Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

চীনের দুর্ভিক্ষ: শতাব্দীর অন্যতম এক মানবিক বিপর্যয়

সময়টা ছিলো পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশক। কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সে তুং তখন চীনের হাল ধরে ঘোষণা দেন চীনকে একটি আধুনিক শিল্পোন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার। একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটানোর স্বপ্ন নিয়ে তিনি ‘দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ নামে আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু এই আন্দোলনের পরিণাম গিয়ে ঠেকেছে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে, যে দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল অন্তত তিন কোটির মতো মানুষ।

বিংশ শতাব্দীর মানবিক বিপর্যয়ের ভয়াবহ ঘটনাগুলোর মধ্যে চীনের এই দুর্ভিক্ষ অন্যতম। মাও সে তুং চেয়েছিলেন চীনের কৃষি অর্থনীতিকে শিল্পে রুপান্তরিত করতে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পকারখানাগুলো রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নেয়া হয়েছিল। আর অন্যদিকে চীনের গ্রামগুলো একত্র করে যৌথ চাষাবাদের আওতায় আনা হয়েছিল এবং কমিউন গঠন করা হয়েছিল। কোনো কোনো হিসেব মতে, ২০-২৫ হাজার কমিউন গঠন করা হয়েছিল। আর এই কমিউনগুলো চলতো পুরোপুরি সামরিক বাহিনীর অধীনে।

image source: laurenream.com

কৃষকদের থাকার জন্য ব্যারাক তৈরি করা হয়েছিল। প্রতিদিন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মাঠে কাজ করা লাগতো। মাও কৃষকদের জমিতে ফসল ফলানোর থেকে লোহার আকরিক উৎপাদনে নির্দেশ দেন। নির্দেশনানুযায়ী লোহা ও ইস্পাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার জন্য কৃষকদের লাগিয়ে দেয়া হলো ছোট ছোট ফার্নেসে। কিন্তু শিল্প ও কৃষিখাতে যে লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তা আসলে বাস্তবে সম্ভব হয়নি। এদিকে কমিউন থেকে প্রাদেশিক নেতাদের যে রিপোর্ট দেয়া হতো তা ছিল পুরোপুরি মিথ্যে। এই মিথ্যা রিপোর্ট মাও-এর কাছে পৌঁছাত, যেখানে উৎপাদনের সাফল্যের কথা উল্লেখ ছিল। উৎপাদনের উর্ধ্বগতি দেখে মাও উৎপাদনের বাড়তি অংশ শহরগুলোতে পাঠিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিতেন। বাড়তি অংশ পাঠানোর ফলে দেখা যেত কমিউনগুলোতে খাওয়ার মতো আর কোনোকিছুই অবশিষ্ট থাকতো না। আর এদিক থেকে মাও-এর বাড়তি উৎপাদনের চাহিদা পূরণ ও মিথ্যা রিপোর্ট চীনে ডেকে আনে ইতিহাসের ভয়াবহ এক দুর্ভিক্ষ।

image source: guestlist.com

চীনের এই দুর্ভিক্ষের বর্ণনা শুনলে আজও মানুষ বিচলিত হয়ে পড়ে। ক্ষুধার যন্ত্রণা এক প্রকট আকার ধারণ করে। কেড়ে নেয় কোটি মানুষের প্রাণ। গ্রামাঞ্চলগুলোতে যেখানে-সেখানে মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যেত। মানুষ বেঁচে থাকার জন্য পোকামাকড়, গাছের গুড়ি, বাকল, পাতা তুলে খেয়ে একেকটি দিন পার করতো। আশেপাশে পশুপাখি যা-ই পেত তারা সেগুলো শিকার করে খেত। এরকম একপর্যায়ে গ্রামগুলোতে কোনো কুকুর, বিড়াল বা গবাদিপশুর দেখা পাওয়া যেত না। ক্ষুধা নিবারণের উদ্দেশ্যে সবগুলোই শিকার করে খেয়ে ফেলা হয়।

এমনও অনেক ভয়াবহ বর্ণনা শোনা যায় যে, মৃতপ্রায় ব্যক্তি নিজেই তার প্রতিবেশীকে মাটি চাপা দিতে বলেছিল। অনেক ক্ষেত্রে সপরিবারে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। গ্রামের পর গ্রাম মৃতদেহের স্তুপ পড়ে ছিল। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, মৃতদেহগুলো খাওয়ার মতো কোনো কুকুর বা অন্য বন্যপ্রাণী পর্যন্ত অবশিষ্ট ছিল না। ক্ষুধার যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে সবকিছু শিকার করে খেয়ে ফেলা হয়েছিল। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল যে, মানুষ তখন মৃতদেহ পর্যন্ত খাওয়া শুরু করেছিল।

image source: taiwantoday.com

দু’মুঠো খাবারের জন্য মানুষ যা করেছিল তা ভাবলেও অবাক হতে হয়। ময়লা-আবর্জনা থেকে শুরু করে কিছুই বাদ দেয়নি। কেউ কেউ তো নিজ সন্তানকে পর্যন্ত খেয়ে ফেলত! অনেকেই নিজের স্ত্রী-সন্তান বিনিময় করতো অন্য কারো সাথে। ক্ষুধার যন্ত্রণা মানুষকে নরখাদক বানিয়ে দিয়েছিল। মানবসৃষ্ট এই খাদ্যাভাবের কবলে পড়ে এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কথা জেনেও নির্বাক ভূমিকা পালন করেছেন কমিউনের নেতারা। তাদের মিথ্যা রিপোর্টের ফলাফল কতটা ভয়াবহ রুপ ধারণ করতে পারে তার ফল এই দুর্ভিক্ষ।

কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান নেতা মাও সে তুং; image source: chinadaily.com

এরই মাঝে মাও সে তুং ঘোষণা করলেন, যারা তার মত ও পরিকল্পনার বিরোধিতা করবে, তারা সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ‘দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ সম্পর্কে অভিজ্ঞ পরিকল্পনাকারী ও প্রকৌশলীদের মতামতও তিনি মানতে নারাজ ছিলেন। তবে এর ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের কথা তিনি জানতেন। তবুও তিনি তার পরিকল্পনার সমালোচনা করতে নারাজ ছিলেন। তিনি একে তার পরিকল্পনার সাফল্য হিসেবেই মনে করেন। যদিও আদৌ কোনো লক্ষণীয় সাফল্য ছিল না। আশ্চর্যজনকভাবে তখন চীনের এই দুর্ভিক্ষের কথা চীনের শহরাঞ্চলের মানুষ ও বিশ্ববাসীর কাছ থেকে পুরোপুরি গোপন রাখা হয়।

image source: quartz.com

চীনের এই দুর্ভিক্ষের পেছনে ঘটে যাওয়া খুটিনাটি বিষয়বস্তু নিয়ে চীনা সাংবাদিক ইয়াং জে সিং এর লেখা “Tombstone: The Great Chinese Famine” বইটি আজও দেশটিতে নিষিদ্ধ। তিনি বইটিতে ৩৬ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেন। কোনো কোনো এলাকায় মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ বা তারও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। চীনের গ্রামগুলো যেন এক মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছিল। চারদিকে মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিল, বীভৎস এক পরিবেশের উত্থান হয়েছিল। মানুষ মৃতদেহের শরীরের মাংস খেয়ে একেকটি বিভীষিকাময় দিন পার করতো। কিন্তু এই দুর্ভিক্ষের সময় কমিউনিস্ট নেতাদের পাশে পায়নি জনগণ, বরং রেড ক্রসের সাহায্যের আবেদন ফিরিয়ে দেন মাও।

ক্ষমতাসীন দলসহ নিজের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বের কাছে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য এরকম একটি দুর্ভিক্ষের কথা গোপন রাখা হয়েছিল। এছাড়া যেসকল শরনার্থী হংকং-এ পালিয়ে এসেছিল তাদের দেয়া প্রত্যক্ষ বর্ণনাগুলো প্রকাশ করা হয়েছিল আরো দুই দশক পর। এমনকি ১৯৯৭ সালের সংস্করণে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাও বিগত ২০০ বছরের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের তালিকায় চীনের এই দুর্ভিক্ষ লিপিবদ্ধ করেনি।

Related Articles