মধ্যযুগে ‘নাইট’ ছিল খুবই সম্মানীয় একটি উপাধি। নাইটহুড খেতাবপ্রাপ্ত ব্যক্তি সমাজে যেমন নির্দিষ্ট সুবিধা ও মর্যাদা লাভ করতেন, তেমনি যুদ্ধের ময়দানেও তাদেরকে আলাদা সম্মান ও ভয়ের চোখে দেখতো সবাই। ইতিহাসের বহু স্থানে আমরা বহু নাইটের বীরত্বের কথা দেখতে পাই। বহু নাইটের বহু বীরত্বগাঁথা উঠে এসেছে নানা সাহিত্যেও।
কিন্তু যে কেউ কিন্তু এই সম্মানীয় উপাধি লাভ করতে পারতো না। এর জন্য প্রয়োজন হতো দীর্ঘ প্রশিক্ষণ ও ধৈর্যের। সাধারণত দুটি উপায়ে একজন ব্যক্তি নাইট হতে পারতো। প্রথমত কেউ যদি যুদ্ধক্ষেত্রে অসাধারণ বীরত্ব ও সাহস দেখাতে পারতো তবে চাইলে কোনো রাজা কিংবা অন্য কোনো নাইট তাকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করতে পারতেন। নাইট হওয়ার দ্বিতীয় পদ্ধতি ছিল অন্য কোনো নাইটের শিষ্য হওয়া এবং কঠিন পরিশ্রম ও অনুশীলনের মাধ্যমে তার আস্থা অর্জন করা।
মধ্যযুগে প্রায় প্রতিটি যুবকই ছোট থেকে নাইট হওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে বড় হতো। তবে তাদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক শেষমেশ নাইট হতে পারতো। কেউ নাইট হতে চাইলে প্রথমে তাকে একজন নাইটের প্রয়োজনীয় অস্ত্র, বর্ম ও যুদ্ধোপযোগী ঘোড়া জোগাড় করতে হতো।
সেসময় এগুলো কিন্তু খুব একটা সস্তা ছিল না। সমাজের সম্পদশালী ব্যক্তিরাই এগুলো জোগাড় করতে পারতো। প্রায়শই কোনো নাইটের সন্তানই নাইট হতো। তবে সাধারণ মানুষও কঠিন অনুশীলন ও চর্চার মাধ্যমে নাইট হতে পারতো। আর কোনো একজন সাধারণ মানুষ ছোট থেকে কিভাবে একজন পুরোদস্তুর মধ্যযুগীয় নাইট হয়ে উঠতো সে সম্পর্কেই আজকে আমরা জানবো। নাইট হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে কয়েকটি ধাপ ছিল। আর সেগুলো হলো-
- পেজ
- স্কয়ার
- নাইটহুড প্রদান
চলুন এখন এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
১) পেজ
নাইট হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো শারীরিকভাবে শক্তিশালী হওয়া। কারণ একজন নাইটকে যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোড়ায় চড়ার সময় একহাতে ঢাল ও অন্য হাতে বর্শা রাখতে হবে। ফলে তাকে শুধু মাত্র তার গোড়ালি ও পা দিয়েই তার ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে হবে। এছাড়াও তার দীর্ঘ সময় ভারী তরবারি নিয়ে যুদ্ধ করার ক্ষমতা থাকতে হবে এবং সেই সাথে ভারী বর্ম পরে দ্রুত চলাচল করার দক্ষতাও থাকতে হবে। শুধু তরবারিতে পারদর্শী হলেই চলবে না। সেই সাথে বাড়তি কোনো অস্ত্র, যেমন- ছুরি, কুঠার, মুগুর, তীর ধনুক প্রভৃতি ব্যবহারেও দক্ষ হতে হবে তাকে। এজন্য খুব অল্প বয়স থেকেই শুরু হতো নাইট হবার প্রশিক্ষণ।
সেসময় বহু পিতা-মাতা চাইতেন তাদের সন্তান বড় হয়ে নাইট হোক। ফলে যখন তাদের সন্তানের বয়স ৭-১০ বছর হতো তখন তারা তাকে অন্য কোনো নাইটের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য পাঠাতেন। ছেলেটিকে নাইটের বাসায় অস্থায়ীভাবে থাকতে হতো এবং বাসার সকল কাজকর্ম করতে হতো। তাকে বলা হতো ‘পেজ’। খাবার পরিবেশন করা, জামাকাপড় পরিষ্কার করা, নাইটের ঘোড়ার দেখাশোনা করা কিংবা কোনো বার্তা পৌঁছে দেয়ার মতো কাজ করতো পেজরা। নাইটের বাসায় কাজ করার সময় তারা সঠিক আদবকায়দা ও সামাজিক নানা আচার আচরণ সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করতো।
শুধু এসবই নয়। এই ধাপেই পেজ যুদ্ধের প্রথম প্রশিক্ষণ শুরু করতো। সাধারণ একজন পেজ অন্য আরেকজন পেজের সাথে কাঠের অস্ত্র ও বর্ম নিয়ে যুদ্ধের অনুশীলন করতো। এছাড়াও এ সময় হাতের সাহায্য ছাড়া ঘোড়া চালানো ও এক হাতে বর্শা নিয়ে ঘোড়া চালনার প্রশিক্ষণ নিতো তারা। এসব অনুশীলনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে পরবর্তী ধাপে পৌঁছে যেত একজন পেজ।
২) স্কয়ার
নাইট হওয়ার পথে দ্বিতীয় ধাপ হলো স্কয়ার হওয়া। স্কয়ার হলো একজন শিক্ষানবিশ নাইট। সাধারণত ১৪-১৫ বছর বয়সে একজন স্কয়ার হতে পারতো। স্কয়ার শব্দটির উৎপত্তি ফ্রেঞ্চ ecuyer থেকে। এর অর্থ ‘বর্ম বাহক’। অস্ত্রচালনা ও অশ্বারোহীতা ছাড়াও একজন স্কয়ারের অন্যতম কাজ ছিল একজন নাইটের সম্পূর্ণ দেখভাল করা। এছাড়াও নাইটের অস্ত্র পরিষ্কার করা, বর্ম পালিশ করা, নাইটের ঘোড়ার দেখাশোনা করা, যুদ্ধে যাওয়ার সময় নাইটকে তার পোশাক পরতে সাহায্য করা, তার বর্ম বহন করা প্রভৃতি কাজ করতে হতো স্কয়ারকে।
এসব সামরিক কাজ ছাড়াও একজন স্কয়ারকে সংগীত চর্চা, নাচ, ল্যাটিন ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় লেখা ও পড়ার মতো নানা গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা অর্জন করতে হতো। তাদেরকে কবিতা আবৃতি সহ সমাজের উচ্চ স্তরের আদব কায়দা শিখতে হতো। সমাজের সম্ভ্রান্ত মহিলাদেরকে শিকারে নিয়ে যাওয়া এবং তাদের সাথে দাবা খেলার মতো কাজও করতে হতো তাদের। একজন স্কয়ারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল শিকার করা ও শিকারের মাংস দিয়ে নাইটের জন্য ভোজের ব্যবস্থা করা। এছাড়াও নাইটে বাসায় থাকা অন্যান্য পেজদের দেখাশোনা ও তারা কোনো কাজে ফাঁকি দিচ্ছে কি না সেটা দেখার দায়িত্ব ছিল স্কয়ারদের।
একজন স্কয়ারকে যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ রূপে প্রস্তুত হতে হতো। সাধারণত তারা বর্শা ও তরবারি নিয়ে অনুশীলন করতো। আর এসব অনুশীলনের ক্ষেত্রে কোনো কোনো সময় তাদেকে সাধারণের তুলনায় ভারী অস্ত্র দেওয়া হতো। এতে করে তাদের পেশী শক্তিশালী হয়ে উঠতো। আসল যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করা যাতে তুলনামূলকভাবে কিছুটা সহজ মনে হয় এজন্যও এমনটা করা হতো। যুদ্ধক্ষেত্রে একজন স্কয়ারের কাজ ছিল নাইটের পাশাপাশি থাকা। তার প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও সরঞ্জাম বহন করা। কোনো নাইট যুদ্ধে আহত হলে তাকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরাপদে বের করে আনাও ছিল স্কয়ারের অন্যতম প্রধান কাজ।
যখন একজন স্কয়ারের প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণ হতো তখন চাইলে তার মনিব নাইট, অন্য কোনো নাইট কিংবা কোনো রাজা তাকে নাইটহুড প্রদান করতে পারতো। এক্ষেত্রে স্কয়ারের বয়স হতো সাধারণত ১৮-২১ বছর। তবে যারা প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণ করতে ব্যর্থ হতো, তাদের পরিণাম কী হতো সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হতো তারা কোনো গীর্জা কিংবা আইন-আদালতের কাজ করার সুযোগ পেতো।
স্কয়ার থেকে নাইট হতে পারেননি এমন একজন বিখ্যাত ব্যক্তি হলেন জিওফ্রে চসার। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত ইংরেজ কবি, দার্শনিক ও বিখ্যাত ক্যান্টারবেরি টেলস এর লেখক। তবে যারা প্রশিক্ষণে সফল হতো এবং নাইট হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি জোগাড় করতে পারতো তাদেরকে দীর্ঘ এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নাইটহুড প্রদান করা হতো।
৩) নাইটহুড প্রদান অনুষ্ঠান
নাইট হতে চায় এমন একজন স্কয়ারের জন্য সবচেয়ে আনন্দময় হলো এই দিনটি। এই দিনেই তার সব স্বপ্ন পূরণ হবে। এই দিনের প্রস্তুতি হিসেবে তাকে ভোরে উঠেই ভালোভাবে গোসল করতে হতো। এরপর দাড়ি-গোফ কামিয়ে পরিপাটি হতে হতো। এই অনুষ্ঠানের আগের রাতটি সাধারণত একজন নাইটহুড প্রার্থী স্কয়ার গীর্জায় প্রার্থনা করে কাটিয়ে দিত। এ সময় সে তার আসন্ন বিপদ-আপদ ও প্রাণহানী থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করতো।
অনুষ্ঠানের দিন একজন স্কয়ারকে দুজন নাইট তার পোশাক পরতে সাহায্য করতেন। এই পোশাকের মধ্যে থাকতো সাদা জামা এবং সাদা বেল্ট যা পবিত্রতাকে নির্দেশ করতো, কালো কিংবা ধূসর রঙের মোজা যা পৃথিবীর ও মাটিকে নির্দেশ করতো এবং টকটক লাল রঙের আলখেল্লা যা রক্তকে নির্দেশ করতো। এরপর স্কয়ার তার মনিব নাইট কিংবা রাজা, যিনি তাকে নাইটহুড প্রদান করবেন, তার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসতেন।
এরপর নাইটহুড প্রদানকারী রাজা কিংবা নাইট তার তরবারিটি নিয়ে স্কয়ারের দুই কাঁধে আলতো করে ছুঁয়ে বলতেন, “Be thou a knight”। আর এর মাধ্যমেই স্কয়ার নাইটহুড লাভ করতেন। এরপর সদ্য নাইটহুডপ্রাপ্ত ব্যক্তি দেশ ও জাতির সেবার উদ্দেশ্যে শপথ ও অঙ্গীকার করতেন। এসব শেষ হলে নতুন নাইটকে একটি ঘোড়া ও তরবারি উপহার দেওয়া হতো। এই উপহার তাকে তার বাবা-মা কিংবা তার প্রশিক্ষণদাতা নাইট প্রদান করতেন। এভাবেই শেষ হতো নাইটহুড প্রাপ্তির দীর্ঘ অনুষ্ঠান। নাইটহুড পাওয়ার পর একজন নাইট তার দেশ কিংবা জাতির সেবার জন্য সম্পূর্ণ রূপে প্রস্তুত হয়ে যেতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয় ছিনিয়ে আনাই তখন হতো তার প্রধান লক্ষ্য।
ফিচার ইমেজ – wallhere.com