Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

তুরস্ক-ইসরায়েলের বৈচিত্র্যময় কূটনৈতিক সম্পর্কের আদ্যোপান্ত

ফিলিস্তিন ভূখণ্ড বিভক্ত করে ইহুদি এবং ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর জন্য দুটো আলাদা রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য জাতিসংঘে আনীত প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল তুরস্ক। তবুও, ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর ১৯৪৯ সালের ২৮ মার্চ বিশ্বের প্রথম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে তুরস্কই। এই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে দেশ দুটোর মধ্যে সূচিত হয় কূটনৈতিক সম্পর্ক। তবে, আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি ইসরায়েল তেল আবিব শহরে তুরস্ক দেশটিতে প্রথম কূটনৈতিক মিশন স্থাপন করে।

১৯৫৬ সালে ইসরায়েল কর্তৃক মিশরের সিনাই উপদ্বীপে আক্রমণ এবং সুয়েজ খাল দখল করার চেষ্টা চালানোর প্রতিক্রিয়ায় তুরস্ক ইসরায়েল থেকে কূটনৈতিক মিশন প্রত্যাহার করে নেয়। সেসময় তুর্কি দূতাবাসের অস্থায়ী প্রধান হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন একজন ‘চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স’ পদমর্যাদার কূটনীতিক। ১৯৫৮ সালের আগস্ট মাসে ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেনগুরিয়ান এক ‘গোপন সফরে’ তুরস্কে পৌঁছান। সেই সফরে তিনি তুরস্কের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্ডেরেসের সাথে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে দুই প্রধানমন্ত্রী দেশ দুটোর মধ্যে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং সামরিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করার ব্যাপারে সম্মত হন। ১৯৬৩ সালে তুরস্ক এবং ইসরায়েলের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়। ফলে তুরস্ক দেশটিতে চলমান কূটনৈতিক মিশন ‘কনস্যুলেট’ পর্যায়ে উন্নীত করে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে আরব দেশগুলোর সাথে ইসরায়েলের যুদ্ধ সেই সময় তুরস্ক এবং ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল জেরুজালেম শহরসহ আরব ভূখণ্ডের বিশাল অঞ্চল দখল করে নিলে তুরস্ক দেশটির এই দখলদারিত্বের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। পাশাপাশি, দখলকৃত ভূখণ্ড অবিলম্বে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য দেশটির প্রতি আহবান জানায়। তবে আরব দেশগুলোর দাবি সত্ত্বেও তুরস্ক ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেনি।

১৯৬৯ সালে পবিত্র আল আকসা মসজিদে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তুরস্ক তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়; image source : Getty Images

১৯৬৯ সালের ২১ আগস্ট কয়েকজন উগ্র জায়নবাদী কর্তৃক দখলকৃত জেরুজালেমের পবিত্র আল আকসা মসজিদে অগ্নিসংযোগের ঘটানোর প্রেক্ষাপটে তুরস্কসহ পুরো মুসলিম বিশ্বে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ১৯৭৫ সালে তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)–কে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৮০ সালে ইসরায়েলে তুরস্কের কূটনৈতিক মিশন সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায়। সেইসময় তুরস্ক দেশটিতে ‘অ্যাম্বাসেডর’ তথা রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের একজন কূটনীতিক নিয়োগ দেয়। তবে, ১৯৮০ সালে ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেমের কিছু অংশ দখল করে জেরুজালেমকে দেশটির রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করলে দেশটির সাথে তুরস্কের কূটনৈতিক সম্পর্কের আবারও অবনতি ঘটে। তবে ১৯৮৬ সালে দেশ দুটোর মধ্যে আবারও কূটনৈতিক সম্পর্কের খানিকটা অগ্রগতি হয়। সেই সময় তুরস্ক দেশটিতে ‘চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স’ পদমর্যাদার একজন কূটনীতিক নিযুক্ত করে।

১৯৮৭ সালে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথম ‘ইন্তিফাদা’ অর্থাৎ, ফিলিস্তিনি গণজাগরণ শুরু হলে তুরস্ক সরকার ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করে। ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আলোচনার এই পর্যায়ে ইসরায়েল এবং তুরস্কের প্রতিনিধিরা বৈঠক করে নিজেদের মধ্যকার মতপার্থক্য নিরসনের চেষ্টা করেন। ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক চলমান থাকাবস্থায়ই ১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর তুরস্ক ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। তুরস্ক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি প্রদানকারী বিশ্বের প্রথমদিককার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।

১৯৯১ সালে ‘মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া’ শুরু হলে তুর্কি–ইসরায়েল কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারও উন্নত হতে শুরু করে। ১৯৯৪ সালের ২৫ জানুয়ারি ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট ইজার ওয়েজম্যান তুরস্ক সফর করেন। একই বছরের ৩রা নভেম্বর তুরস্কের প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী তানসু সিলার দেশটির সরকারপ্রধান হিসেবে সর্বপ্রথম ইসরায়েল সফরে যান। এরপর ১৯৯৬ সালের ১১ মার্চ তুরস্কের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সুলেমান ডেমিরেল রাষ্ট্রীয় সফরে ইসরায়েল পৌঁছান। দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের এসব ধারাবাহিক সফর এবং দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে আরও জোরালো হয় তুরস্ক-ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক। ১৯৯৪-৯৮ সালের মধ্যে দেশ দুটোর মাঝে স্বাক্ষরিত হয় নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি চুক্তি।

২০০৫ সালের পহেলা মে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ইসরায়েল সফরে পৌঁছালে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারন তাকে স্বাগত জানান; image source: TRT World and Agencies

২০০০ সালে প্রভাবশালী ইসরায়েলি রাজনীতিবিদ, এবং পরবর্তীতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারন জেরুজালেমের পবিত্র আল আকসা মসজিদ চত্বরে সফরের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় দ্বিতীয় ‘ইন্তিফাদা’ শুরু হলে তুর্কি–ইসরায়েল কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারও অবনতি হয়। ২০০৩ সালের ১৪ মার্চ তুরস্কের জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির নেতা রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পূর্বসূরীদের পথে হেঁটেছেন। তিনি ২০০৫ সালের পহেলা মে ইসরায়েল সফরে পৌঁছান। সেই সফরে তিনি দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারনের সাথে দুই দেশের বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে করেন দ্বিপাক্ষিক বৈঠক। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে এরদোয়ান ইসরায়েল এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মধ্যে শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেন।

Israeli President Shimon Peres addresses the Turkish Parliament during his visit to Ankara on November 13, 2007.
২০০৭ সালের ১৩ নভেম্বর ইসরায়েলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজ তুরস্কের পার্লামেন্ট অধিবেশনে বক্তব্য রাখার বিরল সুযোগ অর্জন করেছিলেন; image source: TRT World and Agencies

২০০৬ সালে ইসরায়েল লেবাননে হামলা শুরু করলে তুরস্ক এই হামলার ঘটনায় দেশটির বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানায়। ২০০৭ সালের ১১ নভেম্বর ইসরায়েলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজ তুরস্ক সফরে আসেন। সেই সফরে তুরস্কের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এবং দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুলের সাথে বৈঠক করার পাশাপাশি শিমন পেরেজ তুরস্কের পার্লামেন্ট অধিবেশনে বক্তব্য রাখার বিরল সুযোগ অর্জন করেন। ২০০৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় সাধারণ ফিলিস্তিনিদের উপর হামলা শুরু করলে তুরস্ক এই ইসরায়েলি বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ইসরায়েলি এই নৃশংস হামলায় ১,৪০০ জনেরও বেশি বেসামরিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়।

২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম’ এর একটি আলোচনায় রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তার ঠিক পাশে বসা ইসরায়েলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজের বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে সম্মেলন থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন; image source: Anadolu Agency

২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি সুইজারল্যান্ডের দাভোস শহরে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম’-এর একটি আলোচনায় ইসরায়েলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজ গাজা উপত্যকায় দেশটির হামলার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরলে সেই আলোচনায় শিমন পেরেজের ঠিক পাশে বসা তুরস্কের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সেই বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন, এবং কথা বলার জন্য অপেক্ষাকৃত কম সময় বরাদ্দ পাওয়ার অভিযোগ তুলে সেই আলোচনা থেকে হেঁটে বের হয়ে যান।

২০১০ সালের ৩১ মে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করা তুর্কি ত্রাণবহরের জাহাজ ‘মাভি মার্মারা’য় ইসরায়েলি কমান্ডো হামলায় তুরস্কের ন’জন নাগরিক নিহত হওয়ার দেশ দুটোর মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ২০১১ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর তুরস্ক দেশটি থেকে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে। ২০১৩ সালের ২২ মার্চ রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সাথে এক ফোনালাপে ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তুর্কি ত্রাণবহরের জাহাজে হামলার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারও স্বাভাবিক করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ২০১৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ইসরায়েল তুরস্ক সরকারের দাবি মেনে নিয়ে তুর্কি ত্রাণবহরের জাহাজে হামলার ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের নিকট ক্ষতিপূরণ প্রদান করে। ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রকর্তৃক ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমকে স্বীকৃতি এবং মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরের উদ্যোগ গ্রহণের একতরফা ঘোষণাকে তুরস্ক প্রত্যাখ্যান করেছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের আহবানে ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ওআইসির বিশেষ সম্মেলন থেকে ২০১৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

Israeli President Herzog visits Ankara
২০২২ সালের ৯ মার্চ ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হেরজগ তুরস্ক সফরে গিয়ে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সাথে বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন; image source: Reuters

সম্প্রতি, ২০২২ সালের ৯ মার্চ ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হেরজগ তুরস্ক সফর করেছেন। এই সফরে তিনি তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সাথে বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। ইসরায়েলি প্রেসিডেন্টের এই সফর দেশ দুটোর মধ্যে বিদ্যমান মতপার্থক্যগুলো নিরসন করে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরালো করতে সহায়ক হতে পারে।

Related Articles