দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ হলো, তখন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া পুরো বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ছিল। অর্থনীতির দিক থেকে হোক কিংবা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিক দিয়ে হোক, দুই রাষ্ট্রই তখন ছিল ‘সুপার পাওয়ার’। অন্যান্য দেশগুলো এই দুই রাষ্ট্রকে তখন সমীহ করে চলতো এবং এই দুই শক্তিধর দেশও অন্য রাষ্ট্রের প্রতি নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতো। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর যেসব দেশ বিজয়ীদের দলে ছিল তারাও এই দুই পরাশক্তির সাথে পেরে ওঠেনি। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে এই দুই দেশের এত ক্ষমতা ছিল না। যুদ্ধের আগে শক্তিধর দেশ ছিল ব্রিটেন, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স ও চীন- এই দেশগুলো। যুদ্ধকালীন সময় সেসব দেশকে এমনভাবে ক্ষতি করেছিল যে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে তাদের আগের সেই প্রভাব বিস্তারের সুযোগ হয়ে উঠেনি। কারণ, যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ করাই তখন প্রত্যেক দেশের জন্য মুখ্য হয়ে উঠে।
কিন্তু যুদ্ধ শেষ হবার প্রায় সাথে সাথেই যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে একধরনের ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হয়ে যায়, যাকে বলে স্নায়ুযুদ্ধ। এই স্নায়ুযুদ্ধে কিন্তু কখনও সত্যি সত্যি সামনাসামনি যুদ্ধ করতে হয় না। এই যুদ্ধ হয় দুই দেশের মধ্যেকার কথা চালাচালির মাধ্যমে, কিংবা হুমকি দেয়ার মাধ্যমে, অথবা একে অপরের বিরুদ্ধে কোনো মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে, কোনো বিবৃতি বা রটনার মাধ্যমে। কিন্তু দুই দেশ একে অপরের সাথে সামনে থেকে যুদ্ধে নামবে– সেরকমটি স্নায়ুযুদ্ধে হয় না। কারণ দুই দেশ ক্ষমতার একেবারে শীর্ষে অবস্থান করছিলো। দুই দেশের কাছেই নিউক্লিয়ার অস্ত্র মজুদ ছিল।
এই দুই দেশও জানতো যে, যদি তারা যুদ্ধে নামে এবং কোনোভাবে যদি ভয়ংকর নিউক্লিয়ার অস্ত্র যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়ে যায়, তাহলে এই দুই দেশ এবং দেশের মানুষ তো ধ্বংস হবেই, তার সাথে সাথে পুরো পৃথিবীর উপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে, হয়তো মানব সভ্যতার চিহ্ন মুছে যাবে। তাই কার ক্ষমতা কততুকু, কে কার থেকে প্রযুক্তিতে উন্নতি করতে পারে, কে কার থেকে অর্থনীতিতে বলিষ্ঠ হতে পারে, সেদিকে তাদের খেয়াল ছিল এবং একটি অলিখিত প্রতিযোগিতায় নেমেছিল দুই দেশ। সেজন্য প্রায় ৪৫ বছর পর্যন্ত এই দুই দেশের মধ্যে একধরনের বৈরিতা বিরাজ করেছিলো।
এই দুই দেশের নিজেদের মধ্যে কখনও যুদ্ধ হয়নি ঠিকই, কিন্তু তাদের মিত্র রাষ্ট্রের উপর কোনো বৈরি প্রভাব আসলে তখন তারা সেই রাষ্ট্রের জন্য একে অপরের সামরিক বাহিনীর বিপক্ষে লড়াই করেছে। উদাহরণ হিসেবে কোরিয়া এবং ভিয়েতনামের কথা উল্লেখ করা যায়।
এই দুই দেশ আগে কিন্তু কখনও যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়নি। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই দুই দেশের মধ্যে মিত্রতা ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ার যে ক্ষতি হয়ে যায় সেটা পূরণ করার দিকেই স্তালিন সচেষ্ট ছিলেন। তার মধ্যে একধরনের ভয় ঢুকে গিয়েছিলো যে, রাশিয়া বা তৎকালীন USSR তার শত্রুপক্ষের দ্বারা সবসময় হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায়।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তাদেরকে আক্রমণ করে জার্মানি। এতে তাদের ক্ষতি হয়। আবার ১৯৩০ সালে রাশিয়া যখন হিটলারের বিপক্ষে কথা বলেছিল তখনও কোনো রাষ্ট্র তাদের হয়ে কথা বলেনি। অনেক রাষ্ট্র আবার হিটলারের পক্ষেই চলে গিয়েছিলো। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি আবারও রাশিয়া আক্রমণ করে। এবার রাশিয়ার বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়। কয়েক মিলিয়ন একর জমি নষ্ট হয়ে পড়ে এবং ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়। আবার কয়েকশ শহর একদম ধ্বংস হয়ে যায় জার্মানির এই আক্রমণের ফলে।
স্তালিন তার মিত্র দেশগুলোর উপর মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন, কারণ মিত্রপক্ষের কেউ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। এমনকি রাশিয়ার উপর থেকে চাপ কমানোর জন্য ১৯৪৪ সালের আগে তারা পশ্চিম ইউরোপে আক্রমণ চালাতেও পারতো, কিন্তু সেটাও কোনো রাষ্ট্র করেনি। সেজন্য যুদ্ধ শেষ হবার কিছুদিনের মধ্যে স্তালিন পরিকল্পনা করেন যে, এখন তার প্রধান কাজ হবে তার দেশকে এমনভাবে সাজানো যেন আর বিদেশী আক্রমণ না হয় এবং নিজের দেশকে আরও শক্তিমান দেশ হিসেবে গড়ে তোলা। পশ্চিমাদের প্রতি তার বিশ্বাস একদমই ছিল না। অত্যন্ত সন্দেহের চোখে দেখতেন তাদেরকে স্তালিন। বিশেষ করে জার্মানির প্রতি তার এবং তার দেশের লোকেদের ভয় এবং ঘৃণা সমানভাবেই ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রও একটা সময় এসে নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। ইতিহাস থেকে তারা নিজেদের জন্য শিক্ষা নেয়। তারা আক্ষেপ করে যে যুদ্ধের মধ্যেকার সময়ে তারা নিজেদেরকে আলাদা করে রেখেছিল। তারা যুদ্ধের পরে বুঝতে পেরেছিল যে এখনই তাদের সময় নিজেদেরকে অন্য দেশগুলো থেকে শক্তিমান করে তোলার এবং পুরো বিশ্বে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করার।
শক্তিমান যুক্তরাষ্ট্র, যে কিনা নিউক্লিয়ার অস্ত্র ভাণ্ডারে ভরপুর, ভিয়েতনাম যুদ্ধে অপেক্ষাকৃত ছোট এবং কম ক্ষমতাধর দেশের কাছে যখন হেরে গেলো, সেটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর জন্য একটি বড় ধাক্কা এবং শিক্ষা। এরপরে যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র প্রযুক্তি উন্নয়নে তাদের যে পরিমাণ খরচ হয় সেদিকে খেয়াল করলো।
দেখা গেলো, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার এসব অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এতে তাদের অভ্যন্তরীণ উন্নতি একদমই হচ্ছে না। তাদের নিজেদের দেশে বেকার এবং আর্থিক অসচ্ছল মানুষের পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছে। এখন তাদেরকে নিজেদের মানুষদের জন্য কিছু করা প্রয়োজন। ঠিক একইরকম মনোভাব ছিল রাশিয়ারও। তারাও তাদের দেশের মানুষদের মৌলিক চাহিদার দিকে নজর দিতে চাচ্ছিলো। সে জন্য ১৯৬৯ সালে দুই দেশের মধ্যে Strategic Arms Limitation Talk (SALT) তৈরি হয়। ১৯৭২ সালে SALT1 হয়, যেখানে বলা হয় দুই দেশের মধ্যকার নিউক্লিয়ার অস্ত্র কমিয়ে আনতে হবে। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের সাময়িক অবসান হয়। দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান একে অন্যের দেশেও যান।
কিন্তু সত্তর দশকের শেষের দিকে SALT2 স্বাক্ষরের সময় আবার এই যুদ্ধ শুরু হয়ে পড়ে। তখন USSR আফগানিস্তানে আক্রমণ করে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র SALT এর চুক্তিতে সই করতে অস্বীকার করে। ১৯৮০ সালের দিকে, প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের সময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্নায়ুযুদ্ধ আবারও শুরু হলে তারা USSR-কে Evil Empire বলে উল্লেখ করে। এসময় দুই দেশের মধ্যে অস্ত্র ভাণ্ডার বাড়ানোর আরও একবার তাগিদ দেখা দেয়। দুই দেশে তখন নতুন নতুন মিসাইল তৈরির রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। এই সময়েই যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং কঠিন প্রজেক্ট হাতে নেয় যেটা Nuclear Defense System তৈরি করবে। এই প্রজেক্ট বা প্রকল্পের নাম ছিল বিখ্যাত “Star Wars”।
এসময় রাশিয়ার মিখাইল গরবাশেভ এগিয়ে আসেন। তিনি USSR এ একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে চান। দেশের মানুষের উন্নতির জন্য কাজ করতে চান। এবং শুধুমাত্র উন্নত অস্ত্র তৈরিতে কী পরিমাণ সম্পদ নষ্ট হচ্ছে সেদিকে নজর দেন। USSR এর মোট সম্পদের ২৫ শতাংশ ব্যবহার করা হতো শুধুমাত্র অস্ত্র তৈরিতে। তিনি এর বিপক্ষে ছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি চুক্তিতে আসতে চাচ্ছিলেন। তার দেশের নিউক্লিয়ার বোম্বার বিমগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দেন তিনি। পশ্চিমাদের ব্যাপারে তিনি উদার চিত্তের প্রয়োগ ঘটান। এরপর ১৯৮৬ সালে আইসল্যান্ডে এবং ১৯৮৭ সালে ওয়াশিংটনে গরবাশেভ এবং রিগ্যান একসাথে এসব বিষয় নিয়ে বৈঠক করেন এবং স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়।
তথ্যসুত্র
[১] Making History – World History from 1914 to the Present – Christopher Culpin
[২] We Now Know: Rethinking Cold War History – John Lewis Gaddis
[৩] The Cold War: A World History – Odd Arne Westad
ফিচার ইমেজ সোর্স: essay service rkorakot.me