কারো জন্মদিন যদি ৩০শে বৈশাখ হয়, তাহলে সে কি প্রতি বছর তার জন্মদিন পালন করতে পারবে? হ্যাঁ, বাংলা পঞ্জিকা খুলে দেখুন। সে নিশ্চিতভাবেই পারবে। কেননা, এই তারিখটি প্রতি বছরই ঘুরে ঘুরে আসে। এবার ধরুন, কারো জন্মদিন ২৯শে ফেব্রুয়ারি। তার ক্ষেত্রে ঘটনা কী? সে কিন্তু প্রতি বছরই তার জন্মদিন পালন করতে পারবে না। কেবল অধিবর্ষের বছরগুলোতেই সে এটা পারবে। তবে প্রতি চার বছর পর পর নিশ্চিতভাবেই তা সম্ভব।
কিন্তু যদি কারো জন্মদিন হয় ৩০শে মুহাররাম, তাহলে কি সে প্রতি বছর নিশ্চিতভাবে তার জন্মদিন পালন করতে পারবে? না। ঐতিহ্যবাহী ইসলামি হিজরি ক্যালেন্ডার অনুসারে হিসাব করলে সে নিশ্চিতভাবে প্রতি বছর তার জন্মদিন পালন করতে পারবে না। হয়তো কেউ জন্মদিনে সমস্ত প্ল্যান প্রোগ্রাম করে সব উপাচার সাজিয়ে অপেক্ষা করছে, রাতে সবাইকে নিয়ে আনন্দ করবেন। আর ব্যস, সন্ধ্যায় উঠে গেল পরের মাসের চাঁদ। সমস্ত আয়োজন গেল ভেস্তে! এমনকি এ ধরনের জন্মদিন বাদ হয়ে যাবার ঘটনা পরপর কয়েক বছর হতে পারে!
এভাবে হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, মাসের শেষ দিকে এসে আপনি ঘণ্টাখানেক আগেও জানতে পারবেন না যে, পরবর্তী তারিখটি কী হতে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ প্রকৃতিনির্ভর এই ক্যালেন্ডারের আদ্যোপান্ত নিয়েই আমাদের এই আয়োজন। চলুন, শেষ পর্বটি পড়ে নেওয়া যাক।
প্রতি মাসে দিনের সংখ্যা
হিজরি সনের ১২টি মাসের প্রতিটি মাসে দিনের সংখ্যা কত হবে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়ে গেছেন মহানবী (সা)। তিনি বলেছেন,
দিনের সংখ্যা ২৯, এরপর যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে (কিংবা চাঁদ না ওঠে) তবে ৩০ দিন পূর্ণ করে নাও।
[বুখারি; খণ্ড ৩, অধ্যায়-৩১, হাদিস সংখ্যা- ১৩১]
পরবর্তী সময়ে উমার (রা)-এর শাসনামলে হিজরি সন আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হলে এই দিবসের সংখ্যার জটিলতা মুহাম্মাদ (সা) এর এই নির্দেশনা অনুযায়ী সমাধান হয়। হিজরি সনের মাসগুলো সাধারণত ধারাবাহিকভাবে ২৯-৩০-২৯-৩০ এভাবে হয়ে থাকে। অবশ্য বেশিরভাগ চান্দ্র ক্যালেন্ডারেই দিনের সংখ্যা ২৯ বা ৩০, এরূপই হয়ে থাকে।
হিজরি সন একটি চান্দ্রবর্ষ। চান্দ্রবর্ষের প্রতিটি মাস চারটি সপ্তাহে বিভক্ত, যেখানে প্রতি সপ্তাহে থাকে ৭টি করে দিন।
প্রাচীনকালে প্রচলিত প্রায় সবগুলো ক্যালেন্ডারই মূলত চান্দ্র পঞ্জিকা, বিশেষত ধর্মভিত্তিক ক্যালেন্ডারগুলো। কারণ, সূর্যের চেয়ে চাঁদের ভিত্তিতে তারিখ গণনা সহজতর। কেননা, চাঁদের আকার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে, যা দেখে প্রাচীন ব্যবিলনীয় সভ্যতা থেকে শুরু করে আজ অবধি মানুষ খুব সহজেই মাসের তারিখ সংখ্যা গণনা করে নিতে পারে। এ নিয়ে বিস্তারিত পড়তে পারেন এখান থেকে।
দিনের শুরু
আমাদের সমাজে প্রচলিত খ্রিস্টীয় ও বঙ্গাব্দ পঞ্জিকায় রাত ১২টা ০১ মিনিট থেকে দিন ও তারিখ গণনা শুরু হয়। যদিও বঙ্গাব্দ পঞ্জিকায় আগে সূর্যোদয় থেকে দিন ও তারিখ গণনা শুরু হতো। এ লেখায় আলোচনা হবে, হিজরি ক্যালেন্ডারের দিন শুরুর বিষয়টি নিয়ে।
হিব্রু ক্যালেন্ডারের মতোই হিজরি ক্যালেন্ডারেও সূর্যাস্ত থেকে দিন-তারিখ গণনা শুরু হয়। হিব্রু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, ইহুদিদের নিকট পবিত্রতম দিন শনিবার।
রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকাকালে ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি রীতি ছিল। ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে নিহত মরদেহকে কোনোভাবেই শনিবার ক্রুশে ঝুলিয়ে রাখা যাবে না। এজন্য খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের ইস্টারের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ইস্টারের দু’দিন আগে শুক্রবারে (খ্রিস্টানরা বলেন- গুড ফ্রাইডে বা পুণ্য শুক্রবার) অত্যাচারিত যিশু ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে জীবন-চেতনা হারালে ইহুদিরা তড়িঘড়ি করে যিশুর মরদেহ সন্ধ্যা নামার আগেই ক্রুশ থেকে নামিয়ে এনে কবর দিয়ে দেয়। কেননা, হিব্রু ক্যালেন্ডার মোতাবেক- সন্ধ্যার পরই নতুন দিন বা নতুন তারিখ গণনা শুরু হয়ে যায়।
এ অনুযায়ী, রমজানের অবসানে সন্ধ্যাবেলা থেকেই শুরু হয়ে যায় পহেলা শাওয়াল তথা ঈদুল ফিতর। তাই, আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই আপনি আপনার বন্ধুকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে পারবেন, এবং সেটা আর ‘আগাম শুভেচ্ছা’ হবে না; বরং সময়ের মধ্যেই হলো সেই শুভেচ্ছাজ্ঞাপন।
সপ্তাহের সাত দিন
প্রাচীন ব্যবিলনীয় সভ্যতায় আমরা দেখতে পাই, তারাই সর্বপ্রথম সাত দিনের সপ্তাহ গণনা করত। আরবি বর্ষপঞ্জিতেও তাই সাত দিনের সপ্তাহ লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া, হিজরি বর্ষপঞ্জিতে সপ্তাহে সাত দিন থাকার আরেকটি কারণ হতে পারে, সেমেটিজম। সেমেটিক ধর্মগুলোতে, যেমন বাইবেলে, সপ্তাহে সাত দিন নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। ইসলাম যেহেতু সেমেটিক ধর্মের সর্বশেষ সংস্করণ, তাই ইসলামি বর্ষপঞ্জিতেও আমরা অনুরূপ সাতটি দিন দেখতে পাই।
তবে, ইংরেজি ভাষা কিংবা আমাদের বাংলা ভাষায় সপ্তাহের সাত দিনের যে নামগুলো রাখা হয়েছে, এগুলোর সাথে পৌত্তলিকতার সংশ্রব দেখতে পাওয়া যায়। ইসলামি বর্ষপঞ্জিতে সপ্তাহের বারগুলোর নামকরণে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে, যেন পৌত্তলিক ধর্মবিশ্বাস এখানে জায়গা করে নিতে না পারে।
বছরে দিনের সংখ্যা
হিজরি সন যেহেতু একটি চান্দ্রবর্ষ, তাই এতে বছরে ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিন রয়েছে। ফলে, হিজরি সন প্রচলিত সৌর-সন থেকে ১১ দিন বা ১০ দিন কম থাকে। এজন্যেই আমরা দেখি, ঈদসহ অন্যান্য উৎসবগুলো প্রতি খ্রিস্টীয় বছরের সাপেক্ষে এগিয়ে আসে। কথার কথা ধরলে, এ বছরের মে মাসের শেষের দিকে ঈদ হলে, আগামী বছর ঈদ হবে মে মাসের মাঝের দিকে। অর্থাৎ চান্দ্র তারিখটি ১১ বা ১০ দিন এগিয়ে আসবে।
হিজরি সন থেকে অন্য সন
সৌরবর্ষ দ্বারা ঋতু গণনা যথার্থ হয়। চান্দ্রবর্ষ দ্বারা তা করা যায় না। যেহেতু, হিজরি সন একটি চান্দ্রবর্ষ, তাই হিজরি সনের সাথে ঋতুর বদল সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এজন্য কৃষিপ্রধান দেশে খাজনা আদায়ের ক্ষেত্রে হিজরি সন গণনায় কিছুটা জটিলতা দেখা যায়।
কারণ, একটি ফসল পাকে সৌর বর্ষের একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে। হিজরি বর্ষ সমাপ্ত হলে প্রশাসনিকভাবে রাষ্ট্রের কর্মকর্তাগণ খাজনা আদায়ে তৎপর হন। কিন্তু হিজরি বর্ষ যদি ঐ ঋতু আসার আগেই সমাপ্ত হয়ে যায়, তবে ফসল না পাকার কারণে কৃষকেরা খাজনা দিতে পারবে না। প্রশাসনিক এ জটিলতার কারণে বিশ্বের মুসলিম অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চলে হিজরি সনের সমান্তরালে সুবিধাজনক সৌর সন চালু করা হয়েছে।
আমাদের বঙ্গাব্দ সন এমনই একটি উদাহরণ। ৯৬৩ হিজরি সনের পর থেকে ৯৬৪ সাল থেকে হিজরি সনের সমান্তরালে চালু হয় সম্রাট আকবরের তারিখ-এ-এলাহী, যা ফসলি সন নামে পরিচিতি পায়। পরে এই সনই বঙ্গাব্দ নামে আমাদের বাংলা অঞ্চলে জনপ্রিয়তা পায়। বাংলা সালের সূচনা তবে দেখা যাচ্ছে ০১ সাল থেকে নয়, বরং ৯৬৪ সাল থেকে।
সৌর বর্ষের সাথে সমন্বয় করবার জন্যে আবার ইরান ও আফগানিস্তানে প্রচলিত হয়েছে- সৌর হিজরি সন। এতে গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির মতোই বছরে দিন সংখ্যা ৩৬৫। মাসগুলোর নাম রাশিচক্রের ১২টি রাশির ফারসি নামানুসারে রাখা। সৌর হিজরি সনও মূল চান্দ্র হিজরি সন থেকেই বিবর্তিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে।
পরিশেষ
অধ্যাপক স্যামুয়েল পি হান্টিংটন তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য ক্ল্যাশেস অভ সিভিলাইজেশন’ বা ‘সভ্যতার দ্বন্দ্ব’ শীর্ষক বইতে ইসলামকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইসলাম নামের এই সভ্যতার একটি দিক এই যে, এটি প্রায় সকল ক্ষেত্রে নিজের স্বকীয়তাকে রক্ষা করতে পেরেছে।
প্রাচীনকালের বহু ধরনের ক্যালেন্ডারের বিপরীতে একটি স্বতন্ত্র ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জির সূচনা এর একটি নিদর্শন। এই ক্যালেন্ডারটি হযরত মুহাম্মাদ (সা)-এর পরলোকগমনের পর সূচিত হলেও ক্যালেন্ডারের ধরন-দিন-তারিখ ইত্যাদি খুঁটিনাটি সকল বিষয়ে কুরআন ও নবীর বাণী সংকলন হাদিস শাস্ত্রে যে নির্দেশনা পাওয়া যায়, অন্যান্য ধর্মীয় ক্যালেন্ডারের ক্ষেত্রে মূল ধর্মগ্রন্থের নির্দেশনা ততটা দেখা যায় না।
বিশ্বের অন্য অনেক প্রাচীন ক্যালেন্ডারে অনেক যোজন-বিয়োজন ঘটেছে, কিন্তু হিজরি ক্যালেন্ডার অপরিবর্তনীয়ই থেকে গেছে। দেড় সহস্র বছর ধরে চলে আসা হিজরি বর্ষপঞ্জির এই অলঙ্ঘনীয়তা একে অনন্য করে তুলেছে অন্যসব বর্ষপঞ্জি থেকে।