১১ দিনের যুদ্ধ: যে যুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়া হেরেছিল জার্মানির কাছে

বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর একটি হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে জার্মানির শোচনীয় পরাজয়। ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপরে হিটলারের ৪০ লক্ষ সৈন্যের প্রবল আক্রমণ ‘অপারেশন বার্বারোসা’, মস্কোর উপকণ্ঠে সোভিয়েতদের মরণপণ লড়াই, লেনিনগ্রাদের নিষ্ঠুর অবরোধ, স্তালিনগ্রাদের ঐতিহাসিক যুদ্ধ, কুরস্কে ইতিহাসের বৃহত্তম ট্যাঙ্ক যুদ্ধ, ১৯৪৫ সালে জার্মানদের কঠোর প্রতিরোধকে পরাস্ত করে সোভিয়েত সৈন্যদের বার্লিন দখল এবং হিটলারের আত্মহত্যা– এই ঘটনাগুলো বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে অম্লান হয়ে রয়েছে। কিন্তু এটি ছিল জার্মানদের সঙ্গে সোভিয়েতদের দ্বিতীয় যুদ্ধ। সে তুলনায় প্রথম জার্মান–সোভিয়েত যুদ্ধটি ইতিহাসে প্রায় বিস্মৃত হতে বসেছে। এই যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল ১৯১৮ সালে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায় থেকে রুশ সাম্রাজ্য কেন্দ্রীয় শক্তির (জার্মানি, অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া ও ওসমানীয় সাম্রাজ্য) বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ১৯১৪ সালে জার্মানির পূর্ব প্রাশিয়ায় রুশ আক্রমণ শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়, কিন্তু অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির গ্যালিসিয়ায় রুশ আক্রমণ সাফল্য অর্জন করে। ১৯১৫ সালে তীব্র জার্মান ও অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় আক্রমণের মুখে রুশ সৈন্যরা পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয় এবং কেন্দ্রীয় শক্তি রুশ পোল্যান্ড দখল করে নেয়; কিন্তু ককেশাসে রুশরা ওসমানীয় আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। ১৯১৬ সালে রুশদের ‘ব্রুসিলভ আক্রমণাভিযানে’ অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় সমরযন্ত্র প্রায় ধ্বংস হয়ে যায় এবং জার্মান হস্তক্ষেপের ফলে তারা সুনিশ্চিত পরাজয় থেকে রক্ষা পায়; ককেশাসে রুশ সৈন্যরা ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ভূমিতে অগ্রসর হয়; কিন্তু জার্মানদের রুশ ভূমি থেকে বিতাড়িত করতে তারা ব্যর্থ হয়।

যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে রুশ সরকারের দুর্নীতি ও অকর্মণ্যতা, যুদ্ধের ফলে লক্ষ লক্ষ সৈন্যের মৃত্যু এবং যুদ্ধের কারণে রুশ জনসাধারণের খাদ্য সঙ্কট ও অন্যান্য ভোগান্তির ফলে রুশ জনগণ ক্রমশ যুদ্ধবিরোধী হয়ে ওঠে। ১৯১৭ সালের মার্চে রাশিয়ার রাজধানী পেত্রোগ্রাদে বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং একটি অস্থায়ী সরকার ক্ষমতা লাভ করে। এই সরকার কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু ১৯১৭ সালের জুলাইয়ে রুশরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং জার্মানরা লিথুয়ানিয়া ও পশ্চিম লাতভিয়া দখল করে নেয়। এমতাবস্থায় রুশ সৈন্য ও জনসাধারণের যুদ্ধবিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিকরা ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর অস্থায়ী সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে।

১৯১৭ সালের নভেম্বরে বলশেভিকদের ক্ষমতা দখলের অন্যতম একটি হাতিয়ার ছিল রুশ সৈন্যদের যুদ্ধবিরোধী মনোভাব; Source: Brewnimate

৮ নভেম্বর বলশেভিকরা ‘শান্তি সংক্রান্ত ডিক্রি’ জারি করে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িত সকল পক্ষকে কোনো ভূমি দখল বা ক্ষতিপূরণ ছাড়া শান্তি স্থাপন করতে আহবান জানায়৷ একই সঙ্গে তারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে রাশিয়াকে প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দেয়। তাদের এই সিদ্ধান্তের কারণ ছিল বহুবিধ৷ বলশেভিকরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ’ হিসেবে বিবেচনা করত এবং এতে অংশ নেয়ার কোনো আগ্রহ তাদের মধ্যে ছিল না; বলশেভিকরা রুশ সৈন্যদের যুদ্ধবিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল এবং এখন সেই সৈন্যদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে ফেরত পাঠানো ছিল তাদের জন্য রাজনৈতিকভাবে অসম্ভব; যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে টিকে থাকা ছিল তাদের জন্য অসম্ভব; এবং কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে রাশিয়ার অভ্যন্তরে নিজেদের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করা ছিল তাদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

১৯১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর একটি বলশেভিক প্রতিনিধি দল জার্মান–দখলকৃত রুশ পোল্যান্ডের বিধ্বস্ত দুর্গনগরী ব্রেস্ত–লিতোভস্কে আলোচনার জন্য পৌঁছে এবং ১৫ ডিসেম্বর থেকে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। ২২ ডিসেম্বর থেকে উভয় পক্ষের মধ্যে শান্তি সংক্রান্ত আলোচনা শুরু হয় এবং বলশেভিকরা বুঝতে পারে যে, শান্তি স্থাপনের ঘোষণা দেয়া যতটা সহজ, শান্তি প্রতিষ্ঠা করা ততোটা সহজ নয়। কারণ, জার্মানরা শান্তির জন্য চড়া মূল্য দাবি করে। উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় শক্তির সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে জার্মানি ছিল মূল সদস্য, অন্যরা ছিল জার্মানির ‘জুনিয়র পার্টনার’ মাত্র।

জার্মানরা শান্তি স্থাপনের শর্ত হিসেবে বলশেভিকদের কাছ থেকে রুশ পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া ও পশ্চিম লাতভিয়া দাবি করে। জার্মানরা ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে এই অঞ্চলগুলো দখল করে নিয়েছিল এবং শান্তিচুক্তি সংক্রান্ত আলোচনার সময় অঞ্চলগুলো তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। জার্মানদের প্রস্তাবিত শর্ত ছিল বলশেভিকদের জন্য কঠোর, কিন্তু জার্মানদের সামরিক আধিপত্য এবং বলশেভিকদের সামরিক দুর্বলতা বিবেচনায় রেখে লেনিন এই শর্ত মেনে নেয়ার জন্য অন্যান্য বলশেভিক নেতাদের চাপ দেন। কিন্তু অধিকাংশ বলশেভিক ছিল এরকম শর্ত মেনে নেয়ার বিপক্ষে এবং ১৯১৮ সালের জানুয়ারিতে বলশেভিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটি এই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে।

১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত রাশিয়া কেন্দ্রীয় শক্তির সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করে; Source: Wikimedia Commons

বস্তুত বলশেভিক সরকার কোনো স্বাভাবিক সরকার ছিল না। স্বাভাবিক কোনো সরকার এরকম পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে যতদূর সম্ভব একটি নমনীয় শান্তিচুক্তি করার চেষ্টা করত। কিন্তু অধিকাংশ বলশেভিক ছিল কট্টর আদর্শবাদী, এবং ‘সাম্রাজ্যবাদী’দের কাছে কোনো ভূমি বা জনগোষ্ঠীকে হস্তান্তর করতে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। তারা বিশ্বাস করত যে, জার্মানিসহ ইউরোপের অধিকাংশ রাষ্ট্রে গণবিপ্লবের সম্ভাবনা রয়েছে এবং সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতি বলশেভিকদের অবজ্ঞা এসব দেশের জনসাধারণকে নিজ নিজ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উৎসাহিত করবে। বলশেভিকরা এজন্য কেন্দ্রীয় শক্তির প্রতি ‘যুদ্ধও নয় শান্তিও নয়’ এই নীতি গ্রহণ করে।

এই নীতির মর্মার্থ ছিল – বলশেভিকরা কেন্দ্রীয় শক্তির সঙ্গে আর যুদ্ধ করবে না, কিন্তু তাদের প্রদত্ত শর্তে তাদের সঙ্গে সন্ধিও করবে না। সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিয়ন ত্রৎস্কি এই নীতির সবচেয়ে বড় সমর্থক ছিলেন এবং তিনি ১৯১৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শক্তির সঙ্গে আলোচনার জন্য ব্রেস্ত–লিতোভস্কে যান। সেখানে তিনি ঘোষণা দেন যে, সোভিয়েত রাশিয়া কোনো প্রকার চুক্তি ছাড়াই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তার এই অভূতপূর্ব ঘোষণায় কেন্দ্রীয় শক্তির প্রতিনিধিরা হতভম্ব হয়ে পড়েন, কারণ কূটনৈতিক ইতিহাসে এ ধরনের কোনো ঘটনা এর পূর্বে কখনো ঘটেনি। জার্মান সশস্ত্রবাহিনীর হাই কমান্ডের প্রতিনিধি মেজর জেনারেল ম্যাক্স ভন হফম্যান বলেই ফেলেছিলেন, ‘Unerhört!’ (এরকম কখনো শোনা যায় নি!)

কিন্তু বলশেভিকদের নাটকীয় সিদ্ধান্ত কাজে আসেনি। এক সপ্তাহ পর ১৭ ফেব্রুয়ারি জার্মানরা বলশেভিকদের জানায় যে, তারা আর যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়াতে আগ্রহী নয় এবং জার্মানির সাথে নতুন করে যুদ্ধাবস্থা শুরু হতে যাচ্ছে। পরবর্তী দিন অর্থাৎ ১৮ ফেব্রুয়ারি ৫৩ ডিভিশন জার্মান ও অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় সৈন্য সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘অপারেশন ফস্টশ্ল্যাগ’ (Operation Faustschlag) আরম্ভ করে। জার্মান ভাষায় ‘ফস্টশ্ল্যাগ’ শব্দটির অর্থ ‘ঘুষি’। সত্যিই এই জার্মান আক্রমণ বলশেভিকদের ঘুষির মতোই আঘাত করেছিল।

ব্রেস্ত–লিতোভস্কে জার্মানরা সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ত্রৎস্কিকে স্বাগত জানাচ্ছে; Source: Wikimedia Commons

জার্মান ও অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় সৈন্যরা অগ্রসর হয়ে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতে পায় যে, সোভিয়েত পরিখাগুলো প্রায় ফাঁকা পড়ে আছে! বস্তুত বলশেভিকরা যখন কেন্দ্রীয় শক্তির সঙ্গে শান্তি আলোচনায় লিপ্ত ছিল, তখন তারা প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীকেও ভেঙে দিচ্ছিল। বলশেভিকরা নিকোলাই ক্রিলেঙ্কো নামক একজন যুদ্ধ পলাতক জুনিয়র কর্মকর্তাকে রুশ সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করেছিল। সর্বাধিনায়ক হিসেবে ক্রিলেঙ্কোর দায়িত্ব ছিল রুশ সেনাবাহিনীর গণতন্ত্রায়ন এবং সৈন্য প্রত্যাহার। ক্রিলেঙ্কো রুশ সেনাবাহিনীতে পদের বিলুপ্তি করেন, নির্বাচনের ভিত্তিতে কমান্ডার নিয়োগ প্রথা চালু করেন এবং একের পর এক ইউনিটকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রত্যাহার করে নেন। ১৯১৮ সালের ২৯ জানুয়ারি তিনি সমগ্র রুশ সেনাবাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দেন। এর ফলে ‘ইউরোপের স্টিমরোলার’ নামে খ্যাত বিশাল রুশ সেনাবাহিনী অতি দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যায়।

বলশেভিকদের রুশ সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করার পিছনে তিনটি কারণ দায়ী ছিল। রুশ সৈন্যরা আর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে আগ্রহী ছিল না; বলশেভিকরা সমরবাদকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখত; এবং বলশেভিকদের বিশ্বাস ছিল যে, সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য নিয়মিত সামরিক বাহিনীর কোনো প্রয়োজন নেই, বরং সাম্রাজ্যবাদীরা সোভিয়েত রাশিয়াকে আক্রমণ করলে তাদের নিজেদের জনগণ ও সৈন্যদল এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে এবং রুশ জনসাধারণ ‘বিপ্লবী যুদ্ধে’র মাধ্যমে তাদের আগ্রাসন প্রতিহত করবে। বলশেভিকদের এই ভ্রান্ত আদর্শগত চিন্তাধারার কারণে জার্মানরা নতুন করে আক্রমণ শুরু করার পর তারা সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়ে এবং আক্রমণ প্রতিহত করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়।

কেন্দ্রীয় শক্তি ও সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে সংঘটিত এই যুদ্ধটি ‘রেলপথের যুদ্ধ’ (der Eisenbahnfeldzug) নামে পরিচিতি অর্জন করেছিল, কারণ এই যুদ্ধে জার্মানরা রুশদেরকে পরাজিত করতে রুশদেরই তৈরি করা রেলপথকে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করেছিল। লেনিন এই যুদ্ধটিকে ‘১১ দিনের যুদ্ধ’ নামে অভিহিত করেছিলেন, কারণ জার্মান আক্রমণের ১১ দিনের মধ্যেই সোভিয়েত সরকার পরাজয় স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। অবশ্য, যুদ্ধটি প্রকৃতপক্ষে চলেছিল মোট ১৪ দিন, বা ২ সপ্তাহ।

রুশ সেনাবাহিনীর ‘বিপ্লবী’ সেনাপ্রধান নিকোলাই ক্রিলেঙ্কো সেনাবাহিনী ধ্বংসের কাজ তত্ত্বাবধান করেছিলেন; Source: Wikimedia Commons

যুদ্ধের প্রথম দিনই জার্মানরা কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দ্ভিনস্ক (বর্তমান লাতভিয়ার অন্তর্গত) শহরটি দখল করে নেয় এবং ৬ দিনের মধ্যেই পস্কভ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল দখল করে নেয়। এদিকে ২১ ফেব্রুয়ারি জার্মানরা মিনস্ক (বর্তমান বেলারুশের রাজধানী) দখল করে নেয় এবং রুশ সেনাবাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় সৈন্যদলের সদর দপ্তর তাদের হস্তগত হয়। মিনস্ক থেকে জার্মান সৈন্যরা নিপার নদী অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হয় এবং মোগিলেভ দখল করে। জার্মানদের মোগিলেভে পৌঁছানোর অল্প কিছুক্ষণ আগেই সেখানে অবস্থানরত রুশ সেনাবাহিনীর ‘বিপ্লবী’ সদর দপ্তর একটি ট্রেনে করে সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করে এবং অল্পের জন্য জার্মানদের হাতে বন্দি হওয়া থেকে রক্ষা পায়।

২৪ ফেব্রুয়ারি জার্মান ও অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় সৈন্যরা ইউক্রেনীয় রেলকর্মীদের সহায়তায় ঝিতোমির শহর দখল করে নেয় এবং ২ মার্চ আরো পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে কিয়েভ (বর্তমান ইউক্রেনের রাজধানী) দখল করে নেয়। ৪ মার্চ জার্মানরা নার্ভা দখল করে৷ নার্ভা ছিল রাশিয়ার মূল ভূখণ্ড ও এস্তোনিয়ার মধ্যে অবস্থিত প্রতিরক্ষার কেন্দ্রবিন্দু এবং এটি দখলের ফলে জার্মান সৈন্যরা সোভিয়েত রাশিয়ার রাজধানী পেত্রোগ্রাদের ১০০ মাইলের ভিতরে এসে পৌঁছে।

বলশেভিকরা এই যুদ্ধে জার্মানদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি। জার্মান মেজর জেনারেল ভন হফম্যান এই যুদ্ধ সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, এটি তার দেখা ‘সবচেয়ে হাস্যকর’ যুদ্ধ। জার্মানরা মেশিনগানসহ অল্প কিছু পদাতিক সৈন্যকে ট্রেন থেকে একেকটি শহরে নামিয়ে দিত; এই সৈন্যরা সেখানকার স্বল্পসংখ্যক বলশেভিক সৈন্যকে বন্দি করত, এরপর আবার জার্মানরা পরবর্তী শহরের দিকে অগ্রসর হতো। বলশেভিকরা নিজেরাই রুশ সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে ফেলেছিল, কাজেই জার্মানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো সামর্থ্য তাদের ছিল না।

জার্মান মেজর জেনারেল ম্যাক্স ভন হফম্যান ১১ দিনের যুদ্ধে জার্মান ও অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় সৈন্যদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন; Source: Wikimedia Commons

যুদ্ধ শুরুর পরপরই জার্মানরা সোভিয়েতদেরকে শান্তির জন্য নতুন শর্ত জানায়। এই শর্তগুলো ছিল পূর্বে প্রদত্ত শর্তগুলোর চেয়েও অনেক বেশি কঠোর। জার্মানরা এবার পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া ও পশ্চিম লাতভিয়ার পাশাপাশি ফিনল্যান্ড, ইউক্রেন ও অন্যান্য বাল্টিক অঞ্চল থেকেও রুশ সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানায়। বলশেভিক দলের মধ্যে এই নতুন শর্তাবলি মেনে নেয়া বা না নেয়া সম্পর্কে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।

বস্তুত জার্মানদের চুক্তির শর্ত এতটাই কঠোর ছিল যে, শান্তি স্থাপনের পক্ষে থাকা লেনিনও প্রথমে মত প্রকাশ করেছিলেন যে, কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক ‘বিপ্লবী যুদ্ধ’ ব্যতীত রুশ বিপ্লবকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে জার্মানদের ক্ষিপ্র ও অভাবনীয় সাফল্যের পর লেনিন যেকোনো মূল্যে শান্তি স্থাপনের জন্য অন্যান্য বলশেভিক নেতাদের চাপ দিতে থাকেন এবং অবিলম্বে শান্তি স্থাপন না করলে পদত্যাগ করার হুমকি দেন। অবশেষে বলশেভিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৬–৩ ভোটে জার্মানদের শর্ত মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ত্রৎস্কিসহ ৪ জন সদস্য ভোট দানে বিরত থাকেন।

১৯১৮ সালের ৩ মার্চ সোভিয়েত প্রতিনিধি দল ব্রেস্ত–লিতোভস্কে পৌঁছায় এবং কেন্দ্রীয় শক্তির সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ত্রৎস্কির ‘যুদ্ধও নয়, শান্তিও নয়’ নীতি ঘোষণার মতো এই ঘটনাটিও ছিল নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ। সোভিয়েত প্রতিনিধি দল জার্মান সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতি তাদের অবজ্ঞার শেষ নিদর্শন হিসেবে চুক্তিপত্রটি পড়ে দেখতেও অস্বীকৃতি জানায় এবং না দেখেই স্বাক্ষর করে ‘ঝড়ের বেগে’ সম্মেলন কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। চুক্তি স্বাক্ষরের পরের দিনও জার্মানরা যুদ্ধাভিযান অব্যাহত রাখে এবং ৪ মার্চ নার্ভা দখল করে নেয়ার পর তারা তাদের অগ্রাভিযান রোধ করে।

বাহ্যিকভাবে বলশেভিকরা যতটাই অবজ্ঞা প্রদর্শন করুক না কেন, ব্রেস্ত–লিতোভস্কের চুক্তি ছিল রাশিয়ার জন্য অত্যন্ত অপমানজনক। শুধু রাশিয়া নয়, কোনো বৃহৎ শক্তিই ইতোপূর্বে এত অপমানজনক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। এই চুক্তি অনুযায়ী সোভিয়েত রাশিয়া রুশ পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, লাতভিয়া, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, বেলারুশ, ইউক্রেন, ক্রিমিয়া ও দক্ষিণ ককেশাস থেকে সম্পূর্ণরূপে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে এবং অঞ্চলগুলোর ওপর থেকে সকল দাবি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। ইউক্রেন ও ফিনল্যান্ডকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতেও তারা বাধ্য হয়। তদুপরি, রুশ সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে নিষ্ক্রিয় করতে এবং জার্মান–দখলকৃত অঞ্চলে কোনো ধরনের উস্কানিমূলক প্রচারণা না চালাতেও বলশেভিকরা সম্মত হয়।

জার্মান, হাঙ্গেরীয়, বুলগেরীয়, ওসমানীয় তুর্কি এবং রুশ ভাষায় লিখিত ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তিপত্রের অংশবিশেষ; Source: Wikimedia Commons

এই চুক্তির ফলে বলশেভিকরা প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের ইউরোপীয় অংশের এক–তৃতীয়াংশ ভূমি হারায়। এই চুক্তির ফলে সোভিয়েত রাশিয়া ১৮টি প্রদেশ, মোট জনসংখ্যার ৩৪%, মোট শিল্পাঞ্চলের ৫৪%, মোট রেলপথের ২৬% এবং মোট কয়লাখনির ৮৯% কেন্দ্রীয় শক্তির কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। তদুপরি, সোভিয়েত রাশিয়া কেন্দ্রীয় শক্তিকে ৩০ কোটি (বা ৩০০ মিলিয়ন) স্বর্ণমুদ্রা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়।

এই চুক্তির ফলে ১৭০০–১৭২১ সালের উত্তরের মহাযুদ্ধ, ১৬৫৪–১৬৬৭, ১৭৬৮–১৭৭২, ১৭৯২ ও ১৭৯৪ সালের রুশ–পোলিশ যুদ্ধ এবং ১৭৬৮–১৭৭৪, ১৭৮৭–১৭৯২ ও ১৮৭৭–১৮৭৮ সালের রুশ–ওসমানীয় যুদ্ধে বিজয়ের ফলে রাশিয়া ইউরোপে যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল, মাত্র দুই সপ্তাহের যুদ্ধে জার্মানি সেটি দখল করে নেয়। এর মধ্য দিয়ে তিন শতাব্দী ধরে রোমানভ বংশীয় সম্রাটরা লক্ষ লক্ষ রুশ নাগরিকের প্রাণের বিনিময়ে এবং অজস্র অর্থব্যয়ে যে সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল, বলশেভিকরা তাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে সেটিকে কয়েক মাসের মধ্যে ধ্বংস করে ফেলে।

কিন্তু বলশেভিকরা এই চুক্তির সুদূরপ্রসারী প্রভাব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাদের মতে, এই চুক্তি একটি ‘সাময়িক যুদ্ধবিরতি’ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়া এবং বলশেভিকদের জন্য এই ‘১১ দিনের যুদ্ধ’ ও যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে স্বাক্ষরিত ‘ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তি’র ফলাফল ছিল বহুমাত্রিক।

প্রথমত, এই চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে তারা প্রথমবারের মতো বিপ্লবী স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রচেষ্টাকে বাদ দিয়ে কূটনৈতিক বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেয়। এর ফলে বলশেভিকদের ‘আদর্শগত বিশুদ্ধতা’য় যে অধঃপতন ঘটেছিল, সেই অবস্থার আর কখনো পরিবর্তন ঘটেনি।

দ্বিতীয়ত, জনসাধারণের ‘বিপ্লবী যুদ্ধে’র মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব – এই ধারণাটি কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে ‘১১ দিনের যুদ্ধে’ সম্পূর্ণ অবাস্তব বলে প্রমাণিত হয়। এই যুদ্ধের পর উগ্র বামপন্থী বলশেভিকদের ‘বিপ্লবী যুদ্ধে’র তত্ত্বকে ব্যঙ্গ করে লেনিন বলেছিলেন, ‘এবার তাদের কাঠের তলোয়ার তুলে রাখার সময় হয়েছে।’ বস্তুত, এই যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পরপরই সোভিয়েত সরকার ‘লাল ফৌজ’ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

তৃতীয়ত, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর জনসাধারণ বা সৈন্যদল নিজেদের ‘বুর্জোয়া’ শাসকদের বিরুদ্ধে বিপ্লব করে বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, বলশেভিকদের এই ধারণাও ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়। বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্রীয় শক্তির তীব্র আক্রমণ সত্ত্বেও জার্মানি, অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া বা ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ‘প্রলেতারিয়েত’ বা শোষিত জনগণ তাদের শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার কোনো লক্ষণ দেখায় নি।

ব্রেস্ত–লিতোভস্কের চুক্তির ফলে মানচিত্রের পরিবর্তন; Source: Wikimedia Commons

চতুর্থত, ১১ দিনের যুদ্ধের ফলে জার্মান সৈন্যরা সোভিয়েত রাজধানী পেত্রোগ্রাদের ১০০ মাইলের মধ্যে এসে উপস্থিত হয় এবং তারা চাইলেই অগ্রসর হয়ে পেত্রোগ্রাদ দখল করে বলশেভিকদের ক্ষমতাচ্যুত করতে পারত। কিন্তু বলশেভিকরা ব্রেস্ত–লিতোভস্কের চুক্তিতে স্বাক্ষর করায় বলশেভিক আদর্শের প্রতি তীব্র ঘৃণা থাকা সত্ত্বেও জার্মান সামরিক নেতারা পেত্রোগ্রাদ দখল বা বলশেভিকদের উৎখাত করা থেকে বিরত থাকে। এর ফলে বলশেভিক বিপ্লব রক্ষা পায় এবং বলশেভিকরা রাশিয়ার অভ্যন্তরে নিজেদের ক্ষমতা সুসংহত করার সুযোগ লাভ করে।

পঞ্চমত, জার্মান সৈন্যরা পেত্রোগ্রাদের সন্নিকটে উপস্থিত হওয়ার ফলে বলশেভিকরা জার্মান আক্রমণের ভয়ে ভীত ছিল এবং এজন্য তারা রাজধানী মস্কোয় স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯১৭ সালে রুশ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সান্দর কেরেনস্কি যখন জার্মান আক্রমণের আশঙ্কায় রাজধানী স্থানান্তর করতে চেয়েছিলেন, তখন বলশেভিকরা এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। এখন তারা নিজেরাই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। ১৯১৭ সালের এপ্রিলে লেনিন পশ্চিম ইউরোপ থেকে বীরের বেশে পেত্রোগ্রাদের ফিনল্যান্ড স্টেশনে অবতরণ করেছিলেন। এর মাত্র এক বছরের মধ্যে ১৯১৮ সালের ১২ মার্চ রাতের অন্ধকারে বিশ্বস্ত লাতভীয় রাইফেলম্যানদের নিরাপত্তাধীনে তিনি মস্কোর উদ্দেশ্যে পেত্রোগ্রাদ ত্যাগ করেন। পেত্রোগ্রাদ থেকে বলশেভিকদের পশ্চাৎপসরণ অবমাননাকর হলেও কৌশলগত দিক থেকে এটি ছিল যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। জার্মান–দখলকৃত নার্ভা থেকে পেত্রোগ্রাদের দূরত্ব ১০০ মাইলের কম হলেও জার্মান–দখলকৃত মোগিলেভ থেকে মস্কোর দূরত্ব ছিল ৩০০ মাইলেরও বেশি এবং এর ফলে মস্কো ছিল বলশেভিকদের জন্য তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি নিরাপদ।

ষষ্ঠত, এই অবমাননাকর চুক্তিতে স্বাক্ষরের ফলে রাশিয়ার উগ্র ডানপন্থী রাজতন্ত্রী ও জাতীয়তাবাদীরা তো বটেই, উদার গণতন্ত্রীদের থেকে আরম্ভ করে উগ্র বামপন্থী ‘সমাজবিপ্লবী দল’ও (Party of Socialist-Revolutionaries) বলশেভিকদের ওপর ক্ষিপ্ত হয় এবং তাদেরকে রাশিয়ার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অভিযুক্ত করে। এই চুক্তির পর রাশিয়া জুড়ে যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, এই চুক্তিতে বলশেভিকদের স্বাক্ষর করা ছিল তার অন্যতম একটি কারণ।

সপ্তমত, কেন্দ্রীয় শক্তির সঙ্গে পৃথক শান্তি স্থাপনের মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে বলশেভিকরা বেরিয়ে যাওয়ায় পশ্চিম রণাঙ্গনে মিত্রশক্তির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়। এই কারণে এবং বলশেভিকরা বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ডাক দেয়ায় মিত্রশক্তি বলশেভিকদের ওপর মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ হয়। ব্রিটিশ নেতা উইনস্টন চার্চিল ঘোষণা করেছিলেন, বলশেভিক দানবকে দোলনায় থাকা অবস্থাতেই গলা টিপে হত্যা করতে হবে! রুশ গৃহযুদ্ধে মিত্রপক্ষ বলশেভিকবিরোধীদের সমর্থন করে এবং তাদেরকে সহায়তা করার জন্য রাশিয়ার বিভিন্ন স্থানে সৈন্য প্রেরণ করে।

ইউক্রেনের কিয়েভে দখলদার জার্মান সৈন্যদল; Source: Wikimedia Commons

সর্বোপরি, এই চুক্তির ফলে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলো প্রথম বারের মতো বৃহৎ রুশ (Great Russian) কর্তৃত্ব থেকে মুক্তি লাভ করে এবং নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার সুযোগ লাভ করে। যদিও প্রাথমিকভাবে এই প্রদেশগুলো জার্মানির ‘উপগ্রহে’ পরিণত হয়েছিল অথবা জার্মানির প্রভাবাধীন ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর এদের অনেকেই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে সক্ষম হয়। এই রাষ্ট্রগুলো হলো – ফিনল্যান্ড, পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, লাতভিয়া ও এস্তোনিয়া।

জার্মানি এই চুক্তির ফলে ব্যাপকভাবে লাভবান হলেও শেষ পর্যন্ত এই বিশাল বিজয়ই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তার পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ব্রেস্ত–লিতোভস্কের চুক্তির ফলে লব্ধ বিপুল পরিমাণ ভূমি দখল করে রাখার জন্য শ্বেত সাগর থেকে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে জার্মানিকে প্রায় ১০ লক্ষ সৈন্য মোতায়েন করে রাখতে হয়। যদি এই বিশাল অঞ্চল দখলে রাখার প্রয়োজন না হতো, তাহলে জার্মানি এই বিশাল সৈন্যদলকে পশ্চিম রণাঙ্গনে প্রেরণ করতে পারত এবং সেক্ষেত্রে হয়ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানিকে পরিপূর্ণ পরাজয় বরণ করতে হতো না।

জার্মানরা ধারণা করেছিল যে, মিত্রপক্ষের নৌ অবরোধের ফলে জার্মানিতে খাদ্য ও জ্বালানির যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, দখলকৃত ইউক্রেন থেকে বিপুল পরিমাণ খাদ্য ও কয়লা সংগ্রহ করে তারা সেই সমস্যার মোকাবেলা করতে পারবে। কিন্তু তাদের এই আশা কেবল আংশিকভাবে পূর্ণ হয়েছিল। তদুপরি, জার্মানদের দখলকৃত অঞ্চলগুলোর স্থানীয় জনসাধারণ ক্রমে জার্মান শাসনে অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে এবং অঞ্চলগুলোতে জার্মানবিরোধী বিদ্রোহ ও গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়। এই বিদ্রোহগুলোর অনেকগুলোর পেছনেই বলশেভিক গুপ্তচরদের ভূমিকা ছিল। ফিনল্যান্ডে বলশেভিক ও বলশেভিকবিরোধীদের মধ্যে যে নৃশংস গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, সেটিতেও জার্মানদেরকে হস্তক্ষেপ করতে হয়।

১৯১৮ সালে জার্মান সৈন্যদের সঙ্গে সোভিয়েত সৈন্যরা। বলশেভিকরা জার্মান সৈন্যদের মধ্যে ব্যাপক হারে যুদ্ধবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছিল; Source: Wikimedia Commons

শুধু তাই নয়, দখলকৃত অঞ্চলে মোতায়েনকৃত জার্মান সৈন্যদের মাঝে বলশেভিকরা ব্যাপকভাবে যুদ্ধবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছিল এবং এর ফলে পূর্ব রণাঙ্গনে মোতায়েনকৃত জার্মান সৈন্যদের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে জার্মান সেনানায়কদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। এজন্য জার্মান হাই কমান্ড পূর্ব রণাঙ্গন থেকে কয়েক লক্ষ জার্মান সৈন্যকে পশ্চিম রণাঙ্গনে প্রেরণ করলেও বাকিদের সেখানে প্রেরণের ক্ষেত্রে দ্বিধাবিভক্ত ছিল। অন্যদিকে, সোভিয়েত রাশিয়ার ওপর জার্মানদের চাপিয়ে দেয়া কঠোর সন্ধি থেকে মিত্রপক্ষীয় রাষ্ট্রগুলো বুঝতে পেরেছিল, তারা পরাজিত হলে তাদের ভাগ্যেও একই পরিণতি রয়েছে। ফলে মিত্রশক্তি জার্মানদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এমতাবস্থায়, ভাগ্যের পরিহাসে, পূর্ব রণাঙ্গনে ‘১১ দিনের যুদ্ধে’ জার্মানদের অভাবনীয় বিজয় পশ্চিম রণাঙ্গনে তাদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর জার্মানি ও মিত্রশক্তির মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং যুদ্ধবিরতির একটি ধারা অনুযায়ী জার্মানি ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তিকে বাতিল ঘোষণা করে। ১৩ নভেম্বর সোভিয়েত সরকারও ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তিকে অকার্যকর ঘোষণা করে। আবারো ভাগ্যের পরিহাসে, বলশেভিকদের চরম শত্রু মিত্রপক্ষের বিজয়ের ফলে বলশেভিকরা অবমাননাকর ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তি থেকে মুক্তি লাভ করে।

১৯১৯ সালে মিত্রশক্তি যখন জার্মানির ওপর অপমানজনক ভার্সাই চুক্তি চাপিয়ে দেয়, তখন জার্মান প্রতিনিধিরা চুক্তিটি খুবই কঠোর বলে অভিযোগ করেছিল। এর জবাবে মিত্রশক্তির প্রতিনিধিরা শীতলভাবে বলেছিল, ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তির চেয়ে এই চুক্তি অনেক বেশি নমনীয় ও মানবিক!

This is a Bengali article about the 1918 German-Soviet '11 Days' War'.

References:

1. Evan Mawdsley, "The Russian Civil War," Edinburgh: Birlinn Limited, 2011.

2. Oleg Fedyshin, "Germany's Drive to the East and the Ukrainian Revolution, 1917–1918," New Brunswick, 1971.

3. Gerald Freund, "Unholy Alliance: Russian–German Relations from the Treaty of Brest-Litovsk to the Treaty of Berlin," New York: Harcourt, 1957.

Source of the featured image: Wikimedia Commons

Related Articles

Exit mobile version