Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নীলনদ তীরের জনপ্রিয় রানী নেফারতিতির অন্তর্ধান রহস্য

মিশরীয় পুরাণ বা সভ্যতা সম্পর্কে যাদের আগ্রহ আছে, তাদের কাছে বেশ পরিচিত একটি নাম নেফারতিতি। নেফারনেফারুয়াতেন নেফারতিতি সবার কাছে মিশরের রানী এবং ফারাও আখেনাতেনের রাজকীয় বধূ হিসেবেই সুপরিচিত।

নেফারতিতি ও তার স্বামী ধর্মীয় এক বিপ্লবের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তৎকালীন মিশরীয়দের ন্যায় একাধিক দেব-দেবীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের পরিবর্তে তারা একক দেবতা ‘আতেন’ বা ‘সূর্য চাকতি’র (সান ডিস্ক) পূজা করতেন। স্বামীর সঙ্গে তিনি প্রাচীন মিশরীয় ইতিহাসের সবচেয়ে বিত্তশালী সময়ে রাজত্ব করতেন বলে জানা যায়। ঐতিহাসিকদের একদলের মতে, স্বামীর মৃত্যুর পরে তিনি নেফারনেফারুয়াতেন নামে রাজত্ব করেছিলেন। তার পরবর্তী রাজাই তুতানখামুন ছিল কিনা, তা নিয়েও যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। মিশরের নারী ফারাও নেফারতিতির সাম্রাজ্য আমার্না শহরের পতন ঘটিয়ে বিস্তৃতি লাভ করে ঐতিহ্যবাহী শহর থেবসে। চলুন তবে জেনে নেওয়া যাক রহস্যময়ী রানী নেফারতিতি সম্পর্কে।

বহু উপাধিতে ভূষিত করা হয় নেফারতিতিকে। উর্বরতার রানী, প্রশংসনীয় এবং মহান সৌন্দর্যের দেবী, প্রেমময়, দুই হাতের অধিকারী দেবী, প্রধান রাজার প্রিয়তমা স্ত্রী, মিশরের ঊর্ধ্ব ও নিম্নভূমির রক্ষাকর্ত্রী- এমন আরও অসংখ্য নাম রয়েছে তার। তার একটি আবক্ষ মূর্তি তাকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে। বার্লিনের ন্যুয়েস জাদুঘরে সংরক্ষিত মূর্তিটি প্রাচীন মিশরের আসল একটি ভাস্কর্যের প্রতিলিপি। প্রকৃত ভাস্কর্যের ভাস্কর ছিলেন মিশরের অধিবাসী থুতমোস, ১৯১২ সালে তার কারখানায় খুঁজে পাওয়া যায় নেফারতিতির মূর্তিটির অস্তিত্ব। প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য বাদেও মিশরীয়দের ভাস্কর্যে মুখের প্রভাব বোঝাতে এখনো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ানো হয় এই মূর্তিটির কথা।

নেফারতিতির আবক্ষ মূর্তি; Source: ancient-origins.net

নেফারতিতির জন্ম হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৩৭০ অব্দে। তার নামের অর্থ ‘সবচেয়ে সুন্দর মানুষটি ধরণীতে এসে গেছে’। প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে জনপ্রিয় রানী তিনি। থেবসের এক রাজপ্রাসাদে বড় হওয়া এই রানীর পিতা ছিলেন ফারাও তৃতীয় আমেনহোতেপের উজির, অ্যাই। মাত্র এগারো বছর বয়সেই চতুর্থ আমেনহোতেপের সাথে প্রণয়ের সম্পর্কে লিপ্ত হন নেফারতিতি। কথিত আছে, আতেনের প্রতি বিশ্বাস তার মধ্য দিয়েই মিশরে প্রবেশ করে। তার পরামর্শেই চতুর্থ আমেনহোতেপ নিজের নাম পরিবর্তন করে আখেনাতেন রাখেন এবং পরবর্তীতে সিংহাসনে আরোহণ করেন। স্বামীর সাথে রাজত্ব করলেও আখেনাতেনের মৃত্যুর পর নেফারতিতির পরিণতি কী হয়, তার কোনো ঐতিহাসিক রেকর্ড নেই।

নেফারতিতি অ্যাইয়ের কন্যা, এই ব্যাপারে কোনো দ্বিমত না থাকলেও তার মায়ের পরিচয় নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তখনকার শিলালিপিগুলোতে তার মায়ের নাম ‘তিয়ে’ লেখা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তিয়ে ছিলেন নেফারতিতির দুধ মা, আসল মা নন। উজির হিসেবে অ্যাই তার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কিশোর চতুর্থ আমেনহোপেনের দেখাশোনাও করতেন। শৈশবেই তার রাজকুমারের সাথে পরিচয় হয় নেফারতিতির। নেফারতিতি ও তার বোন মাদনোদজেম প্রতিদিনই থেবসের (মতান্তরে আর্মানার) সভায় হাজির হতেন।

নেফারতিতি; Source: kingtutone.com

প্রাচীন কিছু ছবি আর শিলালিপি থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, শৈশব থেকে আতেনের অনুরক্ত ছিলেন নেফারতিতি। তবে সমসাময়িক মিশরীয়রা যেখানে একাধিক ঈশ্বরের উপাসনা করতো, সেখানে তিনি একেশ্বরবাদ বা অন্যান্যদের চেয়ে আতেনকে উপরে রাখার শিক্ষা কোথা থেকে পেলেন, তা একটি রহস্যই বটে। সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে, নেফারতিতিরা দুই বোনই আতেনের অনুসারী ছিলেন। তাদের প্ররোচনায় চতুর্থ আমেনহোতেপ এই বিশ্বাসের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ঐতিহাসিক পিটার বি. হেলেন উল্লেখ করেছেন-

“নেফারতিতির জীবন এবং কাজের সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে, যদিও তার আবক্ষ মূর্তিটি বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশিবার কপি হওয়া মূর্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং তার সময়ে মিশর ছিল বিশ্বের অন্যতম সভ্য দেশ, তারপরও নেফারতিতির সম্পর্কে খুব বেশি জানার কোনো সুযোগ নেই।”

পনের বছর বয়সে চতুর্থ আমেনহোতেপের সাথে বিয়ে হয় নেফারতিতির। ফারাও তৃতীয় আমেনহোতেপের মৃত্যুর পর স্বামীর সাথে সিংহাসনে আরোহণ করেন তিনিও। এই ধাপে এসে স্ত্রীর কথামতো মিশরের জাতীয় ধর্মে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন তিনি, এমনটাই দাবী করেন কিছু গবেষক। খুব সম্ভবত ১৩৫৩ থেকে ১৩৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন নেফারতিতি। তাদের রাজত্বের পঞ্চম বর্ষে (কারো কারো মতে নবম), আমেনহোতেপ নিজের নাম বদলে আখেনাতেন রাখেন, মিশরের বহুকাল ধরে চলে আসা ধর্মচর্চার সংস্কৃতি বাতিল করে দেন। বাকিদের মন্দিরে তালা লাগিয়ে আতেনকে এক ও অদ্বিতীয় দেবতা হিসেবে ঘোষণা দেন তিনি।

এই সিদ্ধান্তকে একদিক থেকে দেখলে যেমন সেখানে একেশ্বরবাদ সৃষ্টির প্রথম ধাপ বলে মনে হবে, অপরদিকে দেবতা আমেনের পুরোহিতদের ক্ষমতা হ্রাস করার একটি রাজনৈতিক ইচ্ছা বললেও খুব একটা ভুল বলা হবে না। আমেনহোতেপের অষ্টাদশীয় রাজরক্তের অধিকারী ছিল আখেনাতেন। এই সুদীর্ঘ সময় ধরে দেবতা আমেনের উপাসক হিসেবে তার পুরোহিতরা এতটাই ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিলেন যে, ফারাও আর তাদেরকে সমতুল্য বলেই বিবেচনা করা হতো। তবে মিশরবাসী নতুন ফারাওয়ের নতুন সিদ্ধান্তে খুব একটা নাখোশ হয়নি। তারা বরং সৃষ্টির দেবতা আতেনকে শুধুমাত্র শক্তিশালী হিসেবে না জেনে সমগ্র মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে পেয়ে খুশি হয়েছিল।

শিল্পীর চোখে নেফারতিতি; Source: pixabay.com

আখেনাতেন-নেফারতিতি দম্পতির ছয় মেয়ে- মেরিতাতেন, মেকেতাতেন, আনখেসেনপাতেন, নেফারনেফারুয়াতেন তাশেরিত, নেফারনেফারুর আর সেতেপেনরে। কোনো ছেলে ছিল না তাদের। আখেনাতেনের উপপত্নীদের গর্ভে জন্ম নেয় দুই পুত্র- তুতানখামুন আর স্মেনখকারে। এই ছয় মেয়ের মধ্যে আনখেসেনপাতেন পরবর্তীতে তুতানখামুনকে বিয়ে করে আনখেসেনামুন নাম গ্রহণ করে এবং ফারাওয়ের দায়িত্ব পালন করে। সপরিবারে ফারাওরা বাস করতেন থেবসের রাজপ্রাসাদে।

আখেনাতেনের রাজত্বে অভূতপূর্ব ক্ষমতা উপভোগ করেন নেফারতিতি। তার শাসনামলের দ্বাদশ বর্ষে ফারাওয়ের সমান ক্ষমতা ও মর্যাদা দেওয়া হয় রানীকে। মন্দিরের দেয়ালগুলোতে ফারাওয়ের ছবি যতটা জায়গা জুড়ে থাকতো, ঠিক ততটাই বড় করে থাকতো রানীর ছবি। তার মর্যাদা সাধারণ মানুষকে বোঝানোর জন্যই হয়তো এই ব্যবস্থা করা হয়। আখেনাতেনের শবাধারের দেয়ালের চারপাশে নেফারতিতির ছবি খোদাই করা ছিল। ফারাওয়ের মমি পাহারা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সাধারণত মিশরের চার নারী দেবী: আইসিস, নেফথিস, সেলকেত আর নেইথের ছবি খোদাই করা হতো। নেফারতিতির ছবি এঁকে সেই ধারাও পরিবর্তন করে ফেলেন আখেনাতেন।

শাসনামলের চতুর্দশ বর্ষে, আখেনাতেন ও নেফারতিতির কন্যা মেকেতাতেন মাত্র ১৩ বছর বয়সে মারা যায়। সে সময়ের একটি ছবিতে দেখা যায়, মৃত সন্তানের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে তার বাবা-মা। এই ঘটনার পরপরই ঐতিহাসিক সব রেকর্ড থেকে হারিয়ে যান নেফারতিতি। বীরদর্পে রাজত্ব করতে থাকা এক রানী বেমালুম গায়েব হয়ে গেলেন কীভাবে, তা আজও এক রহস্য। কেউ কেউ বলেন, মিশরে মহামারী আকার ধারণ করা প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, নেফারতিতি হারিয়ে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই মিশরের সিংহাসন ভাগ করে নেওয়ার জন্য অপর এক সঙ্গীর আশ্রয় নেন আখেনাতেন। সেই ব্যক্তির পরিচয় সম্পর্কে তেমন কিছু জানা না গেলেও, নেফারতিতিকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করার উদ্দেশ্যে তাকে গুম করে দিতে পারেন আখেনাতেন- এই সম্ভাবনাটিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

রহস্যের জাল ছড়িয়ে পড়ে আখেনাতেনের সঙ্গীকে কেন্দ্র করে। এক তত্ত্ব মতে, নেফারতিতি নিজেই সবনেফেরু বা হাতশেপসুত নামে ছদ্মবেশ ধারণ করে মিশরের রানী হিসেবে প্রত্যাবর্তন করেন। আরেক তত্ত্ব অনুযায়ী, আখেনাতেনের উপপত্নীর পুত্র স্মেনখকারে সিংহাসনে আরোহণ করে। তার সাথে নেফারনেফারুয়াতেন নামে রাজত্ব করেন নেফারতিতি। কিন্তু নারী হিসেবেই ভিন্ন একটি ছদ্মবেশ ধারণ করার তার কী প্রয়োজন ছিল, তা বোধগম্য নয়।

নেফারতিতির আসল মূর্তিটি; Source: ancient-egypt-online.com

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাচীন মিশর শাখা নিয়ে কাজ করেন জ্যাকোবাস ভ্যান দিজক। তিনি বিশ্বাস করেন, জীবদ্দশায় স্বামীর সাথে সিংহাসন ভাগাভাগি করে নেন নেফারতিতি। পরবর্তীতে তার জায়গা দখল করে নেন তার বড় মেয়ে মেরিতাতেন। মেরিতাতেন আর আখেনাতেনের ঘরে বেশ কয়েকটি সন্তান জন্ম নেয়। সে সময় পিতা-কন্যার বিয়ের বিষয়টি মিশরীয় সমাজে খুব সাধারণ একটি ঘটনা ছিল। আবার কথিত আছে, ফারাও আখেনাতেনের মৃত্যু থেকে পুত্র তুতানখামুন সাবালক হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়টুকুতে পুরুষের ছদ্মবেশ ধারণ করে রাজকার্য পরিচালনা করেন নেফারতিতি। ভিন্ন আরেকটি মতানুযায়ী, আখেনাতেনের মৃত্যুর পর দেবতা আমেন-রার পূজা আবারও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, বঞ্চিত পুরোহিতরা প্রতিশোধ নিতে রানী নেফারতিতিকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন। কোনটি যে সত্য, তা নিয়ে রয়েছে অসংখ্য জল্পনা-কল্পনা। তবে রানী নেফারতিতির সমাধি খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে গুজবগুলো যেন ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়েছে খেয়াল খুশিমতো।

আশার কথা হচ্ছে, ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ নিকোলাস রিভস তুতানখামেনের সমাধিস্থলের ছবি স্ক্যান করিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে একটি ফাঁপা দেয়ালের সন্ধান পান। তার ধারণা, দেয়ালের অপরপাশে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে রানী নেফারতিতি। ১৯২২ সালে তুতানখামুনের সমাধিস্থল আবিষ্কৃত হওয়ার পর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার এটি। যদি রিভসের ধারণা সত্যি প্রমাণিত হয়, তবে হাজার বছরের পুরনো এক রহস্যের সমাধান হতে চলেছে অচিরেই। তাতে করে একদিকে যেমন নেফারতিতি ভক্তদের প্রশ্নের অবসান হবে, ঠিক তেমনি মিশরের অর্থনীতিও চাঙ্গা হয়ে উঠবে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।

ফিচার ইমেজ: biography.com

Related Articles