![](https://assets.roar.media/assets/riVvkuu3ko4bbvLV_images-(1).jpg?w=1200)
প্রথম ফোনটি বেজে উঠলো ১৯৭৬ সালের ১৮ জুন। ঘড়ির কাঁটায় তখন সময় ভোর ৫টা। এত ভোরে হঠাৎ করে সেক্রেমেন্তো পুলিশ ফাঁড়ির টেলিফোনটি কর্কশ শব্দে বেজে ওঠায় কর্তব্যরত অফিসাররা অবাক হয়ে গেলো। ভোরের আলো তখনও ভালোভাবে ফুটে উঠেনি। এই ভোরবেলা হঠাৎ কার বিপদ হলো! ফোন রিসিভার কানে লাগিয়ে একজন অফিসার কিছুক্ষণ কথা বললেন। এরপর হন্তদন্ত হয়ে কয়েকজন পুলিশ অফিসারকে দ্রুত পাঠিয়ে দিলেন ঘটনাস্থলে, যেখান থেকে এক তেইশ বছর বয়সী তরুণী সাহায্য প্রার্থনা করেছেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় আবিষ্কার করলেন শিলা নামক এক তরুণীকে। তিনি এই অবস্থায় মুখ দিয়ে আঘাত করে বাসার টেলিফোনটি মাটিয়ে ফেলে এরপর পেছনে ফিরে আঙুলের সাহায্যে কোনোরকমে জরুরী পুলিশ সাহায্যের জন্য ফোন করতে পেরেছেন। তার দেহে আঘাতে ক্ষত বিক্ষত ছিল। তাকে দ্রুত চিকিৎসার জন্য নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হলো। তিনি কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠা মাত্র পুলিশ তার জবানবন্দি নেয়। আর সেই জবানবন্দিতে বর্ণিত হয় সেই ভয়াল রাতের ঘটনা।
ঘটনাস্থল যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেমেন্তো অঞ্চল। কিছুটা নির্জন সাইট্রাস হাইটস এলাকায় বাস করতেন শিলা। অবশ্য জেনে রাখা ভালো, নিপীড়িত সেই তরুণীর আসল নাম শিলা নয়। গোপনীয়তার স্বার্থে তাকে এই ছদ্মনাম দেয়া হয়েছে। সেদিন রাতে হঠাৎ করে শিলা তার শয়নকক্ষে মুখোশ পরিহিত এক ব্যক্তিকে দেখতে পান। তার মনে হচ্ছিল তিনি চোখে ভুল দেখছেন। কিন্তু তার ভুল ভাঙে যখন মুখোশধারী লোকটি হঠাৎ করে তাকে আক্রমণ করে বসে। আক্রমণকারীর পরনে ছিল নেভি-ব্লু টিশার্ট এবং ধূসর রঙের হাতমোজা দিয়ে হাত ঢাকা ছিল। কিন্তু অদ্ভুত হলেও সত্যি যে, তখন লোকটির পরনে কোনো প্যান্ট ছিল না। প্রায় চার ইঞ্চি লম্বা এক ছুরি দিয়ে সে শিলার দেহের বিভিন্ন অঙ্গে জখম করে দেয়। কিন্তু একের পর এক আঘাত করার পরেও সে শিলাকে চিৎকার করতে দেয়নি। উল্টো বাম হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরে শাসাতে থাকে। এরপর আক্রমণকারী অসহায় শিলাকে ধর্ষণ করে এবং হাত বাঁধা অবস্থায় ফেলে পালিয়ে যায়। যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা শিলার আর তেমন কিছু মনে নেই। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে কিছু সাদা কাপড়ের দলা আবিষ্কার করে। সম্ভবত আক্রমণকারী কাপড়ের দলা দিয়ে শিলার মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলো। এভাবেই শুরু হয় এক অজ্ঞাত ধর্ষক অনুসন্ধান কেস।1
![](https://assets.roar.media/assets/HzBguKTqX6yGSk6m_3.jpg)
দিন যতই যায়, ততই জটিল হয়ে ওঠে এই কেস। কারণ, সেই প্রথম ফোন কলের পর ইতোমধ্যে কয়েক বছরের মাথায় ১২টি ফোনকল চলে এসেছে। আর সেদিনের ধর্ষক তার অপরাধের বলয় প্রশস্ত করে ধর্ষণের পর হত্যা করা শুরু করে দিয়েছিল। পূর্বাঞ্চলের প্রতিটি নারীর ত্রাস বনে গেলো এই অজ্ঞাত সিরিয়াল ধর্ষক। অনেকে তার অপরাধ অঞ্চলের সাথে মিলিয়ে তার ডাকনাম দিয়েছিল East Area Rapist (ইস্ট এরিয়া রেপিস্ট) বা সংক্ষেপে EAR। অপরাধের মাত্রা দিনের পর দিন বেড়ে গেলেও আগ্রাসনের পুরো দশ বছর জুড়ে পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরেই ছিল এই হত্যাকারী। একসময় তার নাম বদলে দাঁড়ায় গোল্ডেন স্টেট কিলারে। যখন সবাই ভেবেছিল জোডিয়াকের মতো এই ঘাতকও চিরদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে, ঠিক তখন ২০১৮ সালে শেষপর্যন্ত উন্মোচিত হলো সেই ঘাতকের আসল পরিচয়।
প্রাথমিক অনুসন্ধান
পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছিল এটি হয়তো কোনো কলেজপড়ুয়া ছাত্রের কাজ হবে। এক্ষেত্রে অপরাধীকে খুঁজে বের করতে বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। কারণ, বাইরে থেকে যতই অসতর্ক মনে হোক না কেন, শিলার ধর্ষক ছিল অতিমাত্রায় সাবধানী। ঘটনাস্থলে সে একবারের জন্যও হাত থেকে মোজা খোলেনি। আর সেই সময় পুলিশের অপরাধী শনাক্তকরণের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল আঙুলের ছাপ মিলিয়ে দেখা।
তখনও ডিএনএ দ্বারা অপরাধী শনাক্তকরণ পদ্ধতির প্রচলন শুরু হয়নি। তাই পুলিশ নির্যাতিত নারীদের জবানবন্দি এবং ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সূত্র সংগ্রহ করে অগ্রসর হতে থাকে। ধর্ষকের দৈহিক বর্ণনায় তারা জানতে পারেন যে, উচ্চতায় পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চির এই ধর্ষক দেখতে কিছুটা মোটা এবং তার পা অস্বাভাবিক লোমশ। আক্রমণের সময় সে মুখোশ পরিধান করলেও অনেকের ক্ষেত্রে মুখোশ খুলে চেহারা দেখিয়েছে এমনটাও শোনা গেছে। এছাড়া সে ধর্ষিতাদের বিভিন্ন প্রশ্ন করে কিছুটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করতো তার পরিচয় সম্পর্কে। কিন্তু পুলিশ তখনও জানতো না যে, চতুর ধর্ষক ইচ্ছে করে নানা ভুল সূত্র ছড়িয়ে পুলিশকে বিভ্রান্ত করছিলো। তাই পুলিশ সেগুলো অনুসরণ করে এক অনন্ত গোলকধাঁধায় আটকে গিয়েছিল।
ততদিনে দুই বছরে প্রায় ২৪ জন নারী সেই ধর্ষকের শিকার হন। ধর্ষণের পর স্মারক হিসেবে সে ধর্ষিতার বাসা থেকে ছোটখাট বস্তু যেমন চুল বন্ধনী, লিপস্টিক, ফিতা, জুতো ইত্যাদি চুরি করে পালিয়ে যেত। এমনকি মাসখানেক পর অজ্ঞাত নাম্বার থেকে ফোন দিয়ে পূর্ব নির্যাতিতদের নতুন করে আক্রমণের হুমকি দিতো সে। ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তায় সে হাসতে হাসতে প্রশ্ন করতো, “মনে আছে তো আমাকে? ওই যে সেদিন তোমাকে নিয়ে খেলেছিলাম!” পুলিশ নাম্বার অনুসন্ধান করে তেমন কিছুই বের করতে পারতো না কারণ প্রতিবার সে পেফোন থেকে কল করতো।
![](https://assets.roar.media/assets/lyXCx4iK5e0N0FAO_fbi-gskbiometrics.jpg)
হিমশিম খেয়ে উঠা পুলিশের কেস জটিল করতে এবার সে তার অপরাধ ধরন এবং অঞ্চল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়। নতুন অঞ্চলে সে এবার নিঃসঙ্গ নারীর বদলে দম্পতি এবং পরিবারের সাথে বাস করা নারীদের নিজের নতুন লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। এবার তার আক্রমণের ভঙ্গিতেও বড় রকমের পরিবর্তন আসে। এক তের বছর বয়সী কিশোরীকে ধর্ষণের পূর্বে সে তার মাকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় রান্নাঘরের বাসনের সাথে আটক করে রাখে। মা যদি বাঁধন খোলার চেষ্টা করে, কাঁচের বাসন মাটিতে পড়ে শব্দ হবে এবং সে আগেভাগে টের পেয়ে যাবে। এক্ষেত্রে তার মেয়েকে খুন করা হবে বলে শাসিয়ে দিয়েছিল সে। এতদিনে এই ধর্ষকের কথা সবাই কমবেশি জেনে গিয়েছিল। তাই ভয়ে মা এক চুলও নড়তে পারেননি। নীরবে সয়ে গিয়েছিলেন তার প্রিয় কন্যার ধর্ষণের করুণ দৃশ্য। এভাবে কয়েকদিন পর পর নতুন নতুন এলাকায় ঢুঁ মেরে আগ্রাসন চালাতে থাকে এই ধর্ষক। এই সময়ে দৃশ্যপটে হাজির হয় এফবিআই। কিন্তু তারপরেও থেমে যায়নি তার আগ্রাসন।
![](https://assets.roar.media/assets/4zUDI4aeJn4xTb5d_fbi_101075424_ransasckedhouse.jpg)
ধর্ষক থেকে ঘাতক
EAR তার আক্রমণের ধরনে বদল আনলো। এবার তার নামও বদলে গেলো। ইস্ট এরিয়া রেপিস্ট বা ধর্ষক থেকে বদলে সেটা হয়ে গেলো ‘কিলার’ বা ঘাতক। প্রথম আগ্রাসনের দু’বছর পর কেটি এবং ব্রায়ান মেগিয়র নামক এক দম্পতিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে এই ঘাতক। ১৯৭৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি এই দম্পতির জীবনে হানা দেয় ইস্ট এরিয়া রেপিস্ট। কেউ জানে না ঠিক কীভাবে তাদের সাথে এই ধর্ষকের দেখা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা শুধু মুখোশ পরা একজনকে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালাতে দেখেছিল। পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধরে নিয়েছিল হয়তো সেই ধর্ষকের নাম ব্যবহার করে অন্য কেউ এই কাজ করছে, কারণ এর আগে কখনোই সে দম্পতি বা কাউকে হত্যা করেনি। কিন্তু এরপর একাধারে ৫টি হত্যাকাণ্ড ঘটে গেলে তাদের ধারণা পাল্টে যায়।
![](https://assets.roar.media/assets/PKEw06bvfya5cAaz_scremnto-bee.jpg)
হত্যাকাণ্ডের পূর্বে কেটি মেগিয়র বেশ কয়েকবার অজ্ঞাত নাম্বার থেকে ফোনে হুমকি পেয়েছিলেন বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছিলেন। এমনকি একবার একটি নীল গাড়িতে করে একজন লোক তাকে বাসা পর্যন্ত অনুসরণ করেছিল বলেও অভিযোগ লিখিত ছিল। কিন্তু যখনই ঘটনাস্থলে পুলিশ বা কর্তব্যরত কেউ আগমন করতো, তার হদিস পাওয়া যেত না। একদম হাওয়ায় মিলিয়ে যেত লোকটি। মেগিয়র দম্পতি হত্যার পর ঘাতক আবারো অঞ্চল বদলে ফেলে। তার পরবর্তী গন্তব্য ছিল কোস্টা কাউন্টি। এখানে সে ২০টি ধর্ষণের পর এক স্থানীয় চিকিৎসক রবার্ট হফারম্যান এবং তার বান্ধবীকে হত্যা করে। এখানেও সে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। কারণ সে প্রথমবারের মতো বন্দুকের সাহায্যে দুজনকে হত্যা করেছিল। যারা তার আগ্রাসন থেকে কপালজোরে প্রাণে বেঁচে আসতে পেরেছিল, তারা জানালো হত্যা প্রচেষ্টার পূর্বে সঙ্গীর সামনে ধর্ষণ করতে পছন্দ করে এই কুখ্যাত ঘাতক। মেগিয়র এবং হফারম্যানের পর তার তালিকায় যুক্ত হয় স্মিথ, হ্যারিংটন, ডমিঙ্গো এবং সানচেজ নামক স্থানীয় দম্পতি। এভাবে জোড়া হত্যার মাঝে নতুন ভঙ্গিমায় পুরানো ত্রাস ছড়িয়ে যাচ্ছিলো এই ঘাতক।
![](https://assets.roar.media/assets/eyH3D9POCIbAKFn2__101062155_katiebrianmaggiore-fbi.jpg)
ব্যর্থ অনুসন্ধান
১৯৭৬ থেকে শুরু করে ১৯৮৬ পর্যন্ত টানা দশ বছর যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলে আগ্রাসন করে বেড়ায় এই ইস্ট এরিয়া রেপিস্ট। এই সময়ে সে মোট ৫০টি ধর্ষণ এবং এক ডজন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। প্রতিবারই সে বেশ হেসেখেলে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। তার আত্মবিশ্বাস এতটাই উঁচু ছিল যে একবার সরাসরি পুলিশ স্টেশনে ফোন করে, “আমিই ইস্ট এরিয়া রেপিস্ট! তোমরা আমার টিকিটাও ধরতে পারবে না” বলে কৌতুক করে ফোন কেটে দিয়েছিল। পুলিশের পাশাপাশি ব্যুরোর বাঘা বাঘা গোয়েন্দারাও তাকে ধরতে ব্যর্থ হয়। আক্রমণের শিকার অনেকের বর্ণনা শুনে তার বেশ কয়েকটি স্কেচ করা হলেও তাকে ধরা সম্ভব হয়নি। দেখা যেত নতুন আক্রমণের পর নতুনভাবে স্কেচ করা হলে অনেকটাই ভিন্ন চেহারা ফুটে উঠতো। অবশ্য ব্যুরোর গোয়েন্দারা তিনজন ব্যক্তিকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করেছিল। তারা হলেন ব্রেট গ্লেসবি, পল স্নেইডার এবং জো এলসিপ। ব্রেট ১৯৮২ সালে মৃত্যুবরণ করায় তাকে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। ১৯৯০ এর দিকে ডিএনএ প্রযুক্তির প্রচলন হওয়ার পর বাকি দুজনকে নির্দোষ ঘোষণা করে ব্যুরো।
![](https://assets.roar.media/assets/XO2slc29DfcsKI5A_grace-lisa-scott.jpg)
ঘটনাস্থলে ফেলে যাওয়া বস্তু পরীক্ষা করে ঘাতকের ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়, কিন্তু জাতীয় ডেটাবেজে এর সাথে কোনো মিল পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ আসল ঘাতক তার জীবদ্দশায় কখনোই কোনো অপরাধের কারণে আটক হয়নি। তবে ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে ১৯৭৬ এর পূর্বের বেশকিছু ধর্ষণ মামলার আলামতের সাথে এই ঘাতকের মিল পাওয়া সম্ভব হয়। কেস এই পর্যায়ে আরো জটিল হয়ে পড়ে যখন সে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করে একদম লাপাত্তা হয়ে যায়। হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হলেও সে প্রায়ই ফোন করে ভুক্তভোগীদের হুমকি দিত। তার এই ফোন হুমকি পর্ব চলেছিল ২০০১ সাল পর্যন্ত। এভাবে দীর্ঘ সময় ধরে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় ইস্ট এরিয়া রেপিস্টকে যুক্তরাষ্ট্রের সিরিয়াল কিলারদের ইতিহাসে অন্যতম চতুর হিসেবে গণ্য করা হয়।
মিশেল ম্যাকনামারার আবির্ভাব
![](https://assets.roar.media/assets/TaFJW3l3s5Fvxbnd_matt-sayles.jpg)
একবিংশ শতাব্দী মানেই ইন্টারনেট বিপ্লব। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে বহুগুণে। ইন্টারনেটের সাহায্যে অনেক কঠিন কাজ করা যাচ্ছে মুহুর্তের মধ্যে। অবশ্য পাঠকদের ইন্টারনেটের সুবিধা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। দৈনন্দিন জীবন ছাড়াও অপরাধ অনুসন্ধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেও ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু হয় এই শতাব্দীতে। বাদ যায়নি এই ইস্ট এরিয়া রেপিস্টের মামলাও। সবাই যখন এই ঘাতকের কথা বেমালুম ভুলে বসেছিল, তখন মিশেল ম্যাকনামারা নামক এক ব্লগার তার ‘True Crime Diary’ নামক ওয়েবসাইটে এই ঘাতককে নিয়ে নতুন অনুসন্ধান শুরু করেন। তার পুরো অনুসন্ধান ছিল ইন্টারনেটভিত্তিক। তার ওয়েবসাইটে এই ঘাতকের নতুন নামকরণ করা হয় গোল্ডেন স্টেট কিলার। পুরোনো নথিপত্র ঘেঁটে ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন নতুন সূত্র আবিষ্কার করতে থাকেন তিনি। তার ওয়েবসাইটে নিয়মিত লিখতে থাকেন অনুসন্ধানের অগ্রগতি নিয়ে। ২০০৬ সালে যাত্রা শুরু করা এই অনলাইন ব্লগকে কেন্দ্র করে ছোটখাট একটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়। গ্রুপের সদস্যরা সূত্রগুলো একে অপরের সাথে আলোচনার মাধ্যমে এই সিরিয়াল কিলার সম্পর্কে যতটুকু সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করা শুরু করে। ২০১৩ সালে মিশেল ম্যাকনামারা লস এঞ্জেলস ম্যাগাজিনে প্রথমবারের মতো ‘গোল্ডেন স্টেট কিলার’ সম্বোধনের মাধ্যমে একটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন।
তিনি তার ব্লগের প্রবন্ধগুলো একত্রিত করে গুছিয়ে একটি বই লেখা শুরু করেন। ঘাতকের সর্বশেষ আক্রমণস্থল কন্ট্রা কস্তা কাউন্টির পুলিশ অফিসার জন হোলস তার কাজে উৎসাহিত হয়ে একসাথে কাজ করার আমন্ত্রণ জানান। মিশেল ম্যাকনামারা সূত্রগুলো বেশ সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই অনুসন্ধান মিশনে নতুন গতির সঞ্চার করেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে মিশেল ম্যাকনামারা ২০১৬ সালে ঘুমের মাঝে অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে কিছুটা ধীর হয়ে উঠলেও একেবারে থেমে যায়নি ট্রু ক্রাইম ডায়েরির কার্যকলাপ। তার স্বামী প্যাটন অসওয়াল্টের পৃষ্ঠপোষকতায় অসমাপ্ত বইটি I’ll Be Gone In the Dark নামে প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এর মাধ্যমে পৃথিবীবাসীর নিকট উন্মুক্ত হয় এক ভয়াল ঘাতকের আগ্রাসনগাঁথা।
![](https://assets.roar.media/assets/S0KqA2b1e4qhsqsQ_4.jpg)
অবশেষে ধরা পড়লো ঘাতক
মিশেল ম্যাকনামারার মৃত্যুর দুই বছরের মাথায় অবশেষে উন্মোচিত হলো এককালের ত্রাস গোল্ডেন স্টেট কিলারের আসল পরিচয়। আর এই আবিষ্কারের নেপথ্যে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার জন হোলস। তিনি স্বতন্ত্র অর্থায়নে পুলিশ ডেটাবেজে সংরক্ষিত ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে ইন্টারনেটভিত্তিক ডিএনএ বিশ্লেষণ ওয়েবসাইট GEDmatch এর মাধ্যমে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই ওয়েবসাইটের বিশেষত্ব হচ্ছে, নমুনা ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যক্তির পারিবারিক ইতিহাস খুঁজে বের করা। সোজা কথায়, নমুনা ডিএনএ’র কাছাকাছি সবার ডিএনএ’র বৈজ্ঞানিক তালিকা তৈরি করাই এদের কাজ। এই ওয়েবসাইটের ডেটাবেজে প্রায় ৮ লক্ষাধিক ডিএনএ প্রোফাইল সংরক্ষিত রয়েছে। ভাগ্যক্রমে ঘাতকের এক চাচাতো ভাই একবার এই ওয়েবসাইট ব্যবহার করেছিল। তাই ডিএনএ নমুনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেই চাচাতো ভাইয়ের প্রোফাইল সামনে চলে আসে।
![](https://assets.roar.media/assets/oXuQABIPvPta7EQ5_images.png)
অনেকটা খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার মতো অবস্থা থেকে এই মূল্যবান তথ্য উদ্ঘাটন করতে পেরে বিস্মিত হয়ে গেলো পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সবাই। যে কেস দীর্ঘ ৪০ বছর যাবৎ পুলিশ এবং ব্যুরোর বাঘা বাঘা কর্মকর্তাদের নাকানি-চুবানি খাইয়ে ছাড়লো, তা কি না ইন্টারনেটের ভেলকিতে খুব সহজে সমাধা হয়ে গেলো। পরবর্তী ধাপে পুলিশ প্রোফাইল মিল পাওয়া ব্যক্তিকে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তার নিকটাত্মীয়দের ডিএনএ সংগ্রহ করা শুরু করে। আসল ঘাতক ছিল সন্দেহভাজনের চাচাতো ভাই। তার ব্যবহৃত কিছু আসবাবপত্র থেকে নমুনা সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করতেই বেরিয়ে আসে তার পরিচয়। তার নাম জোসেফ জেমস ডি-অ্যাঞ্জেলো। ২০১৮ সালে গ্রেফতারের সময় তার বয়স ছিল ৭২ বছর।
![](https://assets.roar.media/assets/i7VPe9vH8OE2Hkmv_gskevidence-fbi.jpg)
জোসেফ জেমস ডি-অ্যাঞ্জেলো
![](https://assets.roar.media/assets/oQkpxPFS2UVCuZVn_GettyImages-951226824-justin-sulivan.jpg)
যেকোনো সিনেমার পর্দায় যদি সিরিয়াল কিলার আটকের দৃশ্য চিত্রায়ন করা হয়, তাহলে দেখা যাবে বহুস্তরের বাহিনী নিয়ে রীতিমতো এলাহি কাণ্ড ঘটিয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে সেই ঘাতককে। অনেকটা সেরকম দৃশ্যের প্রত্যাবর্তন হতে পারে এমন ধারণা নিয়েই সেদিন পুলিশ সদস্যরা ঘাতককে গ্রেফতার করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু দরজায় কড়া নাড়তেই দরজা খুললো সাদামাটা চেহারার বৃদ্ধ ডি-অ্যাঞ্জেলো। তাকে যখন জানানো হলো গোল্ডেন স্টেট কিলার হিসেবে তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে, সে কোনোরকম বাধা প্রদান করেনি। এমনকি তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ এক মুহূর্তের জন্যেও অস্বীকার করেনি সে। আদালতে সে বেশ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে, যা দেখে নিহত এবং ধর্ষিতদের পরিবারের অনেকেই অবাক হয়ে গিয়েছে। তার চেহারায় ছিল না কোনো ক্রোধ কিংবা হতাশা, ছিল না কোনো অনুতপ্ততার ভাব।
![](https://assets.roar.media/assets/MzwRM6DygOQr0JtB_180425185717-02-joseph-james-deangelo-home-0425-exlarge-169-cnn.jpg)
ভিয়েতনাম যুদ্ধফেরত জেমস জোসেফ ছিল একজন পুলিশ অফিসার। কিন্তু অফিসার হয়ে এক দোকানে চুরির দায়ে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ব্যক্তিজীবনে সে এক স্ত্রী এবং কন্যাসহ সংসার চালাতো। ঘটনাক্রমে যেবছর সে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করে দেয়, ঠিক সেবছর জন্ম নেয় তার কন্যাশিশু। তাই হত্যা বন্ধ হওয়ার পেছনে হয়তো কন্যার জন্ম পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছিল বলে ধারণা করা হয়। তার আয়ের উৎস ছিল এক স্থানীয় গ্যারেজ, যেখানে সে দীর্ঘ ২৭ বছর মিস্ত্রী হিসেবে কাজ করতো। গ্যারেজে কাজ করার সময় সে সেক্রেমেন্তো, ক্যালিফোর্নিয়া এবং রোজভিল অঞ্চলে ভ্রমণ করতো বলে জানা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সময়ে সে জায়গায় জায়গায় ঘুরে মেয়েদের ধর্ষণ ও হত্যা করতো।
২০১৭ সালে সে মিস্ত্রীর কাজ থেকে অবসর নিয়ে নেয়। সবচেয়ে অবাক করা তথ্য হলো, তাকে গ্রেফতার করা হয় সাইট্রাস হাইটস নামক এক জায়গা থেকে। ঠিক এই জায়গাতে ১৯৭৬ সালের জুন মাসে শিলাকে ধর্ষণ করেছিল এই নরপশু। তার গ্রেফতারের পর তাজ্জব বনে যায় প্রতিবেশীরা। তাদের মতে, জোসেফ কিছুটা চুপচাপ এবং বদমেজাজি স্বভাবের ছিল ঠিকই, কিন্তু তাকে কখনোই তারা সন্দেহ করেনি। সেক্রেমেন্তো, সান্তা বারবারা, ওরেঞ্জ, ভেন্টুরা, টুলারে এবং কন্ট্রা কস্তা- এই ছয় কাউন্টিতে তার নামে হত্যা ও ধর্ষণের অভিযোগে ১৩টি মামলা দায়ের করা হয়। বাদী পক্ষের আইনজীবী ৬ কাউন্টিতেই এই ঘাতকের সর্বোচ্চ শাস্তির রায় আদায় করতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। বর্তমানে তার বিচারকার্য চলছে সেক্রেমেন্তো কাউন্টিতে।
![](https://assets.roar.media/assets/VIOw4HoINIGzRBZ0_images.jpg)
৭০-এর ইস্ট এরিয়া রেপিস্ট ওরফে গোল্ডেন স্ট্যাট কিলার অবশেষে গ্রেফতার হলো। এর পেছনে বছরের পর বছর ধরে অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে যাওয়া অফিসারবৃন্দ, মিশেল ম্যাকনামারা, জন হোলস, GEDmatch ওয়েবসাইটের সংশ্লিষ্টদের অবদানকে স্মরণ করে ধন্যবাদ জানিয়েছে ভুক্তভোগী এবং নিহতদের পরিবারের সদস্যবৃন্দ। তবে অনেকেই কর্তৃপক্ষের গাফেলতির কথা জানিয়ে ক্ষোভ ঝেড়েছেন। হ্যারিংটন দম্পতি হত্যার ১৫ বছর পর ব্রুস হ্যারিংটন (নিহতের ভাই) ডিএনএ প্রযুক্তি আরো বড় পরিসরে ব্যবহার করে ঘাতক খুঁজে বের করা সম্ভব বলে বেশ কয়েকবার দাবি জানিয়েছিলেন। আজ সেই ডিএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে যখন ঘাতককে খুঁজে বের করা হলো, তখন তিনি জানিয়েছেন, এই কেসটি আজ থেকে আরো ১০ বছর আগেই হয়তো সমাধান করা সম্ভব হতো। তবে শেষপর্যন্ত ঘাতক সবার সামনে তার ভয়াবহ মুখোশ থেকে বেরিয়ে এসেছে, তা জানতে পেরে অনেকেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন। হ্যারিংটনের ভাষায়ই বলা যাক,
“আজ তোমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাও। সেই পশু আর জানালা ভেঙে আক্রমণ করতে আসবে না। সে এখন কারাবন্দি এবং বিগত ইতিহাসমাত্র।”
ইতিহাসের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/