Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

চীনের ভুলে যাওয়া সৈন্যরা

সান ইয়াত সেন যখন স্বাধীন চীন গড়ার পরিকল্পনা আঁটছিলেন, তখন ঘুণাক্ষরেও তিনি ভাবেননি যে, একদিন নানা দল নিয়ে গড়া বিপ্লবী জোট দুই ভাগে ভাগ হয়ে রক্তক্ষয়ী এক গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। কিন্তু নিয়তির বিধান কে খণ্ডাবে? চীনের কপালে যে জাপানের অত্যাচার আর নিজস্ব আধা-সামন্তদের শোষণের বাইরেও বহু দুর্ভোগ লেখা ছিলো! ১৯২৫ সালে সান ইয়াত সেনের মৃত্যু হলে চীনে বেঁধে যায় ভীষণ এক গৃহযুদ্ধ। এক দিকে পশ্চিমা সমর্থিত জেনারেল চিয়াং কাই শেক এর কুয়োমিনতাং বাহিনী, আর আরেকদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত লাল ফৌজ। ১৯৪৯ সালে যুদ্ধ শেষ হল। লড়াইয়ে হেরে চিয়াং কাই শেক পালালেন তাইওয়ানে। সেখানেই এক নতুন সরকার গড়ে পুনরায় চীন দখলের হুংকার ছাড়তে লাগলেন তিনি। কিন্তু সবই ছিল আসলে ফাঁকা বুলি। বাস্তবে তিনি পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে আদায় করছিলেন কাড়ি কাড়ি অর্থ, চীনের বিরুদ্ধে তাইওয়ানে শেষ ঘাঁটিটি টিকিয়ে রাখতে পশ্চিমা বিশ্বের চেষ্টার কোনো কমতি ছিলো না অবশ্য। কিন্তু তারপরও চিয়াং কাই শেকের ঘন ঘন টাকার ধর্ণায় বিরক্ত হয়ে এক সময় তার নামই দিয়ে দেওয়া হয় ‘জেনারেল ক্যাশ (চিয়াং) মাই (কাই) চেক (শেক)’।

জেনারেল চিয়াং কাই শেক; source: qz.com

পাহাড়ে অজানা সৈন্য

এ তো গেল কুয়োমিনতাং দলের মূল নেতার কথা। জেনারেল বহাল তবিয়তে বহুদিন তাইওয়ান শাসন করেছিলেন। চীন ফেরত নেওয়া তার পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। জেনারেল চিয়াং কিন্তু তার গোটা বাহিনীটাকে নিয়ে পালাতে পারেননি। দক্ষিণের ইউনান প্রদেশে মোতায়েন থাকা ৯৩ নং ডিভিশনের ৩য় আর ৫ম রেজিমেন্টের সেনারা রাতারাতি উধাও হয়ে গিয়েছিল। কী হয়েছিল তাদের ভাগ্যে?

পঞ্চাশের দশকে মায়ানমারের উত্তরের পার্বত্য জঙ্গলে দেখা গেল অজানা একদল সৈন্যকে। যুদ্ধে পাকা, দক্ষ আর নৃশংস এই সেনারা যেন ভোজবাজির মত উদয় হয়ে ঘাঁটি গেড়ে বসলো সেই দুর্গম অঞ্চলে। রেঙ্গুনের হর্তাকর্তারা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। দুই দুই বার তাদেরকে তাড়ানোর জন্য পাঠানো সেনাবাহিনী ভয়ানক মার খেয়ে ফিরে এলো। চিয়াং কাই শেকের মতো তাইওয়ানে বসে নিজের ঘর গোছানো নয়, এই সেনাদলের মূল উদ্দেশ্য ছিল, যেভাবেই হোক চীন পুনরুদ্ধার করা। আজকে এই ভুলে যাওয়া হতভাগ্য অথচ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সৈন্যদলের কাহিনীই বলা হবে।

যখন চীনা লাল ফৌজ ১৯৫০ এর জানুয়ারিতে ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং দখল করে নিল, কুয়োমিনতাং বাহিনীর ৯৩ নং ডিভিশনের ৩য় রেজিমেন্টের সেনাপ্রধান জেনারেল লে ওয়েন হুয়ান আর ৫ম রেজিমেন্টের সেনাপ্রধান জেনারেল তুয়ান শি ওয়েন তাদের বাহিনী নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে মায়ানমারে পালিয়ে যান। এরপর বহু মাইল পাড়ি দিয়ে দুর্গম শান প্রদেশে ঘাঁটি গাঁড়েন তারা। মায়ানমারের সেনাদল এই উটকো সৈন্যদের খবর পেয়ে তাদেরকে তাড়ানোর চেষ্টার কোনো কসুর করেনি। কিন্তু পাকা যোদ্ধা এই সেনারা ঠিকই বারে বারে তাদেরকে পরাস্ত করতে থাকে।

জেনারেল তুয়ান; source: RideAisa.com

ওদিকে বাকি বিশ্ব কিন্তু থেমে ছিল না। ১৯৫০ এ বেঁধে গেল কোরিয়া যুদ্ধ। চেয়ারম্যান মাও উত্তর কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধে নামলেন। তাই দেখে মার্কিন নেতৃত্ব আটলো এক কূটবুদ্ধি। সিআইএ খুঁজে বের করলো এই দুই জেনারেলকে। তাদেরকে দিলো প্রচুর টাকা আর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র; শর্ত? চীন পুনর্দখল করতে হবে। জেনারেল তুয়ান শি আর লে হুয়ান তো এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। সাথে সাথে তারা নেমে পড়লেন চীন পুনর্দখলের অভিযানে। ১৯৫০ থেকে ১৯৫২, এই সময়টাতে অন্তত সাত সাতবার এই দুই জেনারেল চীন আক্রমণ করেন। কিন্তু প্রত্যেকবারই মার খেয়ে পিছু হটতে হয় তাদের। ১৯৫৩ সালে কোরিয়া যুদ্ধ থামলে এটা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায় যে, চীন দখল করা আর তাদের হয়ে উঠবে না। মার্কিন ডলারের প্রবাহও কমে যেতে থাকে। ওদিকে মায়ানমার আর্মির বারংবার আক্রমণ তো আছেই। বিপাকে পড়লেন আটকে পড়া সেনারা। এভাবেই চললো ১৯৬১ সাল পর্যন্ত।

থাইল্যান্ড, কম্যুনিস্ট গেরিলা, আফিম

১৯৬১ সালে থাই সরকার এই সৈন্যদের সাথে এক চুক্তিতে আসলো। সে আমলে থাইল্যান্ডের উত্তরের পার্বত্য জঙ্গলগুলিতে থাইল্যান্ডের কম্যুনিস্ট পার্টির গেরিলারা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। থাই সরকার কিছুতেই তাদের সাথে পেরে উঠছিলো না। চুক্তিমত চিয়াং রাই প্রদেশের মায়ে সালং গ্রামে ঘাঁটি গাড়লো জেনারেল তুয়ানের সৈন্যরা। আর জেনারেল হুয়ানের সৈন্যরা ঘাঁটি করলো চিয়াং মাই প্রদেশের থাম এনগোবে-তে। শর্ত ছিল, থাই গেরিলাদের সাথে লড়তে হবে, বিনিময়ে থাই সরকার এই চীনা সৈন্যদেরকে থাইল্যান্ডে বসবাস করার অনুমতি দেবে।

আবার যুদ্ধ। এবারে থাই গেরিলাদের সাথে। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫, হাজার হাজার মানুষের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো থাইল্যান্ডের দুর্গম জঙ্গলে। খুচরো লড়াই চললো ১৯৮২ সাল নাগাদ, ততোদিনে চীনা সেনাদের বয়স হয়েছে, কম্যুনিস্ট গেরিলারাও হতোদ্যম। চুক্তিমত থাই সেনারা ঐ সব অঞ্চলে চীনা সৈন্যদেরকে থাকার অনুমতি দিলো, নাগরিকত্বও পেল তারা।

তবে এরই মধ্যে কিন্তু চুপিচুপি আরেক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। মার্কিন বা থাই সাহায্য ছিল অপ্রতুল। এদিকে যুদ্ধ চালাতে করতে হচ্ছিল অনেক খরচ। সেনাদের অনেকেই তখনো স্বপ্ন দেখে, চীনে ফিরে যাবে। কাজেই টাকা দরকার, অনেক টাকা। কোত্থেকে পাওয়া যায়? এগিলে এলো খুন সা নামের এক যুদ্ধবাজ নেতা। মায়ানমারের সান প্রদেশের এই ভুইফোঁড় কর্তাটি নিজেকে সান প্রদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত করেছিলো সত্তরের দশক থেকে। গড়ে তুলেছিলো নিজের এক সেনাবাহিনী। কীভাবে? আফিম। দুর্গম পাহাড়ে সরকারের নাগাল পৌছায় না। আফিম চাষ করে সেখানে তাই টাকা মেলে প্রচুর। অস্ত্রশস্ত্র কেনা তো যায়ই, সেই সাথে আরাম আয়েশেরও অভাব নেই।

খুন সার মদদে চলতো রমরমা আফিম ব্যবসা; source: Adrian Cowell

খুন সার পাল্লায় পড়ে সেই চীনা সেনারাও আফিম চাষে মেতে ওঠে। গড়ে ওঠে মায়ানমার, লাওস আর থাইল্যান্ড জুড়ে বিস্তৃত কুখ্যাত ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল’ এর মূল অংশটি। জেনারেল তুয়ান তো ১৯৬৭ সালে এক ব্রিটিশ সাংবাদিকের কাছে স্বীকারও করেছিলেন, এই পাহাড়ে যুদ্ধ চালাতে যে টাকার দরকার, সেটা আফিম চাষ না করে যোগাড় করার কোনো উপায় নেই। কাজেই আফিম চাষ তারা করবেনই।

থাই কর্তারা দেখলেন, এ তো মহা বিপদ। চীনা সৈন্যরা কম্যুনিস্ট গেরিলাদের ঠেকিয়ে দিচ্ছে, তাই তাদের অভিজ্ঞতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে আফিম খেয়ে গোটা জাতটা উচ্ছন্নে যেতে বসেছে। কাজেই ঠিক করা হলো, আগে খুন সাকে শায়েস্তা করতে হবে। আবার যুদ্ধ। সত্তরের গোটা দশকটা জুড়ে থাইল্যান্ড আর মায়ানমারের এই অঞ্চলটাতে খুন সার সৈন্যরা, কম্যুনিস্ট গেরিলারা, থাই আর মায়ানমারের সেনাবাহিনী আর চীনা কুয়োমিনতাংয়ের যোদ্ধারা এক জটিল যুদ্ধে মেতে উঠলো। অবশেষে ১৯৮০ সালের দিকে খুন সাকে মায়ানমারে তাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। আফিম চাষ বন্ধ হল না বটে, তবে মায়ে সালং অঞ্চলের চীনা সৈন্যরা আফিম চাষ থেকে বেরিয়ে এলো।

বর্তমান

আজকের সান্তিখিরি, এক শান্ত জনপদ; source: Takeaway

১৯৯৪ এর পর থেকে মায়ে সালং অঞ্চলের রক্তাক্ত ইতিহাস পাল্টে যেতে থাকে। থাই সরকার প্রচুর বিনিয়োগ করে সেখানে। গড়ে ওঠে রাস্তাঘাট, হোটেল আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এলাকাটার নাম পাল্টে রেখে দেওয়া হয় সান্তিখিরি, যার অর্থ শান্তির পাহাড়। চীনা সৈন্যরা অনেকেই দেশ থেকে আসা চীনা মেয়েদের বিয়ে করে সংসার শুরু করে। অনেকে আবার স্থানীয় থাই মেয়েদের বিয়ে করে সমাজে মিশে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। জেনারেল লু ইয়ে তিয়েন ছিলেন এই বৃদ্ধ সৈন্যদের শেষ নেতা। চীন ছেড়েছেন তিনি বহুদিন হলো। এখন কেবল থাই পাহাড়ে ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি, চাষবাস আর ব্যবসা নিয়ে মেতে আছেন এক সময়ের দুর্ধর্ষ এই যোদ্ধারা।

জনৈক সাবেক কুয়োমিনতাং যোদ্ধা; source: New York times

কিন্তু তাই বলে কি তারা বা তাদের বংশধরেরা নিজেদের অতীত শেকড়কে ভুলে গিয়েছেন? না। এখনো সান্তিখিরির রাস্তায় কান পাতলে শোনা যাবে চীনা ভাষার কথোপকথন। বাসার বারান্দায় ঝোলে ঐতিহ্যবাহী চীনা লণ্ঠন, এমনকি বাড়িগুলি বানানোও হয় চীনা ধাঁচে। বৃদ্ধ যেসব চীনা সৈন্যরা বেচেঁ আছেন তারা তো বটেই, তাদের বংশধরেরাও অনেকে এখনো নিজেদের চীনা বলে পরিচয় দেন। ফিরে যেতে চান ফেলে আসা দেশটিতে। কিন্তু চীন বা তাইওয়ান, কেউ তাদের কথা মনে রাখেনি। তাই থাইল্যান্ডের পাহাড়ে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কোনো গতি নেই এসব বিস্মৃত চীনা সৈন্যদের।

ফিচার ইমেজ- Getty Images

Related Articles