ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন আচার ও উৎসব প্রতিপালিত হয় হিজরি ক্যালেন্ডারের সময়ে মেপে। কোনো কোনো আরবদেশে প্রশাসনিক কাজেও এই ক্যালেন্ডারের ব্যবহার রয়েছে। ইসলামের মৌলিক ধর্মগ্রন্থগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশনা অনুসরণপূর্বক এই ক্যালেন্ডারটি প্রস্তুত করা হয়েছে। দেড় হাজার বছরের পুরনো এই বর্ষপঞ্জি কোনো রদবদলকে স্বাগত না জানিয়ে আজও অক্ষত হয়ে আছে।
প্রথমেই একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া যাক, বলুন তো, বিশ্ব জুড়ে কম-বেশ পালিত হচ্ছে এমন কোন ক্যালেন্ডার আছে, যেটি সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত কোনো ধরনের পরিমার্জন বা সংস্কার ব্যতিরেকে অপরিবর্তিতভাবে পালিত হয়ে আসছে?
জানি, এ প্রশ্ন পড়ার আগেই তো নিবন্ধের শিরোনামটি পড়ে ফেলেছেন, সুতরাং উত্তর ধরেই ফেলেছেন! হ্যাঁ- সেটা হলো হিজরি সন। ইসলাম ধর্মভিত্তিক এই হিজরি সনের বিশেষত্ব হচ্ছে, ইসলামের আর সব বিধি-নিষেধের মতোই এই ক্যালেন্ডারও ধ্রুবতার নীতিতে পরিগণিত হচ্ছে।
সন-তারিখ গণনার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে বিভিন্ন ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জি। তন্মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডার বা গ্রেগরীয় পঞ্জিকা। দেশ-জাতির সীমানা ছাড়িয়ে এটি হয়ে উঠেছে বিশ্বজনীন পঞ্জিকা। এত বৃহৎ পরিসরে আর কোনো পঞ্জিকা ব্যবহৃত হয় না।
বোধ করি, এর নিকটবর্তী যে ক্যালেন্ডারটি রয়েছে, যা বিশ্বজনীন ব্যবহৃত হয়— যদিও মূলত ধর্মীয় কারণে, সেটি হলো হিজরি পঞ্জিকা। হযরত মুহাম্মাদ (সা)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার ঐতিহাসিক ঘটনার দিন থেকে গণনাকৃত এ পঞ্জিকা ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন উৎসব আর আচার-অনুষ্ঠান পালনের জন্য তারিখ নির্ধারণের উদ্দেশ্যে মুসলিমদের মাঝে ব্যবহৃত হয়। এজন্য হিজরি বর্ষপঞ্জির আরেক নাম ‘ইসলামি বর্ষপঞ্জি’। আরবরা এর পত্তন করেছেন বলে একে ‘আরবি বর্ষপঞ্জি’ও বলেন কেউ কেউ।
কিছু কিছু আরবদেশে ধর্মীয় কাজের পাশাপাশি প্রশাসনিকভাবেও এই পঞ্জিকাটি বহুল ব্যবহৃত হয়। আমরা এই লেখায় একাধিক পর্বে হিজরি সনের ইতিকথা এবং সেই প্রসঙ্গে ইসলাম ধর্মশাস্ত্রের নির্দেশনা নিয়ে আলোচনা করব।
হিজরি সনের আদিকথা
‘হিজরি’ কথাটি ‘হিজরত’ শব্দ থেকে এসেছে। আর ‘হিজরত’ শব্দের অর্থ দেশান্তর। নবী মুহাম্মাদ (সা) জন্মেছেন মক্কায়, ইসলাম প্রচার করেছেন সেখানেই। তাঁর জীবনে এসেছে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত। অবশেষে, বিরুদ্ধবাদীরা তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। অগত্যা তিনি তাঁর জন্মভূমি ছেড়ে ইয়াসরিব (বর্তমান মদীনাতুন্নাবী বা মদিনা) এর দিকে যাত্রা করেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনাই হিজরত নামে পরিচিত।
হিজরতের আগে মহানবী (সা) ইসলাম প্রচারে জীবন উজাড় করে দিলেও খুব বেশি সংখ্যক মানুষ তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয়নি। একরকম বৈরী পরিবেশের মধ্যেই তাঁকে দিনাতিপাত করতে হয়েছে।
কিন্ত হিজরতের পর তিনি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তাঁর ধর্ম প্রচারের পরিধি কেবল মদিনা শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং বহির্বিশ্বের নানা প্রান্তে তিনি এ সময় ইসলাম প্রচার আরম্ভ করেন। মোদ্দাকথা, হিজরতের ঘটনা ছিল ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটা মাইলফলক। তাই, পরবর্তী সময়ে সন গণনার ক্ষেত্রে হিজরতের ঘটনাই সকলের নিকট ধর্তব্য হয়েছিল।
আর সে পরিপ্রেক্ষিতেই ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমার (রা) মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক চান্দ্রমাসের পঞ্জিকা প্রণয়ন করেন। কিন্তু ঠিক কোন প্রেক্ষাপটে এই ইসলামি সন প্রচলিত হয়েছে, তা নিয়ে রয়েছে কয়েকটি অভিমত রয়েছে। [1]
ঐতিহাসিক ইবনে সমরকন্দি বলেন,
“আবু মুসা আশআরি (রা.) উমার (রা.)-এর কাছে পত্র লিখেছেন-
আপনার পক্ষ থেকে আমাদের কাছে অনেক ফরমান আসে; কিন্তু তাতে তারিখ লেখা থাকে না। সুতরাং সময়ক্রম নির্ধারণের জন্য সাল গণনার ব্যবস্থা করুন।”
তারপর উমার (রা.) হিজরি সালের গোড়াপত্তন করেন।
পরে প্রণীত হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পত্র প্রেরণের তারিখটি দাঁড়ায়- ১০ জুমাদাল উলা, ১৭ হিজরি।
ঐতিহাসিক আল্লামা আইনি ইতিহাসবিদ আবুল ইকজানের বরাত দিয়ে আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন,
“উমার (রা.)-এর কাছে একটি দলিল পেশ করা হয়, যাতে কেবল শাবান মাসের কথা লেখা হয়। কিন্তু সেটি কত সালের শাবান মাস, তা উল্লেখ করা ছিল না। উমার (রা) জানতে চান-
এটা কোন শাবান! এ বছরের শাবান নাকি আগামী বছরের শাবান?”
তারপর হিজরি সন প্রবর্তন করা হয়।
আল্লামা শিবলি নোমানি (রহ.) এ অভিমতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। [2]
বোঝা গেল, বিস্তৃত খিলাফত পরিচালনায় সন-তারিখ সম্বলিত একটি পঞ্জিকার গুরুত্ব প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছিলেন।
তৎকালীন আরবে প্রচলিত নানা সন
আরবদেশে কিন্তু আবহমানকাল থেকেই সন পালন করা হতো। [3] হিসেবের সুবিধার জন্য সবগুলো সনই ছিল চন্দ্রকেন্দ্রিক।
ইসলামি আইনশাস্ত্রের বই ‘আল মাওছুআতুল ফিকহিয়্যা আল কুয়েতিয়্যা’ গ্রন্থে [৪] উল্লেখ করা হয়েছে,
ইসলামপূর্ব যুগে আরবে সমন্বিত কোনো তারিখ বা সন ব্যবস্থা ছিল না। সে সময় তারা প্রসিদ্ধ ঘটনা অবলম্বনে বছর ও মাস গণনা করত।
উদাহরণস্বরূপ, মক্কায় অবস্থিত কাবাঘর ধ্বংস করতে ইয়েমেন থেকে বাদশাহ আবরাহা কয়েকটি হাতি নিয়ে অভিযান পরিচালনা করেন এবং দারুণ বিপর্যয়ের শিকার হন। এর আগে আরবের লোকেরা হাতি কখনো দেখেনি।
আবরাহার এই হস্তী অভিযান আরববাসীদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং তারা সে বছরের নাম দেয় ‘আমুল ফীল’ বা হস্তীবর্ষ। হস্তী অভিযানের এই প্রসিদ্ধ ঘটনা সূরা ফীল-এ উল্লেখ করা আছে। [5]
হস্তীবর্ষ ছাড়াও আরবের নানা গোত্র বিভিন্ন রকম সাল গণনা করত। যেমন- বাসুস, দাহেস, গাবরা, ইয়াওমু জি-কার, হরবুল ফুজ্জার ইত্যাদি ঐতিহাসিক ঘটনা ও যুদ্ধের দিনকে স্মরণ রেখে তারা বছরের হিসাব রাখত।
কিন্তু এই সালগুলোর কোনোটিই যেহেতু সার্বজনীন ছিল না, তাই সর্বজনগ্রাহ্য ও পরিশীলিত রূপের একটি নতুন ক্যালেন্ডারের দরকার পড়ে, যাতে ইসলাম ধর্মের আচার অনুষ্ঠান ও প্রশাসনিক নানা কাজকর্ম সঠিকভাবে করা যায়।
নতুন সন প্রচলনের পরামর্শ সভা
প্রখ্যাত তাফসীরকারক ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যখন উমার (রা.) সন প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি মজলিসে শূরা বা পরামর্শসভার আহ্বান করেন। সন প্রবর্তন যে জরুরি, সেকথা সকলেই স্বীকার করেন। কিন্তু সনটি ঠিক কোন তারিখ হতে গণনা করা হবে, তা নিয়ে সভার সদস্যরা নানা মত ব্যক্ত করেন। সভায় সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাত থেকে সাল গণনার প্রস্তাব দেন। তালহা (রা.) নবুয়তের বছর থেকে সাল গণনার অভিমত ব্যক্ত করেন। আলী (রা.) প্রস্তাব দেন হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে বর্ষ গণনার ব্যাপারে। এদের মধ্যে সকলে আলী (রা)-এর প্রস্তাবে সকলে একমত হন।
হিসাব কেমন হবে?
সমকালীন ধর্মীয় ও প্রশাসনিক নেতারা একটি নতুন সন গণনা করার ব্যাপারে তো একমত হন। কিন্তু কেমন হবে সেই সনের রূপরেখা? এই সনটি কি জ্যোতির্বিদ্যার কঠিন গাণিতিক হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে গণনা করা হবে? নাকি প্রাকৃতিক কোনো প্রসঙ্গবস্তুর সাপেক্ষে হবে?
এ ব্যাপারে মুহাম্মাদ (সা)-এর একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য,
আমরা নিরক্ষর জাতি, আমরা লিখতে বা গণনা করতে জানি না। মাস তো হলো এত এত দিনে অথবা এত এত দিনে, অর্থাৎ মাস কখনো কখনো ২৯ দিনে, আর কখনো কখনো তা ৩০ দিনে পূর্ণ হয়।
[বুখারি: ১৮১৪, মুসলিম: ১০৮০]
এখানে, মহানবী মুহাম্মাদ (সা) বলছেন যে, মাস গণনার জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে গেলে যে লিপিবিদ্যা ও প্রখর গাণিতিক জ্ঞানের প্রয়োজন হয়, তা সেই সমাজের অনেকেরই নেই।
স্পষ্টতই উমার (রা)-এর সময়েও এ অবস্থার খুব একটা ভিন্নতা দেখা যায় না। মহানবী (সা) মূলত এই হাদিসের মাধ্যমে এমন একটি বর্ষপঞ্জির অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন, যেটা স্বাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন নন, এমন যেকোনো ব্যক্তিও সহজেই হিসেব রাখতে পারে। ফলে, মহানবীর উত্তরসূরিগণ এই হাদিস থেকে ক্যালেন্ডার কীরূপ হবে, তার একটি নির্দেশনা পেলেন।
তবে কি আকাশের তারকারাজির ভিত্তিতে তারিখ গণনার পদ্ধতি গ্রহণ করা যায়? যদিও ইসলাম ধর্মে বারংবারই চন্দ্র-সূর্য-তারকা এসবের পূজা-অর্চনা কিংবা এদের জ্যোতিষীয় প্রভাব গ্রহণের ব্যাপারে কঠোর সাবধানবাণী পেশ করা হয়েছে, তথাপি, এসবের দ্বারা সন-তারিখ গণনার ব্যাপারে ইসলামের অস্তিবাচক বক্তব্য পাওয়া যায়। কুরআনে উল্লেখ আছে,
তিনিই ঊষার উন্মেষ ঘটান, আর তিনিই বিশ্রামের জন্য রাত এবং গণনার জন্য চন্দ্র ও সূর্যকে সৃষ্টি করেছেন, এ সব পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ কর্তৃক সুবিন্যস্ত।
[কুরআন; সূরা আল-আনআম, ৬:৯৬]
এবার আলোচ্য বিষয় হলো, চন্দ্র ও সূর্য এই দুয়ের মধ্যে কোনটিকে বর্ষগণনার ভিত্তি হিসেবে ধরা হবে? এ ব্যাপারে কুরআনের আয়াতগুলো বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, ইসলামি শরিআত কোনদিকে ইশারা করছে।
মুসলমানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ইবাদাত হলো হজ, যা আবহমানকাল থেকেই আরবদেশের মক্কাস্থিত কাবাকেন্দ্রিক পালিত হয়ে আসছিল। বছরের একটি সুনির্দিষ্ট সময়ে এই অনুষ্ঠানটি সম্পাদিত হতো। কুরআন বলছে,
হজের মাসগুলো সুবিদিত।
[কুরআন, সূরা বাকারাহ, ২:১৯৭]
একই সূরার অন্যত্র কুরআন বলছে,
“তারা তোমাকে নতুন চাঁদের হ্রাস-বৃদ্ধি সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে। বলে দাও- এটি সময়ের সুনির্দিষ্ট হিসাব ও হজের তারিখের হিসাব নির্ধারণের জন্য।”
[সূরা বাকারাহ; ২:১৮৯]
অতএব, হজের তারিখের যথাযথ হিসাবরক্ষণের জন্যে চান্দ্রসনের বিকল্প নেই। খোদ কুরআন থেকেই এই নির্দেশনা পাওয়া গেল। ফলে, আসন্ন সনটি চান্দ্রসন হবে- তা নিয়ে সাহাবীদের মধ্যে কোনো মতানৈক্য থাকল না।
কুরআনের নির্দেশনা ছাড়াও অনেক হাদিসে দেখা যায়, নবী (সা) রমজান ও অন্যান্য মাসের হিসাব গণনায় সরাসরি ক্রিসেন্ট চাঁদ (হিলাল) দেখবার নির্দেশনা দিয়েছেন। ফলে, সমকালীন যুগের সকলে এ বিষয়ে সর্বসম্মত যে, ইসলামি বর্ষপঞ্জিটি অবশ্যই চাঁদভিত্তিক হবে। প্রসঙ্গত বলে রাখা যায়, বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা পার্থিব বিভিন্ন কাজে চান্দ্রসন নয়, সৌরসন ব্যবহার করেন। যেমন, খ্রিস্টাব্দ, বঙ্গাব্দ ইত্যাদি। এগুলো কি তবে ইসলামি নির্দেশনা লঙ্ঘন করে পালন করা হচ্ছে? উত্তর হচ্ছে, না। সূর্য ও চন্দ্রের গতিবিধি লক্ষ্য করে সৌর-সন ও চান্দ্র-সন উভয়টিই গণনা করার ব্যাপারে কুরআন অনুমোদন প্রদান করেছে,
তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং এগুলোর মঞ্জিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো। আল্লাহ এগুলো নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এসব নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন।
[কুরআন, সূরা ইউনূস; ১০:৬]
এভাবেই ধর্মগ্রন্থের নির্দেশমালাকে একসূত্রে গেঁথে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করে প্রবর্তন করা হয় ইসলামি হিজরি ক্যালেন্ডার। ১৪৪৩ হিজরি নববর্ষকে উপলক্ষ্য করে এই লেখার পরবর্তী পর্বে আমরা জানব, ক্যালেন্ডারটির খুঁটিনাটি বাকি অংশ। সবার হিজরি নববর্ষ সুন্দর হোক। এই প্রত্যাশা রইল।