এসময় দিল্লি আর আগ্রাসহ মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যান্য শহরগুলো প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। রোগবালাই ছড়িয়ে পরে জীবন প্রায় দুর্বিষহ হয়ে পড়ে।
সম্রাট হুমায়ুন যখন আবার দিল্লি আর আগ্রার দায়িত্ব বুঝে পান, তখন সব গুছিয়ে নেয়ার আগেই আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হন। ফলে আকবর সম্রাট হিসেবে যেমন সাবেক মুঘল সাম্রাজ্যের খুব অল্পই ভূখন্ড পান, ঠিক তেমনই যা পেয়েছেন, তা-ও পেয়েছেন প্রায় একরকম ধ্বংসস্তুপের মতোই। মুঘল জেনারেলরা অবশ্য সমগ্র রাজ্যে ছড়িয়ে গিয়েছিলেন। নানা প্রান্ত থেকে বিজয়ের সংবাদ আসছিলো। তবে এর মাঝেও কাশ্মীরে স্থানীয় শাসন চলছিলো, অন্যদিকে বাংলায় সুরি শাসকরা তখনো বেশ শক্ত অবস্থান নিয়ে বসে ছিলেন।
এদিকে আফগান শাসক আদিল শাহ বিহারে বেশ শক্তিশালী অবস্থায় ছিলেন। অন্যদিকে, সম্রাট হুমায়ুন হিন্দুস্তান থেকে বিতাড়িত হওয়ার সুযোগে রাজপুতরাও নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। হুমায়ুনের মৃত্যুর পর আকবর মসনদে বসলে মেবার, যোধপুর, জয়সলমীর আর বুন্দি মুঘলদের নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাতে থাকে। এছাড়া খান্দেশ, বেরার, বিদর, গোলকুন্ডা, আহমেদনগর আর বিজাপুরের মতো ছোট ছোট মুসলিম রাজ্যগুলোও মুঘলদের প্রভাব থেকে বের হয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে থাকে। একই পথের যাত্রী হয়েছিলো বিজয়নগরও।
বিপদের শেষ শুধু এসবই না। এসময় আরব সাগরের উপকূলে পর্তুগিজদের মতো বর্বর শক্তিও বেশ শক্ত আসন গেঁড়ে বসে। পশ্চিম উপকূলের দমন, গোয়া আর দিউ তাদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। সব মিলিয়ে বলা যায়, সামলানোর জন্য এতসব বিপদ আকবরের মতো বালক সম্রাটের জন্য একটু বেশিই বিপদজ্জনক হয়ে উঠেছিলো। তবে মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য সবচেয়ে বিপদজ্জনক হয়ে উঠছিলো আদিল শাহের হিন্দু সেনাপতি হিমু।
মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য দুঃসংবাদ। পূর্বদিক থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের দিকে তখন ধেয়ে আসছিলো ভয়ঙ্কর এক শক্তি!
৩
বর্তমান ভারতের হরিয়ানার রেওয়ারীতে জন্ম নেয়া হিমুর আসল নাম হেমচন্দ্র। হিন্দু ধর্মীয় বর্ণপ্রথার বিভাজন অনুযায়ী তিনি ছিলেন বৈশ্য বর্ণের। প্রাথমিক জীবনে লবণের ব্যবসা করতেন। সুরি শাসক ইসলাম শাহের নেকনজরে পড়েন মূলত তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার জন্য। হিমুও ইসলাম শাহের প্রতি বিশ্বস্ত হয়ে উঠলেন। প্রথমে আফগান সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনা বিভাগে কাজ করেন। এরপর ইসলাম শাহ তাকে দরবারে স্থান দেন। এসময় হিমু বেশ নিষ্ঠার সাথে আফগান সরকারে কাজ করতে থাকেন।
ইসলাম শাহ মারা যান ১৫৫৩ সালের ৩০ অক্টোবর। ইসলাম শাহের পর দিল্লির মসনদে বসেন তার ১২ বছরের পুত্র ফিরোজ শাহ সুরি। এর তিনদিন পরেই নতুন এই সুলতানকে হত্যা করে মসনদে বসেন শের শাহের ভাই নিজাম খানের পুত্র মুবারিজ খান। তিনি উপাধি নিলেন আদিল শাহ। হিমু আদিল শাহের এতটাই বিশ্বস্ত ছিলেন যে, আদিল শাহ হিমুকে তার প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে বসলেন! তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন আর প্রচন্ড পরিশ্রমী হিমুও তার বিশ্বস্ততার চূড়ান্তটা দেখালেন। আদিল শাহের জন্য বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তিনি মোট ২৪টি যুদ্ধ করেছিলেন, এর ভেতর ২২টিতেই তিনি জয়ী হয়েছিলেন।
সম্রাট হুমায়ুন যখন ইন্তেকাল করলেন, হিমু তখন বঙ্গে বঙ্গের সুলতান মুহাম্মদ শাহকে পরাজিত ও হত্যা করেন। সম্রাট হুমায়ুনের এভাবে হুট করে চলে যাওয়ায় হিমু নিজের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখতে পেলেন। এসময় থেকেই তিনি দিল্লি দখলের স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন। অনতিবিলম্বে হিমু দিল্লির দিকে যাত্রা শুরু করলেন।
পূর্ব দিক থেকে এক ভয়ংকর শক্তি নিয়ে এগোচ্ছিলেন হিমু। তার সাথে ৫০,০০০ সৈন্যের বিশাল এক বাহিনী। চুনার হয়ে ইতাবা, কালপি, আগ্রা আর বায়ানা হয়ে যাত্রা করলেন। পথে যতগুলো মুঘল সেনাঘাঁটি চোখে পড়লো, সবগুলোকে দখল করে নিলেন। যেখানে মুঘলদের থিতু হয়ে বসার কথা, তা না হয়ে মুঘলরা আবারও ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলেন। বলতে গেলে বিনা বাধায় আগ্রা হিমুর দখলে চলে গেলো। আগ্রা থেকে হিমু বিপুল সম্পদ আর অস্ত্রশস্ত্র দখল করলেন। এরপর বাহিনীতে আরও হিন্দু সৈন্য নিয়োগ দিয়ে গোয়ালিয়র দুর্গকে নিজের ঘাঁটি বানান।
এবার হিমুর পরবর্তী গন্তব্য দিল্লি!
৪
সমসাময়িক সময়ে আদিল খানকে ডাকা হতো ‘আঁদলি’ নামে। নারী আর মদের নেশায় বুদ হয়ে পড়ে থাকা এ শাসকের জন্য নামটি বেশ মানানসই ছিলো। ‘আঁদলি’ শব্দটির অর্থ হলো অন্ধ। আদিল শাহ ভাবছিলেন হিমু তার জন্য এসব করছে। কিন্তু, অন্ধ ও মূর্খ এই শাসক জানতেন না, হিমুর মাথায় অন্য কিছু ঘুরছিলো। হিন্দুস্তান থেকে তিনি শুধু মুঘলদেরই না, বরং সমগ্র মুসলিম শাসনই উপড়ে ফেলতে চাচ্ছিলেন। মুঘলদের দুরাবস্থার এই প্রেক্ষিতে তিনি আবারও দিল্লিতে হিন্দু শাসন দেখার স্বপ্ন দেখতে লাগলেন।
এদিকে, আকবর আর বৈরাম খানের কাছে জরুরি বার্তা পাঠানো হলো। বার্তা পাঠালেন দিল্লির গভর্নর তারদি বেগ। আগ্রাসহ মুঘল সাম্রাজ্যের বেশ কিছু ভূমি হিমুর দখলে চলে গেছে, তা-ও জানানো হলো। বৈরাম খান পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পারলেন। তিনি দ্রুত পীর মুহাম্মদ শিরওয়ানীসহ আরও কয়েকজন মুঘল কমান্ডারকে দিল্লি পাঠালেন।
তারদি বেগও হাত গুটিয়ে বসে না থেকে দিল্লির আশেপাশে থাকা মুঘল সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলোর কাছে সাহায্য চেয়ে বার্তা পাঠালেন। বার্তার প্রেক্ষিতে সাড়াও দেয়া হলো। এদিকে হিমু সবেমাত্র তুঘলকাবাদে তার শিবির স্থাপন করলেন। দিনটি ছিলো ১৫৫৬ সালের ৬ অক্টোবর। হিমুর সাথে আছে ৫০,০০০ সৈন্য, ১,০০০ হাতি আর ৫১টি কামান।
পরের দিন অর্থাৎ, ৭ অক্টোবর দুই বাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি হলো। আব্দুল্লাহ খান উজবেককে অগ্রবর্তী বাহিনীর দায়িত্বে রেখে হায়দার মুহাম্মদ ডানবাহু ও সিকান্দার খান উজবেককে বাম্বাহুর দায়িত্বে মোতায়েন করা হলো। তারদি বেগ নিজে অবস্থান নিলেন মধ্যবাহিনীতে।
যুদ্ধের শুরুটা মুঘলদের জন্য ভালোই ছিলো। মুঘল যোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণ হজম করতে না পেরে একপর্যায়ে হিমুর বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলো। সুযোগ বুঝে সেনাবাহিনীর ডান আর বাম ইউনিট দুটি হিমুর বাহিনীর উপর উপর্যুপুরি চাপ তৈরি করতে থাকলো। হিমুর যোদ্ধারা মাটি কামড়ে সব সহ্য করে গেলো, তবে এবার আর সামলাতে পারলো না, হাল ছেড়ে দিলো। ছত্রভঙ্গ হয়ে হিমুর সেনারা পালিয়ে যেতে লাগলো।
ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারতো, তবে শেষ হলো না। হিমুর সৈন্যরা পালিয়ে গিয়েছে, তাই যুদ্ধ শেষ, এমন ভাবনা থেকেই তারদি বেগের মূল বাহিনীর যোদ্ধারা বিশৃঙ্খল হয়ে গণিমত সংগ্রহের জন্য ছড়িয়ে গেলো। দূর থেকে বিষয়টি লক্ষ্য করলেন হিমু। তিনি ৩০০ হাতি আর তার রিজার্ভ বাহিনীর অশ্বারোহীদের নিয়ে তারদি বেগের উপর ভয়ঙ্কর এক মরণ কামড় দিলেন। তারদি বেগের সাথে এসময় সামান্য কিছু সৈন্য ছিলো। এ অবস্থায় ফল কী দাঁড়াতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। নিশ্চিত বিজয় মুঘলদের হাত ফঁসকে বেরিয়ে গেলো।
তারদি বেগের পরাজয়ে হিমুর সেনাবাহিনীর অন্যান্য বিচ্ছিন্ন ইউনিটও হিমুর পাশে এসে দাঁড়ালো। অন্যদিকে মুঘলরা সম্পূর্ণরূপে বিশৃঙ্খল হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে খাবি খেতে লাগলো। পরাজয় বুঝে মুঘল সৈন্যরা যে যেদিকে পারলো পালিয়ে গেলো। এত সহজে দিল্লি রক্ষার সুযোগ পেয়েও তা হারিয়ে বসলো মুঘলরা, তা-ও নিজেদের নির্বুদ্ধিতার কারণে।
তুঘলকাবাদের এ যুদ্ধের পর হিমু দিল্লি দখল করে নিলেন। তার হাতে মুঘল সাম্রাজ্যেই প্রধান দুটি শহর দিল্লি আর আগ্রা দুটিই পদানত হলো।
৫
দিল্লি রক্ষায় ব্যর্থ হয়ে তারদি বেগ পালালেন। আকবর ও বৈরাম খান এসময় সিরহিন্দের দিকে ছিলেন। পালিয়ে তিনিও সিরহিন্দে গেলেন।
বৈরাম খান ও তারদি বেগ বাস্তব জীবনে বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তারা একে অপরকে ভাই বলে সম্বোধন করতেন। তবে রাজক্ষমতার কাছে আপন ভাই-ই কিছু না, আর এ তো পাতানো ভাই। সত্যিকার অর্থে, একে অপরকে ভাই বলে ডাকলেও বৈরাম খান আর তারদি বেগ ক্ষমতার প্রশ্নে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। দুজনই দুজনকে রাজনৈতিকভাবে পুরোপুরি ধসিয়ে দেয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকতেন। ভাগ্যগুণে (!) সেই সুযোগটি আগে পেয়ে গেলেন বৈরাম খান। দিল্লি রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার অপরাধে তারদি বেগকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলো। বিচারে বৈরাম খানের ইশারায় অনেক জেনারেলই তারদি বেগের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন।
মৃত্যুদন্ড কার্যকরের বেলায়ও তারদি বেগের উপর অবিচার করা হলো। গুরুত্বপূর্ণ যে কাউকে মৃত্যুদন্ড দিতে হলে সম্রাটের নিকট থেকে সরাসরি আলাদা আলাদাভাবে তিনবার আদেশ নিতে হতো। তারদি বেগের বেলায় মাত্র একবার আদেশ নিয়েই তড়িঘড়ি করে বৈরাম খান তাকে হত্যা করান। হত্যার পূর্বমুহূর্তে তারদি বেগ মাগরিবের নামাজের জন্য অযু করতে যাচ্ছিলেন। বৈরাম খানের মনে আশঙ্কা ছিলো আকবর হয়তো তারদি বেগকে ক্ষমা করে দিতে পারেন!
যা-ই হোক, তারদি বেগের মৃত্যুর কথা আকবরের কানে গেলে তিনি বৈরাম খানকে ডেকে ব্যাখ্যা চাইলেন। বৈরাম খান বললেন সম্রাটের থেকে তো একবার অনুমতি নেয়াই হয়েছে। আবার অনুমতি লাগতে পারে, এটা তিনি ভাবেননি। যুক্তি হিসেবে খুবই কাঁচা ছিলো এটা, তবে বালক আকবর এই যুক্তি মেনে নিলেন।
৬
এদিকে দিল্লিতে চলছে উৎসব। সাড়ে ৩০০ বছরের পর দিল্লি আবারও হিন্দু শাসনাধীনে এসেছে। যুদ্ধ জয়ের পরেই হিমু নিজেকে দিল্লির স্বাধীন শাসক হিসেবে ঘোষণা দেন। উপাধিসহ তার নাম হয় রাজা হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্য।
হিন্দু রীতিতে মাথায় রাজছত্র ধরা হয় আর গঙ্গার পবিত্র পানি ছিটিয়ে হিমুকে পবিত্র করা হয়। দিল্লির মসনদ দখল উপলক্ষ্যে হিমু ভোজের আয়োজন করে। ৩/৪ দিন ধরে চলা এ ভোজ অনুষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষ আপ্যায়িত হয়েছিলো। এদের মাঝে যেমন ছিলেন রাজপুতরা, তেমনই ছিলেন আফগানরা। দিল্লি পতনের এ ঘটনা তারা কীভাবে দেখছিলেন কে জানে!
দিল্লি দখলের পর এবার হিমু হাত দিলেন সেনাবাহিনী পুনর্গঠনে। এতদিন তিনি মূলত আফগান সুলতান আদিল শাহ সুরির হয়ে লড়াই করছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তার সেনাবাহিনীতে আফগান মুসলিম সেনাদের আধিক্য ছিলো। হিমু সেনাবাহিনীর এই অবস্থা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলেন। অল্প কয়েকদিনেই বিপুল পরিমাণ হিন্দু যোদ্ধা সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হলো। সেই সাথে আরও উন্নত কামান নির্মাণের জন্য বর্বর পর্তুগিজদের সাথে চুক্তি করলেন। অন্যদিকে, নিজের ভাগিনা রামচন্দ্রকে সেনাবাহিনীর উপরের দিকে তুলে আনলেন।
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, হিমু এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করলেন যে, একদিকে তো তিনি মুঘলদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেনই, এখন সেই সাথে আফগানদেরও নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে ফেললেন। অবশ্য তিনি পত্রের মাধ্যমে আদিল শাহকে জানালেন যে, তিনি তারই অধীনস্ত হিসেবে দিল্লি শাসন করবেন।
৭
দিল্লি দখলের পর হিমুর কর্মকান্ডের ব্যাপারে ঐতিহাসিকরা একাধিক মত দিয়েছেন। একদল মত দিয়েছেন, দিল্লি দখলের পর হিমু নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। বেশিরভাগ হিন্দু ঐতিহাসিকই এই মতের পক্ষে জোর দেন। কারণ, এতে দিল্লির উপর হিমুর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। এমনকি এখনও হিমুকেই দিল্লির শেষ স্বাধীন হিন্দু রাজা হিসেবে সম্মান দেয়া হয়।
অন্যদিকে, আরেকদল ঐতিহাসিকের বক্তব্য হলো, বাস্তবতার সাথে হিমুর কর্মকান্ড মেলে না। কারণ, আকবর তখনও দিল্লির বাদশাহ। আর হিমু আকবরকে পরাজিত তো করতে পারেনইনি, বরং হিমুর সাথে আকবরের তখন পর্যন্ত সরাসরি কোনো সংঘাতই হয়নি। এ অবস্থায় মসনদে নিজের দাবীর স্বপক্ষে বৈধতা পাওয়া কীভাবে সম্ভব!
তবে অবস্থা যা-ই হোক না কেন, বাস্তবতা হলো, বালক আকবর বাদশাহ হয়েই দেখলেন তার সাম্রাজ্যের দুটি রাজধানীই শত্রুর দখলে চলে গেছে। বলতে গেলে তার মসনদই কেড়ে নেয়া সম্পন্ন হয়ে গেছে। এখন, হিন্দুস্তান এবং মুঘল সাম্রাজ্যের ভাগ্য নির্ভর করছে হিমুকে পরাজিত করার উপর। বালক আকবররে জন্য তা বেশ কষ্টকরই। তবে সৌভাগ্য, আকবরের সাথে রয়ে গেছেন বৈরাম খান, খান-ই-খানান বৈরাম খান!
[এই সিরিজের পূর্বের প্রকাশিত পর্বটি পড়ুন এখানে। সিরিজের সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।]