১৭৭২ সাল।
মারাঠা সাম্রাজ্যের পেশোয়া বা প্রধানমন্ত্রী শ্রী মাধব রাও দীর্ঘদিন ধরে দুরারোগ্য যক্ষ্মা রোগে ভুগছিলেন। এই অসুস্থতার কারণেই মহীশূরে হায়দার আলীর উপর তৃতীয়বার আক্রমণের আকাঙ্ক্ষা কার্যত অপূর্ণই থেকে গিয়েছিল। এদিকে রোগের লক্ষণ বেড়েই চলছিল। ইংরেজ চিকিৎসক ডাকা হলো, তবুও কোনো কাজ হলো না। পেশোয়া বুঝতে পারছিলেন, তার জীবনের অন্তিম সময় উপস্থিত। তার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী গণেশ চিন্তামণি মন্দিরে নেওয়া হলো।
সেই বছরের ১৮ নভেম্বর তার মৃত্যু হলো।
মাধব রাও পেশোয়ার ছোট ভাই ছিলেন নারায়ণ রাও। দুই ভাইয়ের মধ্যে বয়সের ব্যবধান প্রায় ১০ বছরের। বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর তিনি হলেন মারাঠা সাম্রাজ্যের পেশোয়া বা পন্থপ্রধান। তিনি বালাজী বাজীরাও ওরফে নানা সাহেবের তৃতীয় সন্তান ছিলেন। তিনি ক্ষমতায় আসীন হলেন বটে, তবে তা নিষ্কণ্টক ছিলো না। তার কাকা রঘুনাথ রাও বেশ আগে থেকেই চক্রান্ত করার অপরাধে গৃহবন্দী ছিলেন। নারায়ণ রাও তাকে সাময়িকভাবে মুক্ত করেছিলেন। আবারও একই পথে গেলে পুনরায় তাকে আটক করা হয়।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে নারায়ণ রাওয়ের শেষ রক্ষা হলো না। ক্ষমতালোভী কাকা রঘুনাথ রাও ও তার পত্নী আনন্দীবাঈয়ের চক্রান্তে ১৭৭৩ সালের ৩০ আগস্ট গণেশ উৎসবের দিন তিনি নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তার ১৮ বছরের ছোট জীবনের এখানেই ইতি হলো। বলা হয়, পুণা অঞ্চলে পেশোয়ার প্রাসাদে নিহত হবার সময়ের আর্তচিৎকার পরবর্তী অনেকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। ভৌতিক এই কাণ্ডকারখানা বন্ধ করার জন্য অনেক পূজা-পাঠও করানো হয়েছিল।
নারায়ণ রাওয়ের বিধবা পত্নীর নাম ছিলো গঙ্গাবাঈ। তিনি একটি ফুটফুটে পুত্রসন্তানের জন্ম দিলেন। বিধান অনুযায়ী এই পুত্রেরই পরবর্তী পেশোয়া হবার কথা। এই শিশুর নাম রাখা হলো সোয়াই মাধব রাও। তার রাজ্যাভিষেক করার প্রস্তুতি নেওয়া হলো। নাবালক হবার কারণে তার পক্ষে শাসনকাজ পরিচালনারও ব্যবস্থা নেওয়া হলো। তুখোড় কূটনৈতিক নানা ফড়নবীশের নেতৃত্বে মন্ত্রীসভার বারোজন সদস্য এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
রঘুনাথ রাও প্রমাদ গুনলেন। তার পেশোয়া হবার সাধ যেন অপূর্ণ থেকে যাচ্ছিল। সুতরাং তাকে আবারও চক্রান্তের আশ্রয় নিতে হলো। তিনি বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) অঞ্চলের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হর্তাকর্তাদের শরণাপন্ন হলেন। কোম্পানির বোম্বে প্রতিনিধিরা তাকে বেশ খাতির করলেন। বাহ্যিকভাবে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেশীয় রাজ্যগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব উপেক্ষা করার নীতি নিয়েছিল, কিন্তু গোপনীয়তার সাথে রাজনৈতিক স্বার্থ আদায় করায় পিছিয়ে ছিল না। এক্ষেত্রেও তা-ই দেখা গেল। ১৭৭৫ সালের ৬ মার্চ ইংরেজদের সাথে রঘুনাথ রাওয়ের একটি চুক্তি হলো। এই চুক্তি অনুসারে ইংরেজরা তাকে ২,৫০০ সৈন্য দিয়ে সাহায্য করবার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু এই সৈন্যদলের খরচ রঘুনাথের উপরেই ছিল। অন্যদিকে, তিনি ইংরেজদের সালসেটি, বেসিন, বরোচ ও সুরাট এলাকার কিছু অঞ্চলের রাজস্ব দেওয়ার কথা দিলেন। এছাড়াও প্রতিশ্রুতি দিলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোনো শত্রুপক্ষের সাথে রাজনৈতিক বন্ধুত্বের পথে যাবেন না।
বোম্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার কর্নেল কিটিংয়ের নেতৃত্বে একদল সৈন্য পুণায় প্রেরণ করে। যুদ্ধে পুনার সৈন্যরা পরাজিত হলো বটে, কিন্তু কোম্পানির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অলক্ষ্য বিরোধ এখানেও দেখা গেলো। কলকাতা কাউন্সিল বোম্বে সরকারের করা এই চুক্তির বৈধতা মানতে অস্বীকার করল। কোম্পানির গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস বোম্বের প্রতি কিছুটা অনুকূল ভাব দেখিয়েছিলেন। কিন্তু কাউন্সিল মেম্বারদের অধিকাংশই বোম্বের উপর নাখোশ হলেন। কাউন্সিলের নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওয়ারেন হেস্টিংস চুক্তি নবায়নের জন্য কর্নেল আপটনকে পুণায় পাঠান। ১৭৭৬ সালের ১ মার্চ আপটন পূর্বের চুক্তি একেবারে বাতিল করে দিয়ে ‘পুরন্দর ট্রিটি’ নামের এক নতুন চুক্তি করলেন। এই চুক্তি অনুসারে ইংরেজদের সালসেটি ও বরোচের রাজস্ব পাওনা বহাল থাকে। উপরন্তু, পুণা আক্রমণে কোম্পানির ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১২ লাখ টাকা আদায়ের ব্যবস্থা নেওয়া হলো।
অন্যদিকে যে রঘুনাথ রাও সবকিছুর পেছনে কলকাঠি নাড়ছিলেন, কোম্পানি কৌশলগত কারণে তার পক্ষ থেকে সরে আসার পথ নিল। মাসিক ২৫ টাকা বৃত্তির বিনিময়ে তাকে গুজরাটের কোপারগাঁওয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু খেলা এখানেই শেষ হলো না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোম্বাই কাউন্সিলের কয়েকজন সদস্য রঘুনাথকে আশ্রয় দিলেন। এদিকে ১৭৭৭ সালে নানা ফড়নবীশ ফরাসী বণিকদের একটি বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে ওঠে। ইংরেজরা বিষয়টির গভীরতা বুঝতে পারলো। কলকাতা কাউন্সিল একরকম বাধ্য হয়ে বোম্বাই কাউন্সিলের সাথে মিলিতভাবে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামল।
১৭৭৯ সালের ৪ জানুয়ারি কর্নেল ইগারটনের নেতৃত্বে ইংরেজদের একটি বাহিনী বোহর ঘাট এলাকায় পৌঁছতেই মারাঠা সেনার হামলার মুখোমুখী হলো। মারাঠাদের আক্রমণের মুখে কোম্পানির সৈন্যরা ওয়াড়গাঁওয়ে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হলো। অপ্রত্যাশিত বিপদ দেখে ইংরেজরা আপোষের পথে গেল। ১৬ জানুয়ারি অনিচ্ছা সত্ত্বেও মারাঠাদের সাথে ‘ওয়াড়গাঁও ট্রিটি’ নামে এক চুক্তি করতে বাধ্য হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী, ইংরেজরা তাদের দখলে নেওয়া জায়গা ফেরত দেবে এবং রঘুনাথ রাওকে মারাঠাদের কাছে পাঠাবে।
এদিকে কোলকাতায় কোম্পানির গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এই চুক্তি মানতে একেবারে নারাজ হলেন। উত্তর ভারত থেকে কর্নেল টমাস গডার্ডের অধীনে ইংরেজদের এক বাহিনী বোম্বের উদ্দেশ্যে যুদ্ধযাত্রা করল। ৬০০০ সৈন্যের এই বাহিনী ১৫ ফেব্রুয়ারি আহমেদাবাদ দখল করে নেয়। এই বাহিনীর হাতে ১৭৮০ সালের ১১ ডিসেম্বর বেসিনেরও পতন হয়। উজ্জয়িনীর মারাঠা শাসক মাহাদজী সিন্ধিয়া ভালোমতো প্রস্তুত হবার আগেই ক্যাপ্টেন পপহ্যামের নেতৃত্বে বাংলা থেকে আসা ইংরেজদের এক সৈন্যদল ১৭৮০ সালের ৪ আগস্ট গোয়ালিয়র দখল করে নেয়। কিন্তু বেসিন দখল করে পুনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার সময় কর্নেল গডার্ড ১৭৮১ সালের এপ্রিলে হরিপন্ত ফাড়কে ও তুকোজী হোলকারের নেতৃত্বে মারাঠাদের এক বাহিনীর হাতে পরাজিত হন।
অন্যদিকে, তার আগেই ফেব্রুয়ারিতে মাহাদজী সিন্ধিয়া মধ্য ভারতে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। প্রাথমিকভাবে ইংরেজরা এগিয়ে থাকলেও মারাঠাদের শক্তিমত্তা সম্পর্কে তাদের আগের ধারণা এখানে কিছুটা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। তবুও তারা থেমে ছিল না। মার্চ মাসে চলা যুদ্ধে এক রাতের হামলায় ইংরেজরা মারাঠা বাহিনীর হাতি, অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্যের সরবরাহ নিজেদের দখলে নিতে সফল হয়। দেখা যাচ্ছিল, যুদ্ধে দুই পক্ষের পাল্লাই কেউ কারো চেয়ে বেশি হতে পারছে না। এদিকে ১৭৮১ সালের এপ্রিল মাসে কর্নেল মুর্যে ক্যাপ্টেন পপহ্যামকে সহায়তা করতে এগিয়ে এলেন। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়ালো, সবার অস্ত্র সবার দিকে তাক করা ছিল, একটু অসাবধান হলে অবধারিত মৃত্যু!
ফলে অস্ত্র সংবরণ করে সন্ধির দিকে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ খোলা রইল না। মূলত মাহাদজী সিন্ধিয়ার মধ্যস্থতায় চুক্তির ব্যবস্থা হলো। এই চুক্তি ‘ট্রিটি অব সলবাই’ নামে খ্যাত। ১৭৮২ সালের ১৭ মে স্বাক্ষরিত এই চুক্তি মারাঠাদের পক্ষে মাহাদজী সিন্ধিয়া ও ইংরেজদের পক্ষে ওয়ারেন হেস্টিংসের মধ্যে সম্পাদিত হয়। এর ফলে ইংরেজরা সালসেটি ও বরোচের উপর তাদের দখল পাকাপোক্ত করতে সক্ষম হয়। বিনিময়ে ইংরেজরা মাধব রাও নারায়ণকে পেশোয়া হিসেবে স্বীকার করে নেয়।
এই যুদ্ধ ভারতবর্ষে ইংরেজ আধিপত্য বিস্তারের প্রশ্নে বেশ গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায়। বাহ্যিকভাবে দেখতে গেলে, যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি, আর্থিক লোকসান ও মৃত্যু ছাড়া ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আসলে কোনো লাভই হয়নি। কিন্তু অন্যভাবে এই যুদ্ধ ইংরেজদের জন্য সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছিল। কারণ দক্ষিণ ভারতে মহীশুরের হায়দার আলী, টিপু সুলতান, ফরাসী কুঠিয়াল ও হায়দ্রাবাদের নিজাম শাহীর সাথে ইংরেজদের বোঝাপড়ার জন্য ইংরেজদের অন্য প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মারাঠা শক্তির নীরবতা সেসময় কাম্য ছিলো। এদিকে ইংরেজদের সাথে সন্ধির ফলে মারাঠা সাম্রাজ্যও রাজ্যবিস্তারে মন দেয়। তবে তাদের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার খুবই অভাব ছিল। স্থানীয় শাসকগণ পুণা রাজদরবারের অনুমতি ছাড়াই অনেক সিদ্ধান্ত নিতেন। এই বিচ্ছিন্নতাই একসময় তাদের পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।