
কেমন ছিল প্রাচীন সভ্যতাগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা?
শিক্ষা বলতে কী বোঝায় সেই সম্পর্কে আমাদের সবারই কম-বেশি ধারণা আছে। শিক্ষা মানুষের মাঝে ইতিবাচক এবং তুলনামূলক স্থায়ী পরিবর্তন ঘটায়। শিক্ষা এরকম আরো বহু পরিবর্তনই আনে একজন মানুষের দৈনন্দিন আচার-ব্যবহার, চিন্তা-চেতনায়। এর অর্থ হলো, শিক্ষার পেছনে উদ্দেশ্য আছে। আজ শিক্ষার পেছনে যেসব উদ্দেশ্য আছে, প্রাচীনকালেও কি শিক্ষার উদ্দেশ্য একই ছিল? নাকি সময়ের সাথে সাথে বদলেছে উদ্দেশ্যগুলো? আর সেই উদ্দেশ্য সফল করতে কি বদলেছে শিক্ষাব্যবস্থাও? জানতে চাইলে, লেখাটি আপনার জন্যই।

গ্রীক সভ্যতার বুনিয়াদ তৈরি হয়েছিল কম করে হলেও ৪,০০০ বছর আগে। সেই সময়ে গ্রিস ছিল তাদের সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ চূড়ায়, যা আজও আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে চলছে শিল্পকলা, দর্শন, বিজ্ঞান, গণিত এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। প্রাচীন গ্রীকরা সন্দেহাতীতভাবেই তৎকালীন সময়ে স্থাপত্যশিল্পে শীর্ষে ছিলো। তাদের মধ্য থেকেই উঠে এসেছেন মহান সব চিন্তাবিদ, দার্শনিক আর সামরিক কৌশল বিশেষজ্ঞ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক প্রভাব এই গ্রীক সভ্যতার। একদিনে তো আর এমন হয়নি। এত প্রভাবও তো আর এমনি এমনি বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি গ্রীক নাগরিকেরা। বিচারকের দন্ডাদেশ, গ্রীক পুরাণ, গণতন্ত্র, ট্র্যাজেডি, কমেডি, থিয়েটার, অলিম্পিক- এসব কিন্তু এই গ্রীক সভ্যতারই আশীর্বাদ।
খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর দিকে বৃহত্তর গ্রিসে মূলত দুটি পরাশক্তি ছিল। একটি গণতান্ত্রিক এথেন্স আর অন্যটি স্পার্টার সামরিক রাজ্যশাসন। গণতন্ত্রের সুতিকাগার এথেন্সে রাজ্যের আইন কিংবা নীতিমালা প্রণয়নে সর্বস্তরের মানুষের অবদান ছিল। এথেনিয়ানরা কখনো বিলাসিতায় গা ভাসাতো, আবার কখনো দুর্দণ্ড প্রতাপে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ত। যেসব ঘরে এরা বাস করত, কত সুনিপুণ হাতের কারুকার্যই না ছিল এদের গৃহে।
ওদিকে স্পার্টানরা নিজেদের সমস্ত রকমের ভোগ-বিলাসিতা থেকে দূরে রাখত। তাদের খাদ্যাভ্যাসে ছিল ঝোল। যে ঝোল ছিল শূকর, রক্ত, লবণ আর ভিনেগারের পাঁচমিশালি রেসিপি দিয়ে তৈরি। এই তথ্যগুলো কেন দরকার! কারণ একটা জাতির গূঢ় বোধ প্রকাশ পায় তাদের শিক্ষাব্যবস্থায়। জীবনব্যবস্থা, জীবনযাপনের ধরনের বাইরে তো আর শিক্ষাব্যবস্থা নয়! তাই শিক্ষাব্যবস্থায় নিঃসন্দেহে জীবনধারারও একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব থাকে।
প্রাচীন এথেনিয়ানদের শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল শিল্পকলায় প্রশিক্ষিত এবং সমৃদ্ধ নাগরিক তৈরি করা, যারা সবসময় শান্তির কথা বলবে, আর কোনো যুদ্ধ হলেও যেকোনো সময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকবে। এবং তাদের ছিল তিন রকমের স্কুল। একটি শারীরিক শিক্ষা স্কুল এবং অন্য দুটো হচ্ছে সঙ্গীত আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার স্কুল।
শারীরিক শিক্ষা স্কুলে ছেলেরা শিখত বর্শা নিক্ষেপ, চাকতি নিক্ষেপ, দীর্ঘ লাফের নানা কৌশল, দৌড়, মুষ্টিযুদ্ধ, দঙ্গল আর কুস্তি। সঙ্গীত স্কুলে তাদেরকে শেখানো হতো লাইরি, যার আক্ষরিক অর্থ সুরবাহার। কিন্তু লাইরি মূলত তৎকালীন প্রাচীন গ্রিসে ব্যবহৃত একধরনের তারের বাদ্যযন্ত্র। আরও শেখানো হতো কীভাবে এই লাইরির সঙ্গে সুর-তাল-লয় মিলিয়ে গান গাওয়া যেতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হিসেবে ছেলেরা শুধু পড়ালেখাই শিখতো। তবে হোমারের মতো কবির লেখা বাই হার্ট এর অনুচ্ছেদও পড়ানো হতো সেকালে। কবিতা কিংবা পদ্য তখন পড়ানো হতো শুধুমাত্র বাচ্চাদের সঠিক আর ভুলকে চেনানোর জন্য, ভালো আর খারাপকে চেনানোর জন্য। যদিও কিছু কিছু সময় চিত্রাঙ্কনও শেখানো হতো, তবে তা খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
মেয়েদেরকে আবার স্কুলে পাঠানো হতো না। তবে তাদের অনেকেই ঘরে বসেই আরামে আরামে অর্জন করে নিয়েছিলো পড়তে আর লিখতে পারার দক্ষতা। আর বয়স ৬-৭ পর্যন্ত ছেলেদেরও পড়াত তাদের মা অথবা কোনো পুরুষ দাস। ৬-১৪ বছর পর্যন্ত তারা প্রাথমিক শিক্ষাই অর্জন করতো। ঐ সময় বইয়ের কথা তো কল্পনাই করা যেত না। ফলশ্রুতিতে মুখস্থ বিদ্যাই ছিল ভরসা। পরে তারা ভর্তি হত উচ্চ বিদ্যালয়ে আরো দু’বছরের জন্য। সেখানেই পড়ান হতো জটিল জটিল সব লেখা, আর সেখান থেকে সোজা মিলিটারি স্কুল। এই স্কুল পার হলেই গ্র্যাজুয়েট।
৪৪৭ খ্রিস্টপূর্বে গ্রিসে পারথেনন ছিল শক্তি ও সম্পদের প্রতীক। এটি বেশ গুরুত্ববহ ছিল, কারণ একে ঘিরেই গ্রিসের অবকাঠামো বিবেচনা করা যায়। স্থাপত্যশিল্প আর এই শিল্পের যে শিক্ষা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গ্রিস বহন করে আসছে, তারই প্রতীক এই পারথেনন। স্থাপত্যশিক্ষা তো আছে বটেই, তবে প্লেটো এসেই খুলে বসলেন দর্শনের স্কুল, নাম দিলেন একাডেমি। অ্যারিস্টটল আবার খুলে বসলেন লাইসিয়াম।
প্রাচীন গ্রিস জুড়ে সফিস্টদের প্রভাব ছিল অনমনীয়। কারণ তখনকার এথেনিয়ান রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেতে সবচেয়ে বেশি যে গুণের দরকার ছিল তা ছিল বাগ্মীতা এবং তর্কে যুক্তি দিয়ে হারিয়ে দেবার ক্ষমতা। জ্ঞানী, স্বাধীন এই সফিস্ট গোষ্ঠী বাগ্মীতা দিয়ে জনগণকে বিমুগ্ধ করে রাখার এবং যুক্তিতর্কে অন্যদেরকে হারিয়ে দেবার কৌশল শেখাতেন বলেই নিঃসন্দেহে সফিস্টরাই সবচেয়ে প্রগাঢ় প্রভাবক ছিলেন গ্রিসের। আবার গরীব ঘরের ছেলেপেলেরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, সঙ্গীত কিংবা শারীরিক শিক্ষার দিকে না গিয়ে ব্যবসা শিক্ষার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন, যাকে বলে প্রায়োগিক তথা হাতে-কলমে ব্যবসা শিক্ষা। বাবা ব্যবসা করে আর সেই বাবার সাথে থেকে ব্যবসা শিখছে সন্তান।

অন্যদিকে স্পার্টানদের শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্যই ছিল একটি সুশৃঙ্খল, সুবিন্যস্ত সেনাবাহিনী প্রস্তুত রাখা। হোক সে পুরুষ কিংবা নারী- প্রত্যেক স্পার্টানেরই দরকার ছিল একদম নিখুঁত শারীরিক গঠন। স্পার্টান ছেলেদের একদম ছয়-সাত বছর বয়সেই পাঠিয়ে দেয়া হতো সামরিক স্কুলে, যেখানে তারা টিকে থাকার নানা কৌশল শিখত এবং একজন সুসংহত সৈনিক হবার জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য দক্ষতাও অর্জন করত। আর স্পার্টান মেয়েদের কাজ ছিল শুধু খাওয়া, ঘুম আর সিস্টারহুড ব্যারেকের প্রশিক্ষণ। মেয়েদেরকে শেখানো হতো কুস্তি, মল্লযুদ্ধ, জিমন্যাস্টিক্স আর লড়াই করে বেঁচে থাকার সব টোটকা। এই সময়ে শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন যে জিনিসটা যোগ হয়েছিলো, তা হলো প্রশ্ন করা। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৯ অব্দে সক্রেটিসের সময়েই প্রশ্ন করতে করতে একদম গহীন থেকে মূল সত্যকে বের করে আনার সংস্কৃতিও শুরু।
এবারে একটু বর্তমানের পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের দিকে নজর দেয়া যাক। যদি প্রাচীন চীনের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার কথা বলতে হয়, তবে খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ শতাব্দী থেকেই চীনে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়েছে বলে ধারণা করা হয়, বিশেষ করে শ্যাং শাসনামলে (১৫২৩-১০২৭) খ্রিস্টপূর্ব। সেই সময়কাল জুড়েও পুরো শিক্ষাব্যবস্থা ছিল শুধুমাত্র উচ্চশ্রেণীকে কেন্দ্র করেই, যার উদ্দেশ্য ছিল শুধু সরকারি তথা রাজ্য আমলা তৈরি করা।
প্রথমদিকে তাদের পাঠ্যক্রমটি ছিল তথাকথিত ষটচক্র শিল্পকে ভিত্তি করে। ষটচক্রে অন্তর্ভুক্ত ছিল রীতি, সঙ্গীত, রথচালনা, ইতিহাস এবং গণিত। কনফুসিয়াসের লেখা চারটি বই আর পাঁচটি ক্লাসিকের উপর ভিত্তি করেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিলো চীনের শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলাম।

তার এই কাজগুলোই পরবর্তীতে সমাজ ও সরকারের মৌলিক নীতিমালার রূপরেখা প্রণয়নে মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করেছিলো এবং একইসাথে একজন ব্যক্তির আদর্শ আচার-আচরণ কেমন হওয়া উচিত তারও বিস্তর বর্ণনা ছিল বইগুলোতে। আর এই সবকিছুই সার্বিকভাবে কনফুসিয়ান দর্শনকে সংজ্ঞায়িত করে, যা প্রচ্ছন্নভাবে তৎকালীন মানুষের জীবনের মোটামুটি সকল ক্ষেত্রেই কম-বেশি প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলো, আর শিক্ষার উপর তো নিশ্চিতভাবেই।
প্রাচীন চীনেও সেই শিক্ষাসুবিধা উচ্চবিত্ত শ্রেণীর জন্যই ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো। এ শিক্ষাব্যবস্থাই বহাল ছিল বহুকাল ধরে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সেই উচ্চবিত্তই জন্ম দিয়ে গেছে চীনে, যারা শোষণ করেছে নিরক্ষর জাতিকে।
সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য আবার শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত খরচে রাজ্য আওতাধীন নয় এমন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবার রেওয়াজ ছিল, যাকে বলে শ্যুয়ান। আর এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ শ্যুয়ানের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করা। কনফুসিয়াসের দর্শন (সমাজের প্রতি প্রত্যেকেরই নিজস্ব দায়িত্ব রয়েছে, আর তা সঠিকভাবে পালন করলে রাষ্ট্র উপকৃত হয় এবং রাষ্ট্রের প্রত্যেকে তুলনামূলক বেশি সুখী জীবনযাপন করতে পারে) ছাড়াও ভিন্ন একটি দর্শন প্রতিষ্ঠিত ছিল চীনের শিক্ষাব্যবস্থায়, যা টাওয়িয়ান দর্শন নামে পরিচিত।
যা-ই হোক, শিক্ষাব্যবস্থায় নানা সময়ে নানাভাবে আমূল পরিবর্তন এসেছে নানা উদ্দেশ্য সফল করতে, আর সেই উদ্দেশ্য বদলাবার সাথে সাথেই বদলে গেছে শিক্ষাব্যবস্থাও! সুতরাং, প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, শিক্ষাব্যবস্থা আর উদ্দেশ্য একে অপরের পরিপূরকই বটে।
প্রাচীন গ্রিস, চীনসহ অন্যান্য অনেক প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থাই কোন উদ্দেশ্য পূরণে কীভাবে মোড় নিয়েছে তা জানতে থাকুন রোর বাংলার সাথেই, অপেক্ষা করুন পরবর্তী পর্বগুলোর জন্য।