ক্যামব্রিজ স্পাই রিং: ব্রিটেনে সোভিয়েত গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক | শেষ পর্ব

[১ম পর্ব পড়ুন]

ক্যামব্রিজ স্পাই রিংয়ের পাঁচজনই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে কর্মরত ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপের দেশগুলোর ইতিহাসে কী বিশাল তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির বিপক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেন একসাথে লড়েছিল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরই আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়। এ সময় আমেরিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রগুলোর একটি ছিল ব্রিটেন। শুধু তা-ই নয়, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এক বিখ্যাত ভাষণে সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্য ঠেকাতে আমেরিকাকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। যুদ্ধের পর ইউরোপের অনেক ক্ষতিগ্রস্ত দেশকে আমেরিকার মার্শাল পরিকল্পনার অধীনে অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করা হয়, যার মধ্যে ব্রিটেনও ছিল। যেহেতু স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল আমেরিকা, এবং ব্রিটেন ছিল আমেরিকার সবচেয়ে বড় মিত্র, তাই ব্রিটেনের অনেক গোপন তথ্য জানা সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে খুবই জরুরি ছিল।

Jgogogj
image source: newsweek.com

এই বিষয়টি এখনও অজানা যে ঠিক কী পরিমাণ তথ্য ‘ক্যামব্রিজ স্পাই রিং’-এর পাঁচ ব্যক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে হস্তান্তর করেছিলেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধারণা করা হয়, ১৯৪৫-৫১ সালের মধ্যেই প্রায় শ’খানেক ফাইল হস্তান্তর করা হয়। রেকর্ড অনুযায়ী, গাই বার্গেস ১৯৪৫ সালের প্রথমদিকেই প্রায় ৩৬৯টি গোপন ডকুমেন্ট হস্তান্তর করেন। ১৯৩৪-৫১ এই সতের বছরে ডোনাল্ড ম্যাকলিনও প্রায় সমপরিমাণ ডকুমেন্ট গোপনে সোভিয়েত গোয়েন্দাদের কাছে হস্তান্তর করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ক্যামব্রিজ স্পাই রিংয়ের তথ্য পাচারের ঘটনা সম্পর্কে প্রথম অবগত হয় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। আমেরিকার গোয়েন্দাদের পক্ষ থেকে বার বার ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থাকে সতর্কবার্তা দেয়ার পরও তারা সেটাকে গুরুত্ব সহকারে নেয়নি, যার চড়া মূল্য দিতে হয় পরবর্তীতে। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রশাসন কোনোভাবেই চিন্তাও করতে পারেনি যে ব্রিটেনের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা এ ধরনের কাজে জড়াতে পারেন!

Jfifolhkg
ডোনাল্ড ম্যাকলিন, ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা; image source: historyofspies.com

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গাই বার্গেস ও ডোনাল্ড ম্যাকলিন– দুজন ব্যক্তি মাতাল হয়ে থাকতেন। এই বিষয়টি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকা– দুই দেশকেই চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভয় ছিল- হয়তো নেশার ঘোরে একসময় নিজেদের গুপ্তচরবৃত্তির কথা ফাঁস করে দেবেন এই দুজন। এতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান সমস্যা ছিল যে ব্রিটেনের গোপন ও স্পর্শকাতর তথ্য পাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। গাই বার্গেস একবার এক পানশালায় মাতাল হয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ফাইল ফেলে এসেছিলেন, যেটি তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পেয়েছিলেন। জানা যায়, মাতাল অবস্থায় ডোনাল্ড ম্যাকলিনও নিজের কাছের মানুষদের কাছে তথ্য পাচারের ইঙ্গিত দেন। আমেরিকান গোয়েন্দারা দেখছিল- এত উঁচু ও স্পর্শকাতর পর্যায়ের দুজন ব্যক্তি পানশালায় মাতাল হয়ে বসে থাকেন, যা খুবই অপ্রত্যাশিত। তারা এই দুই কর্মকর্তার পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

Hgkgk
গাই বার্গেস, পররাষ্ট্রদূত; image source: dailymail.co.uk

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কিম ফিলবিকে যখন আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিস্থ ব্রিটিশ দূতাবাসে প্রেরণ করা হয়, তখন তিনি জানতে পারেন যে ‘ভেনোনা প্রজেক্ট’ এর মাধ্যমে ব্রিটিশ এবং আমেরিকান গোয়েন্দারা তথ্য পাচারের সাথে জড়িত ‘হোমার’ ছদ্মনামের এক ব্রিটিশ কর্মকর্তাকে হন্য হয়ে খুঁজছেন। কিম ফিলবি বুঝতে পারেন- ডোনাল্ড ম্যাকলিনকে ধরার জন্যই ব্রিটিশ ও আমেরিকান গোয়েন্দারা তৎপরতা চালাচ্ছে৷ তিনি তার সাথে থাকা গাই বার্গেসকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেন যেন সে ডোনাল্ডকে সতর্ক করতে পারে। ১৯৫১ সালের গ্রীষ্মে ম্যাকলিন ও বার্গেস– দুজনই নিখোঁজ হন। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়, ব্রিটিশ ও আমেরিকান গোয়েন্দাদের হাত থেকে বাঁচতেই তারা আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু এই ধারণার স্বপক্ষে যথাযথ প্রমাণ না থাকায় খুব বেশি দূর এগোনো যাচ্ছিল না। ১৯৫৬ সালে নিখোঁজ হওয়ার পর প্রথমবারের মতো সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোতে এক সংবাদ সম্মেলনে বার্গেস ও ম্যাকলিনকে দেখা যায়, এবং সেই সাথে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে তারা ব্রিটিশ ও আমেরিকান গোয়েন্দাদের হাত থেকে বাঁচতেই সোভিয়েত ইউনিয়নে আশ্রয় নিয়েছেন।

Ugophplv
অ্যান্থনি ব্লান্ট ছিলেন কাউন্টারইন্টেলিজেন্সের দায়িত্বে; image source: cosmopolitan.com

ব্রিটিশ ও আমেরিকান গোয়েন্দারা বার্গেস ও ম্যাকলিনকে ধরতে ব্যর্থ হওয়ার পর আবিষ্কার করেন- এই দুজনই শুধু সোভিয়েত গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য পাচার করেনি, বরং তারা ভেনোনা প্রজেক্ট ও সোভিয়েত ইউনিয়নের এক প্রাক্তন গোয়েন্দার মাধ্যমে জানতে পারেন যে- বেশ কয়েকজনের একটি নেটওয়ার্ক সুপরিকল্পিতভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচার করছে। তাদের সন্দেহ ছিল- হয়তো ওয়াশিংটন ডিসিতে ব্রিটিশ দূতাবাসে কর্মরত কিম ফিলবি সম্ভাব্য স্পাই নেটওয়ার্কের তৃতীয় ব্যক্তি। ফিলবির বিরুদ্ধে গোপনে তদন্ত শুরু হয়। তবে শেষপর্যন্ত তদন্তে এমন কিছুই পাওয়া যায়নি যার মাধ্যমে তাকে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত করা যায়। যা-ই হোক, তাকে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এরপর ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারির কাছ থেকে তিনি ছাড়পত্র লাভ করেন, যদিও এটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল।

Ufkglkv
জন কেয়ার্নক্রস, পেশায় কোডব্রেকার; image source: express.co.uk

ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-সিক্স থেকে পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার পর কিম ফিলবি সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন, এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে যান। সেখানে তার এক বন্ধু তার সাক্ষাৎকার নিতে আসলে তিনি তার গুপ্তচরবৃত্তির কথা স্বীকার করেন। তবে তার ভয় ছিল- হয়তো স্বীকারোক্তির পর তাকে অপহরণ করা হতে পারে। তাই সাক্ষাৎকারের অল্প কিছুদিন পরই লেবানন থেকে তিনি সরাসরি সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কোতে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন।

Ucifogkkgmg
কিম ফিলবি, যিনি ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত ছিলেন; image source: arabnews.com

১৯৬৪ সালে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-ফাইভের কাছে তথ্য আসে যে অ্যান্থনি ব্লান্ট সোভিয়েত গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য পাচার করছেন। এই তথ্য প্রদান করেন মাইকেল হুইটনি স্ট্রেইট নামের এক আমেরিকান, যিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্লান্টের সহপাঠী ছিলেন। এমআই-ফাইভ ব্লান্টকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় ব্লান্ট বলেন যে, তিনি একটি শর্তের পরিপ্রেক্ষিতে সব ধরনের তথ্য দিতে রাজি আছেন- তার বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের বিচারিক কার্যক্রম থেকে দূরে থাকতে হবে। ব্রিটেনের তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল তাকে গোপনে এই নিশ্চয়তা দেন যে, যদি তিনি তথ্য দেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। তিনি স্বীকারোক্তি দেন যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করেছেন তিনি। তার এই স্বীকারোক্তি যখন জনসমক্ষে আসে, তখন সেটি ব্রিটিশ রাজপরিবার এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার ভিত কাঁপিয়ে দেয়। তবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকার নিশ্চয়তা দেওয়ার বিষয়গুলো এত গোপনে ঘটেছিল যে, তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক ডগলাস-হোম এই সম্পর্কে কিছুই জানতেন না! ১৯৭৯ সালে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার তার সম্পর্কে তথ্য দেন, এবং তার নাইটহুড কেড়ে নেয়া হয়।

ক্যামব্রিজ স্পাই রিংয়ের পঞ্চম ব্যক্তি ছিলেন জন কেয়ার্নক্রস। স্কটিশ এই ভদ্রলোক প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ভাষার উপর পড়াশোনার পর ভর্তি হন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত ট্রিনিটি কলেজে। ছাত্রজীবন থেকেই তার ব্রিটেনের শাসকশ্রেণীর প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে। তার জীবনীতে লেখক এই বিষয়টি খুব ভালো করে তুলে এনেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন ব্লেচলি পার্কে তিনি জার্মান কোডগুলোকে ডিকোডের দায়িত্ব পালন করতেন, তখন থেকেই তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দাদের কাছে ডিকোড করা বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করতেন। তার এই সহায়তার জন্য সোভিয়েত রেড আর্মি নাৎসি বাহিনীর বিপক্ষে কুরস্কের যুদ্ধে বিশাল সফলতা লাভ করে। এছাড়া তিনি স্যার মরিস হ্যাঙ্কির ব্যক্তিগত সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। স্যার হ্যাঙ্কি ব্রিটেনের পারমাণবিক বোমা তৈরির যে কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছিল, সেখানে নিয়মিত তদারকি করতেন। ধারণা করা হয়, স্যার হ্যাঙ্কির কাছে ব্রিটেনের পারমাণবিক কর্মসূচির যেসব গোপন তথ্য ছিল, সেগুলো কেয়ার্নক্রস দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে যখন ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা জিজ্ঞাসাবাদ করে তাকে, তিনি সব কিছু স্বীকার করে নেন।

ক্যামব্রিজ স্পাই রিংয়ের পাঁচজন ব্যক্তির শেষ পরিণতি কী হয়েছিল, সেই সম্পর্কেও জেনে নেয়া যাক। একটা বিষয় হচ্ছে- এই স্পাই নেটওয়ার্কের কাউকেই আসলে এত বড় অপরাধের পরও সেরকম শাস্তি পেতে হয়নি। জন কেয়ার্নক্রস ১৯৯৫ সালে ব্রিটেনেই স্ট্রোক করে মারা যান। গাই বার্গেস ও ডোনাল্ড ম্যাকলিন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সোভিয়েত রাশিয়ায় ছিলেন। দুজনই অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় গাই বার্গেসের বয়স ছিল ৫২ বছর, অপরদিকে ডোনাল্ড ম্যাকলিনের ৬৯ বছর। অ্যান্থনি ব্লান্ট ৭৫ বছর বয়সে লন্ডনে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। ক্যামব্রিজ স্পাই রিংয়ের সবচেয়ে দুধর্ষ যে ব্যক্তি, সেই কিম ফিলবি সোভিয়েত রাশিয়ায় প্রায় ২৫ বছর কাটানোর পর অতিরিক্ত মদ্যপানজনিত কারণে ১৯৮৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

Related Articles

Exit mobile version