২০১৪ সাল থেকে ইউরোপের বুকে একটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধের ফলে সংঘটিত ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র দেখলে প্রতীয়মান হয় যে, অত্যাধুনিক ও সুসজ্জিত ইউরোপের কোণে যেন সিরিয়া, লিবিয়া বা ইয়েমেনের একটি ক্ষুদ্রতর সংস্করণ স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু মূলধারার প্রচারমাধ্যমগুলো (যাদের শীর্ষে রয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের শীর্ষ প্রচারমাধ্যমসমূহ) রাজনৈতিক কারণে সাধারণভাবে এই যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র প্রচার করা থেকে বিরত থেকেছে। এই যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে।
২০১৪ সালে ইউক্রেনে তীব্র রাজনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব ইউক্রেনে অবস্থিত ইউক্রেনের দুটি প্রদেশ (দনেৎস্ক ও লুহানস্ক) ইউক্রেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ইউক্রেনীয় সরকার দনেৎস্ক ও লুহানস্কের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য সেখানে সৈন্য প্রেরণ করে, এবং ফলশ্রুতিতে ইউক্রেনের সঙ্গে দনেৎস্ক ও লুহানস্কের যুদ্ধ আরম্ভ হয়, যে যুদ্ধ এখনো চলমান। উল্লেখ্য, বর্তমানে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী দনেৎস্ক’ ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী লুহানস্ক’–এর নিজস্ব সরকার, আইনসভা, সংবিধান, পতাকা, সশস্ত্রবাহিনী, বিচার বিভাগ ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে, এবং প্রজাতন্ত্র দুটি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে ইউক্রেনীয় সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, সুতরাং প্রজাতন্ত্র দুটি এখন কার্যত স্বাধীন।
ইউক্রেনীয় সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি কোনো যুদ্ধ নয়। ২০১৪–২০১৮ সাল পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সরকার এই যুদ্ধকে ‘পূর্ব ইউক্রেনে সন্ত্রাসবাদীবিরোধী অভিযান’ (ইউক্রেনীয়: Антитерористична операція на сході України, ‘আন্তিতেরোরিস্তিচনা অপেরাৎসিয়া না স্খোদি উক্রাইনে’) নামে অভিহিত করত। ২০১৮ সাল থেকে তারা একে ‘যৌথবাহিনী অভিযান’ (ইউক্রেনীয়: Операція об’єднаних сил, ‘অপেরাৎসিয়া ওবিয়েদনানিখ সিল’) নামে অভিহিত করছে। দনেৎস্ক ও লুহানস্কের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই যুদ্ধটি তাদের ওপর ইউক্রেনীয় সরকারের আক্রমণ এবং তারা কেবল ‘ইউক্রেনীয় আক্রমণ’ প্রতিহত করছে। দনেৎস্ক ও লুহানস্কের মূল সমর্থক রাশিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে, এই যুদ্ধটি মূলত ‘ইউক্রেনীয় গৃহযুদ্ধ’ এবং এতে পশ্চিমাপন্থী ও চরম রুশবিরোধী পশ্চিম ইউক্রেনভিত্তিক ইউক্রেনীয় সরকার রুশপন্থী ও পশ্চিমাবিরোধী পূর্ব ইউক্রেনভিত্তিক দনেৎস্ক ও লুহানস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। নিরপেক্ষতা রক্ষার্থে এই নিবন্ধে এই যুদ্ধকে ‘দনবাস যুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
‘দনবাস’ দক্ষিণ–পূর্ব ইউক্রেনের একটি ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঞ্চলের নাম। ‘দনবাস’ (রুশ: Донбасс) শব্দটি রুশ ভাষার ‘Донецкий угольный бассейн’ বা ‘দনেৎস্কি উগোলিনি বাসেইন’ শব্দগুচ্ছের সংক্ষিপ্ত রূপ, যেটির বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘দনেৎস কয়লা বেসিন’। ঐতিহাসিকভাবে, দনেৎস নদীর তীরবর্তী কয়লাসমৃদ্ধ অঞ্চলটি (দনেৎস্ক, লুহানস্ক, ইউক্রেনের দনিপ্রোপেত্রোভস্ক প্রদেশের অংশবিশেষ এবং দক্ষিণ রাশিয়ার অংশবিশেষ) ‘দনবাস’ নামে পরিচিত। অবশ্য বর্তমানে ‘দনবাস’ শব্দটি সাধারণভাবে কেবল দনেৎস্ক ও লুহানস্ককে বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। রুশ সীমান্তবর্তী পরস্পর সংলগ্ন এই অঞ্চল দুটিতে চলমান যুদ্ধই ‘দনবাস যুদ্ধ’।
এক্ষেত্রে একটি বিষয় স্পষ্ট করে নেয়া প্রয়োজন। ১৯৯১ সালে ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং সেসময় থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দনেৎস্ক ও লুহানস্ক প্রদেশ দুটির সম্পূর্ণ অংশ ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল। দনেৎস্ক প্রদেশের মোট আয়তন ২৬,৫১৭ বর্গ কি.মি.। বর্তমানে প্রদেশটির ৭,৮৫৩ বর্গ কি.মি. ভূখণ্ড ‘গণপ্রজাতন্ত্রী দনেৎস্কে’র নিয়ন্ত্রণাধীন, আর বাকি ১৮,৬৬৪ বর্গ কি.মি. ভূখণ্ড ইউক্রেনীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। অন্যদিকে, লুহানস্ক প্রদেশের মোট আয়তন ২৬,৬৮৩ বর্গ কি.মি.। বর্তমানে প্রদেশটির ৮,৩৭৭ বর্গ কি.মি. ভূখণ্ড ‘গণপ্রজাতন্ত্রী লুহানস্কে’র নিয়ন্ত্রণাধীন, আর বাকি ১৮,৩০৬ বর্গ কি.মি. ভূখণ্ড ইউক্রেনীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। অর্থাৎ, দনবাসের (দনেৎস্ক ও লুহানস্কের) মোট আয়তন ৫৩,২০০ বর্গ কি.মি., যার মধ্যে প্রায় ৩০.৫% (১৬,২৩০ বর্গ কি.মি.) দনেৎস্ক ও লুহানস্ক প্রজাতন্ত্রদ্বয়ের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, আর বাকি প্রায় ৬৯.৫% (৩৬,৯৭০ বর্গ কি.মি.) ইউক্রেনীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে রয়েছে।
দনবাস যুদ্ধের ফলে ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫,০০০ ইউক্রেনীয় সৈন্য ও স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধা নিহত হয়েছে এবং প্রায় ১১,০০০ ইউক্রেনীয় সৈন্য ও স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধা আহত হয়েছে (ইউক্রেনীয় সরকারের পক্ষে যুদ্ধ করে হতাহত মার্সেনারিদের হিসেব এই পরিসংখ্যানের অন্তর্ভুক্ত নয়)। অন্যদিকে, এই যুদ্ধের ফলে ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দনেৎস্ক ও লুহানস্কের অন্তত ৫,০০০ সৈন্য নিহত হয়েছে এবং অন্তত ১৩,০০০ সৈন্য আহত হয়েছে। তদুপরি, এই যুদ্ধের ফলে দনবাসের অন্তত ৩,৫০০ জন বেসামরিক অধিবাসী নিহত হয়েছে এবং অন্তত ১৫ লক্ষ মানুষ শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধ শুরুর পূর্বে দনবাসের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৬৫ লক্ষ, সুতরাং আনুপাতিকভাবে দনবাসে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রা সিরিয়া বা ইয়েমেনে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রার চেয়ে কম নয়।
বস্তুত, দনবাস যুদ্ধকে কেবল ইউক্রেন এবং দনেৎস্ক ও লুহানস্কের মধ্যকার যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। বর্তমান রুশ–পশ্চিমা স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দনবাস যুদ্ধ কার্যত পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্যেকার একটি ‘প্রক্সি যুদ্ধে’ রূপ নিয়েছে, যেখানে ইউক্রেন পশ্চিমা বিশ্বের প্রক্সি হিসেবে এবং দনেৎস্ক ও লুহানস্ক রাশিয়ার প্রক্সি হিসেবে কাজ করছে। তদুপরি, ইউক্রেনীয় সরকার এই যুদ্ধকে ‘রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করছে। কার্যত রাশিয়া দনেৎস্ক ও লুহানস্ককে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করছে, কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত সরাসরি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় নি। অবশ্য ইউক্রেনীয় সরকার দনেৎস্ক ও লুহানস্কের স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে স্বীকার করতে নারাজ। তারা দনেৎস্ক ও লুহানস্ককে ‘সন্ত্রাসবাদী’, ‘রুশ মার্সেনারি’, ‘রুশ অনিয়মিত সৈন্য’ প্রভৃতি নামে আখ্যায়িত করেছে এবং দাবি করছে যে, এই যুদ্ধ মূলত ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে চলমান রুশ আগ্রাসন।
কিন্তু ইউক্রেনীয় সরকারের সৃষ্ট এই বিবরণ যৌক্তিকতা বিবর্জিত। ২০২১ সালের মার্চ থেকে রাশিয়া ইউক্রেনীয় সীমান্তের কাছে সৈন্য সমাবেশ করেছে এবং তখন থেকে ইউক্রেন ও পশ্চিমা বিশ্ব অভিযোগ করে আসছে যে, রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর আক্রমণ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের এই বক্তব্যের অর্থ দাঁড়ায়, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে এখনো কোনো যুদ্ধ শুরু হয়নি, কিন্তু যুদ্ধ শুরুর সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে রাশিয়া ও ইউক্রেন ২০১৪ সাল থেকে যুদ্ধে লিপ্ত – ইউক্রেনীয় সরকারের এই বক্তব্যের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকে না।
বস্তুত রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে এখনো কোনো যুদ্ধ আরম্ভ হয়নি, কিন্তু দনবাসে চলমান যুদ্ধে রাশিয়া দৃঢ়ভাবে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে এবং দনেৎস্ক ও লুহানস্কের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তদুপরি, ২০১৪ সালে রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া দখল/ক্রিমিয়ার রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্তি, ইউক্রেনের অভ্যন্তরে ইউক্রেনীয় সরকার কর্তৃক গৃহীত তীব্র রুশবিরোধী নীতি, ইউক্রেনে পশ্চিমা বিশ্বের ব্যাপক প্রভাব বৃদ্ধি, ইউক্রেন কর্তৃক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘ন্যাটো’তে যোগদানের সম্ভাবনা, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড, রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেনের নিকট স্বল্প মূল্যে প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি স্থগিতকরণ এবং ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ পাইপলাইন নির্মাণ প্রভৃতি নানাবিধ কারণে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে তীব্র দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিরাজ করছে।
রুশ–ইউক্রেনীয় দ্বন্দ্ব এবং দনবাস যুদ্ধের কারণ কী? এই দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ কেন আরম্ভ হয়েছে? কেনই বা এই দ্বন্দ্ব/যুদ্ধের কোনো নিষ্পত্তি হচ্ছে না? বস্তুত রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যবর্তী সম্পর্কের ঐতিহাসিক পটভূমি বিশ্লেষণ ব্যতীত এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা সম্ভব নয়। এজন্য রুশ–ইউক্রেনীয় সম্পর্কের ঐতিহাসিক পটভূমির সারসংক্ষেপ এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয়বস্তু।
রুশ রাষ্ট্রের সূচনা এবং মোঙ্গল, পোলিশ ও লিথুয়ানীয় আক্রমণ
বর্তমান রাশিয়ার ইউরোপীয় ভূখণ্ডের পশ্চিমাংশ, ইউক্রেন ও বেলারুশে প্রাচীনকাল থেকে পূর্ব স্লাভিক জাতির বিভিন্ন শাখাপ্রশাখা বসবাস করত। এরা সামগ্রিকভাবে ‘রুশ’ (Русь) নামে পরিচিত ছিল। ৮৬২ সালে স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চল থেকে আগত ভাইকিংরা (রুশ ভাষায় ‘Варяги’ বা ‘ভারিয়াগি’ নামে পরিচিত) নভগরোদে (বর্তমান উত্তর রাশিয়ার নভগরোদ প্রদেশের ভেলিকি নভগরোদ শহর) রুশ ইতিহাসের প্রথম স্বীকৃত রাষ্ট্র স্থাপন করে। উক্ত ভাইকিংদের সঙ্গে স্থানীয় রুশ ও ফিনো–উগ্রিক (এবং পরবর্তীতে বৃহত্তর তুর্কি) জাতিসমূহের সংমিশ্রণের ফলে আধুনিক রুশ জাতির সৃষ্টি হয়েছে। নভগরোদকে কেন্দ্র করে ভাইকিং–উদ্ভূত রিউরিকোভিচি রাজবংশ রুশ ভূখণ্ডগুলোকে একত্রিত করতে শুরু করে। তারা ৮৮২ সালে কিয়েভ (বর্তমান ইউক্রেনের রাজধানী) দখল করে এবং শহরটিকে ক্রমশ বিস্তৃত হতে থাকা রুশ রাষ্ট্রের রাজধানীতে রূপান্তরিত করে।
উক্ত রাষ্ট্রটি ইতিহাসে ‘রুশ’, ‘কিয়েভস্কায়া রুশ’ (রুশ: Киевская Русь) এবং ‘প্রাচীন রুশ’ (রুশ: Древняя Русь, ‘দ্রেভনিয়া রুশ’) নামে পরিচিত। বর্তমানে নভগরোদ ও কিয়েভ শহরদ্বয়কে রুশ সভ্যতার উৎপত্তিস্থল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দশম শতাব্দী নাগাদ কিয়েভস্কায়া রুশ রাষ্ট্রটি ক্রমশ অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে, এবং পশ্চিমে ভিশ্চুলা নদী থেকে পূর্বে ভোলগা ও ওকা নদীর সংযোগস্থল পর্যন্ত এবং উত্তরে শ্বেত সাগর থেকে দক্ষিণে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। কিন্তু দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কিয়েভস্কায়া রুশ রাষ্ট্রটি বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং রিউরিকোভিচি রাজবংশের বিভিন্ন শাখাপ্রশাখা উক্ত রাষ্ট্রগুলোকে শাসন করতে থাকে। অবশ্য তখনো কিয়েভকে প্রধান রুশ নগরী হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
১২৩৭–৪০ সালে মোঙ্গল–নিয়ন্ত্রিত গোল্ডেন হোর্ড (রাষ্ট্রটি ‘জুচি উলুস’ নামেও পরিচিত ছিল) রুশভূমিতে আক্রমণ চালায় এবং রুশ রাষ্ট্রগুলোর সিংহভাগকে বিধ্বস্ত করে দেয়। ১২৪০ সালে গোল্ডেন হোর্ডের আক্রমণে কিয়েভ বিধ্বস্ত হয় এবং তখন থেকে রুশ রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দু কিয়েভ থেকে পূর্ব দিকে স্থানান্তরিত হয়। গোল্ডেন হোর্ড পরাজিত ও বিধ্বস্ত রুশ রাষ্ট্রগুলোকে নিজস্ব রাষ্ট্রকাঠামোতে অঙ্গীভূত করে নেয় নি। বরং রুশ রাষ্ট্রগুলোর সিংহভাগ গোল্ডেন হোর্ডের করদ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। অন্যদিকে, পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়া তদানীন্তন রুশ ভূখণ্ডের পশ্চিম ও দক্ষিণাংশ (যেগুলোর মধ্যে ছিল বর্তমান ইউক্রেনের সিংহভাগ ভূখণ্ড) দখল করে নেয়। এভাবে মোঙ্গল আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচীন রুশ ভূখণ্ড তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
প্রায় ২৪০ বছরব্যাপী গোল্ডেন হোর্ডের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধবিগ্রহের পর গোল্ডেন হোর্ডের আয়ত্তাধীনে থাকা রুশ করদ রাষ্ট্রগুলো মোঙ্গলদের কর্তৃত্ব থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয় এবং মস্কোর (বর্তমান রাশিয়ার রাজধানী) নেতৃত্বাধীনে ‘মাস্কোভি’ (ইংরেজি: Muscovy) বা ‘মস্কো গ্র্যান্ড প্রিন্সিপালিটি’ (রুশ: Великое княжество Московское, ‘ভেলিকোয়ে ক্নিয়াঝেস্তভো মস্কোভস্কোয়ে’) নামক একটি বৃহৎ রাষ্ট্রের অধীনে একত্রিত হয়। লিথুয়ানিয়া ও পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি যুদ্ধের পর মাস্কোভি ত্রয়োদশ শতাব্দীতে উক্ত রাষ্ট্রদ্বয়ের কাছে হারানো বেশকিছু ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করে, কিন্তু বর্তমান ইউক্রেনের সিংহভাগ ভূখণ্ড তখনো পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ার অধীনে থেকে যায়। তদুপরি, গোল্ডেন গোর্ডের একটি উত্তরসূরী রাষ্ট্র ক্রিমিয়ান খানাত লিথুয়ানিয়ার কাছ থেকে বর্তমান ইউক্রেনের অংশবিশেষ দখল করে নিয়েছিল, এবং ১৪৭৫ সাল নাগাদ উক্ত রাষ্ট্রটি ওসমানীয় রাষ্ট্রের একটি আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার অধীনে রুশ জাতির বিভাজনের সূচনা
১৫৪৭ সালে ‘মস্কো গ্র্যান্ড প্রিন্সিপালিটি’র শাসক ‘সমগ্র রাশিয়ার জার’ উপাধি গ্রহণ করেন এবং এর ফলে মস্কো গ্র্যান্ড প্রিন্সিপালিটি ‘রুশ জারতন্ত্র’ (রুশ: Русское царство, ‘রুস্কোয়ে জারস্তভো’) নাম ধারণ করে। অন্যদিকে, ১৫৬৯ সালে পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়া একত্রিত হয়ে ‘পোলিশ–লিথুয়ানীয় কমনওয়েলথ’ (পোলিশ: Rzeczpospolita Obojga Narodów) নাম ধারণ করে। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে পোলিশ–লিথুয়ানীয় কমনওয়েলথ রাশিয়া আক্রমণ করে ও রাশিয়াকে দখল করে নেয়ার প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু তাদের আক্রমণ ব্যর্থ হয়। এই পর্যায়ে বর্তমান ইউক্রেনের ভূখণ্ড তিনটি রাষ্ট্রের মধ্যে বিভক্ত ছিল – রাশিয়া, পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়া এবং উসমানি সাম্রাজ্যের অধীনস্থ ক্রিমিয়ান খানাত। সেসময় বর্তমান দনবাস অঞ্চলসহ পূর্ব ইউক্রেনের বৃহদাংশ ছিল রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন, কিয়েভসহ মধ্য ও পশ্চিম ইউক্রেনের সিংহভাগ ছিল পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন এবং দক্ষিণ ইউক্রেনের অংশবিশেষ ছিল ক্রিমিয়ান খানাতের নিয়ন্ত্রণাধীন।
উল্লেখ্য, ‘কিয়েভস্কায়া রুশ’ বা ‘প্রাচীন রুশে’র সময় বর্তমান রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশের ভূখণ্ডে বসবাসরত সকল স্লাভকেই ‘রুশ’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সেসময় ইউক্রেনীয় বা বেলারুশীয় পরিচিতির উৎপত্তি হয়নি। অর্থাৎ, রুশভূমিতে মোঙ্গল আক্রমণের পূর্বে ইউক্রেনীয় বা বেলারুশীয় নামে কোনো জাতির অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু মোঙ্গল আক্রমণের ফলে রুশ রাষ্ট্রগুলোর বিপর্যস্ত অবস্থার সুযোগে পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়া বর্তমান ইউক্রেন ও বেলারুশের ভূখণ্ডের সিংহভাগ দখল করে নেয়। কিন্তু উক্ত ভূখণ্ডে বসবাসরত রুশরা পোলিশ ও লিথুয়ানীয়দের আধিপত্য মেনে নেয়নি। উক্ত ভূখণ্ডে বসবাসরত রুশরা ছিল প্রধানত অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মের অনুসারী, অন্যদিকে পোলিশ ও লিথুয়ানীয়রা ছিল ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের অনুসারী। তদুপরি, রুশদের ভাষা, সংস্কৃতি, আইনব্যবস্থা ও জীবনধারা ছিল পোলিশ ও লিথুয়ানীয়দের তুলনায় স্বতন্ত্র এবং পোলিশ ও লিথুয়ানীয় অভিজাত শ্রেণি নিজেদেরকে রুশদের তুলনায় উচ্চস্তরের জাতি হিসেবে বিবেচনা করত।
এমতাবস্থায় পোলিশ ও লিথুয়ানীয় শাসকরা তাদের শাসনাধীনে থাকা রুশদেরকে ‘পোলীয়করণ’ (Polonization) ও ‘লিথুয়ানীয়করণ’ (Lithuanianization) করার প্রচেষ্টা চালায়। বিশেষত তারা উক্ত রুশদের ওপর ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্ম চাপিয়ে দেয়ার ব্যাপক প্রচেষ্টা চালায়। প্রায় চার শতাব্দীব্যাপী প্রচেষ্টার ফলে সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার শাসনাধীনে থাকা রুশদের একটি অংশ ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। এর ফলে পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার অধীনে বসবাসরত রুশদের একাংশের মধ্যে পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার অধীনে বসবাসরত রুশদের বাকি অংশের এবং রাশিয়ার অধীনে বসবাসরত রুশদের তুলনায় স্বতন্ত্র এক জাতিসত্তার বীজ রোপিত হয়।
বোহদান খেমেলনিৎস্কির বিদ্রোহ এবং রাশিয়া ও ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডের পুনরেকত্রীকরণের সূচনা
অবশ্য পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার অধীনে থাকা রুশদের সিংহভাগই পোলিশ–লিথুয়ানীয় শাসনের ফলে অসন্তুষ্ট ছিল এবং এর ফলে বিভিন্ন সময়ে তারা পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, কিন্তু সেগুলোর সবই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৬৪৮ সালে পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার অধীনে থাকা ‘কসাক’রা (রুশ: Казаки, ‘কাজাকি’) বোহদান খেমেলনিৎস্কির নেতৃত্বে পোলিশ–লিথুয়ানীয় শাসনের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিদ্রোহ করে। উল্লেখ্য, ‘কসাক’রা হচ্ছে রুশ জাতির একটি শাখা, যারা স্বতন্ত্র সামরিক–কৃষি সমাজে বসবাস করত এবং প্রধানত রাশিয়া ও পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার সীমান্তরক্ষী সৈন্যদল হিসেবে দায়িত্ব পালন করত। ১৬৪৮ সালের কসাক বিদ্রোহ পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার অধীনে থাকা রুশ জনসাধারণের সমর্থন লাভ করে এবং বিদ্রোহটি ব্যাপক আকার ধারণ করে। ১৬৫৪ সালের জানুয়ারিতে বর্তমান ইউক্রেনের পেরেইয়াস্লাভ শহরে অনুষ্ঠিত একটি সভায় খেমেলনিৎস্কির নেতৃত্বাধীন কসাকরা আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার কাছে সামরিক সহায়তা প্রার্থনা করে এবং বিনিময়ে রাশিয়ার আনুগত্য স্বীকার করে নেয়।
এর ফলে রাশিয়া ও পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় যায় এবং ১৬৬৭ সাল নাগাদ এই যুদ্ধে পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়া পরাজিত হয়। ফলশ্রুতিতে পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার অধীনে থাকা দনেপর নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড ও কিয়েভ রাশিয়ার হস্তগত হয়। এসময় ‘ইউক্রেনীয়’ বলতে কোনো জাতির অস্তিত্ব ছিল না এবং ‘ইউক্রেন’ বলতে কেবল একটি ভৌগোলিক অঞ্চলকে বোঝানো হতো। ইউক্রেনে বসবাসরত রুশদের ‘ক্ষুদ্র রুশ’ হিসেবে অভিহিত করা হতো এবং সেই মোতাবেক ইউক্রেনকে ‘ক্ষুদ্র রাশিয়া’ (রুশ: Малороссия, ‘মালোরোসিয়া’) নামে আখ্যায়িত করা হতো। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত তাদের এই পরিচিতি বিদ্যমান ছিল।
অর্থাৎ, সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত বর্তমান পূর্ব ইউক্রেনের বৃহদাংশ রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল এবং সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়া কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত দনেপর নদীর পূর্ব তীরবর্তী ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডও (কিয়েভ–সহ) পুনরায় রাশিয়ার হস্তগত হয়। অবশ্য দনেপর নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড তখনো পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল এবং দক্ষিণ ইউক্রেনের অংশবিশেষ ক্রিমিয়ান খানাতের অধীনে ছিল।
পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার বিভাজন এবং দুই ইউক্রেনের সৃষ্টি
অষ্টাদশ শতাব্দী নাগাদ পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়া ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো (রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া) তাদের ভূখণ্ড নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে শুরু করে। ১৭৭২, ১৭৯৩ ও ১৭৯৫ সালে যথাক্রমে পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাজন সংঘটিত হয় এবং পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়া কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে বিভাজিত হয়। এদিকে ১৭৭৯ সালে ক্রিমিয়ান খানাত কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড সরাসরি ওসমানীয় রাষ্ট্রের কর্তৃত্বাধীনে চলে যায়, কিন্তু ১৭৮৭–১৭৯২ সালের রুশ–ওসমানীয় যুদ্ধে ওসমানীয় রাষ্ট্রের পরাজয়ের ফলে উক্ত ভূখণ্ড রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়।
অর্থাৎ, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ বর্তমান ইউক্রেনের ভূখণ্ড দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে— রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়া। এসময় ইউক্রেনের সিংহভাগ ভূখণ্ড রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং অঞ্চলটি ‘ইউক্রেন’ বা ‘ক্ষুদ্র রাশিয়া’ নামে পরিচিত ছিল। অন্যদিকে, ইউক্রেনের অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র একটি অংশ অস্ট্রিয়ার শাসনাধীনে ছিল এবং সেটি ‘পশ্চিম ইউক্রেন’ নামে পরিচিতি অর্জন করে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘ক্ষুদ্র রাশিয়া’ ও পশ্চিম ইউক্রেনে ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদের প্রসার
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় পুরো সময় জুড়ে ‘ক্ষুদ্র রাশিয়া’ বা রুশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটেনি। সেসময়ের রুশ সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী ‘বৃহৎ রুশ’ (বর্তমান রুশ জাতি), ‘ক্ষুদ্র রুশ’ (বর্তমান ইউক্রেনীয় জাতি) এবং ‘শ্বেত রুশ’ (বর্তমান বেলারুশীয় জাতি) জাতিত্রয়কে অখণ্ড ‘নিখিল রুশ জাতি’র (রুশ: общерусский народ, ‘ওবশ্চিয়েরুস্কি নারোদ’) অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। দীর্ঘদিন বিদেশি শাসনাধীনে থাকার ফলে ‘ক্ষুদ্র রুশ’দের মধ্যে যে স্বতন্ত্র সত্তার বিকাশ ঘটেছিল, সেটাকে রুশ সরকার রুশ জাতিরই একধরনের আঞ্চলিকতা হিসেবে বিবেচনা করতো এবং তখনো ক্ষুদ্র রুশদের সিংহভাগ ‘ইউক্রেনীয় পরিচিতি’ গ্রহণ করেনি। কেবল ১৮৮০–এর দশকে এসে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের প্রেক্ষাপটে রুশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনের জনসাধারণের ক্ষুদ্র একটি অংশের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা ছড়িয়ে পড়ে।
অবশ্য সেসময় রুশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনের ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা ছিল প্রধানত বামপন্থী ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার অনুসারী এবং রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া তাদের সিংহভাগের উদ্দেশ্য ছিল না। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল রুশ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আঞ্চলিক ও সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসন লাভ। কিন্তু অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির (১৮৬৭ সালে অস্ট্রীয় সাম্রাজ্য অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরির সমন্বয়ে গঠিত একটি ‘দ্বৈত রাজতন্ত্রে’ পরিণত হয়) অধীনস্থ পশ্চিম ইউক্রেনে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিস্তারের প্রক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের।
অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির শাসকশ্রেণি ছিল জাতিগতভাবে জার্মান ও হাঙ্গেরীয়, এবং তারা রুশ ও অন্যান্য স্লাভিক জাতিকে (এবং পশ্চিম ইউক্রেনের রুশদেরকে) নিজেদের তুলনায় নিচু শ্রেণির হিসেবে বিবেচনা করত। তদুপরি, তারা ছিল ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের অনুসারী; অন্যদিকে, পোলিশ–লিথুয়ানীয়দের সুদীর্ঘ প্রচেষ্টার ফলে পশ্চিম ইউক্রেনের রুশদের একাংশ ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেও তাদের সিংহভাগ তখনো অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মের অনুসারী ছিল। এই পরিস্থিতিতে এবং অস্ট্রীয় (পরে অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয়) শাসকদের নানা ধরনের বৈষম্যের প্রতিবাদে পশ্চিম ইউক্রেনের রুশদের মধ্যে রুশ জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার বিস্তার আরম্ভ হয়।
অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় সরকারের আশঙ্কা ছিল, পশ্চিম ইউক্রেনের রুশদের মধ্যে রুশ জাতীয়তাবাদের বিস্তারের ফলে অঞ্চলটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদের সৃষ্টি হবে এবং এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাশিয়া অঞ্চলটি দখল করে নিতে পারবে। এই প্রেক্ষাপটে তারা একটি অভিনব কৌশল অবলম্বন করে। পশ্চিম ইউক্রেনের রুশদের জোরপূর্বক ‘জার্মানীকরণে’র (Germanization) প্রচেষ্টা না চালিয়ে তারা পশ্চিম ইউক্রেনের রুশদের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেয়। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় সরকার পশ্চিম ইউক্রেনে প্রচলিত রুশ ভাষার আঞ্চলিক রূপকে একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং এটি ‘ইউক্রেনীয়’ ভাষা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তারা সেখানকার রুশদের রুশ হিসেবে পরিচিতি প্রদানের পরিবর্তে ‘ইউক্রেনীয়’ হিসেবে পরিচিতি প্রদান করতে উৎসাহিত করে এবং ‘ইউক্রেনীয়’ পরিচিতি গ্রহণকারীদের জন্য কিছু সুযোগ–সুবিধার ব্যবস্থা করে। একইসঙ্গে তারা পশ্চিম ইউক্রেনে রুশ ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদের প্রসারকে কঠোর হাতে দমন করে।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মোঙ্গল আক্রমণের পর থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত পশ্চিম ইউক্রেনের রুশরা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল এবং রুশ জাতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। প্রায় পাঁচ শতাব্দী যাবৎ পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়া তাদের মধ্যে স্বতন্ত্র জাতিসত্তা সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং পরবর্তী এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিম ইউক্রেনের রুশদের মধ্যে স্বতন্ত্র জাতিসত্তার বিকাশ ঘটতে থাকে। ক্রমশ উৎপত্তি ঘটে ইউক্রেনীয় জাতির। অবশ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদের বিস্তৃতির মাত্রা অনুধাবন করা যায়নি।
পশ্চিম ইউক্রেনের রুশদের মধ্যে ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদ বিস্তারের পাশাপাশি একই সময়ে অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় গোয়েন্দা সংস্থা রুশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনে ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদের বিস্তার ঘটানোর জন্য বিস্তৃত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে জার্মান গোয়েন্দা সংস্থা তাদেরকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে। জার্মান ও অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় গোয়েন্দা সংস্থার সুপরিকল্পিত কার্যক্রমের ফলে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে রাশিয়া জুড়ে সংঘটিত ব্যাপক আর্থ–সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় রুশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনেও ইউক্রেনীয় পরিচিতি ও ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদ বিস্তার লাভ করতে থাকে। অবশ্য ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদ পশ্চিম ইউক্রেনের জনসাধারণের মধ্যে যতটা শিকড় গাড়তে পেরেছিল, রুশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনের জনসাধারণের মধ্যে ততোটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে রুশ সরকারের ধারণা ছিল, অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে পশ্চিম ইউক্রেনের ‘ভ্রাতৃসুলভ’ রুশ জনসাধারণ ‘বিজাতীয়’ অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে এবং রুশ সৈন্যদের ‘মুক্তিদাতা’ হিসেবে স্বাগত জানাবে। অন্যদিকে, জার্মান ও অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় সরকারদ্বয়ের ধারণা ছিল, রাশিয়ার সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে রুশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদী জনসাধারণ রুশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে এবং জার্মান ও অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় সৈন্যদের মুক্তিদাতা হিসেবে স্বাগত জানাবে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর মস্কো, বার্লিন ও ভিয়েনা সকলের সমীকরণই পুরোপুরি পাল্টে যায়!