বছরের দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারি, বেশ ব্যস্ততার মধ্যে কাটায় নগরবাসী। তারপরও মাসের মাঝামাঝি সময়ে আগমন ঘটা বসন্তকে কেন্দ্র করে নানা আয়োজন থাকে মাস জুড়ে, এছাড়া বই মেলা ও বাণিজ্য মেলা তো আছেই। এসব আয়োজনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখা যায় নগরবাসীর। মানুষ বলে বসন্তের বাতাসে নাকি অন্যরকম একটা ব্যাপার আছে। বসন্তে প্রকৃতি রূপ পাল্টায়, এর সাথে সাথে রূপ পালটায় মানুষের মন। বসন্ত যেমন সুবাস ছড়ায় বাতাসে তেমনি ছড়ায় ভালোবাসা! পশ্চিমা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে প্রতি বসন্তে ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ আমাদের দেশেও পালিত হচ্ছে ভ্যালেন্টাইনস ডে। এ মাসে উদযাপিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহীদ দিবস ২১শে ফেব্রুয়ারি গুরত্বপূর্ণ হলেও তরুণদের মাঝে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে পশ্চিমা এ দিনটিও।
সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন-এর নামানুসারে এ দিনটিকে ভ্যালেনটাইনস ডে ডাকা হয়। বাংলায় একে ভালোবাসা দিবস বলে। কিন্তু কে এই ব্যক্তি? ক্যাথলিক চার্চ থেকে তিনজন পৃথক সেইন্টের কথা জানা যায় যাদের নাম ভ্যালেন্টাইন বা ভ্যালেন্টিনাস এবং এদের প্রত্যেককেই হত্যা করা হয়েছিল। এর মধ্যে প্রথমজন সম্রাটের আদেশ অমান্য করে রোমান তরুণদের বিয়ে দিত। আরেকজন খ্রিস্টানদের রোমান কারাগারের অত্যাচার থেকে পালাতে সাহায্য করত। আর অন্যজন কারারুদ্ধ অবস্থায় জেলারের অন্ধ মেয়ের প্রেমে পড়ে তাকে চিঠি দিত। ভ্যালেন্টাইন যে-ই হোক না কেন, মানুষের মধ্যে এমন একটি ধারণা কাজ করে যে সে বেশ রোমান্টিক একজন সেইন্ট ছিল।
ভ্যালেন্টাইনস ডে
কোথা থেকে এলো ভ্যালেন্টাইনস ডে? কেনই বা এত ঘটা করে উদযাপন করি আমরা এ দিনটি?
মানুষ বহু আগে থেকেই এর উত্তরগুলো অনুসন্ধান করছে, কিন্তু কোনো নির্ভরযোগ্য কারণ কখনোই পাওয়া যায়নি। একাধিক উপকথা প্রচলিত আছে দিনটিকে কেন্দ্র করে। এ অনুসন্ধানের প্রয়াস হিসেবে ১৮৫৩ সালে নিউ ইর্য়ক টাইমস-এ প্রকাশিত এক অনুসন্ধিত্সু প্রতিবেদনে বলা হয়, “এটি তেমন রহস্যময় ঐতিহাসিক বা প্রত্নতত্ত্বীয়/পৌরাণিক সমস্যাগুলোর একটি যার নিয়তিতে কখনও সমাধান নেই”
এ দিবসটিকে নিয়ে সেই প্রাচীন রোম থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রচলিত আছে বেশ কিছু তত্ত্ব-গল্প-ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু এখানে দেওয়া হলো।
রোমান ব্যাকেনাল
ব্যাকেনাল হচ্ছে রোমান দেবতা ব্যাকাসের উদ্দেশ্যে করা উৎসব। এ উৎসব সাধারণত মদ্যপান করে উদযাপন করা হত। ভ্যালেন্টাইন ডের সবচেয়ে প্রচলিত যে ব্যাখ্যা রয়েছে তা হচ্ছে এটি এক ধরনের ব্যাকেনাল, প্রাচীন লুপাকেলিয়া উৎসব থেকে এসেছে। লুপাকেলিয়া এক ধরনের ফার্টিলিটি রাইট (উর্বরতা সম্পর্কিত ধর্মীয় উৎসব) যেখানে উচ্চ শব্দে উৎসবের পাশাপাশি মদ্যপান করা হত। এ উৎসবে রোমান নারী-পুরুষেরা জুটি তৈরি করত। লুপাকেলিয়া বহু শতাব্দী ধরেই ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিলো। রোম যখন পৌত্তলিকতা থেকে খ্রিস্টান ধর্মের দিকে বেশি ঝুঁকলো, তখন এটিকে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে উদযাপন শুরু। ভ্যালেন্টাইন ডের এই তত্ত্বটি বহু দশক ধরেই নানা পত্র-পত্রিকা ও প্রবন্ধে ছাপা হয়ে আসছে।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডো বুল্ডারের অধ্যাপক নওয়েল লেন্সকি ২০১১ সালে ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও-তে বলেন যে, পোপ প্রথম গ্যালাসিয়াস পঞ্চম শতাব্দীতে এটিকে খ্রিস্টানদের পবিত্র দিন ঘোষণার আগপর্যন্ত এ উৎসবটি লাম্পট্য, ব্যাভিচার ও নগ্নতার জন্য পরিচিত ছিল। তিনি আরো বলেন, “এটি ছিলো মূলত মদ্যপানোত্সব, শুধু খ্রিস্টানরা তাদের পোশাক পুনরায় পরিধান করেছিল। কিন্তু তা এই দিনটিকে উর্বরতা (Fertility) ও ভালোবাসার দিন হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেনি। ”
সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের জীবন সম্পর্কে কিছুটা হলেও বিশ্বাসযোগ্য কিছু তথ্য পাওয়া যায়। ১৯২৩ সালে টাইমস-এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দুজন সেইন্ট ছিলো ‘ভ্যালেন্টাইন’ নামে। এ দুজনকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। দুজনের গল্প এক করে একজন ভ্যালেন্টাইনের নামেই চলছে এ দিনটি। তবে এ দুজনের কারো গল্পের সাথে রোমান্টিসিজমের কোনো সম্পর্কই ছিলো বলে জানা যায় না।
১৯৬৫ সালে দ্য বোস্টন গ্লোব-এ প্রকাশিত এক লোককথা অনুসারে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো সম্রাট ক্লডিয়াসের আদেশ অমান্য করায়। ক্লডিয়াসের আদেশ অনুসারে রোমান সৈনিকদের বিয়ে করা নিষিদ্ধ ছিলো। আর ভ্যালেন্টাইন এ আদেশ অমান্য করে গোপনে তাদের বিয়ে পড়াতেন।
পরবর্তীতে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের শিরচ্ছেদ করা হয়। রোমান পুরুষেরা সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনকে উৎসর্গ করে এক উৎসব পালন করতে শুরু করে। এ উৎসবে রোমান পুরুষেরা আর্ন (পাত্র বিশেষ) এ রাখা তরুণীদের নাম থেকে একটি নাম তুলত এবং যার নাম উঠত তার সাথে সেই বছরটি কাটাত। দ্য গ্লোব-এর এক প্রতিবেদন হতে জানা যায় বহু বছর এ প্রথা চালু ছিলো যা পরবর্তীতে জার্মানি ও ইংল্যান্ডেও প্রচলিত হয়েছিল।
বসন্ত উদযাপন
হতে পারে বসন্ত উদযাপনের একটি অযুহাত ভ্যালেন্টাইনস ডে। উপরের কথাগুলো যদি আপনার কাছে যথেষ্ঠ মনে না হয়, তাহলে আছে আরেকটি তত্ত্ব। ক্যানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জ্যাক বি. অরুচ, কবি জেফরি চোসার এর উপর গবেষণার অংশ হিসেবে ভ্যালেন্টাইনস ডে নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন। গবেষণা থেকে প্রফেসর নিশ্চিত হন যে, চোসারই ভ্যালেন্টাইন নিয়ে প্রচলিত আধুনিক রোমান্টিক ধারণার প্রবর্তক।
১৯৮১ সালে প্রকাশিত প্রফেসর অরুচের অ্যাকাডেমিক আর্টিকেল “St Valentine, Chaucer and Spring in February” -তে তিনি বিতর্ক করেন যে ১৪ শতকে চোসার ‘Parlement of Foules’ এবং ‘The Complaint of Mars’ কবিতা দুটি লেখার আগপর্যন্ত সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনকে কেন্দ্র করে রোমান্টিক ঐতিহ্যসমূহের কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে অনেকে শেক্সপিয়ারকে রাখে এ তালিকায়।
চোসার সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনকে কেন রোমান্টিক করে উপস্থাপন করেছিলেন, হয়তো একটা উপযুক্ত কারণ ছিলো। ১৪ ফেব্রুয়ারি তার সেইন্ট ডে (পৃথক কোনো সেইন্টকে যেদিন স্মরণ করা হয়) করে পালন করা হত। আর ১৪ শতকে ব্রিটনরা (ব্রিটেনের কেলটিক অধিবাসী) ভাবত একই দিনে পাখিদের মিলন ও ফুল ফোটার মধ্য দিয়ে বসন্তের আগমন ঘটত।
চোসারের ব্যাখার সাথে এ ব্যাপারে যুক্ত হয়েছিল আরেকটি কারণ তা হচ্ছে, ইউরোপীয়দের মনে হয়েছিল ‘ভ্যালেন্টাইন’ নামটি বেশি ভালো শোনায়। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে যে সকল সেইন্ট ডে পালন করা হত সেগুলো নামের কাব্যিক আবেদন কম ছিল, যেমন- সেইন্ট স্কলাসটিকা, সেইন্ট অস্ট্রাবার্থা, সেইন্ট ইউলেলিয়া ইত্যাদি।
যদিও প্রফেসর অরুচের তত্ত্বটি ছিল দুটি তত্ত্বের সমন্বয়ে, তিনি জানতেন রোমান্টিক রোমানদের প্রচলিত গল্পের কাছে তার তত্ত্ব টিকবে না। ২০১১ সালে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, “এটি (তার অ্যাকাডেমিক আর্টিকেল) কোনো পার্থক্যই তৈরি করেনি। প্রতি বছর ভ্যালেন্টাইনস ডে-কে নিয়ে যেসব লেখা প্রকাশিত হয় তাতে একই মিথগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটে”।
আমাদের দেশে ভ্যালেন্টাইনস ডে
বাংলাদেশে ভ্যালেন্টাইনস ডে-র প্রথা শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে। সাংবাদিক শফিক রেহমান এ দিবসটি প্রথম উদযাপন করেন। লন্ডনে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত থাকার সুবাদে পাশ্চাত্যের প্রথাগুলোর সাথে ছিল তার বেশ ভাল পরিচয়। সেখানে তিনি ভ্যালেন্টাইনস ডে উদযাপন দেখেন এবং দেশে ফিরে ১৯৯৩ সালে তিনি এ দিবসটি পালন করেন। লন্ডনে দিবসটি ‘সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে’ নামে প্রচলিত থাকলেও আমাদের দেশে আনা হলে ধর্মীয় কারণে ‘সেইন্ট’ বাদ দিয়ে শুধু ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ রাখা হয়।
ভালবাসা দিবস হিসেবে এর প্রচার শুরু হয় যায়যায়দিন পত্রিকার মাধ্যমে। এমনকি সেসময় যায়যায়দিন পত্রিকার সম্পাদক শফিক রেহমান তেজগাঁয়ে পত্রিকা অফিসের সামনের রাস্তাটির নামকরণ করেন ‘লাভ লেন’ হিসেবে। বিদেশি এ প্রথাকে যে সকলে সানন্দে গ্রহণ করেছিল তা নয়, অনেকে বিরোধিতাও করেছিল। অনেকের কাছে ভিনদেশি এ প্রথার অনুপ্রবেশ দেশি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জন্য হুমকি মনে হয়েছিল। তবে তরণ-তরুণীদের মাঝে এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এখন এটি আমাদের দেশে বৃহৎ পরিসরে উদযাপন করা হয় নানা ধরনের আয়োজনের মধ্য দিয়ে।
চলবে…
ফিটার ইমেজ- First Love (Graffiti) by ABOVE