ট্রেনে ট্রেনে আবার ডুয়াল লড়াই হয় কীভাবে! ডুয়াল লড়াইয়ের কথা মনে আসলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ওয়াইল্ড ওয়েস্টের মরুভূমি, মাথায় কাউবয় হ্যাট আর হাতে ধোঁয়া ওঠা আগ্নেয়াস্ত্র নেয়া কোনো যোদ্ধার চেহারা। কারণ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডুয়াল ব্যাপারটার সাথে আমাদের পরিচয় হলিউডের সিনেমার মাধ্যমে, যেখানে ডুয়াল ব্যাপারটাকে সাধারণত দুজন মানুষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একে অপরের দিকে গুলি ছোড়ার লড়াই কৌশল হিসেবে দেখানো হয়।
কিন্তু ১৮৯৬ সালে মিসৌরি কানসাস টেক্সাস রেলরোড যে ডুয়াল লড়াইয়ের আয়োজন করেছিল, সেটা ছিল কিছুটা ভিন্ন ধরনের। মানুষের পরিবর্তে বাষ্পীয় রেলগাড়িকে একে অপরের দিকে তেড়ে আসার এক ডুয়ালের আয়োজন করে তারা। এ যুগে এমন মারাত্মক আর ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়তো কোনো কোম্পানির জন্যেই সহজ কাজ হতো না, কিন্তু আজ থেকে ১২৬ বছর আগে ১৮৯৬ সালের নিয়মনীতি, আইন, এবং মানুষের ধারণা— সবই ছিল ভিন্ন ধরনের। আর সে কারণেই হয়তো এমন হতবাক করা বিস্ময়কর ব্যবসায়িক পন্থা অবলম্বন করতে পেরেছিল মিসৌরি কানসাস টেক্সাস রেলরোড কোম্পানি, যাদের সংক্ষেপে ডাকা হতো ক্যাটি বলে।
মূলত ১৮৯৩ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পরবর্তী সময়ে অনেক রেল কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যাবার ঝুঁকিতে পড়ে। সে কারণে নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বড় কোম্পানিরা নতুন ব্যবসায়িক পন্থা খুঁজতে থাকে। ১৮৯৫ সালে কেবল যাত্রী পরিবহন করে ১.২ মিলিয়ন ডলার আর মালামাল পরিবহন করে আরও ৩ মিলিয়ন ডলার আয় করা মিসৌরি কানসাস টেক্সাস রেলরোড কোম্পানিও নিজেদের প্রতিষ্ঠানকে আরো জনপ্রিয় করার পন্থা খুঁজছিল। সেসময় বোর্ড মেম্বারদের কাছে দুই ট্রেনের ডুয়াল লড়ানোর এই বিস্ময়কর পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হন জেনারেল প্যাসেঞ্জার এজেন্ট উইলিয়াম জর্জ ক্রাশ।
এই ধরনের পরিকল্পনা সেসময়ে একেবারে নতুন ছিল না। ক্রাশের বছরখানেক আগে ওহিওর রেলওয়ের সরঞ্জাম বিক্রয়কারী এএল স্ট্রিটার্স এ ধরনের একটি ধারণার বাস্তব রূপ দেয়— যা সবার বেশ নজর কাড়ে। সে ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল নিতান্তই কম, এবং একজন মাত্র মানুষ আহত হয়েছিল বলে জানা যায়। কিন্তু যে পরিমাণ প্রচারণা এই খবর পেয়েছিল, তাতে অনুপ্রাণিত হয়েই ক্রাশ বড় মাপে তার পরিকল্পনা সাজিয়ে টেক্সাস রেলরোড কোম্পানির সামনে হাজির করে।
মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্রাশ চেয়েছিলেন দুটি বাষ্পচালিত রেলগাড়ি নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে একে অপরের উপর পূর্ণ গতিতে আছড়ে পড়বে। যন্ত্রদানবদের এই মুখোমুখি সংঘর্ষ দেখতে সাধারণ মানুষদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে তারা দুই রেলগাড়ির ভয়ানক এই ডুয়াল উপভোগ করবে। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে টিকিটের টাকা নেয়া হবে। সেই সাথে এই ধরনের অভাবনীয় উদ্যোগের জন্য পত্রপত্রিকায় যে পরিমাণে খবর ছাপা হবে, তাতেই মিসৌরি কানসাস টেক্সাস রেলরোড কোম্পানির বড় মাপের প্রচার হয়ে যাবে।
ক্রাশের পরিকল্পনা শুনে বোর্ড মেম্বাররা সন্তুষ্ট হলেও দুটো ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে কী ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে সে বিষয়ে জানার জন্য তাদের রেল ইঞ্জিনিয়ারদের ডেকে পাঠানো হলো। তাদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে একজন বাদে সব ইঞ্জিনিয়ার জানালো এ ধরনের সংঘর্ষে বড় দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভবনা নেই। শুধু একজন ইঞ্জিনিয়ার জানাব- এ ধরনের ঘটনার ফলে বয়লার ফাটার মতো দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু তার সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে দুই ট্রেনের সম্মুখযুদ্ধের আয়োজনের জন্য সম্মতি দিয়ে দিল ক্যাটি বোর্ড মেম্বাররা।
টেক্সাসের ওয়াকো নামের শহরের উত্তরে তিন দিকে পাহাড়ে ঢাকা একটি স্থান প্রথমে এই প্রদর্শনীর জন্য নির্বাচন করা হয়। ওয়াকো থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরবর্তী এই স্থানটি তখনও ফাঁকাই ছিল। ক্রাশ এবং একদল কর্মী মূল প্রদর্শনীর কয়েক সপ্তাহ আগে সেখানে অস্থায়ী একটি শহর নির্মাণের কাজ শুরু করেন। মূল লাইনকে অস্থায়ী এ শহরের সাথে সংযুক্ত করতে ৪ মাইলের আলাদা রেললাইন বসানোর কাজ শুরু হয় পুরোদমে। একই সাথে শুরু হয় রাজসিক এই লৌহদানব ট্রেন যুদ্ধের প্রচারণা। মিসৌরি কানসাস টেক্সাস রেলরোডের পক্ষ থেকে চারিদিকে খবর ছড়িয়ে দেয়ার কাজ শুরু হয়। হ্যান্ডবিল, লিফলেট, সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন; সব মাধ্যমে চলতে থাকে আসন্ন এই বিস্ময়কর ঘটনার প্রচারণা।
দেখতে দেখতে গড়ে উঠতে শুরু করে ক্রাশের অস্থায়ী শহর। তপ্ত মরুতে আগত দর্শকদের পানির সমস্যা মেটাতে খনন করা হয় দুটি কুয়া এবং সেই সাথে স্থাপন করা হয় পানির লাইন। ডালাস থেকে লোক ভাড়া করে আনা হয় ডজনখানেক লেমোনেড স্ট্যান্ড পরিচালনা করার জন্য। আগত দর্শকদের খাবারের চাহিদা মেটাতে অল্প সময়ের ভেতরেই একটি রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করে ফেলা হয় সেখানে। গ্র্যান্ডস্ট্যান্ড, তিনটি স্পিকার স্ট্যান্ড, সাংবাদিকদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম, দুটি টেলিগ্রাফ অফিস এবং একটি বিশেষ ট্রেন ডিপো ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে একটি কাঠের জেলখানা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয় ক্রাশের শহরে। রেলগাড়ির লড়াইয়ের পাশাপাশি দর্শকদের বিনোদনের জন্য কার্নিভালের ব্যবস্থাও করা হয়।
তবে মূল আয়োজন যে ট্রেনকে ঘিরে, সেই রেল ইঞ্জিন যোগাড়ের দায়িত্ব দেয়া হয় স্বয়ং উইলিয়াম ক্রাশকে। নানা জায়গা ঘুরে নিজের পছন্দসই দুটো রেলইঞ্জিন জোগাড় করেন তিনি। সেসময় নতুন চালু হওয়া ৬০ টনি রেল ইঞ্জিনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় অবসরে চলে যাওয়া দুটো ৩৫ টনি রেল ইঞ্জিনকে এ কাজের জন্য নির্বাচন করেন ক্রাশ। ইঞ্জিন নম্বর ৯৯৯ এবং ১০০১ এর ইঞ্জিন দুটোকে প্রদর্শনীর জন্য বিশেষ রঙে রাঙানো হয়। ৯৯৯-এ সবুজ রঙের উপর লাল ডোরা আর ১০০১-এ লালের উপর সবুজ ডোরা আঁকা হয়। ইঞ্জিন দুটোকে পূর্ণ রেলগাড়ির রূপ দিতে ছয়টি করে বক্স-কার বা বগী যুক্ত করা হয় এদের সাথে।
দর্শকদের মধ্যে এ ঘটনা নিয়ে বেশ সাড়া পড়তে শুরু করে। ক্যাটি রেল কোম্পানি এক্ষেত্রেও অভিনব এক পন্থার আশ্রয় নেয়। প্রদর্শনীর জন্য আলাদা কোনো টিকেটের ব্যবস্থা না রেখে তারা ঘোষণা করে- তাদের রেলগাড়িতে চেপে ২ ডলার খরচ করে যদি কেউ একটি রাউন্ড ট্রিপে ভ্রমণ করে, তাহলে তাদের বিশেষ এই প্রদর্শনীতে প্রবেশের জন্য আলাদা কোনো খরচ করা লাগবে না। আয়োজকদের ধারণা ছিল- সম্ভবত ২০ থেকে ২৫ হাজার দর্শক এই ঘটনা দেখতে হাজির হবে। কিন্তু তাদের বিজ্ঞাপন এতটাই জোরদার হয়েছিলো যে শেষ পর্যন্ত এই প্রদর্শনীতে ৪০ হাজার দর্শক উপস্থিত হয়!
তবে উপচে পড়া দর্শদের ব্যাপারে আন্দাজে গরমিল হলেও বাকি কাজ তারা প্রদর্শনীর আগে ভালোভাবেই গুছিয়ে আনে। দর্শকদের রেল ট্র্যাকের ১৮০ মিটারের ভেতরে যাবার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তবে সাংবাদিক এবং প্রেসের লোকেদের ১০০ গজের ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি দেয় আয়োজকরা। ৩০টি স্পেশাল ট্রেনে করে দর্শকরা উৎসবের দিনে ক্রাশের অস্থায়ী শহরে আসতে শুরু করে। ১৮৯৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার ভেতরেই প্রায় ১০ হাজার দর্শক চলে আসে ক্রাশের নব্যনির্মিত শহরটিতে। বিকেল ৪টায় রেলগাড়ির ডুয়ালের ঘোষণা থাকলেও দর্শকদের কথা মাথায় রেখে এক ঘণ্টা পেছানো হয় সেটি।
অবশেষে বিকেল ৫.১০ মিনিটে মাথায় বিশাল হ্যাট পরিহিত ক্রাশ এলেন ঘোড়ায় চড়ে ধুলো উড়িয়ে, ঠিক যেন ডুয়ালের জন্য প্রস্তুত কোনো কাউবয়। তার নির্দেশে দুই ইঞ্জিনের চালক আর কন্ডাক্টররা ট্রেন দুটোকে চালু করে দেন। বিকেলের ম্লান হয়ে আসা রোদে সম্মুখযুদ্ধের জন্য একে অপরের দিকে এগোতে শুরু করে বাষ্পচালিত বিশালাকার দুই রেলগাড়ি।
ইঞ্জিনিয়াররা যদিও আগে হিসেব-নিকেশ করে বের করে রেখেছিলেন কত গতিতে কত সময় ছুটে চলার পর ঠিক কোথায় দুটো ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে। সেই হিসাবেই ট্রেনের গতি ঘণ্টায় ১০ মাইলে ওঠার আগেই রেল ইঞ্জিন থেকে লাফ দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে সফল হন দুই ট্রেনের চালক এবং কুশলীরা। লাগামবিহীন ঘোড়ার মতো ট্রেন দুটো একে অপরের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। গলগল করে কালো ধোঁয়া ছাড়া বাষ্পীয় ইঞ্জিনগুলো ঘণ্টায় ৫০ মাইল বেগে একে অপরের উপর আছড়ে পড়ে। অসামান্য সেই মুহূর্ত ধরা পড়ে বহু সাংবাদিকের ক্যামেরায়।
অল্প কিছু বিশৃঙ্খলা বাদে এ পর্যন্ত সবকিছু আয়োজকদের পরিকল্পনা অনুযায়ীই এগোয়। কিন্তু যে বিপদের আশঙ্কা একেবারে প্রথমেই করা হয়েছিল এবং একজন রেল ইঞ্জিনিয়ার যে ব্যাপারে সবাইকে সাবধানও করেছিলেন, সেটাই ঘটে। প্রচণ্ড সংঘর্ষের কারণে বাষ্পীয় ইঞ্জিন দুটোর ধাতব বয়লার ফেটে বোমার স্প্রিন্টারের মতো চারদিকে ছিটকে পড়তে শুরু করে। বিস্ফোরিত ধাতব ভগ্নাংশ (Shrapnel) সরাসরি এসে আঘাত করে অরক্ষিত দর্শক আর সাংবাদিকদের উপরে। নানা সূত্র অনুযায়ী, এ দুর্ঘটনায় কমপক্ষে দুজন সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন, এবং ওয়েকো থেকে আসা একজন ফটোগ্রাফার তার চোখ হারান।
ঘটনার আকস্মিকতায় কয়েক মুহূর্তের জন্য সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলেও কিছুক্ষণ বাদেই শুরু হয় চরম বিশৃঙ্খলা। এত হট্টগোলের মাঝে বেশ কিছু দর্শক নিরাপদ দূরত্বে পালিয়ে না গিয়ে বরং ধূমায়িত ট্রেনের ধ্বংসাবশেষ থেকে স্যুভেনির সংগ্রহের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রচণ্ড উত্তপ্ত সেই ধ্বংসাবশেষ ছুঁতে গিয়ে অগণিত মানুষ নিজেদের হাত-পা পুড়িয়ে ফেলে।
বিস্ফোরণ, মানুষ হতাহতের ঘটনা আর এত অনিয়মের কারণে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে আয়োজক প্রতিষ্ঠান মিসৌরি কানসাস টেক্সাস রেলরোডের। তাৎক্ষণিকভাবে বহিষ্কার করা হয় উইলিয়াম জর্জ ক্রাশকে। ঘটনা সামাল দিতে চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়া সাংবাদিককে সে সময়ের হিসেবে ১০ হাজার ডলারের ক্ষতিপূরণ এবং আজীবনের বিনামূল্যে ট্রেনে যাতায়াতের পাশ প্রদান করা হয়। বাকি সবগুলো ঘটনাও বিচক্ষণতার সাথে সামলে নিতে সফল হয় তারা। জনরোষ বা রেলবর্জনের মতো যে আশঙ্কা তারা করছিলেন, তেমন কিছু না হয়ে বরং বিপরীতটাই ঘটে তাদের ভাগ্যে।
বিশাল এই বিস্ফোরণ আর প্রদর্শনীর খবর চারিদকে ফলাও করে প্রচার করতে শুরু করল সাধারণ দর্শকেরা। সংবাদপত্রেও ছাপা হতে থাকে একের পর এক প্রতিবেদন। দেখতে দেখতে ব্যবসায় মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে কোম্পানির। অবস্থায় উন্নতি দেখে আবারো ক্রাশকে তার কাজে ফিরিয়ে আনে কর্তৃপক্ষ। এভাবেই সমাপ্তি ঘটে ইতিহাসে বিখ্যাত, বিস্ময়কর এই রেল সংঘর্ষের প্রদর্শনীর।