
পর্তুগিজ নাবিক বার্তোলোমিউ ডিয়াজ তার জাহাজের বহর নিয়ে যখন আটলান্টিক আর ভারত মহাসাগরের মাঝখানের উত্তাল সাগরের ঢেউয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন তখন দক্ষিণ আফ্রিকার পাথুরে সৈকত আর ঝড়ো আবহাওয়া দেখে কিছুটা হতাশই হয়েছিলেন। কিন্তু তখনও কি তিনি ভাবতে পেরেছিলেন যে এই নিষ্প্রাণ জমিটুকুর নিচেই লুকিয়ে রয়েছে বহুমূল্য রত্নভাণ্ডার আর তা পাওয়ার জন্যই এখানে রক্তের বন্যা বইয়ে দেবে ইউরোপের সাদা চামড়ার মানুষরা?
পটভূমি
সুয়েজ খালের অস্তিত্ব না থাকায় ইস্ট ইন্ডিজের উপনিবেশ থেকে ইউরোপে যেতে পুরো আফ্রিকা ঘুরতে হতো ডাচ ফ্লাইংম্যানদের। এই দীর্ঘ ভ্রমণে ক্লান্ত নাবিকদের জন্য প্রয়োজন হতো বিশ্রামের, সাথে জিহ্বায় ফলমূল-মাংসের ছোঁয়াও লাগাটা ছিলো দরকারী। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ কোম্পানির কর্ণধার ইয়ান ফন রিবেকের অনুরোধে কেপ কলোনীতে ডাচ কৃষকদের আগমন ঘটে। নতুন জীবনের আশায় দলে দলে কেপ কলোনীতে ভীড় জমাতে থাকে ওলন্দাজ কৃষকরা। কেপের কৃষকদের খামারে সহযোগিতা করার জন্য ইন্দোনেশিয়া থেকে দাস আমদানি ব্যবসা শুরু করে কোম্পানি। কিন্তু চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে এই বিশাল সংখ্যার কৃষকদেরকে নেদারল্যান্ডসে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানায় কোম্পানির হর্তাকর্তারা। যা-ই হোক, কেপ কলোনীতেই নিজেদের স্থায়ী ঠিকানা গেঁড়ে নেয় ডাচরা, শুরু করে নতুন জীবন।

আঁকিয়ের কল্পনায় কেপ অফ গুড হোপে ডাচ জাহাজের আগমন; Source: Wikimedia Commons
সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো, বিপত্তিটা বাঁধলো নয় হাজার কিলোমিটার উত্তরে। ডাচ রিপাবলিক দখল করার জন্য আক্রমণ করে বসলো ফ্রেঞ্চ বাহিনী। ডাচ রাজা পঞ্চম উইলিয়াম পালিয়ে আশ্রয় নিলেন ব্রিটিশদের কাছে, সাহায্য করতে বললেন ডাচ রিপাবলিক পুনরুদ্ধার করার জন্য, বিনিময়ে ডাচ উপনিবেশগুলো যুক্ত হবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে। অবশেষে বিদ্রোহ দমন করার পর উইলিয়াম তার রাজ্য ফেরত পেলে ছয় মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে কেপ কলোনী কিনে নেয় গ্রেট ব্রিটেন।
কিনে নেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই গ্রেট ব্রিটেন থেকে আসা ৫,০০০ অভিবাসী আস্তানা গাড়লো কেপ কলোনীতে, নতুন আইনের মাধ্যমে কেপ কলোনীতে ডাচ ভাষা নিষিদ্ধ করলো ব্রিটিশ গভর্নর। ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হলো, ক্ষেত-খামার ছেড়ে কেপ থেকে উত্তরে পাড়ি জমালো বোয়াররা (কেপ কলোনীতে বাস করা ডাচ বংশোদ্ভূত), গন্তব্য ট্রান্সভাল কিংবা অরেঞ্জ নদীর ওপাড়।

১৮০৯ সালের কেপ কলোনীর মানচিত্র; Source: David Rumsey Historical Map Collection
এরপরের একশ বছরের ইতিহাস প্রায় একইরকম। নাটাল থেকে বোয়ারদেরকে উৎখাত করলো ব্রিটিশরা, একে একে জুলু আর বাসোথোসহ অন্যান্য উপজাতিদের কাছ থেকে বিশাল অঞ্চল দখল করে ব্রিটিশ রাজত্বের সীমানা বাড়তে থাকলো। বাকি ছিলো বোয়ার নিয়ন্ত্রিত ‘অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট’ আর ‘ট্রান্সভাল রিপাবলিক’। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো, ঝামেলাটা বাঁধলো তখনই যখন অরেঞ্জ নদীর তীরে হীরার টুকরোর দেখা মিললো। এর কিছুদিন পরেই ট্রান্সভালের মাটিতে হলুদরঙা সোনার চোখধাঁধানো সৌন্দর্য্যে বিমোহিত হয়ে ইউরোপ থেকে ছুটে এলো ব্যবসায়ীরা। ট্রান্সভালের সোনার খনির দখল পেতে মরিয়া হয়ে উঠলো ব্রিটিশরা, এদিকে বোয়াররাও তাদের জমি ছাড়তে রাজি নয়। শুরু হলো যুদ্ধ, অ্যাংলো-বোয়ার যুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটি রক্তলাল হতে বেশি সময় নিলো না।

অ্যাংলো-বোয়ার যুদ্ধ পূর্ববর্তী দক্ষিণ আফ্রিকার মানচিত্র, নীল – গ্রেট ব্রিটেন নিয়ন্ত্রিত কেপ কলোনী; কমলা – অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট; সবুজ – ট্রান্সভাল রিপাবলিক; লাল – জুলু অধ্যুষিত নাটাল যা পরবর্তীতে ব্রিটিশরা দখল করে নেয়; Source: Wikimedia Commons
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প
দ্বিতীয় অ্যাংলো-বোয়ার যুদ্ধ যখন শুরু হলো, তখন সময়টা ১৮৯৯ সালের প্রায় শেষের পথে। মাত্র ৮ মাসের মধ্যেই ট্রান্সভালের শেষ শহরটিও আত্মসমর্পণ করে ফেলে বোয়ারদের চেয়েও প্রায় ৩ গুন বিশাল ব্রিটিশ বাহিনীর সামনে! সাড়ে তিন লক্ষ নিয়মিত সেনাদেরকে সাহায্য করতে সুদূর কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এমনকি ভারতের উপনিবেশ থেকেও সৈন্য নিয়ে এসেছে ব্রিটিশরা, সাথে আরও এক লক্ষ কালো চামড়ার আদিবাসীরা তো রয়েছেই। এই বিশাল বাহিনীর সামনে টিকতে না পেরে আত্মগোপন করে বোয়াররা, গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে চেষ্টা করে নিজেদের চামড়া বাঁচানোর।

গেরিলা যুদ্ধের জন্য পরিকল্পনারত বোয়ার কমান্ডাররা; Source: Wikimedia Commons
আত্মগোপন করে থাকা হাজার হাজার বোয়ার পুরুষ তখন নিজেদের বাড়ি ছেড়েছুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আছে ট্রান্সভালের প্রান্তরে, ঠিক তখনই ব্রিটিশ সরকার ‘স্কর্চড আর্থ’ নীতি প্রণয়ন করলো। বোয়ারদের বাড়ি পুড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হলো, ক্ষেতে লবণ দেওয়া হলো, লুটপাট করা হলো পশুসম্পদ, এমনকি পানির সরবরাহ কমিয়ে দিতে কুয়াতেও বিষ ঢেলে দেওয়া হলো! এদিকে বোয়ার নারী ও শিশুদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো তথাকথিত ‘শরণার্থী ক্যাম্প’-এ, যা কিছুদিন পরেই পরিণত হলো জনাকীর্ণ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। দক্ষিণ আফ্রিকার সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গরাও এর বাইরে ছিলো না। হাতেগোনা কয়েকটা গ্রামে তারাকাটের বেড়া দেওয়া ছাড়া বাকিদেরকে নিয়ে আসা হলো ক্যাম্পগুলোতে, যেখানে তারা কাজ করবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অবৈতনিক শ্রমিক হিসেবে।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রান্তরে কিছুদিনের মধ্যেই ১০০-এরও বেশি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প গড়ে উঠলো, যেখানে আটকা পড়লো এক লক্ষেরও বেশি বোয়ার আর কৃষ্ণাঙ্গ জনগণ। একদিকে খাদ্যের অপ্রতুলতা, অন্যদিকে বন্দীর সংখ্যার আধিক্য, বন্দীদেরকে একবেলা খাবার দিতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলো ক্যাম্পের নার্সরা। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের নোংরা পরিবেশে রোগের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়লো, মারা যেতে থাকলো একের পর এক বন্দী। শিশুদের উপর প্রভাবটা পড়লো সবচেয়ে বেশি, মড়কে মারা যাওয়া ২৮ হাজার বোয়ার বন্দীর মধ্যে ২২ হাজারই ছিল এই অভুক্ত বাচ্চারা!

নিলসট্রুম ক্যাম্পে বন্দী বোয়ার শিশুরা; Source: Library of the London School of Economics and Political Science
অ্যাংলো-বোয়ার যুদ্ধের শেষ গড়াতে না গড়াতেই বেসামরিক নিহত লোকের সংখ্যা পৌঁছে গিয়েছিলো প্রায় ৪৬ হাজারে, যার বেশিরভাগই ছিল বোয়ার শিশুরা। বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এমন ঘটনা ঘটলো যেখানে পুরো একটা জাতিকে ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিলো।
তাহলে চলুন দেখে নেওয়া যাক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা ছবিগুলো।
১
দক্ষিণ আফ্রিকা, ১৯০১ – ক্যাম্পে সদ্য পৌঁছানো বোয়ার জনগণ।

Source: Wikimedia Commons
২
আইরিন ক্যাম্প, ১৮৯৯- ১৯০২ – তাঁবুতে বসে থাকা অস্থিচর্মসার এক বোয়ার বালক।

Source: Wikimedia Commons
৩
কিম্বার্লি ক্যাম্প, ১৯০১ – স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য আলাদাভাবে তৈরি ক্যাম্প।

Source: Library of the London School of Economics and Political Science
৪
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কাছে গ্রেফতার হওয়া বোয়ার সৈন্যরা, যাদেরকে জাহাজে করে অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আর তাদের পরিবারের শেষ আশ্রয় হবে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প।

Source: Wikimedia Commons
৫
ব্লুমফন্টেইন ক্যাম্প, ১৯০১ – লিজি ফন জিল, ক্যাম্পে থাকাকালীন সময়ে খাবারের অভাবে মৃতপ্রায় এক বোয়ার শিশু।

Source: Wikimedia Commons
৬
নর্ভাল পোর্ট ক্যাম্প, ১৯০১ – তাঁবুতে ছেয়ে থাকা বিশাল প্রান্তর এবং আরেকটি ক্যাম্প।

Source: Library of the London School of Economics and Political Science
৭
বালমোরাল ক্যাম্প, ১৯০১ – পত্রিকায় মগ্ন হয়ে আছে ক্যাম্প পাহারার দায়িত্বে থাকা রক্ষীরা।

Source: Library of the London School of Economics and Political Science
৮
স্প্রিংফন্টেইন ক্যাম্প, ১৯০১ – মাংস বিতরণের সময়।

Source: Library of the London School of Economics and Political Science
৯
দক্ষিণ আফ্রিকা, ১৯০১ – তাঁবুর মধ্যে গাদাগাদি করে বসে থাকা এক বোয়ার পরিবার।

Source: Library of the London School of Economics and Political Science
১০
দক্ষিণ আফ্রিকা, ১৮৯৯ – কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা স্থানীয়দের গ্রাম যা ওয়ার্ক ক্যাম্পে পরিণত করা হয়েছে।

Source: Wikimedia Commons
১১
ক্যাম্প ডারবান, জুন ১৯০২ – ক্যাম্পে কাজের ফাঁকে বিশ্রামরত অবস্থায় স্থানীয়রা।

Source: Library and Archive Canada
১২
দক্ষিণ আফ্রিকা, ১৯০১ – স্থানীয়দের দিয়ে রেললাইন তৈরি করিয়ে নেওয়ার সময়।

Source: Library of the London School of Economics and Political Science
১৩
ক্লার্কসডর্প ক্যাম্প, ১৯০১ – ক্যাম্প নার্স মিস মর্টনের কাজ দেখছে ক্যাম্পে থাকা একদল স্থানীয় শিশু।

Source: Library of the London School of Economics and Political Science
১৪
দক্ষিণ আফ্রিকা, ১৮৯৯-১৯০২ – ক্যাম্পের হাত থেকে বাঁচার জন্য দেশ থেকে পালানোর শেষ চেষ্টা করছে এক শরণার্থী বোয়ার পরিবার।

Source: Wikimedia Commons
১৫
মেয়ারব্যাংক, ১৯০১ – মেয়ারব্যাংক স্টেশনে নিজেদের সহায় সম্বল নিয়ে পৌঁছানো বোয়ার শরণার্থীরা।

Source: Library of the London School of Economics and Political Science
১৬
দক্ষিণ আফ্রিকা, ১৯০১ – স্থানীয়দের এক ক্যাম্পে খাবার বিতরণের সময়।

Source: Library of the London School of Economics and Political Science
১৭
দক্ষিণ আফ্রিকা, ১৮৯৯-১৯০২ – মা মারা যাওয়ার পর একদল বোয়ার শিশুর দায়িত্বে থাকা এক স্থানীয় নারী।

Source: Wikimedia Commons
১৯
মিডলবার্গ ক্যাম্প, ১৯০১ – নদীর পানিতে কাপড় ধোয়ার সময় বোয়ার নারীরা।

Source: Library of the London School of Economics and Political Science
২০
ব্রোংকারস্প্রুইট ক্যাম্প, ১৯০১ – কম্বল গায়ে জড়িয়ে ক্যাম্পে ঘোরাঘুরি করার সময় স্থানীয় শিশুরা।

Source: Wikimedia Commons