দু চাকার যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে জন্ম নিলেও স্বল্প দামে সব সবধরনের মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ইঞ্জিনচালিত সাইকেল বা মোটর সাইকেল। যারা চার চাকার গাড়ি কিনতে পারত না, তারা যেমন মোটর সাইকেল ব্যবহার করতো, তেমনি ধনীদের মধ্যেও এই মোটর সাইকেল ছিল সমান জনপ্রিয়। ১৯৬০ এর দিকে ইংল্যান্ডে এই মোটর সাইকেল আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। তরুণরা এই সাব-কালচারকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। চিরাচরিত মোটর সাইকেলকে আরো দ্রুত গতিসম্পন্ন এবং একইসাথে ফ্যশনেবল করে তারা বানায় ‘ক্যাফে রেসার’।
ক্যাফে রেসার একধরনের হালকা ও শক্তিশালী মোটরসাইকেল, যা আরামের চেয়ে বরং গতি এবং সহজে হ্যান্ডল করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা হয়। ক্যাফে রেসার তাদের ভিজ্যুয়াল মিনিমালিজমের জন্য অল্প সময়েই জনপ্রিয়তা পায়। এতে লো-মাউন্ট হ্যান্ডল বার, কাস্টম সিট কাউলিং এবং অধিক ধারণক্ষমতার জ্বালানির ট্যাঙ্ক রয়েছে।
ইতিহাস
ক্যাফে রেসার সাব-কালচারের জন্ম হয় ৫০’এর দশকে, ইংল্যান্ডে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইংল্যান্ডে বাইক বেশ সহজলভ্য হয়ে ওঠে। অধিকাংশ পরিবার চার চাকার গাড়ি যেমন কিনতে পারতো, তেমনি পরিবারের তরুণরাও সাথে একটি মোটর সাইকেলও কিনতো। মোটর সাইকেল শুধু কম উপার্জনের মানুষের বাহন হয়ে থাকেনি, এটি হয়ে উঠল সব আয়ের মানুষের কাছে গতি এবং স্ট্যাটাসের অংশ। ঠিক এই সময়ে রক এন’ রোল কালচারের তরুণরা তাদের চিরাচরিত বাইকের ডিজাইন এবং ইঞ্জিনে পরিবর্তন নিয়ে আসে। এটি যেন ছিল প্রচলিত কালচারের বিরুদ্ধে বিপ্লবের মতো।
তৎকালীন রক সঙ্গীতের শ্রোতাদের জীবনে রক ব্যান্ডের প্রভাব ছিল। সাধারণ তরুণরা রক ব্যান্ডের সদস্যদের অনুকরণ করত। রক ব্যান্ডের সদস্যরা শহরের বিভিন্ন ক্যাফেতে আড্ডা দিত, তরুণদের মাঝেও এই ক্যাফে কালচার ছড়িয়ে পড়ে। শহরের বিভিন্ন ক্যাফেতে তারা আড্ডা দিত, আর এক ক্যাফে থেকে আরেক ক্যাফেতে যাওয়ার জন্য তারা মোটর সাইকেল ব্যবহার করত। তাদের জীবনযাপনের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য তারা তাদের মোটর সাইকেলে পরিবর্তন আনে। এ থেকেই জন্ম নেয় ক্যাফে রেসার।
ক্যাফে রেসার নামের উৎপত্তিও এভাবে হয়- এমন তরুণের দল, যারা ক্যাফেতে আড্ডা দেয় এবং মোটর সাইকেল নিয়ে রেস করে। এই তরুণরা ক্যাফেতে বসে অপেক্ষা করত, যদি কেউ এসে তাদের চ্যালেঞ্জ করে রেসের জন্য। কেউ চ্যালেঞ্জ করলে তারা সবাই দৌড়ে বাইরে গিয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করত আর অন্যরা হৈ হুল্লোড় করতো, কে জিতবে তা দেখার জন্য। ক্যাফের অন্য ট্রাক ড্রাইভাররা তাদের তখন বলত, “তোমরা প্রকৃত রেসার না, তোমরা শুধুমাত্র ক্যাফে রেসার”। তবে এই নামটাই ওই সময়ের তরুণদের পছন্দ হয়ে যায়। গড়ে ওঠে ক্যাফে রেসার কালচার।
ক্যাফে রেসারের জন্মস্থানের মধ্যে অন্যতম জায়গা হচ্ছে লন্ডনের ‘এইস ক্যাফে’। এই এস ক্যাফে, বিজি বী, ক্যাফে রাইজিং সানের মতো আরও কয়েকটি ক্যাফে টিনেজারদের আড্ডা দেওয়া আর বাইক পার্কিংয়ের জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এস ক্যাফে বাদে অন্য ক্যাফেগুলো অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ১৯৭০ পর্যন্ত ক্যাফে রেসার বাইকের মডিফিকেশন পার্টস কাস্টম-মেইড ছিল। তরুণরা তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগতির বাইক কিনত। এরপর সব খুলে ইঞ্জিন টিউন করে, নতুন বডি ওয়ার্ক করে, সিট আর হ্যান্ডল বদলে রাস্তায় রেসের জন্য নেমে পড়ত। অনেকসময় অ্যালুমিনিয়াম ফুয়েল ট্যাঙ্কে রংও করা হতো না।
তবে ১৯৭০ এর দিকে জাপানি বাইক কোম্পানিগুলো ক্যাফে রেসারে পরিবর্তন আনে। জাপানি বাইক কোম্পানি কাওয়াসাকি ফ্যাক্টরি মেইড ক্যাফে রেসার নিয়ে আসে। ফাইবার গ্লাস ফুয়েল ট্যাঙ্ক, থ্রি বা ফোর স্ট্রোক ইঞ্জিন, স্পোক হুইল ইত্যাদি ছিল জাপানি ক্যাফে রেসারের বৈশিষ্ট্য। ৭০ এর দশকে এই মোটর সাইকেল বিপ্লব অন্য বাইক কোম্পানিগুলোর নজরে আসে। ইতালিয়ান মোটো গুজ্জি, আমেরিকান হার্লে ডেভিডসন, জাপানি হোন্ডাসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি ক্যাফে রেসার বাইক বাজারে আনে।
৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইতালির বেনেলি, জার্মানির বি এম ডব্লিউ, স্পেনের বুল্ট্যাকো আর ডার্বি তাদের প্রচলিত বাইকের ফ্যাক্টরি মেইড ক্যাফে রেসার ভার্সন বাজারে আনে, এর ফলে কোন রকম মডিফিকেশনের দরকার ছাড়াই তরুণদের গতি এবং ভিন্টেজ ডিজাইনের চাহিদা মিটতো, যা বর্তমানে ‘রেডি টু রাইড’ ক্যাফে রেসার নামে পরিচিত। একবিংশ শতাব্দীতে ট্রায়াম্ফ, ইয়ামাহা, রয়্যাল এনফিল্ড, ডুক্যাটি, হোন্ডা ক্যাফে রেসার বেশ জনপ্রিয়। এছাড়া বর্তমান সময়ে ২০০০ সালের আগের বাইকগুলো মডিফাই করে ক্যাফে রেসার বানানোর ট্রেন্ড শুরু হয়েছে। বিভিন্ন দেশে বাইক কাস্টমাইজ করার জন্য আলাদাভাবে গ্যারেজ গড়ে উঠেছে।
ক্যাফে রেসার যেভাবে বানাবেন
প্রথমেই আপনাকে মনস্থির করতে হবে, আপনার সত্যিই ক্যাফে রেসার বাইকের প্রয়োজন আছে কি-না। কারণ আপনি একটি রেডিমেড বাইক অল্প দামে এবং কম ঝামেলায় পেতে পারেন, সেখানে একটি ক্যাফে রেসার বানাতে সময় এবং টাকা দুটোই আপনার বেশি প্রয়োজন হবে। তবে যদি আপনার পুরোনো রেট্রো স্টাইল বাইক থাকে, তবে জিনিসটা সহজ হবে।
প্রথমেই আপনার প্রয়োজন বাজেট ঠিক করা। কত সময় এবং টাকা ব্যয় করতে পারবে, তার ওপর আপনার ক্যাফে রেসার বাইক কেমন হবে- তা নির্ভর করছে। বাজেট ঠিক হলে আপনাকে নেমে পড়তে হবে মূল অস্ত্র খোঁজার কাজে, যা হচ্ছে কোন বাইক নিয়ে আপনি কাজ করবেন। বাংলাদেশে আপনি খুব ভালো ক্লাসিক বাইকের সন্ধান পাবেন না, তাই ১০০সিসির পুরোনো বাইকগুলো নিয়ে কাজ করা সুবিধাজনক। এতে পার্টস খোঁজার ঝামেলা কম হবে এবং টাকাও বাঁচবে।
ভারতে আপনি অনেক অপশন পাবেন বাইকের। হোন্ডা, ইয়ামাহা, এমনকি রয়্যাল এনফিল্ড আর হার্লে ডেভিডসন দিয়েও আপনি ভারতে কাস্টম ক্যাফে রেসার বানাতে পারবেন। তবে খেয়াল রাখবেন যে বাইকই বেছে নেবেন, একটু ভালো কন্ডিশনে নিতে। এতে ওই বাইকের সিট, হেডলাইট, হ্যান্ডলবার বিক্রি করে কিছু বাড়তি টাকাও উপার্জন করতে পারবেন।
এরপর আপনার কাজ হবে বাইকের সমস্যা খুঁজে বের করা, কারণ আপনি প্রায় ৩০ বা ৪০ বছরের পুরনো বাইক কিনবেন এবং এতে অসংখ্য সমস্যা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এগুলো ঠিক করতে কত টাকা এবং কী কী যন্ত্রপাতি লাগবে, তা জেনে নিন। এবার সম্পূর্ণ বাইকের সিট, ইঞ্জিন এবং আর সব অংশ খুলে ফেলুন এবং সমস্ত নষ্ট আর অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দিন। এতে আপনার বাইক পরিষ্কার করতে এবং নতুন করে কাজ শুরু করতে সুবিধা হবে।
এবার বাইকটিকে তার দ্বিতীয় জীবন দেওয়ার পালা। ইঞ্জিন ক্লিনিং থেকে শুরু করতে পারেন। ইঞ্জিনে লিকেজ থাকলে ঠিক করতে হবে। অয়েল ফিল্টার লাগবে নতুন, ইঞ্জিন অয়েল চেঞ্জ করতে হবে, গিয়ার বক্সে সমস্যা থাকতে পারে, জং ধরা সব বোল্ট বদলাতে হবে। ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। ইঞ্জিনে নতুন এক্সহস্ট লাগিয়ে এবং ইঞ্জিনে তেলের পরিমাণ বাড়িয়ে তা করা যেতে পারে। সিলিন্ডার, পিস্টন, ক্র্যাঙ্কস, রড মডিফাই করলে বেশি হর্সপাওয়ার পাওয়া যাবে। ফ্রেম এবং ইঞ্জিন কভার ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে, স্যান্ড ব্লাস্টিংও করতে পারেন। ফুয়েল ট্যাঙ্ক যদি আরও বড় করতে চান, তবে দক্ষ কাউকে দিয়ে করানো ভালো। যদি তা না করেন, তবে পেইন্ট স্যান্ড ব্লাস্ট করে সব লিকেজ ঠিক করে নিতে হবে। সব কিছু ঠিকভাবে হলে পেইন্টের কাজে লেগে পড়ুন।
ক্যাফে রেসার বানাতে আপনার অনেক পার্ট লাগবে। হ্যান্ডলে নতুন বিয়ারিং অবশ্যই লাগাবেন। সাস্পেনশনের পেছনে ব্যয় করতে কার্পণ্য করবেন না, এটি আপনার রাইডকে মসৃণ করবে। ক্যাফে রেসারে স্পোক হুইল বেশি ভালো লাগে। এক্ষেত্রে একটু বড় স্পোক হুইল ব্যবহার করা যেতে পারে। টায়ার কেনার ক্ষেত্রেও জিনিসটা মাথায় রাখতে হবে। এসব যদি খুব ভালো কন্ডিশনে ব্যবহৃত অবস্থায় পান, তবে দাম অর্ধেক কমে যাবে। নতুন ব্রেক অবশ্যই লাগাতে হবে, কারণ আপনার বাইক আর পুরনো বাইক নেই, এর ক্ষমতা ও গতি- দুটোই এখন বেড়েছে।
ভিন্টেজ স্টাইল গোল লোয়ার হেড লাইট ইউজ করতে হবে। ভেতরে এলইডি ব্যবহার করা যেতেই পারে। টেইল লাইটে পরিবর্তন আনতে হবে সিটের সাথে সামঞ্জস্য রেখে। বাইকের সিট আপনার স্টাইলকে বদলে দেবে। এজন্য লেদারের সিঙ্গেল সিট ব্যবহার করলে বেশি ভালো লাগবে। লোয়ার হ্যান্ডলবার অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে কারণ এটাই ক্যাফে রেসারের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
সব পার্টসে পছন্দমত পেইন্ট করা হয়ে গেলে অ্যাসেম্বলি শুরু করুন। কিছু বোল্ট হয়ত বানিয়ে নিতে হবে নতুন করে। সময় নিয়ে সব কিছু অ্যাসেম্বলি করুন।
বাইকের কাজ যেদিন থেকে শুরু করবেন, একটু চেষ্টা করবেন ভিডিও করে সংরক্ষণ করতে। এটা আপনার সারা জীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করে সবাইকে আপনার কাজ দেখাতেও পারবেন। যদি এতসব আপনার কষ্টসাধ্য লাগে এবং নিজের বাইক নিয়ে কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকে তবে কাজটা কোনো পেশাদার লোকের হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত।
কেন আপনি ক্যাফে রেসার চালাবেন
অনেক সময় এবং অর্থ ব্যয় করে একজন ক্যাফে রেসার তৈরি করে। সুতরাং এটা একজনের কাছে সারাজীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে। তাছাড়া আপনার বাইক হবে অনন্য। প্রত্যেকটি ক্যাফে রেসারের ডিজাইন আলাদা হয়। রাস্তায় আপনার বাইকের মতো আর কারো বাইক থাকবে না। এছাড়াও ক্যাফে রেসার আপনার বাইক রাইডিং অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করবে। নতুন সাস্পেনশন, দ্রুত গতির ইঞ্জিন, লোয়ার হ্যান্ডেলবার আপনার রাইডকে মসৃণ করবে। আপনি একটা ৩০ বছর বা তার বেশি পুরনো বাইককে নতুন করে ব্যবহার করছেন। জিনিসটা কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে। অনেকে শুধু ফ্যামিলি বাইক সংরক্ষণ করতেই বাইক সংরক্ষণ করে।
মোটর বাইক এখন আর শুধু যাতায়াতের সহজ মাধ্যম নয়, এটি এখন লাইফ-স্টাইলের অন্তর্গত। তরুণ রাইডাররা তাদের বাইকে চায় দুরন্ত গতি আর অনন্যতা। বাইক ট্রেন্ড বছর বছর বদলালেও ক্যাফে রেসার বাইক সবসময়ই কমবেশি মানুষের কাছে জনপ্রিয় থেকেছে। মাঝে কয়েকবছর স্পোর্টস বাইকের বাজার গরম থাকলেও সম্প্রতি ক্যাফে রেসার তার পূর্বের জনপ্রিয়তা ফিরে পেয়েছে। বাইক কোম্পানিগুলো যেমন স্পোর্টস বাইকের সাথে ক্যাফে রেসার ও বাজারে আনছে, তেমন তরুণরা পুরনো বাইক মডিফাই করে ক্যাফে রেসার বানাচ্ছে। ভারত এবং বাংলাদেশে অনেক কাস্টম বাইক গ্যারাজ গড়ে উঠেছে যেখানে মানুষ সাধ্যের মধ্যে তার শখ পূরণ করতে পারে। ভবিষ্যতে হয়ত এই ভিন্টেজ ক্যাফে রেসারের কাছে হার মানবে আধুনিক স্পোর্টস বাইক।
বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/