বাংলার ইতিহাসে এদেশের প্রতিটি অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর রয়েছে তার স্বতন্ত্র স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। তার মধ্যে সমগ্র আদিবাসীদের অবদান যদি আমরা আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসতে চাই, বলে হয়তো শেষ করা যাবে না। প্রাক ব্রিটিশ আমল হতে শুরু করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তানিদের ঠেকানো, এমনকি বাংলার মুক্তিসংগ্রামে এদেশের আদিবাসীদের অসমসাহসী অবদান চোখে পড়ার মতো।
স্রেফ তেভাগা আন্দোলনের (১৯৪৬-৪৭) কথাই ধরা যাক। এতে রাজবংশী কিংবা সাঁওতালদের অবদান জমিদারদের ভিত্তিমূলকে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছিল। এভাবে আরো অনেক পদক্ষেপ, যেমন- গারো বিদ্রোহ (১৭৭৫-১৮০২), চাকমা আন্দোলন (১৭৮০-১৮০০), খাসি বিদ্রোহ (১৭৮৩), সাঁওতালদের বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৭), মুন্ডাদের বিদ্রোহ (১৮৫৭), নাচোল বিদ্রোহ ইত্যাদির পথ ধরে পাকিস্তান হবার পর দীর্ঘ লাঞ্চনা ও বঞ্চনার শেকল থেকে মুক্তি পেতে অবতীর্ণ হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১)। আজ আমাদের আলোচনা হবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর আদিবাসীদের অংশগ্রহণ বিষয়ে।
দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় মুক্তি সংগ্রাম
মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের অবদান নিয়ে কথা বলতে গেলে কী নিয়ে শুরু করা হবে, সেটা একটা বিষয়। মানিকছড়ির মং প্রু সেইন (মং রাজা) কথা উল্লেখ করা যায়। ভারতে পাড়ি জমানো শরণার্থীদের আশ্রয়দানসহ তিনি নিজে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুজিবনগর সরকারকে অর্থ সহায়তা, মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রিশটিরও বেশি আগ্নেয়াস্ত্র প্রদানসহ কয়েকটি অপারেশনে সফলভাবে বীরত্বের সাথে তিনি যুদ্ধ করেন।
তেমনি আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা চাকমা রাজপরিবারের সদস্য কে কে রায়, যিনি একজন সক্রিয় ও নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা। উল্লেখ করতে হবে আদিবাসী নেতা মানবেন্দ্র লারমার নামও। তাছাড়া রাঙামাটি জেলা শহরে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে গঠিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে অন্যতম ছিলেন রাঙামাটি সরকারি কলেজের তৎকালীন ছাত্রনেতা গৌতম দেওয়ান। উল্লেখযোগ্য অন্যান্য চাকমা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে রসময় চাকমা, তাতিন্দ্রলাল চাকমা প্রমুখ বিবেচ্য।
চাকমা ও মারমা জনগোষ্ঠী থেকে অনেকেই ইপিআর-এর সদস্য ছিলেন; ইপিআর সদর্স রমণী হেমরঞ্জন চাকমা, রঞ্জন চাকমা, খগেন্দ্র চাকমা, অ্যামি মারমা প্রমুখ মহান যুদ্ধে শহীদ হন। এছাড়া বিমলেন্দু দেওয়ান, আনন্দ বাঁশি চাকমা, কৃপাসুখ চাকমাসহ ২০-২২ জন সরকারি কর্মকর্তা ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখ করতে হবে বীরবিক্রম উখ্য জিং মারমার নামও।
চাকমাদের কথা যখন বলাই হলো, ত্রিপুরা কেন বাদ পড়বে? (‘ত্রিপুরা’ বলতে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বোঝানো হয়েছে) পার্বত্য চট্টগ্রামে ১ নং সেক্টরের আওতায় প্রথম যে মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয় (৫ মে ১৯৭১), তাতে সদস্যসংখ্যা ছিল ২৫ জন, যার নেতৃত্বে ছিলেন হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা। এটি পরে একটি পূর্ণাঙ্গ দল হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এছাড়া এ দলের মধ্যে বরেন ত্রিপুরা ছিলেন অন্যতম।
আসা যাক রাখাইনদের কথায়। এবার সিলেবাস কিছুটা কমনও পড়তে পারে। নায়েক সুবাদার ইউ কে চিং- বীরবিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা তিনিই। তিনি রাখাইন জনগোষ্ঠীভুক্ত, জন্ম ১৯৩৩ সালে বান্দরবান মহকুমার উজানীপাড়ায়। ১৯৫২ সালে ইপিআর-এ যোগ দিয়ে ১৯৭১ সালে ৬ নং সেক্টর থেকে যুদ্ধ করেন। নভেম্বর, ১৯৭১ এর মাঝামাঝিতে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলায় পাকিস্তানিদের অ্যাম্বুশে পড়েন এবং ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ২৫ জুলাই, ২০১৪ সালে। একইসাথে বলতে হবে বীর মুক্তিযোদ্ধা উ-উসিতমং, উ-মংয়াইন, উ-ক্যহ্রাচিং প্রমুখের নামও।
বৃহত্তর রাজশাহী, রংপুর ও ময়মনসিংহ
উত্তর, উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উপাখ্যানও কিন্তু কম নয়। পরিসংখ্যান হতে প্রাপ্ত তথ্যমতে, শুধুমাত্র রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানায় ৬২ জন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার নাম উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্যদিকে, দিনাজপুরে ওঁরাও ও সাঁওতালদের নিয়ে ১,০০০ জনের বিশাল মুক্তিবাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, গারো, হাজং ও কোঁচ জনগোষ্ঠী থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকায় যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল প্রায় ১,৫০০ আদিবাসী। গারোদের মধ্যে কোম্পানি কমান্ডার দীপক সাংমো, মহান মুক্তিযোদ্ধা থিওফিল হাজাং, পরিমল দ্রং, অনাথ নকরেক, সেকশন কমান্ডার ভদ্র মারাক, প্লাটুন কমান্ডার যতীন্দ্র সাংমো, কমান্ডার অরবিন্দ সাংমা ও নারী মুক্তিযোদ্ধা ভেরোনিকা সিমসাংয়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ। রংপুরের মিঠাপুকুর, রানীপুকুর, শ্যামপুর, তারাগঞ্জ প্রভৃতি এলাকা থেকে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সমবেত হয় আদিবাসী ও বীরজনতা। তাদের হাতে ছিল লাঠি, খুন্তি, বল্লম ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র। বেশিরভাগই ছিল সাঁওতাল সম্প্রদায়ভুক্ত। সুযোগ বুঝে হানাদার বাহিনী সেদিন বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করেছিল, তাতে মারা যান ২০০ জনের মতো সাঁওতাল বীর। তাদের সম্মানে ঐ স্থানে ২০০০ সালে নির্মাণ করা হয় ‘রক্ত গৌরব’ স্মৃতিসৌধ।
উত্তরবঙ্গ থেকে অন্যান্য যাদের নাম উল্লেখ না করলেই নয়- মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠক সাগারাম মাঝি, শহিদ ফাদার মারান্ডি (দিনাজপুর), মুক্তিযোদ্ধা সুরেশচন্দ্র পাহান (নওগাঁ), বিশ্বনাথ মাঝি, বুদু লাকড়া (মিঠাপুকুর, রংপুর), ওঁরাওদের মধ্য থেকে মনাইচন্দ্র খালকো (দিনাজপুর), কশবা মিশন হতে যোগ দেওয়া নারী মুক্তিযোদ্ধা জসপিন ঢপ্প (দশম শ্রেণী, দিনাজপুর) প্রমুখ।
উত্তর-পূর্বাঞ্চল হতে
মৌলভীবাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ এলাকায় চা-বাগানে কর্মরত জনগোষ্ঠী হতে মুক্তিযুদ্ধে ছয় শতাধিক নিহত এবং প্রায় দেড়শো জন আহত ও নিগৃহীত হয়েছিলেন। এ অঞ্চলের মণিপুরী জনগোষ্ঠীর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। গিরীন্দ্র সিংহ, নিমাই সিংহ, কৃষ্ণকুমার সিংহ, সাধন সিংহ, অনিতা সিংহ, বাণী সিনহা প্রমুখ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিক। নীলমণি চ্যাটার্জী, নন্দেশ্বর সিংহ, বিজয় সিংহ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ শরণার্থী হতে যাওয়া অসংখ্য মানুষকে সংঘবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করতে উৎসাহিত করেন। নীলমণি চ্যাটার্জী গড়ে তুলেছিলেন ১,২০০ মুক্তিযোদ্ধার এক অকুতোভয় মুক্তিদল।
পাকবাহিনীর ছোবল ও অন্যান্য
শুধু বীরত্ব নয়, পাকবাহিনীর হিংস্রতা ও লোলুপ দৃষ্টির কবল থেকে মুক্তি পায়নি আদিবাসীরাও। ১৯৭১ সালের মে মাসে মহেশখালি ঠাকুরতলা বৌদ্ধবিহারে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল হানাদার বাহিনী, হত্যা করেছে অসংখ্য নিরীহ রাখাইন মানুষকে, লুট করেছে ৬২টি রৌপ্যমূর্তি ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।
আমরা অনেকেই কাঁকন বিবির কথা জানি। প্রকৃত নাম ’কাকাত হেনইঞ্চিতা’, আমরা সহজ করে বলি কাঁকন বিবি। জন্ম মেঘালয়ে, ১৯১৫ সালে। ছিলেন এক বীরযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা ও গুপ্তচর। তিনি ২০১৮ সালের ২১ মার্চ, সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজে মারা যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় জীবনের দুঃসহ টানাপোড়েনের মধ্য দিয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি সহায়তা করে গেছেন।
এভাবে আমাদের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে আছে আদিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জানা-অজানা শতসহস্র গল্প। স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের উচিত গল্পগুলো জানা, এর প্রেক্ষাপটকে সামনে নিয়ে আসা।
পরিশেষে
বাংলা ও বাঙালি জাতীয়তা নিয়ে আমাদের গর্ব কখনোই পরিপূর্ণ হবে না, যদি না আমরা আদিবাসীদের এ মহান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বুক ভরে গ্রহণ না করি। অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন,
“দেশে আদিবাসীদের যে সংখ্যা, সে অনুপাতে তারা মুক্তিযুদ্ধে অনেক বেশি হারে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে।”
অতীতের সকল আন্দোলনের পাশাপাশি আজ অবধি অনেক আদিবাসী জনগোষ্ঠী নিজ অধিকার আদায়ের আন্দোলনে কাজ করে যাচ্ছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ছিল তারই অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। সকলের সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমেই আমরা গড়ে তুলতে পারি আমাদের স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’কে।