Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ব্ল্যাক ডেথের অদ্ভুত যত চিকিৎসা

ব্ল্যাক ডেথ থেকে রক্ষা পাওয়ার অদ্ভুত ঘটনা নিয়ে বলার আগে জিনিসটা সম্পর্কে কিছুটা প্রাথমিক ধারণা দেওয়া যাক। ১৩৪৬ সালে ১৩৫১ সাল পর্যন্ত চলা এই মহামারীর উৎপত্তি অনুমান করা হয় মধ্য এশিয়ার মালভূমিতে। এরপর সিল্ক রোড পেরিয়ে পৌছে যায় ইউরোপের বন্দরে। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে পুরো ইউরোপ, ভারত, চীন, মধ্যপ্রাচ্য এমনকি আফ্রিকাতেও। পৃথিবীজুড়ে প্রায় সাড়ে সাত কোটি থেকে বিশ কোটি মানুষ প্রাণ হারায় এই ভয়াবহ, বীভৎস রোগে, ইউরোপের জনসংখ্যা কমে যায় এক-তৃতীয়াংশে যা পরবর্তী চার শতকেও পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

প্রথমে এই রোগে আক্রান্ত নারী ও পুরুষ কবজি বা বগলের কোনো স্থানে টিউমারের মতো কোনো কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করে। ধীরে ধীরে সেটি বড় হতে থাকে। এক পর্যায়ে এটি আপেল বা ডিমের আকৃতির মতো ধারণ করে ও ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কালো রঙের এই ফোঁড়া অত্যন্ত বেদনাদায়ক হয়। রোগাক্রান্ত ব্যক্তি তার সারা শরীরে এটি দেখতে পায়। এক পর্যায়ে এগুলো পচে যায় ও পুঁজ বের হতে থাকে।

এই নারকীয় মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইউরোপিয়ানরা এমন কিছু পদ্ধতি বেছে নিয়েছিল যেগুলো স্বয়ং রোগ থেকেও কম ভয়ঙ্কর নয়। প্লেগের শিকার হওয়া মানুষগুলো তাদের মৃত্যুশয্যায় পাওয়া অদ্ভুত উপদেশগুলোই তুলে ধরা হলো। আরেকটা ব্যাপার, উপরের কালো টুপিওয়ালা এবং লম্বা মুখোশওয়ালা ছবি দেখে যদি মনে হয় এর সাথে ব্ল্যাক ডেথের সম্পর্ক কি, তবে জেনে রাখুন ঐ যুগের ডাক্তাররা সংক্রামক রোগ এড়ানোর জন্য ঐ ধরণের পোষাক পরতেন!

সুগন্ধি পদ্ধতি

বর্তমান যুগেও প্লেগের প্রতিকার হিসেবে বড় ধরণের একটি ভুল ধারণা হলো সুগন্ধি ব্যবহার। এ কারণে ব্ল্যাক ডেথের সময়ে লোকদেরকে সবসময় সুগন্ধযুক্ত ফুল বহন করার নির্দেশ দেওয়া হত। ফুল না পাওয়া গেলে বিকল্প হিসেবে ঔষধি ফলের গোছা নিয়ে ঘোরার পরামর্শ দেওয়া হত!

সুগন্ধি ব্যবহারের সাথে যে প্লেগ রোগ প্রতিকারের কোনো সম্পর্কই নেই, তা কুসংস্কারাছন্ন লোকদের আর কে বোঝাবে? তবে ব্ল্যাক ডেথের ফলে সুবিধা পেয়েছিল সুগন্ধি বিক্রেতারা। পারফিউমের বল নামে পরিচিত “পোম্যান্ডার” ধনীদের কাছে বিক্রি করে ভালোই কামিয়ে নিয়েছিল পারফিউমিয়েরা। যাদের পোম্যান্ডার কেনার মতো সচ্ছলতা ছিল না, তারা স্রেফ দরজা-জানালা বন্ধ করে বদ্ধ ঘরে শুয়ে থাকত, যাতে বাইরের বাজে গন্ধ ঘরে প্রবেশ না করতে পারে। সুগন্ধি আজ থেকে সাতশ বছর আগেও কোনো কাজে আসত না, এখনো আসার প্রশ্নই ওঠে না।

ধর্মান্ধতা

মধ্যযুগ যে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে ধর্ম নিয়ে অনেক বেশি কুসংস্কারচ্ছন্ন ছিল তা বলাই বাহুল্য। ইউরোপের খ্রিষ্টান কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম সমাজে বেশ বড় ধরণের একটি ধারণা ছিল ব্ল্যাক ডেথ তাদের উপর খোদার কোনো গজব কিংবা সৃষ্টিকর্তা তাদের পরীক্ষা করছেন। ক্যাথলিকরা এ ধারণাকে আরও এক ধাপ উপরে নিয়ে গিয়েছিলেন, রাজপথে দাঁড়িয়ে তারা নিজেদের পিঠে নিজেরাই চাবুক মারতেন এবং সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন! কারণ সৃষ্টিকর্তা যখন শাস্তি দিচ্ছেন তখন আপনার কর্তব্য নিজেকে আরও বেশি শাস্তি দেওয়া!

নর্দমায় অবস্থান করা

ইউরোপের উপর দিয়ে প্লেগের ঝড় বয়ে যাওয়ার সময় অনেকের মনে হঠাৎ করেই ধারণা আসে নর্দমার দুর্গন্ধময় পরিবেশ তাদের ব্ল্যাক ডেথের সংক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে রাখবে! এ কারণে অনেকেই কিছুক্ষণ নর্দমায় থেকে আসতেন, এমনকি অনেকে বসবাসও শুরু করে দেন। কিন্তু এর ফলে ব্ল্যাক ডেথের হাত থেকে তো বাঁচা সম্ভবই হয়নি, উপরন্তু সুস্থ মানুষরা নর্দমার নোংরা পরিবেশে অন্য কোনো রোগের সংক্রমণে মারা যান।

রক্ত অপসারণ

ফোঁড়া থেকে শুরু করে ক্যান্সার যেকোনো রোগ প্রতিকারের জন্য ইউরোপে বেশ জনপ্রিয় একটি কুসংস্কার ছিল দেহ থেকে রক্ত অপসারণ করা। এ কারণে স্বচ্ছল ব্যক্তিরা জোঁকের শরণাপন্ন হতেন, কোনো ধরণের ব্যথা প্রয়োগ ছাড়াই জোঁক দেহ থেকে রক্ত শুষে নিতে পারে। কিন্তু সবার তো আর জোঁক কেনার সামর্থ্য ছিল না, এ কারণে প্লেগের শিকারে পরিণত হওয়া বেশিরভাগ ব্যক্তি পুরনো যুগের পদ্ধতিতে ঝুঁকে পড়েন, যেটি হলো ধারাল বস্তু দিয়ে নিজের চামড়া কেটে রক্ত বের করা!

ব্লেড দিয়ে শিরা পর্যন্ত কেটে ফেলে রক্ত ফেলে দিয়ে সে অবস্থাতেই রেখে দেওয়া হত। পরিচ্ছন্নতার অভাবে সেই ক্ষত থেকেই সংক্রমণ হত এবং গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হত। পেইন কিলারের অভাবে কোনো ধরণের উপকার ছাড়াই ভয়াবহ ব্যাথা সহ্য করতে হত কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্লেগের শিকার হওয়া এ সকল ব্যক্তিকে।

রত্ন চূর্ণ ভক্ষণ

প্লেগ প্রতিকারের জন্য অভিজাত সমাজের আরেকটি অদ্ভুত প্রতিকারের পদ্ধতি ছিল রত্ন বিশেষ করে পান্নার গুড়ো খাওয়া! মূল্যবান রত্নগুলোকে গুড়ো করে পাউডার বানিয়ে পানিতে মিশিয়ে কিংবা রুটি দিয়ে এমনকি সরাসরিও খেয়ে ফেলা হত। অনেকটা কাচের গুড়োর মতো এই খাবার অভিজাতদেরকে বাধ্য হয়েই খেতে হত, বর্তমানকালের বিলিয়নিয়ারদের মতো সোনার পিজ্জার মতো বিলাসিতার জন্য নয়।

মূত্রস্নান

ব্ল্যাক ডেথের সময় চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে যে জিনিসটি ঠিকঠাকভাবেই পাওয়া যেত তা হল মূত্র! প্লেগের শিকার হওয়ার পর বেঁচে থাকার জন্য রোগীকে দিনে বেশ কয়েকবার মূত্রস্নান করানো হত!

বর্তমানে অসুস্থ রোগীকে দেখতে গেলে যেমন ফল কিংবা জুস দেওয়া হয়, ব্ল্যাক ডেথের সময় সেরকমভাবেই মূত্র দেওয়া হত! অর্থাৎ ব্ল্যাক ডেথের কবলে পড়েনি এরকম কারোর মূত্রই প্রয়োজন হত। শুধু মধ্যযুগ নয়, এই আধুনিক যুগেও বিভিন্ন রোগ; যেমন- ফোঁড়া ইত্যাদির প্রতিকার হিসেবে মূত্রস্নান করা হয়, বিশেষ করে সূর্যগ্রহণের দেখার পর কুসংস্কারবশত অনেকেই মূত্র দিয়ে চোখ ধুয়ে ফেলেন!

মনুষ্যবিষ্ঠা

কোনো রোগী কখনোই চাইবে না মনুষ্যবিষ্ঠার সংস্পর্শে আসতে তা সে যত কঠিন রোগই হোক না কেন! কিন্তু ব্ল্যাক ডেথের ভয়াবহ রুপ মনে এতটাই ত্রাস এবং ভয় সৃষ্টি করেছিল যে মানুষ অনেক দ্বিধা করেও প্রাণ বাঁচানোর জন্য শেষমেশ না করে পারেনি।

প্রথমে গাছের আঠা, ফুলগাছের মূল এবং বিষ্ঠা মিশিয়ে পেস্টের মতো বানানো হত! তারপর ক্ষতস্থানের উপর এর প্রলেপ দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হত! তখন মানুষ প্লেগে মারা যেত নাকি এসব অদ্ভুত প্রতিকারের ব্যবস্থাতেই মারা যেত সেটাই এখন ভাববার বিষয়।

আর্সেনিক অথবা পারদ

প্লেগের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে অনেকেই এর প্রতিকারের আশায় ওষুধের খোঁজে ছুটে বেড়িয়েছে এদিক-সেদিক। মানুষের ভয়কে কাজে লাগিয়ে অনেক প্রতারকও ভালোই লাভ করেছিল। প্লেগের প্রতিকারের নামে তারা আর্সেনিক এবং পারদ মিশানো ওষুধ বিক্রি করত! যার কারণে প্লেগে মারা যাওয়ার অনেক আগেই পারদ-আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় লোকজন মারা যাওয়া শুরু করেছিল।

ভাইসারি পদ্ধতি

জগৎবিখ্যাত হাতুড়ে ডাক্তারের নামের তালিকা করলে একেবারে প্রথম সারিতেই থমাস ভাইসারির নাম থাকবে। ইংল্যান্ডের এই বিখ্যাত নকল ডাক্তার প্লেগের প্রতিকার করতে অদ্ভুত এক পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছিলেন। জ্যান্ত অবস্থাতেই মুরগির পশ্চাৎদেশের লোম কেটে ফেলে মুরগির লোম ছাড়ানো অংশটি দেহের ক্ষতস্থানের সাথে বেঁধে রাখা হত যতক্ষণ না পর্যন্ত মুরগি অসুস্থ হয়ে পড়ে!

থমাস ভাইসারের এই পদ্ধতি এত জনপ্রিয় হয়ে পড়ে যে ইংল্যান্ডের রয়্যাল সার্জন কলেজ তাকে সম্মান জানানোর উদেশ্যে প্রতি বছর বার্ষিক সম্মেলনের আয়োজন করে! প্লেগের সাথে সাথে মুরগির পরজীবী ছড়িয়ে দেওয়া ব্যক্তির জন্য বেশ বড় একটা অর্জনই বটে!

ইহুদী হত্যা

ব্ল্যাক ডেথের সময় এর কারণগুলোর অদ্ভুত সব গুজবের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ইহুদীরা এর পেছনে দায়ী! ইউরোপজুড়ে এই গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর ইউরোপের অনেক জায়গায় ইহুদীদের একজায়গায় করে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়! অনেক ইহুদীই অত্যাচারের ভয়ে প্লেগের মহামারীর পিছনে থাকা হিসেবে নিজেদের দোষ স্বীকার করে নেয়, যার কারণে এই গুজব ইউরোপীয় খ্রিষ্টানদের মনে আরও বদ্ধমূল হয়ে গেড়ে বসে। ইউরোপে ইহুদী হত্যা সীমা ছাড়িয়ে গেলে স্বয়ং পোপ সপ্তম ক্লিমেন্টকে বাধ্য হয়ে খ্রিষ্টানদেরকে থামানোর জন্য ঘোষণা করতে হয় প্লেগে মারা যাওয়া সবাইকেই ঈশ্বর ক্ষমা করে দিয়েছেন!

 

 

Related Articles