ভেরা গেদ্রোয়েত। নামটা কি চেনা চেনা লাগছে? উঁহু, তা-ই না? ইতিহাসকে বদলে দেওয়া এই রাশিয়ান নারীকে চেনেন না অনেকেই। সাধারণ কোনো নারী ছিলেন না ভেরা। তিনি ছিলেন চিকিৎসক ও লেখক। রাশিয়ার প্রথম নারী সামরিক সার্জন! শুধু তা-ই নয়। পুরো রাশিয়ার সার্জারির প্রথম মহিলা অধ্যাপক ছিলেন তিনি। নারী চিকিৎসকদের মধ্যে তিনিই প্রথম ইম্পেরিয়াল প্যালেস অব রাশিয়াতে যোগদান করেন। যুদ্ধে আহত সৈনিকদের ল্যাপারোটমির জন্য পরিচিত হলেও, একটা সময় আন্তর্জাতিক চিকিৎসা নীতিমালাই বদলে দেন এই নারী। চিকিৎসক হওয়ার পাশাপাশি লেখক হিসেবে কবিতা আর আত্মজীবনীও লেখেন ভেরা। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি যে অবদান রাখেন, তা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে থাকলে কখনোই যুদ্ধের দামামা এতগুলো মানুষের জীবনকে নষ্ট করতো না বলে মনে করা হয় আজও! কী করেছিলেন তিনি?
১৮৭০ সালে জন্ম নেন ভেরা গেদ্রোয়েত। রাশিয়ার কিভে জন্ম হয় তার। বাবার দিক দিয়েই ‘রাজকন্যা’ খেতাব পান ভেরা। তবে রাজকন্যার ‘র’ ও ছিল না তার মধ্যে। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন দুরন্ত। সেন্ট পিটসবার্গে পড়াশোনা শুরু করেন ভেরা। এর আগে অবশ্য বাড়িতে বসেই পড়েন তিনি।
মাত্র ১৬ বছর বয়সেই আটক করা হয় তাকে, বামপন্থী রাজনৈতিক দলের সাথে যোগ দিয়ে বিপ্লবী কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য। এরপর অবশ্য ছাড়া পান ভেরা। তবে বেশিদিন বাড়িতে থাকেননি তিনি। সুযোগ পেয়েই আবার পালিয়ে যান এই সাহসী নারী। এবার পালান সুইজারল্যান্ডে। সেখানে মেডিকেলের পড়াশোনা শুরু করেন গেদ্রোয়েত। রাশিয়ার ১৮০০ আর ১৯০০ শতকের দিকে হাতেগোনা যে কয়েক হাজার মেডিকেল শিক্ষার্থী ছিলেন, তাদের মধ্যে গেদ্রোয়েত ছিল অন্যতম একজন। তখন অন্যান্য দেশের তুলনায় সুইজারল্যান্ডের মেডিকেল শিক্ষার নারীদের উপস্থিতি বেশ চোখে পড়ার মতো ছিল।
১৯০১ সালে রাশিয়ায় ফিরে আসেন ভেরা। সেখান থেকেই পরীক্ষা দিয়ে পুরোপুরি চিকিৎসক হন তিনি। তবে প্রথমেই যুদ্ধক্ষেত্রে যোগ দেননি। শিল্পকারখানায় সার্জন হিসেবেন কাজ শুরু করেন তিনি। যোগ দেন পশ্চিম রাশিয়ার মালজভ সিমেট ফ্যাক্টরিতে। সেখানে তিনি একদম নিজের মতো করে একটি হসপিটাল ফ্যাক্টরি চালু করেন। ১৮৯৫ সালে এক্স-রে মেশিন উদ্ভাবিত হয়। ভেরা সেই সময়েই নিজের হাসপাতালে এক্স-রে মেশিন এবং ফিজিওথেরাপির যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করেন। প্রথম বছরে মোট ১০৩ জন কর্মীর মধ্যে মাত্র দু’জন মৃত্যুবরণ করেন এই হাসপাতালে।
কারখানায় কর্মীদের উপরে অতিরিক্ত কাজের চাপ পড়ায় এবং এর অনেকটাই তাদের তলপেটে পড়ায় কর্মীরা ক্লান্ত থাকতেন এবং নানাবিধ শারীরিক সমস্যায় ভুগতেন। এদের মধ্যে অনেকেই ভেরার কাছে হার্ণিয়ার অপারেশন করেন। সেসময় তখনো তলপেট বা শরীরের নিম্নাংশ নিয়ে মানুষের অতটা চিন্তা ছিল না। এ ব্যাপারে এগিয়ে আসেন ভেরা। ফলে কয়েক বছর পর রুশো-জাপানিজ যুদ্ধ শুরু হলে ভেরা রেডক্রসে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগদান করেন। অসম্ভব রকমের ভয়াবহ এই যুদ্ধে রাশিয়া জাপানের কাছে হেরে যায়। প্রায় এক লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেন এই যুদ্ধে।
যুদ্ধে ভেরার অবদান ঠিক কতটুকু ছিল, তা নিয়ে সঠিক জানা যায় না। জন বেনেট নামক আরেকজন চিকিৎসক এ নিয়ে কাজ করেন। তিনি তার লেখার ভেতরে যুদ্ধকে নিয়ে ভেরার নিজের লেখা একটি প্রতিবেদনকে জুড়ে দেন। যেটি পরবর্তী সময়ে সংবাদমাধ্যমের হাতে আসে। তবে এ যুদ্ধের পর থেমে থাকেননি ভেরা। ১৯০৪ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর, মুকদেন নামক একটি গ্রামে (বর্তমানে চিনের শেনইয়াং নামে পরিচিত) একটি চিকিৎসালয় খোলেন ভেরা। এটি যে শুধু একটি ফিল্ড হসপিটাল ছিল, তা নয়। ট্রেনের পাশাপাশি মাটিতেও গড়ে ওঠে হাসপাতালের অনেকটা অংশ। একের পর এক প্রচুর আহত মানুষ আসতে শুরু করে এই হাসপাতালে। নিজের প্রতিটি রোগীর ব্যাপারে লিখতে শুরু করেন ভেরা।
শুধু যে তিনি রোগীদের সম্পর্কে লিখতেন, তা-ই নয়, একইসাথে আক্রান্তরা কীসের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন, সেটাও লেখার চেষ্টা করেন তিনি। একবার এক রোগীর মাথায় গুলি লাগে। ফলে তার শরীরের বাঁপাশ কাজ করা বন্ধ করে দেয়। পরে মস্তিষ্ক থেকে সেই গুলি বের করে আনেন ভেরা। রোগী পরবর্তীতে বাঁহাত নড়াচড়ার উপযোগী হয়। এই কাজগুলো তাকে যে শুধু আনন্দই দিত, তা নয়। একইসাথে, কাজগুলো তাকে একরকমের সার্থকতা প্রদান করতো। তবে কিছুদিন পরেই যখন ঠাণ্ডা আর তুষার পড়তে শুরু করলো, এই পুরো ব্যাপারটিই পাল্টে যেতে শুরু করলো। মোবাইল হসপিটাল ঠিক থাকলেও এর বাইরে শত শত রোগী, যারা তাঁবু গেড়ে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের ঠাণ্ডার কারণে অসুস্থতা বাড়তে থাকে। ১৯০৫ সালে তাই একটি অপারেটিং থিয়েটার সংযুক্ত করা হয় ট্রেনের সাথে।
পরবর্তী মাসগুলোতে এই ট্রেন মুকদেন থেকে শুরু করে ফুশান পর্যন্ত, আহত যোদ্ধাদের কাছে যেতে থাকে। প্রথম চার সপ্তাহেই মোট ৫৬টির বেশি অস্ত্রোপচার করেন ভেরা। ফলে, তার হাসপাতালের স্থান বাড়াতে হয়। কিছুদিন পর এ স্থানে জাপানিজ আক্রমণ বাড়ে। সেখান থেকে রোগীদের নিয়ে পালিয়ে আসেন ভেরা গেদ্রোয়েত।
সেসময় যুদ্ধের সময় পেটে আঘাত পেলে এবং ভেতরে রক্তক্ষরণ হলে সেটা চিকিৎসকেরা দেখার চেষ্টা করতেন না। বরং কোনোরকম অস্ত্রোপচার ছাড়াই রোগীর অবস্থা ভালো হচ্ছে না খারাপ হচ্ছে, তা বোঝার চেষ্টা করতেন। অনেকসময় এই রোগীরা মৃত্যুবরণ করতেন খুব তাড়াতাড়ি। ভেরা নিজের পূর্ববর্তী জ্ঞান থেকে শিক্ষা নিয়ে তলপেটের এই সার্জারি করা শুরু করেন। ল্যাপারোটোমিস নামক এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগীর আক্রান্ত স্থানের ভেতরে প্রবেশ করে দেখতেন ভেরা। রক্তক্ষরণ থামানোর চেষ্টা করতেন। প্রতিনিয়ত এই কাজটি করেন তিনি আর একইসাথে এর ফলাফলটাও লিখে রাখেন।
তিনি নিজের লেখনীতে উল্লেখ করেন, কেন একজন রোগীর তলপেটে রক্তক্ষরণ হচ্ছে এবং তা কীভাবে বন্ধ করা যাবে, তা বোঝার পদ্ধতিটি খুব দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে কোন ব্যান্ডেজ ব্যবহার করতে হবে, কীভাবে ক্ষত দ্রুত ঠিক হবে- এ সবকিছু লেখেন ভেরা। তবে এদের মধ্যে বেশিরভাগ তথ্যই পরে সংরক্ষণ করা হয়নি। ঠিকভাবে সংরক্ষিত হলে যা কিনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মৃত্যুর হার অনেকটা কমিয়ে দিতে পারত। যুদ্ধের প্রায় ১০ বছর আগেই সবগুলো তথ্য লিখে গিয়েছিলেন ভেরা।
যুদ্ধ শেষ হয়ে এলে নিজের কলকারখানার কাজে ফিরে আসেন ভেরা। সেখান থেকে যোগ দেন রাশিয়ার রাজকীয় পরিবারে, সার্জন হিসেবে। এমনকি শাসন আলেকজান্দ্রা এবং তার মেয়েদেরকেও সার্জারির কাজ শেখান এই নারী।
তেজস্বী নারী ছিলেন ভেরা। নিজের মাথা কখনো নোয়াননি। শাসকদের কাছেও নয়। ১৯১৭ সালে যুদ্ধের জন্য প্রাসাদ ছেড়ে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যান তিনি। আহত হন। পরবর্তী সময়ে শিক্ষক হিসেবে সার্জারি শেখানোর দায়িত্ব নেন তিনি এবং একটা সময় অধ্যাপক হয়ে যান। লিখতে শুরু করেন। এবার আর চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যাপার নয়, কবিতা লিখতে কলম হাতে ধরেন তিনি। ‘পুরুষালি’ চেহারা, কণথ আর নারীদের মধ্যকার আধিপত্যের কারণে অনেকেই তাকে সমকামী বলে ভাবেন। তবে, এসব নয়, নিজের জ্ঞানে আর গুণে জনপ্রিয় ছিলেন ভেরা গেদ্রোয়েত।
তার লেখনী এখনো কিভে বিখ্যাত। ১৯৩২ সালে জন্মস্থানেই মারা যান ভেরা এবং সেখানেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়। চিকিৎসাবিদ্যার অন্যতম নারী কর্ণধার হিসেবে নয়, কারো লিখে যাওয়া মূল্যবান তথ্য সংরক্ষণ না করলে সেটা যে হারিয়ে যেতে পারে এবং ক্ষতির কারণ হতে পারে, তার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হিসেবেও অনেকে ভাবেন এই মহীয়সী নারীকে।