Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভ্যাসিলি আরখিপভ: সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধ থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর নেপথ্য নায়ক?

সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের। অক্ষশক্তিকে পুরোপুরি পরাজিত করে বিশ্বে অপ্রতিরোধ্য মিলিটারি শক্তি হিসেবে জায়গা করে নেওয়া আমেরিকা ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে তখন পৃথিবীর বুকে এককাধিপত্য বিস্তারের এক শীতল লড়াই শুরু হয়েছে, যাকে আমরা স্নায়ুযুদ্ধ নামে জানি।

এই স্নায়ুযুদ্ধের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যায় হিসেবে ধরা হয় কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস। যার ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৯৬২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত। সোভিয়েত গোপনে কিউবাতে নিউক্লিয়ার মিসাইল স্থাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন তথ্য আমেরিকান সিক্রেট সার্ভিসের কানে আসা থেকেই মূলত ঘটনার শুরু।

যদিও সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন ফাস্ট সেক্রেটারি নিকিতা ক্রুশ্চেভ কিউবার অনুরোধেই এটা করছিলেন, কিন্তু এর পেছনে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল- আমেরিকাকে চাপে রাখা এবং তুরস্ক ও ইতালিতে স্থাপিত আমেরিকার জুপিটার ব্যালিস্টিক মিসাইলকে প্রতিহত করা।

আমেরিকার তৎকালীন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির নিকট রাশিয়ার মুখ্য উদ্দেশ্য একেবারেই পরিস্কার ছিল না। তবে আমেরিকা থেকে মাত্র ৯০ মাইল দূরের কিউবাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক মিসাইল থাকাটা আমেরিকার নিরাপত্তার জন্য কতটা হুমকির কারণ, তা নিশ্চয়ই বলবার অপেক্ষা রাখে না।

কিউবা থেকে আমেরিকার যে যে শহরগুলোতে খুব সহজে পারমাণবিক হামলা করা সম্ভব; Image Source: Smithsonian.com

সিআইএ কিউবার ওপর নজরদারি বাড়াতে থাকে। দুই দেশের মাঝে উত্তাপ আরো একধাপ বেড়ে যায়, যখন রাশিয়া আমেরিকার স্পাই প্লেন কিউবাতে ভূপাতিত করে। এটা ছিল ইউ-২ মডেলের একটি স্পাই এয়ারক্রাফট, যা প্রথমবারের মতো কিউবাতে সোভিয়েত, তথা রাশিয়ার নির্মাণাধীন পারমাণবিক অবকাঠামোর ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছিল। যার দ্বারা আমেরিকা পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে যায় যে, রাশিয়া পারমাণবিক মিসাইল স্থাপন করছে।

ইউ-২ স্পাই এয়ারক্রাফট থেকে পাওয়া কিউবাতে নির্মাণাধীন নিউক্লিয়ার ফ্যাসিলিটির ছবি; Image Source: allthatsinteresting.com

প্রেসিডেন্টের নির্দেশে মার্কিন সৈন্যরা কিউবার নৌপথে কঠোর নজরদারি স্থাপন করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সবরকম জাহাজ কিউবাতে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

ততদিনে এই স্নায়ুযুদ্ধ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেওয়ার একেবারে দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। দুই দেশের এই রেষারেষি যে শুধু স্থলেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, বরং এসবের উত্তাপ ক্যারিবীয় সাগরকেও অশান্ত করে তোলে। বিশেষ করে যখন আমেরিকার রণতরী ইউএসএস বেইল-এর রাডারে রাশিয়ান সাবমেরিন ধরা পড়ে।

পেন্টাগন হয়ে এ খবর চলে যায় প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির কাছে। প্রেসিডেন্ট নির্দেশ দেন, সতর্কতাস্বরূপ নন-লিথাল অস্ত্র ব্যবহার করতে, যাতে কোনো হতাহতের ঘটনা না ঘটে।

যে সাবমেরিনটির ওপর আমেরিকা আক্রমণ করতে যাচ্ছিল, সেটি ছিল রাশিয়ার বি-৫৯ সাবমেরিন। বি-৫৯ বুঝতে পেরেছিল যে, তারা আমেরিকান রেডারে ধরা পড়ে গেছে। রাডারকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য তারা আগের তুলনায় সাগরের আরও বেশি গভীরে ড্রাইভ করতে থাকে।

কিন্তু এতে কোনো লাভ হয় না।  ইউএসএস বেইল, বি-৫৯-কে উদ্দেশ্য করে ডেপথ চার্জেস ছুঁড়তে আরম্ভ করে। ডেপথ চার্জ আসলে পানির ভেতর গ্রেনেডের সমান শক্তিশালী একটি নৌ-অস্ত্র, যার ক্রমাগত প্রয়োগে কোনো সাবমেরিনকে ডুবিয়ে দেওয়া সম্ভব।

কিন্তু ইউএসএস বেইল থেকে ছোঁড়া ডেপথ চার্জেসগুলো সবই ছিল নন-লিথাল। আমেরিকা মূলত চাচ্ছিল, রাশিয়ান সাবমেরিনটিকে পানির ওপরে ভাসিয়ে একে ফেরত পাঠাতে। কিন্তু আমেরিকা যেটা জানতো না সেটি হলো, বি-৫৯-এ ছিল নিউক্লিয়ার টর্পেডো!

এবার আসা যাক বি-৫৯ এর কাছে। এটা ক্যারিবিয়ান সাগর দিয়ে যাত্রা করছিল কিউবার উদ্দেশ্যে। আমেরিকান রাডারে ধরা পড়ার পর ক্যাপ্টেন সাবমেরিনটিকে আরও গভীর দিয়ে  ড্রাইভ করাতে থাকে। কিন্তু ক্যাপ্টেনের এই সিদ্ধান্ত সাবমেরিনটির জন্য বিপদ বয়ে আনে।

কিউবার নৌপথে পাহারারত আমেরিকান বহর; Image Source: mirror.co.uk

প্রথমত, তারা আমেরিকান রণতরীগুলোর রাডারকে ফাঁকি দিতে রীতিমত ব্যর্থ হয়, এবং দ্বিতীয়ত, সাগরের অনেক গভীরে থাকার কারণে মস্কোর সাথে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এরকম পরিস্থিতির ভেতরে সাবমেরিনটি আক্রমণের শিকার হয়।

বি-৫৯ এর ক্যাপ্টেন ভ্যালেটিন স্যাভিটস্কির তখন নাস্তানাবুদ অবস্থা। কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসের সময়টিতে আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে ক্রমাগত সম্পর্কের অবনতির ফলে সামরিক বাহিনীর অনেকেই ধারণা করেছিলেন, খুব দ্রুতই দুটি দেশের মঝে যুদ্ধ হতে পারে।

ভ্যালেটিন স্যভিটস্কি ভাবলেন, যুদ্ধ হয়তো শুরু হয়ে গেছে। যার কারণে আমেরিকা তাদের সাবমেরিনের ওপর আক্রমণ করেছে। তিনি আশঙ্কা করেন, আমেরিকান যুদ্ধ জাহাজগুলোর ক্রমাগত আক্রমণের ফলে বি-৫৯ নিমেষেই সাগরের বুকে তলিয়ে যাবে। এ অবস্থায় তার কাছে মাত্র একটিই রাস্তা খোলা ছিল, আর তা হলো নিউক্লিয়ার টর্পেডোর ব্যবহার।

ইউএস ন্যাশনাল সিকিউরিটি আর্কাইভের একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা আছে, স্যাভিটস্কি বলেন,

আমরা এবার তাদেরকে (আমেরিকান যুদ্ধজাহাজ) ধ্বংস করবো। আমরা মরতে চলেছি, কিন্তু আমরা ওদেরকেও ডুবিয়ে মারবো। আমরা নৌবহরের লজ্জা হয়ে উঠবো না।”

বি-৫৯ যে নিউক্লিয়ার টর্পেডো বহন করছিল, সেটি ছিল হিরোশিমাতে ফেলা পারমাণবিক বোমা লিটল বয়-এর সমান শক্তিশালী। স্যাভিটস্কি তার ক্রুদের টর্পেডো ক্ষেপণের প্রস্তুতি নিতে বলেন। প্রটোকল অনুসারে, সাবমেরিন থেকে টর্পেডো ক্ষেপণ করতে হলে সাবমেরিনে থাকা তিনজন ক্যাপ্টেনেরই সম্মতির প্রয়োজন পড়ে। ভ্যালেটিন স্যাভিটস্কি তার সাথে থাকা বাকি দুজন ক্যাপ্টেনের অনুমতি চান।

সাবমেরিনটিতে থাকা দ্বিতীয় ক্যাপ্টেন ইভান ম্যসলেন্নিকভ স্যাভিটস্কির সিদ্ধান্তে সম্মতি প্রকাশ করেন। কিন্তু তৃতীয় ক্যাপ্টেন এ ব্যাপারে অসম্মতি জানান এবং টর্পেডো ক্ষেপণ করতে বাঁধা দেন। এই লোকটিই ছিলেন ভ্যাসিলি আরখিপভ।

তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আমেরিকান ডেসট্রয়ারগুলো থেকে ওয়ার্নিং হিসেবে নন-লিথাল ডেপথ চার্জেস ছোঁড়া হচ্ছে, যাতে করে তারা কিউবা না যায়।

এটা অজানা যে, আরখিপভ কিভাবে স্যাভিটস্কিকে নিউক্লিয়ার টর্পেডো ব্যবহার না করার জন্য রাজি করিয়ে ছিলেন, কিন্তু আরখিপভের সাথে কথা বলার পর স্যাভিটস্কি আর টর্পেডো ক্ষেপণ করতে চাননি, বরং ড্রাইভিং গভীরতা কমিয়ে সাবমেরিনটিকে পানিতে ভাসানোর নির্দেশ দেন।

পানিতে ভাসমান বি-৫৯ এবং একটি আমেরিকান হেলিকপ্টার; Image Source: warshipsifr.com

ভ্যসিলি আরখিপভ যেভাবে পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচালেন

রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে ঐ সময়ে চলতে থাকা দ্বন্দ্বের মধ্যে যদি বি-৫৯ আমেরিকার কোনো যুদ্ধজাহাজকে পারমাণবিক অস্ত্র দ্বারা আক্রমণ করতো, তবে আমেরিকা কোনোভাবেই চুপ করে বসে থাকতো না। তারা সর্বপ্রথম তাদের নিউক্লিয়ার মিসাইল দ্বারা আক্রমণ করতো মস্কোতে!

এর বিপরীতে রাশিয়া তাদের নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডগুলো ব্যবহার করতো লন্ডনের ইস্ট অ্যাঞ্জেলিনা বিমানঘাঁটি এবং তুরস্ক ও ইতালির কিছু সামরিক লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করতে। যাতে আমেরিকা তার মিত্র দেশগুলোর থেকে কোনো সাহায্য পেতে না পারে।

এই হামলার জবাবে আমেরিকা তাদের নিজস্ব পরমাণু যুদ্ধের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতো এবং চীনসহ রাশিয়ার অন্যান্য মিত্র দেশগুলার শত শত লক্ষ্যবস্তুতে তাদের মজুদ রাখা হাজার হাজার পারমাণবিক অস্ত্র দ্বারা হামলা করতো।

হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে মাত্র দুটি বোমার আঘাতে প্রাণ হারায় প্রায় ২ লক্ষেরও বেশি মানুষ। যদি সত্যিই পৃথিবীর বুকে এমন ভয়াবহ পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হতো, তবে নিমেষেই শেষ হয়ে যেত লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ। কোটি কোটি মানুষ হতো আহত, আর যারা বেঁচে থাকতো, তারাও বাস করতো ভয়াবহ তেজষ্ক্রিয়তার মধ্যে।

বিশ্ব ইতিহাস পাল্টে যেতো পুরোপুরিভাবে। আমাদের দেশটার জন্ম হবার আগেই হয়তো পরিণত হতো পারমাণবিক ধ্বংসস্তুপে। আর আমাদের পূর্বসুরীরাই যদি বেঁচে না থাকতো, ভাবুন তো আমাদের অস্তিত্ব কোথায় যেত!

আর এই সবকিছুই ভ্যাসিলি আরখিপভ থামিয়ে দিয়েছিলেন টর্পেডো ক্ষেপণে বাঁধা প্রয়োগ করে।

যুবক বয়সে ভ্যাসিলি; Image Source: The Guardian

অপ্রশংসিত এক নায়ক ভ্যাসিলির পরবর্তী জীবন ও মৃত্যু

আমেরিকানদের কাছে রীতিমতো আত্মসমর্পণ করে ফিরে আসাটা তৎকালীন সোভিয়েত নেতাদের কাছে লজ্জাজনক মনে হয়েছিল। যার ফলে আরখিপভ তার নিজ দেশের নেতাদের নিকট সমালোচিত হন। এবং এই ঘটনা লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যায়।

শেষ জীবন পর্যন্ত ভ্যাসিলি সোভিয়েত নৌবাহিনীতেই কর্মরত ছিলেন এবং  ১৯৯৮ এর ১৯ আগস্ট কিডনি ক্যান্সারে আক্রান্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তার ক্যান্সারের পেছনে কারণ ছিল সাবমেরিন দুর্ঘটনার ফলে নির্গত তেজষ্ক্রিয় রশ্মি।

আমেরিকার কাছ  থেকে সম্মাননা পাওয়া

­আমেরিকানরা প্রথম ভ্যাসিলি আরখিপভের এই ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারে ৫০ বছর পরের এক পুনর্মিলনীতে। সাবেক সোভিয়েত কর্মকর্তা ও ঐ সময়টাতে আরকিখিপভের ক্রু মেম্বারদের একজন, ভাদিম অরলভ জানান বি-৫৯ একটা ১০ কিলোটনের নিউক্লিয়ার টর্পেডো বহন করছিল।

এর আগপর্যন্ত আমেরিকানদের ধারণা ছিল না, যে সাবমেরিনটাকে তারা ফিরে যেতে বাধ্য করেছিল, সেটা তাদের জন্য কত বড় ক্ষতির কারণ হতে পারতো। তারপর থেকেই বিশ্ববাসী আরখিপভের কীর্তি সম্পর্কে অবগত হয়। আমেরিকানরাও স্বীকার করে নেয় আরখিপভের এই মহৎ কর্মের ফলে বিশ্ব এক মহাপ্রলয় থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিল

মৃত্যুর ১৯ বছর পর আরখিপভকে আমেরিকার একটি সংগঠন ‘ফিউচার অব লাইফ’ পুরস্কারে ভূষিত করে।

পুরস্কারটি গ্রহণ করে আরখিপভের কন্যা ইলিনা এন্ড্রিউকোভা তার বাবার সম্পর্কে বলেন,

“তিনি সবসময় ভাবতেন, যা তিনি করেছেন তা তার কাজের অংশ এবং কখনো সেটাকে বীরত্ব বলে বিবেচনা করেননি। তিনি এমন একজন মানুষ হিসেবে কাজটি করেছেন, যিনি জানতেন, রেডিয়েশন থেকে কতটা ধবংস ঘটানো সম্ভব! তিনি এই কাজটি করেছেন ভবিষ্যতের কথা ভেবে, যাতে আমরা এই গ্রহটিতে বেঁচে থাকতে পারি।”

ফিউচার অব লাইফ পুরস্কার হাতে আরখিপভের কন্যা ইলিনা এন্ড্রিউকোভা; Image Source: warshipsifr.com

ভ্যাসিলি আরখিপভ ঐ সময়টাতে যে দূরর্দশী সিদ্ধান্ত নিয়ে পৃথিবীকে এক নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন, তার জন্য বিশ্ববাসী যুগ যুগ ধরে তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।

Related Articles