‘ব্যান্ড’ শব্দটা আমাদের কানে আসলে প্রথমেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পাশ্চাত্য ভাবধারার গানের দলের কথা। রক, পপ, জ্যাজ, ব্লুজ, রক এন্ড রোল, মেটাল ইত্যাদি বিভিন্ন ধারার হতে পারে ব্যান্ড সঙ্গীত। এরকম বিশেষ ধারার গানের দলের দলগত সংগীত পরিবেশনাকে মোটা দাগে ব্যান্ড সংগীত বলা হয়। এই সংগীত বর্তমানে সারা বিশ্বেই তারুণ্যের উচ্ছ্বাসের প্রতীক, উদ্দীপনার কেন্দ্রস্থল। আমাদের দেশের কথাই বলি, এই পর্যায়ে আসতে গিয়ে ব্যান্ড সংগীতকে নানা ঘাত-প্রতিঘাত পার করে হয়েছে। সংগীতের ইতিহাসে অপেক্ষাকৃত এই নতুন সংযোজনকে অনেক সময় অপসংস্কৃতি বলেও চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে সব পেরিয়ে তারুণ্যের কাছে ব্যান্ড কালচার নিজস্ব আসন তৈরি করে নিয়েছে।
শুরু হলো যাদের হাতে
আমাদের দেশে ব্যান্ড সংগীতের শুরুটা হয়েছিল সেন্ট গ্রেগরির এক স্কুল বালকের হাত ধরে। নাম ফজলে রব। ১৯৬৩ সালের ১৮ মার্চ তার মনে এক নতুন স্বপ্নের জন্ম নেয়। স্বপ্নটা ছিল গিটার শেখার আর দলবেঁধে গান করার। এই স্বপ্নের জন্ম হয়েছিল স্কুলের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় ক্লাস এইট পড়ুয়া টেলফার জনসন নামের এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছাত্রের গিটারের জাদুতে মুদ্ধ হয়ে। অনবদ্য গিটার প্লেয়িংয়ে টেলফার গাচ্ছিলেন বিটলস-পূর্ব সময়ের ব্যান্ড মিউজিক শাসন করা ‘দি শ্যাডো’ এর জনপ্রিয় আর্টিস্ট ক্লিফ রিচার্ডের একটি জনপ্রিয় গান।
রবের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল ৩০০ টাকা দিয়ে কেনা একটি ইলেকট্রিক গিটার আর এ্যাম্প। এবারে দলবেঁধে গাইবার পালা।
পরের বছর রবের সঙ্গী হলেন গিটার বাজিয়ে রফিক মাযহার ইসলাম সাজু নামের আরেক স্কুলপড়ুয়া স্বপ্নবাজ। তারপর সুফি রশিদ নামের আরেকজন তাদের দলে ভিড়লেন, তখনো কিন্তু তারা ব্যান্ড গঠন করতে পারেননি। এই তিনজন মিলে স্কুল, কলেজ, পাড়া-মহল্লায় গান গাইতে শুরু করলেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সুফি সঙ্গ ত্যাগ করলে রফিক রিদম গিটার বাজানো শুরু করেন। ঢাকার বিখ্যাত নবাব বাড়ির ছেলে খাঁজা সাব্বির কাদের ড্রামসেট নিয়ে ঢুকে গেলেন এই চক্রে। অবশেষে ১৯৬৪ সালে ব্যান্ড গঠন হয়, নাম রাখা হয় ‘আইওলাইটস (Iolites)’।
তখন পর্যন্ত তাদের দলে কোনো ভোকালিস্ট ছিল না, এরপর আলমগীর হক নামে এক ছেলেকে পাওয়া গেল। এই সেই আলমগীর হক যিনি আশির দশক থেকে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় গায়কদের একজন, উর্দু পপস্টার, অনেকে যাকে প্রাচ্যের ‘এলভিস প্রিসলি’ বলে ডাকেন।
কোক স্টুডিওতে তার গাওয়া বাংলা-উর্দুর মিশেলে ‘আমায় ভাসাইলি রে’ গানটা হয়তো অনেকেই শুনেছেন। তিনি একাধিকবার বাংলাদেশে গান গাইতেও এসেছেন। আলমগীর ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬/৬৭ সাল পর্যন্ত এই ব্যান্ডে ছিলেন। এরপর বড় গায়ক হবার স্বপ্ন নিয়ে করাচি চলে যান।
আরো যেসব ব্যান্ড ছিল
সেই একই সময়ে, অর্থাৎ ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র সাফাত আলী তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ‘জিংগা শিল্পী গোষ্ঠী’ নামে গানের দল গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এদেরকে সেই অর্থে ব্যান্ড বলা যায় না, এরা ছিলো পারিবারিক ঘরানার অর্কেস্ট্রা দল। ১৯৬৪ সালে সাফাত আলীর বোন নাজমা আলী (নাজমা জামান) আর সাহেলা পারভীন গায়ক হিসেবে দলে যোগ দেন। মূলত এই দুজনের পারফর্মেন্সের জন্যই জিংগার নাম খুব অল্প সময়ের মধ্যেই চারিদিকে ছড়িয়ে গিয়েছিল।
১৯৬৪ সালে ঢাকায় টিভি চ্যানেল চালু হবার পরের বছরেই জিংগা সেখানে প্রথম পপগানের অনুষ্ঠান করে। এরা মূলত টেলিভিশন প্রোগ্রামই বেশি করতো। সে সময়ে জিংগার হাত ধরে বাংলা গানের নতুন ধারা আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
১৯৬৫ সালে ঢাকার বাইরে ব্যান্ড সংগীতকে সচল করতে এগিয়ে আসেন আরেক স্কুলপড়ুয়া বালক ফরিদ রশিদ। তিনি চট্রগ্রামে ‘লাইটেনিংস’ নামে একটি ব্যান্ড গঠন করেন। এই ব্যান্ডে নোয়েল মেন্ডিজ রিদম গিটার বাজাতেন, নিও মেন্ডিজ বাজাতেন ড্রামস-কিবোর্ড, লিড গিটারে ছিলেন শাকিল আর দলনেতা রশিদ বাজাতেন বেজ গিটার। চার সদস্যের এই ব্যান্ড প্রথমে চট্টগ্রামের হোটেল আগ্রাবাদে বাজাতো, এরপর তারা শহরের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, পাড়া-মহল্লায়ও বাজাতে শুরু করেন। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে ব্যান্ডটির কার্যক্রম শেষ হয়ে যায়।
এ সময় ঢাকায় ‘র্যাম্বলিং স্টোন’ নামে একটি ব্যান্ড বেশ জনপ্রিয় হতে শুরু করে। জাফর ইকবাল, ফারুক, তোতা, মাহমুদ, কাইয়ুম ছিল এই ব্যান্ডের সদস্য। জাফর ইকবাল শৈশব থেকে আদর্শ মানতেন এলভিস প্রিসলিকে। ক্লাস সেভেনে থাকা অবস্থায় প্রথম গিটার বাজানো শুরু করেন। ১৯৬৬/৬৭ সালে এরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের চাম্বেলি রুমে নিয়মিত বাজাতে শুরু করে। একপর্যায়ে জাফর ইকবাল গান ছেড়ে অভিনয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন, পরবর্তীতে তিনি সেই সময়ের বাংলা সিনেমার অন্যতম সেরা নায়ক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে চর্চা করার জায়গা পুড়ে যাওয়ার কারণে ব্যান্ড ভেঙে যায়।
এছাড়া নারায়ণগঞ্জের জালাল আবেদিন ‘বকলম’ নামে একটি ব্যান্ড গঠন করেন। যদিও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বকলম ভেঙে যায়, টিভি প্রোগ্রামে জিংগা শিল্প গোষ্ঠীর হয়ে জালাল নিয়মিত গিটার বাজাতে শুরু করেন। সে সময় নারায়ণগঞ্জেই ‘ফায়ার অন আইস’ নামে আরেকটি ব্যান্ডের কথা শোনা যায়। এই ব্যান্ডের সদস্য ছিলেন সেলিম আলম, রেজা আহমেদ, ছোটন ইসলাম ও হাবিব জাফরুল্লাহ মিঠু।
১৯৬৭ সালে রবিনসহ আরো কয়েকজন মিলে ‘টাইম এগো ইমোশন’ গঠন করেন। র্যাম্বলিং স্টোনের কয়েকজন সদস্য যোগ দেয়ার ফলে এই ব্যান্ড সে সময় বেশ আলোড়ন তোলে। তাছাড়া ১৯৬৯/৭০ সালের দিকে এনিটা, সীমা, জাহাংগীর, ইকবাল হায়দার, স্বপন, রতন, জ্যাকব, ইব্রাহিম মিলে চট্রগ্রামে গঠন করেন ব্যান্ড ‘স্পাইডার’। এসবের পাশাপাশি আরো বেশ কিছু ব্যান্ড গঠন করার চেষ্টা চালানো হয়, কিন্তু সেসব আর আলোর মুখ দেখেনি।
কার্যক্রম
১৯৬৫ সাল থেকে ‘আইওলাইটস’ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিয়মিত পারফর্ম করতে শুরু করে। তখন প্রতিটি বড় বড় হোটেলেই গানবাজনার ব্যবস্থা ছিল, যদিও স্বাভাবিকভাবে কোথাও বাংলা গান গাওয়া হতো না। বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিকের শুরুর দিকে এই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ছিল সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক। ইন্টারকনের ছোট ডায়াসে গানবাজনা হতো, যেটা ‘চাম্বেলি রুম’ নামে পরিচিত ছিল। এই চাম্বেলি রুম ব্যান্ড মিউজিক বিস্তারের ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
ইন্টারকনে শো করার আগেই ‘আইওলাইটস’ শাহবাগ হোটেল (বর্তমান পিজি হাসপাতাল) ও ঢাকা ক্লাবে শো করতো। ১৯৬৫ সালে বিটিভিতে ৩০ মিনিটের একটি প্রোগ্রামে ‘আইওলাইটস’ ইন্সট্রুমেন্টাল পরিবেশন করেছিল। এরপর হাদী নামে এক প্রযোজকের হাত ধরে এই ব্যান্ডের পারফরমেন্সের মাধ্যমেই এদেশের টিভি চ্যানেলে প্রথমবারের মতো ‘ব্যান্ড শো’র সম্প্রচার শুরু হয়।
১৯৬৭ সালে বর্তমান ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে বাংলাদেশে প্রথম টিকিটের বিনিময়ে কনসার্টের আয়োজন করেছিল আইওলাইটস। কনসার্টের ব্যপ্তিকাল ছিল ঘণ্টা তিনেক। সে বছরই ব্যান্ডের নাম পাল্টে হয়েছিল ‘উইন্ডি সাইড অব কেয়ার’। তারা এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে ‘৬৭ সাল পর্যন্ত তাদের ব্যাংক একাউন্টে তৎকালীন ২৭ হাজার টাকা জমা হয়েছিল। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে প্রতি শো’তে তারা পেত ৭৫০ টাকা, প্রবেশমূল্য ছিল ৫ টাকা। সেই সময়ের ৭৫০ টাকা এখন কত টাকা হয় হিসেব করে ফেলুন!
১৯৬৮ সালে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সেই চাম্বেলি রুমে ‘সেরা ব্যান্ড’ নির্বাচনের জন্য প্রতিযোগীতা হয়েছিল, যেখানে উইন্ডি সাইড অব কেয়ার (আইওলাইটস) ছাড়াও র্যাম্বলিং স্টোন, লাইটনিংস ও ইনসেটস ডিউ নামে মার্কিন মুলুকের এক ব্যান্ড সহ আরো কয়েকটি ব্যান্ড নাম লিখিয়েছিল। প্রতিযোগীতায় সবাইকে হারিয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যান্ডের তকমা জিতেছিলো উইন্ডি সাইড অব কেয়ার বা আইওলাইটস। আর ব্যান্ডের ড্রামার খাজা সাব্বির শ্রেষ্ঠ মিউজিশিয়ান নির্বাচিত হয়েছিল।
তখন ইএমআই রেকর্ড কোম্পানি তাদের অ্যালবাম বের করার প্রস্তাব দিয়েছিল, উইন্ডি সাইড অব কেয়ার এই প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেছিল। ফর্টি ফাইভ আরপিএম-এ অ্যালবাম বের হয়েছিল, যেটা ছিল বাংলাদেশের কোনো ব্যান্ডের প্রথম অ্যালবাম। তারা মূলত পশ্চিমা মিউজিকের সাথে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশীয় মিউজিককে একত্রিত করেছিলেন তিনটি ইনস্ট্রুমেন্টাল ট্র্যাকে।
উপসংহারের বদলে
যে যাত্রার শুরু হয়েছিল ১৯৬৩ সালে, ১৯৬৯ সালে সেই যাত্রা কয়েক বছরের জন্য থেমে যায় বৃহত্তর স্বার্থে। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান শুরু হলে গোটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেমে যায়। তারপর শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধে সংগীতের সাথে জড়িত অনেকে গিটার, ড্রামস আর কিবোর্ড ফেলে হাতে রাইফেল তুলে নেন।
এ পর্যন্ত সময়কে বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসের প্রথম পর্ব বলা যায়। অবশ্য তাদের সে সময়ের কোনো সৃষ্টি সেভাবে এখন আর আমাদের মাঝে নেই, তবে তারা ঠিকই আছেন আমাদের ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসের পাতায় অনুপ্রেরণা হয়ে ।