Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ব্রাউন মাউন্টেইন লাইটস: যে আলো মানুষ অপহরণ করে!

আমেরিকার নর্থ ক্যারোলাইনা রাজ্যের একটি নিচু শৈলশিরা নর্থ মাউন্টেইন। দিনের বেলা দেখতে শান্ত, নির্জন পাহাড় মনে হলেও রাতে এর আরেক রুপ দেখা যায়। রাতের আকাশে প্রায়ই দেখা যায় ছোট ছোট আলোর বলের মতো কিছু বস্তু। প্রথম দর্শনে তারা ভেবে ভুল হতে পারে। কিন্তু এই আলোর বলের অস্বাভাবিক নড়াচড়া দেখে সেই ভুল খুব তাড়াতাড়িই ভেঙে যায়। দেখে মনে হয় আলোর বলগুলো অভিকর্ষের কোনো নিয়মই মানছে না। চোখের পলকেই ডানে-বায়ে, উপরে-নিচে, পাহাড়ের একপাশ থেকে অন্যপাশে কোনো বাঁক না নিয়েই চলে যায় এই আলোর বল।

Day image of Brown mountain
দিনের ব্রাউন মাউন্টেইন; Image Source: romanticasheville.com

অদ্ভুতুড়ে এই আলোকবলয় দেখতে যতটা সুন্দর তার থেকে বেশি ভয়ংকর। কারণ এই আলোর বল দেখা দেওয়ার সাথে অন্য একটি বিষয়ও সম্পর্কিত। আর তা হলো, যখন এই আলোর বলগুলো পাহাড়ের উপরে দেখা যায় তখন তখন ওই পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়া মানুষ নিখোঁজ হয়! অনেক মানুষ পাহাড়ে ঘুরতে যায় ঠিকই। কিন্তু রাত কাটানো সবাই ফিরে আসে না। অনেক সময় যারা নিখোঁজ হওয়া মানুষদের খুঁজতে যায় তারাও অনেকে ফেরে না। এই নিখোঁজ হওয়া নিয়ে ওই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন গল্প প্রচলিত আছে।

এই নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা আমেরিকার ঔপনিবেশিক আমলেরও আগে থেকে চলে আসছে। ঐতিহাসিক ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দ্বাদশ শতকে আমেরিকার আদিবাসী চেরোকে ইন্ডিয়ানদের কাছে আলোর বলগুলোর দেখা যাওয়ার কথা প্রথম শোনা যায়। আদিবাসী ইন্ডিয়ান উপকথা অনুযায়ী- ঐ সময়ে ব্রাউন মাউন্টেইনের পাদদেশে চেরোকে আর কাটা’বা ইন্ডিয়ানদের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে দুই পক্ষেরই সৈন্য নিহত হয়। আর ওই আলোগুলো তখন থেকেই দেখা যাচ্ছে। তারা মনে করে, ঐ আলোর বল হলো যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের মৃত বিধবা স্ত্রীদের আত্মা। এরা খুঁজতেই পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়। তারপর থেকেই নাকি পাহাড়ের আকাশে যখন এই আলোর বল দেখা যায় তখন মানুষ নিখোঁজ হয়!

ghost lights
Image Source: ghosthuntingtheories.com/

ব্রিটিশ আর স্প্যানিশরা যখন এই অঞ্চলে আসে তখন তারাও একই রকম ঘটনার সম্মুখীন হয়। সবচেয়ে প্রচলিত গল্পগুলোর একটা হলো একজন কারখানা মালিকের, যিনি ওই পাহাড়ে শিকারে যান এবং রাত হয়ে যাওয়ার পরও কারখানায় আর ফিরে আসেন না। রাত গভীর হলে তার কারখানার ক্রীতদাসরা লন্ঠন নিয়ে মালিকের সন্ধানে পাহাড়ে যায়। শোনা যায়, এই দাসদের কেউই পাহাড় থেকে ফিরে আসেনি। কারখানা মালিক এবং দাসদের সাথে আসলে কী হয়েছিল কেউ জানে না। এরপর পাহাড়ের ভীতি লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে।

আরও একটি গল্প প্রচলিত আছে। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত বছর নিখোঁজের ঘটনা শোনা যায়নি। আবার পাহাড়ে ভ্রমণকারীরা রাত কাটাতে শুরু করে। ১৮৫০ সালে একজন মহিলা সন্ধার দিকে ব্রাউন মাউন্টেইনে ঘুরতে যান। রাত গভীর হলেও তিনি ফিরে না আসলে তার স্বামী লোকাল কমিউনিটিতে জানিয়ে তার স্ত্রীকে খুঁজতে স্থানীয়দের সাহায্য চান। কিন্তু সবাই ধারণা করে যে ঐ মহিলার স্বামীই খুন করেছে ওই মহিলাকে। এলাকার প্রায় সবাই সেই মহিলাকে খুঁজতে বের হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে সবাই পাহাড়ে সেই মহিলাকে খুঁজবে। অনেকক্ষণ খুঁজেও মহিলার সন্ধান পাওয়া যায়নি।

রাত ঘনিয়ে আসলে আকাশে ওরকম অদ্ভুত আলো দেখা যায়। কেউ কেউ ভাবে যে, সেই মৃত মহিলার আত্মা তার খুনের বদলা নিতে এসেছে। অনেকেই ভয় পেয়ে সেই মহিলাকে খোঁজা বন্ধ করতে অনুরোধ জানায়। ঠিক হয় যে সকালে ফিরে এসে আবার ঐ মহিলাকে খোঁজা হবে। কিন্তু সবাই যখন ফিরে আসে তখন দেখা যায় যারা খুঁজতে গিয়েছিল তারা অনেকেই ফেরেনি। স্থানীয় পুলিশও ভয়ে এগোয়নি। এরপর ভয়ে হারিয়ে যাওয়া লোকদের আর কেউ খুঁজতে যায়নি। এরপর অনেক দিন পর্যন্ত এই পাহাড়ে কেউ রাত কাটায়নি। তবে ১৯৮০ সালের পর থেকে আবারও ব্রাউন মাউন্টেইনে হাইকিং আর ক্যাম্পিং শুরু হয়। দলবেঁধে মানুষ এখানে ক্যাম্পফায়ার বানিয়ে রাত কাটানো শুরু করে।

সম্প্রতি ২০১১ সালের এক রাতে ঘটে আরো একটি ঘটনা। কয়েকশো প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করে তারা ব্রাউন মাউন্টেইনের আকাশে আলোর কয়েকটি বল দেখেছে। অনেকেই ছবি-ভিডিও তুলে রাখে। এই ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোড়ন তোলে। ওই রাতে ২৭ জন মানুষ নিখোঁজ হয় যাদের মধ্যে তিনজন পুলিশ অফিসারও ছিলেন। সরকারিভাবে উদ্ধার অভিযান চালালেও নিখোঁজ মানুষদের আর খু্ঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশ তদন্ত চালায়, কিন্তু তারা কোনো সুরাহা করতে পারেনি। স্থানীয় মানুষদের দাবি যে, মিলিটারি এবং বিশেষ কোনো সংস্থা ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

এছাড়া অনেক নিখোঁজের ঘটনা প্রায়ই স্থানীয় থানায় জানানো হয়। পুলিশ অনেকবার সার্চ মিশন চালালেও নিখোঁজ মানুষদের খুঁজে বের করতে পারেনি। অনেক সময় নিখোঁজ মানুষদের গাড়ি, ব্যবহৃত তাঁবু বা ব্যাগ পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় পাহাড়ে। এখনো এই পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় এসব পরিত্যক্ত জিনিস পড়ে থাকতে দেখা যায়।  

strange lights

রাতের আকাশে দেখা যাওয়া বিচিত্র আলো ; Image Source: supernaturalmagazine.com

বর্তমান সময়ে এই নিখোঁজের ঘটনা নিয়ে অনেক রকম জল্পনা কল্পনার সৃষ্টি হয়েছে মানুষের মনে। ঘটনার কারণ হিসেবে কেউ বলে যে, নিখোঁজ মানুষদের উপর গোপন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালানোর জন্য মিলিটারি ধরে নিয়ে গেছে, কেউ বলে কোনো মাফিয়া গ্যাং মানুষ ধরে নিয়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করে, আবার এখনো অনেকে বিশ্বাস করে এগুলো আত্মার কাজ। তবে বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আর একটি কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে, সেটি হলো ঐ আলোর বলয়গুলো আসলে অত্যাধুনিক এলিয়েন স্পেসশিপ (UFO)। এলিয়েনরা স্পেসশিপে করে পৃথিবীর মানুষ অপহরণ করে নিয়ে যায় পৃথিবীর বাইরে। মানুষ হল তাদের কাছে ল্যাবের গিনিপিগ! মানুষের উপর নানা রকম পরীক্ষা- নিরীক্ষা চালানো হলো এই এলিয়েনদের আসল উদ্দেশ্য।

প্রমাণ হিসেবে অনেকেই বলে প্রজেক্ট ব্লু-বুকের কথা। ১৯৫২ সালে আমেরিকান এয়ারফোর্স একটি গোপন প্রজেক্ট শুরু করে যার নাম প্রজেক্ট ব্লু-বুক। এই প্রজেক্টের উদ্দেশ্য ছিল এটা দেখা যে ইউএফও কি আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বয়ে আনবে কি না। প্রজেক্টের আওতায় ১২,৬১৮টি ইউএফও রিপোর্ট সংগ্রহ করা হয় এবং তা নিয়ে গবেষণা করা হয়। প্রজেক্টের একটা অংশ ছিল ব্রাউন মাউন্টেইন নিয়ে। সেখানে ১৯৫২-১৯৬৬ সালের কয়েকটি রিপোর্টে বলা হয় ব্রাউন মাউন্টেইনের অস্বাভাবিক আলোর বলগুলো নিয়ে। ১৯৬৯ সালে প্রজেক্টটি বন্ধ হয়ে যায়।

Project blue book
প্রজেক্ট ব্লু-বুক;  Image Source: theblackvault.com
Blue book  records
Project Blue Book Records, 18 July 1969;   Image Source: theblackvault.com

আধুনিক ইন্টারনেটের যুগে এই ধারণাটি আরো প্রসার লাভ করেছে। অনলাইনে কয়েকটি ওয়েবসাইট আছে শুধু ব্রাউন মাউন্টেইন লাইটস নিয়ে। ১৯৯৯ সালে এক টিভি সিরিজ বানানো হয়েছিল ব্রাউন মাউন্টেইনের আকাশে এলিয়েন মহাকাশযান এবং মানুষের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে। ২০১৪ সালে আমেরিকায় একটি চলচ্চিত্র বানানো হয় UFO Abduction নামে। সেখানে দেখানো হয় ১১ বছরের এক ছেলে এবং তার পরিবার কীভাবে ব্রাউন মাউন্টেইনে এলিয়েন আক্রমণের শিকার হয় এবং পুরো পরিবার নিয়ে নিখোঁজ হয়। সিনেমার পরিচালক দাবি করেন, সিনেমাটি একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এবং সিনেমার শুরুতে ও শেষে প্রজেক্ট ব্লু বুক থেকে কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করেন।

poster
Alien Abduction (2014) এর পোস্টার; Image Source: imdb.com

এলিয়েন, আত্মা, মিলিটারি বা কোনো মাফিয়া গ্যাংয়ের কারসাজি নাকি নিছক কোনো প্রাকৃতিক কারণে মানুষ হারিয়ে যায় তা সঠিক করে কেউ বলতে পারে না। প্রত্যেকটি কারণের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মানুষ যুক্তি দেখায়। কিন্তু এত বছর পরও আসল রহস্যের সমাধান হয়নি। হয়তো ব্রাউন মাউন্টেনের এই আলোর বলগুলো চিরকাল রহস্যই থেকে যাবে মানুষের কাছে।

প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘ইতিহাস’ বিভাগে এখন থেকে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/

Related Articles