মানুষের শখের কোনো শেষ নেই। বাগান করা থেকে শুরু করে দামি দামি চকলেটের র্যাপার সংগ্রহ- এমন কোনো অদ্ভুত শখ নেই যা মানুষ খুব যত্নে লালন করে না। তবে পোষাপ্রাণীর প্রতি মানুষের রয়েছে আদিম দুর্বলতা। আর সেটা যদি ঘরের সৌন্দর্য বাড়ায় তাহলে তো পোয়াবারো। বহুকাল ধরে ঘরের ভেতর কাঁঁচের বাক্সে মাছ পালার ব্যাপারটা জনপ্রিয় হয়ে আসছে। কত রকমের মাছই না মানুষ রাখে এই বাক্স বা অ্যাকুরিয়ামে। কিন্তু জলচর একটি জ্যান্ত প্রাণীকে যে ঘরের ভেতর পালা যায়, এই ধারণাটা মানুষ কীভাবে পেল? কবে থেকেই বা তারা এভাবে মাছ পালতে শিখলো?
অতীতের কথা
পৃথিবীর সর্বপ্রথম অ্যাকুয়ারিস্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয় সুমেরিয়ানদের, যারা প্রায় ৪,৫০০ বছর আগে শখের বশে মাছ পালা শুরু করেছিল। এই তালিকায় অ্যাসিরিয় আর মিশরীয়রাও রয়েছে, এমনকি জাপানেও বহু আগেই মাছ পালন শুরু হয়েছিল। তবে তারা ঠিক কীভাবে কাজটি করতেন তা এখনও জানা যায়নি। এছাড়া রোমান সাম্রাজ্যে রাজা-রাজড়ারা অতিথিদের ঘরে দামি মার্বেল পাথরে তৈরি বড় পাত্রে সাগরের বার্বেল মাছ (এক জাতীয় কার্প) রাখতেন, তাতে ঘরের সৌন্দর্য বেড়ে যেতো বহু গুণে।
চীনাদের প্রকৃতিপ্রেমের কথা কে না জানে? কাজেই এমন একটি মজার শখের সাথে চীনাদের নাম আসবে, এমনটা অবধারিত। সেই ১,৩০০ সালের দিকে চীনের সম্রাট হংউ পোর্সেলিনের পাত্রে গোল্ডফিশ রেখে ঘর সাজানোর শখে মশগুল ছিলেন। এমনকি এজন্য একটি পোর্সেলিন কোম্পানি খোলার অনুমোদনও তিনি দিয়েছিলেন। এছাড়া প্রাচীন ইরাকে ঘরের ভেতর মাছ পালার প্রচলন ছিল। তবে ইতিহাস বলে, সর্বপ্রথম সুমেরিয়রাই কৃত্রিম পুকুর বানিয়ে তাতে মাছ পালার প্রচলন শুরু করেন। সেসময় কৃত্রিম উপায়ে মাছ পালাটা অবশ্য অভিজাত শ্রেণীর মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল।
প্রথম কাঁচের অ্যাকুরিয়াম
১৮০০ শতকের দিকে কাঁচের তৈরি আবদ্ধ পাত্রে সামুদ্রিক জীব সংরক্ষণ করার ধারণাটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। শুরু করেন ডক্টর ন্যাথানিয়েল ব্যাগশ’ ওয়ার্ড, তার অবদানের কারণে এ ধরনের কাঁচের পাত্রগুলোকে বলা হয়ে থাকে ওয়ার্ডিয়ান ট্যাঙ্ক। তিনি এ ধরনের ট্যাঙ্কে গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের বিভিন্ন সামুদ্রিক জীব রাখার প্রস্তাবনা করেন, ১৮৪১ সালে সেরকম একটি মডেলও বানিয়ে দেখান তিনি। সেখানে অবশ্য তিনি সামুদ্রিক শৈবাল আর খেলনা কিছু মাছ ব্যবহার করেছিলেন। তবে খুব তাড়াতাড়িই তিনি সেখানে সত্যিকারের প্রাণী রেখে পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। ওয়ার্ডিয়ান কেসকে ফার্নের আবাস হিসেবে তৈরি করা যায় কি না সেটা নিয়ে বিস্তর পরীক্ষা করেছিলেন তিনি।
ওয়ার্ডিয়ান কেসগুলো ধীরে ধীরে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। বিশেষত প্রাণী এবং উদ্ভিদবিদরা তো যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। গবেষণার জন্য কাঁচের পাত্রের ছোট্ট পরিসরে জীবজন্তু নিয়ে গবেষণা করার চেয়ে সুবিধাজনক আর কী হতে পারে? আর সেজন্যই সেই আমলের সব উদ্ভিদবিদের সংগ্রহশালায় একটি ওয়ার্ডিয়ান পাত্র একেবারে অবধারিত একটি ব্যাপার। তাছাড়াও ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে বিভিন্ন ছোট চারা আর ফার্ন আনা নেওয়া করার কাজেও এই কেসের ব্যবহার বেড়ে চলল বিস্তর।
তবে সর্বপ্রথম সামুদ্রিক অ্যাকুরিয়াম তৈরির কৃতিত্ব কাউকে দিতে হলে তা বোধহয় যাবে অ্যানা থাইনের ঝুলিতে। তিনি প্রায় তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে কাঁচের পাত্রের ভেতর সাগরের লোনা পানিতে পাথুরে প্রবাল আর সামুদ্রিক শৈবাল টিকিয়ে রেখেছিলেন, সম্পূর্ণ ভারসাম্য বজায় রেখে! প্রায় একই সময়ে রবার্ট ওয়ারিংটন ১৩ গ্যালনের একটি পাত্রের ভেতর গোল্ডফিশ, শামুকসহ আরও কিছু প্রাণী রেখে অনেকদিন যাবত তা নিরীক্ষা করেন। পরে ১৮৫০ সালে কেমিক্যাল সোসাইটি জার্নালে তার প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তগুলো তিনি প্রকাশ করেন।
অ্যাকুরিয়াম শব্দের উৎপত্তি
১৮৫১ সালের দিকে যুক্তরাজ্যে অ্যাকুরিয়ামের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ সময় যুক্তরাজ্যের গ্রেট এক্সিবিশনের কাস্ট আয়রনের ফ্রেমে তৈরি সুসজ্জিত আর রঙিন একটি কাঁচের পাত্র প্রদর্শনীর জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছিল। ফলে সেখান থেকে অনেকেই অ্যাকুরিয়ামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তবে তখন কিন্তু একে অ্যাকুরিয়াম বলা হতো না। এই নামটির প্রচলনের জন্যে বাহবা পাবেন ফিলিপ হেনরি গসে। তিনি সর্বপ্রথম মাছ আর গাছভর্তি কাঁচপাত্রের নাম দেন ‘অ্যাকুয়াটিক ভিভ্যারিয়াম’, যা পরবর্তীতে সংক্ষিপ্ত হয়ে অ্যাকুরিয়ামে পরিণত হয়। এর দুই বছর পর জনগণের উৎসাহ দেখে লন্ডন চিড়িয়াখানা একটি ‘ফিশ হাউজ’ বা মাছের ঘর তৈরি করে তা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে।
অ্যাকুরিয়াম শব্দের জনক হেনরি গসে কাঁচের ঘরে মাছ রাখা নিয়ে একটি বইও লিখেছিলেন, যার নাম- ‘The aquarium‘। বইটিতে তিনি বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন, কী কী উপায়ে ঘরের ভেতর মাছ রাখা যায়। কোন মাছের সঙ্গে কোন গাছ, অথবা কোন দুটি মাছকে একসাথে রাখা যাবে, কেমন খাবার দিতে হবে, প্রতি গ্যালন পানির জন্য কয় জোড়া মাছ রাখা যাবে ইত্যাদি বিষয়ে তিনি ছবিসহ সুন্দর ব্যাখ্যা করেছেন বইতে। এছাড়া ১৮৫৩ সালে ফিশ হাউজ দেখবার পর লোকে এমনিতেই নিজেদের চেষ্টায় আর উদ্যোগে নতুন নতুন অ্যাকুরিয়াম তৈরি করতে শুরু করে।
ধীরে ধীরে হেনরি গসে এবং রবার্ট ওয়ারিংটন একই সময়ে অ্যাকুরিয়াম নিয়ে আরও গবেষণা করে একে উন্নত করতে চেষ্টা করেন। যুক্তরাজ্যে তখন অ্যাকুরিয়াম নিয়ে লোকে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। অ্যাকুরিয়ামে একবার মাছ রাখলে কিছুদিন পর পর পানি ময়লা হয়ে যেতো। এতে মাছ মারা যেতো। কয়েকদিন পর পর পানি পরিষ্কার করাটা একটু ঝামেলাই ছিল বটে। এ সময় এডওয়ার্ড এডওয়ার্ডস নামক এক প্রাণিবিদ ভদ্রলোক চমৎকার একটি বুদ্ধি নিয়ে এলেন। তিনি এমন একটি অ্যাকুরিয়াম দাঁড় করালেন যাতে পানি নিজে নিজে ছেঁকে পরিষ্কার হয়ে নিচের দিকে একটা পাত্রে জমা হয়। এতে মাছ পালনের ঝামেলা বেশ অনেকখানিই কমে গেল।
যুক্তরাজ্যের ভিক্টোরিয়ান যুগে অ্যাকুরিয়ামের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে যায়। তখনকার বেশিরভাগ অ্যাকুরিয়ামের গঠন মোটামুটি একই রকম ছিল, চারদিকে কাঠের ফ্রেম আর সামনে কাঁচ। অবশ্য পানি থেকে বাঁচাতে কাঠের ওপর দিয়ে নেয়া হতো পিচের প্রলেপ। এছাড়া কাস্ট আয়রনের ব্যবহারও ছিল বেশ জনপ্রিয়। অ্যাকুরিয়ামের তলদেশ তৈরি হতো স্লেটের সাহায্যে, আর নিচে থেকে তাপ প্রদান করা হতো অনবরত। পরবর্তীতে অ্যাকুরিয়ামের অনেক রকম ডিজাইন অবশ্য চলে আসে। দেয়ালে ঝোলানো অ্যাকুরিয়াম, জানালার মতন ফ্রেম করে দেয়ালে লাগানো অ্যাকুরিয়াম, এমনকি পাখির খাঁচার সাথে একসাথে সমন্বয় করেও তৈরি করা হতো অনেক অ্যাকুরিয়াম। উনিশ শতকের শেষভাগে এ সমস্ত ডিজাইন বেশ জনপ্রিয়তা পায়।
আধুনিকতার ছোঁয়া
১৯০৮ সালের দিকে অ্যাকুরিয়ামে ব্যবহারযোগ্য এয়ার পাম্প আবিষ্কৃত হয়, যেটা ছিল সম্পূর্ণ যান্ত্রিক। অর্থাৎ এটা চালাতে বিদ্যুতের প্রয়োজন হতো না, পানির বেগ ব্যবহার করেই এটা চালানো হতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে যায়, তখন সবাই বিদ্যুতচালিত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সংযুক্ত করে অ্যাকুরিয়ামকে করে তোলে আরও আকর্ষণীয়। পানি ফিল্টার করা, বাতাস পাম্প করা ছাড়াও পানির তাপমাত্রা মাছের জন্য ঠিকঠাক রাখতে হিটারও ব্যবহার করা শুরু করলেন অ্যাকুয়ারিস্টরা। সেসময় তারা নিজেদের এলাকার জলাশয়ের বিভিন্ন মাছ ছাড়াও বহিরাগত অঞ্চলের চমকপ্রদ মাছও বিশেষ যত্ন নিয়ে অ্যাকুরিয়ামে রাখতে লাগলেন।
সব মিলিয়ে অ্যাকুরিয়ামে মাছ পেলেপুষে বড় করার ব্যাপারটি দিনকে দিন আরও জমজমাট হয়ে উঠতে লাগল। এক দেশ থেকে অন্য দেশে শক্ত প্লাস্টিকের ব্যাগে মাছ আমদানি রপ্তানি শুরু হলো, সাথে অ্যাকুরিয়ামের অন্যান্য সরঞ্জাম। ছোট ছোট বাইসাইকেল ফুট পাম্প লাগিয়ে বিভিন্ন ট্রপিক্যাল অঞ্চলের মাছ পৌঁছে যেতো দূর দেশে। কিন্তু একটি সমস্যা রয়েই গেল, লোহার ফ্রেম থেকে মরচে ধরে অ্যাকুরিয়াম নষ্ট হয়ে যেতে থাকলো। এই সমস্যার সমাধান নিয়ে এলেন মার্টিন হরোউইটজ। লস অ্যাঞ্জেলেসের এই বাসিন্দা সিলিকনের আঠা দিয়ে সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ কাঁচের তৈরি মেরিন অ্যাকুরিয়াম তৈরি করলেন, যা ছিল মরিচামুক্ত। তবে লোহার ফ্রেমের প্রচলন আরও কিছুদিন ছিল, যা কেবল সৌন্দর্য বর্ধনের জন্যই।
এবার আসা যাক লন্ডন চিড়িয়াখানার সেই ফিশ হাউজের প্রসঙ্গে। ১৮৫৩ সালের সেই ছোট প্রদর্শনীতে দর্শকের মন ভরছিল না, দিন দিন তাদের চাহিদা বেড়েই চলেছিল। লন্ডন চিড়িয়াখানায় এখন যে বিশাল আকারের অ্যাকুরিয়ামটি দেখা যায়, সেটি কিন্তু তখনকার ফিশ হাউজ নয়। ১৯২১ সালে জায়গা বদল করে ‘ম্যাপিন টেরেস’ এর নিচে বিশাল ফিশ হাউজটি নিয়ে আসা হয়। ১৯২৪ সালে রাজা পঞ্চম জর্জ ও তার স্ত্রী রানী মেরি এটি উদ্বোধন করেন।
পৃথিবীর বৃহত্তম কয়েকটি গণ অ্যাকুরিয়াম
লোকের শখের অ্যাকুরিয়ামের কথা তো অনেক হলো। কিন্তু তাদের মাছ দেখার এই খায়েশ মেটাতে পৃথিবীতে কত যে সুন্দর বিশাল আকারের অ্যাকুরিয়াম রয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এর মাঝে আবার কয়েকটি কি না আন্ডার ওয়াটার, অর্থাৎ সাগরতলের ভেতর চাইলেই যে কেউ হেঁটে বেড়াতে পারবে আর মাছ দেখতে পারবে। এমনকি দামি সব হোটেলে অ্যাকুরিয়ামের ভেতরে থাকার জন্য রুম দেওয়া হয়, অনেক পয়সা খরচ করে সেখানে মানুষ সময় কাটাতে যায়।
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কয়েকটি গণ অ্যাকুরিয়াম, যেগুলো সাধারণ জনগণ টিকিট কেটে দেখতে পারে সেগুলো হলো দুবাই মল অ্যাকুরিয়াম (দুবাই), মন্টেরি বে অ্যাকুরিয়াম (ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র), ইউশাকা ম্যারিন ওয়ার্ল্ড (দক্ষিণ আফ্রিকা), শাংহাই ওশান অ্যাকুরিয়াম (চীন), অ্যাকুরিয়াম অফ জেনোয়া (ইতালি) ইত্যাদি। তবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অ্যাকুরিয়াম হলো জর্জিয়া অ্যাকুরিয়াম। আটলান্টার এই অ্যাকুরিয়ামটি সব মিলিয়ে ৬.৩ মিলিয়ন গ্যালনের! ১ লক্ষেরও বেশি সামুদ্রিক প্রাণীর আবাসস্থল এই অ্যাকুরিয়াম।
১৯৯৬ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী, ডাকটিকেট সংগ্রহের পর ‘ফিশ কিপিং’ বা অ্যাকুরিয়ামে মাছ পালা যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম জনপ্রিয় শখের মধ্যে পড়ে। এমনকি সারা বিশ্বে বর্তমানে অ্যাকুরিয়ামে মাছ রেখে অন্দরমহল সাজানো নিয়ে অনেকের স্পৃহা কাজ করে। এছাড়া মাছের ব্রিডিং, ছোট ছোট মাছকে যত্ন করে বড় করে তোলা ইত্যাদি মানুষকে দৈনিক মানসিক অবসাদ দূর করতে সহায়তাও করে। তাই অ্যাকুয়ারিস্টদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।