প্রায় একশ বছর আগে সংগঠিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বদলে দেয় পৃথিবীর মানচিত্র, আমূল পরিবর্তন আনে মানব সভ্যতার গতিপথে। প্রায় ১ কোটি সামরিক এবং ৭০ লক্ষ বেসামরিক মানুষ নিহত হয় ৪ বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে। শুধু হতাহতের সংখ্যাই নয়, আরো বেশ কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পাই এই যুদ্ধে। এই যুদ্ধকে সবচেয়ে বেশি যেটা আলাদা করে সেটা হলো ট্রেঞ্চ যুদ্ধ (Trench Warfare)। এছাড়া, এই যুদ্ধে প্রথম গ্যাস বোমা ব্যবহার করা হয়, বিমান হামলা শুরু হয়, সাবমেরিন ব্যবহার করা হয়। জার্মানি ও ফ্রান্সের ১৫-৬৫ বছর বয়সী ৮০% পুরুষ প্রত্যক্ষভাবে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এই যুদ্ধকে বলা হতো “War to end all war”। তবুও যুদ্ধ শেষে সংঘটিত শান্তি চুক্তি ইন্ধন যোগায় ৩০ বছর পর শুরু হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। এই যুদ্ধ শেষে ভেঙে যায় অটোম্যান সাম্রাজ্য, রাশিয়ায় শুরু হয় কমিউনিজমের যাত্রা।
সর্বোপরি, এই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি যেটা আমাদেরকে বিস্মিত করে সেটা মানুষের সহ্যক্ষমতা। কতটা প্রতিকূল পরিবেশে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে? মানুষের শারীরিক-মানসিক সহ্যক্ষমতার সীমা কোথায়? সেই সাথে আমাদের আশ্চর্য করে যে— যুদ্ধ মানুষের জীবনের মূল্যকে কোন পর্যায়ে নামিয়ে দেয়। রাজ্যের সীমানা এক মাইল বাড়ানোর জন্য কতগুলো জীবনকে বলিদান করা যায়!
আপাতদৃষ্টিতে, বিশ্বব্যাপী ৪ বছর ধরে চলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু করার জন্য অনুঘটক ধরা যায় ১৯ বছর বয়সী এক স্লাভ যুবককে। গ্যাব্রিয়েল প্রিন্সেপ একজন স্লাভ জাতীয়তাবাদী। তার স্বপ্ন ছিল বসনিয়াকে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য থেকে মুক্ত করে সার্বিয়ার সাথে যুক্ত করা। ১৯১৪ সালের ২৮ জুন, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান যুবরাজ ফার্ডিন্যান্ড ও তার স্ত্রীকে বসনিয়ার সারায়েভো শহরে গুলি করে হত্যা করে প্রিন্সেপ। বর্তমানের প্রেক্ষাপটে এরকম ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলা চলে। কিন্তু কীভাবে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা একটি বিশ্বযুদ্ধ শুরু করতে পারে সেটা বুঝতে গেলে আমাদের ঐসময়ের ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলোর পাওয়ার ডাইনামিক্স বুঝতে হবে।
বর্তমান যুগে আমরা সুপার-পাওয়ার বলতে একটি বা সর্বোচ্চ দুটি রাষ্ট্রকে বুঝি। কিন্তু ১৯১৪ সালে, শুধু ইউরোপেই সুপার-পাওয়ার রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের তালিকায় ছিল কমপক্ষে ৪টি রাষ্ট্র— ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স ও রাশিয়া। এছাড়াও ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য, আর অটোম্যান সাম্রাজ্য। এতগুলো শক্তিশালী রাষ্ট্র পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করবে সেটার সম্ভবনা ক্ষীণ। তৎকালীন রাজনীতিবিদরা সেটা মাথায় রেখে শুরু করে জোট গঠন। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অন্যতম বন্ধুতে পরিণত হয় জার্মান সাম্রাজ্য। অন্যদিকে জার্মানির চিরশত্রু ফ্রান্স— মিত্রতা করে রাশিয়া, আর ব্রিটেনের সাথে। উল্লেখ্য, জার্মানির পশ্চিম সীমান্তে ফ্রান্স, আর পূর্ব সীমান্তে রাশিয়া থাকায়, তারা শত্রু দিয়ে ঘেরাও হয়ে পরে।
এবারে আসা যাক ১৯১৪ সালের জুন-জুলাই মাসের ঘটনাপ্রবাহে। যুবরাজ ফার্ডিন্যান্ডকে হত্যার জন্য অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়া দায়ী করে সার্বিয়াকে। সার্বিয়া ছোট অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্র হলেও চাইলেই সার্বিয়া আক্রমণ করতে পারে না অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়া। কারণ, সার্বিয়ার বন্ধু শক্তিশালী রাশিয়া। সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা মানে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে জড়ানো। তাই অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়া আগে তাদের মিত্র জার্মানির সমর্থন নিশ্চিত করে নেয়। জার্মানি ধারণা করে, রাশিয়ার সৈন্যবাহিনী সার্বিয়ার সাহায্যে পৌঁছানোর আগেই সার্বিয়ারকে হারিয়ে ফেলা সম্ভব। তাই জার্মানি গোপনে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়াকে সমর্থন দেয়। ২৮ জুলাই অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়া সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
সার্বিয়া স্বভাবতই রাশিয়ার কাছে সাহায্য চায়, জবাবে রাশিয়া সেনা প্রস্তুতি শুরু করে। জার্মানি রাশিয়াকে সেনা প্রস্তুতি বন্ধ করতে বলে। রাশিয়া রাজি না হওয়ায় জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ১লা আগস্ট। এখন জার্মানি যায় ফ্রান্সের কাছে, জানতে চায় তাদের অবস্থান। ফ্রান্স জানায় তারা নিরপেক্ষ। কিন্তু ফ্রান্সের সাথে রাশিয়ার সমঝোতা চুক্তি আছে। তাই নিশ্চয়তাস্বরূপ জার্মানি ফ্রান্সের কাছে জার্মানি-ফ্রেঞ্চ সীমান্তে অবস্থিত সব ফ্রেঞ্চ দুর্গের চাবি চায়। ফ্রান্স সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করে। জার্মানি যুদ্ধ ঘোষণা করে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ৩রা আগস্ট। শান্তি বজায় রাখার জন্য গঠন করা জোট ইউরোপকে টেনে নিয়ে যায় এক মহাযুদ্ধের দিকে।
জার্মানি বহুদিন আগে থেকেই এইরকম যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে আসছে, যেখানে তাদের পূর্বে রাশিয়া আর পশ্চিমে ফ্রান্সকে মোকাবিলা করতে হবে। গবেষণা অনুযায়ী, দুই সীমান্তে একসাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া জার্মানির পক্ষে সম্ভব না। ফলে তারা এমনভাবে যুদ্ধ পরিকল্পনা আটে যাতে তাদের একসাথে দুই সীমান্তে যুদ্ধ করতে না হয়। রাশিয়া বিশাল রাজ্য হওয়ায়, তাদের সৈন্য জড়ো করে জার্মান সীমান্তে আক্রমণ করতে কিছুদিন সময় লাগবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই সময়ের মধ্যে জার্মানিকে তাদের সর্বশক্তি দিয়ে ফ্রান্স দখল করে ফেলতে হবে। এরপর তারা তাদের শক্তি কেন্দ্রীভূত করবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। ফলে তাদের একসাথে দুই সীমান্তে যুদ্ধ করতে হবে না। জার্মান সেনা গবেষকরা হিসাব কষে বের করে, তাদের হাতে ৯৫০ ঘণ্টা সময় থাকবে, যার মধ্যে তাদের ফ্রান্সকে হারিয়ে রাশিয়ানদের মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু ফ্রান্সের মতো শক্তিশালী রাজ্যকে এত কম সময় হারানো তো সহজ কথা না। তার উপর জার্মান-ফ্রেঞ্চ সীমান্তে আছে ফ্রান্সের অনেকগুলা আধুনিক শক্তিশালী দুর্গ। তাই জার্মানি সরাসরি ফরাসি সীমান্তে আক্রমণ না করে পশ্চিমে বেলজিয়ামের ভিতর দিয়ে ফ্রান্সকে আক্রমণ করবে। এই পরিকল্পনা বিখ্যাত শ্লিফেন প্ল্যান (Schlieffen plan) নামে পরিচিত। যুদ্ধের শুরুতে জার্মান বাহিনী এই শ্লিফেন প্ল্যান অনুযায়ী এগোতে থাকে।
বেলজিয়ামকে জার্মানি নিশ্চয়তা দেয় যে, তারা বেলজিয়াম আক্রমণ করবে না যদি তাদের সেনাবাহিনীকে বিনা বাধায় বেলজিয়ামের ভেতর দিয়ে ফ্রান্স যেতে দেওয়া হয়। বেলজিয়াম এই আহবান প্রত্যাখ্যান করে। যুদ্ধের একেকটা সিদ্ধান্তের কী পরিণতি হয়েছিল, সেটা গবেষণা করলে আমরা বুঝতে পারি সিদ্ধান্তগুলো ভুল ছিল না ঠিক ছিল। এই যুদ্ধে দুই পক্ষই অনেক ভুল পদক্ষেপ নেয়, যা যুদ্ধকে অনেক প্রলম্বিত করে, ও লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়। যুদ্ধ শুরুর এই পর্যায়ে তাদের প্রথম ও সবচেয়ে বড় ভুল করে জার্মানি। ৩রা আগস্ট জার্মানি বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, এবং তাদের বিশাল বাহিনী নিয়ে বেলজিয়ামের ভেতর দিয়ে ফ্রান্সের দিকে এগোতে শুরু করে।
এখনো পর্যন্ত যুদ্ধে নিরপেক্ষ ছিল ব্রিটেন। যে সময়ের কথা হচ্ছে, ঐসময় ব্রিটেনের সাম্রাজ্য ছিল বিশাল। দুনিয়ার এক-চতুর্থাংশ ছিল তাদের দখলে। অর্থনৈতিক দিক দিয়েও তারা ছিল প্রতাপশালী। তাদের সেনাবাহিনী জার্মানির মতো শক্তিশালী না হলেও তাদের ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী নৌবাহিনী। কোনো দেশই চায়নি ব্রিটেন তাদের বিপক্ষ শক্তি হোক। সঙ্কটের শুরুতে ব্রিটেনও নিরপেক্ষই থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু ব্রিটেনের সাথে বেলজিয়ামের চুক্তি আছে, কোনো রকম বিপদে বেলজিয়ামকে সেনা সুরক্ষা দেবে ব্রিটেন। তাই জার্মানি যখন বেলজিয়ামের বিরোধিতা সত্ত্বেও, বেলজিয়ামের ভেতর দিয়ে সেনা চালনা শুরু করে, তখন উপায়ান্তর না থাকায় ৪ঠা অগাস্ট জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ব্রিটেন।
যুদ্ধ শুরুর আগে ইউরোপের হর্তাকর্তারা এটা বুঝতে পারছিল যে, গোটা ইউরোপ এক ভয়ানক পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই ভয়াবহতার মাত্রা সম্পর্কে ধারণা ছিল না কারোই। তৎপরিস্থিতি ছিল— বিগত ৪০ বছরে ইউরোপে বড় কোনো যুদ্ধ হয়নি। যেগুলো হয়েছিল, সেখানে একপক্ষ ছিল অনেক বেশি শক্তিশালী, অন্যপক্ষ দুর্বল। ইতোমধ্যে ইউরোপ জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক এগিয়েছে। আধুনিক অনেক অস্ত্র পৌঁছেছে সৈনিকদের হাতে, যেগুলোর ব্যাপক ব্যবহার আগে হয়নি। উদাহরণ হিসেবে প্রথমে বলতে হয় মেশিনগানের কথা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে মেশিনগান স্বল্প পরিসরে কিছু যুদ্ধে ব্যবহার হয়, এবং যুদ্ধ জয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে মেশিনগান প্রযুক্তির অনেক উন্নয়ন হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকের মেশিনগান মিনিটে ৪০০-৬০০ গুলি করতে সক্ষম ছিল। যুদ্ধের শেষের দিকে এই ক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এরপর আসা যাক অশ্বারোহী (cavalry) বাহিনীর ভূমিকায়। আজ থেকে ৫ হাজার বছর আগে, যখন থেকে মানুষ সাম্রাজ্যে বাস শুরু করে, তখন থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগপর্যন্ত অশ্বারোহী বাহিনী ছিল যেকোনো সৈন্যবাহিনীর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মেশিনগানের আবির্ভাবে অশ্বারোহী বাহিনী অকেজো হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল ট্যাঙ্ক। এই যুদ্ধের শেষের দিকে ট্যাঙ্কের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়, এবং যুদ্ধকে এর অন্তিম পরিণতির দিকে নিয়ে যায়।
যুদ্ধের প্রকৃত রূপ কী হতে যাচ্ছে— সেই সম্পর্কে প্রথমবারের মতো বিশ্ববাসী ধারণা পায় বেলজিয়ামের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাওয়া জার্মান বাহিনী দেখে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জার্মান আর্মিকে বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম সেরা আর্মি বলা চলে। তাদের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে ধারণা পেতে কিছু তুলনা তুলে ধরা যাক। বিশ্বজয়ী আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট, যিনি গ্রীস থেকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিলেন, তার সৈন্যবাহিনী ছিল সর্বোচ্চ ৮০ হাজার। এটি ২ হাজার বছর আগের কথা। ১৮১২ সালে যখন নেপোলিয়ন তার ‘গ্র্যান্ড আর্মি’ নিয়ে রাশিয়া আক্রমণ করে, তখন তার সৈন্য সংখ্যা ছিল ৫ লাখ। বেলজিয়ামের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাওয়া জার্মানির সৈন্যসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ। এত সংখ্যক মানুষ এক উদ্দেশ্যে একদিকে ধাবিত হওয়ার ঘটনা মানব সভ্যতার ইতিহাসে এর আগে ঘটেনি। এক বহমান নদীর মতো এগিয়ে চলে এই বাহিনী। অবিচ্ছিন্ন, সংগঠিত, ও সংঘবদ্ধ এই বাহিনীকে দেখলে চমৎকৃত না হয়ে উপায় নেই।
যে বেলজিয়ামের ভেতর এত কিছু শুরু হয়েছে, তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যুদ্ধের এই পর্যায়ে। বেলজিয়াম বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা কম হলেও তাদের ছিল আধুনিক কিছু দুর্গ। জার্মানি ধারণা করেছিল, বেলজিয়াম বাহিনী হয়তো তাদের সৈন্যসংখ্যা দেখে সরে দাঁড়াবে। কিন্তু যদি বেলজিয়াম বাহিনী প্রতিরোধ তৈরি করে, তাহলে সেটা মোকাবেলা করতে জার্মানি ৩০ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী প্রস্তুত করে। এদের কাজ ছিল আগে গিয়ে বেলজিয়ান দুর্গগুলো দখল করে নেওয়া। এই বাহিনীই প্রথম মেশিনগানের ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়। দলে দলে তারা এগোতে থাকে দুর্গগুলোর দিকে, আর ঝাঁঝরা হতে থাকে মেশিনগানের গুলিতে। লাশের স্তূপ এত উঁচু হয়ে যায় যে সেটা একপর্যায়ে ঢালের মত কাজ করে জার্মান বাহিনীর জন্য। দুর্ভেদ্যই রয়ে যায় দুর্গগুলো।
হাজার হাজার লাশের পাহাড় তৈরি হওয়ার পর জার্মান বাহিনী বুঝতে পারে, তাদের পন্থা বদলাতে হবে। তারা এমন এক অস্ত্র নিয়ে আসে যার ধারেকাছে কিছু দুনিয়া এর আগে দেখেনি। কামান এর আগে অনেক যুদ্ধেই ব্যবহার হয়েছে, কিন্তু যুদ্ধের এ পর্যায়ে জার্মানি যে কামান নিয়ে আসে সেটা অন্যমাত্রার। একশ বছর আগের নেপোলিয়নের করা যুদ্ধে ব্যবহৃত কামানের ওজন ছিল ৫০০ কেজি। সেটা যে গোলা ছুড়ত, তার ওজন ছিল ৫.৫ কেজি আর সেটা ২ কি.মি. দূর পর্যন্ত গোলা ছুড়তে পারত। বেলজিয়ামে ব্যবহৃত সর্ববৃহৎ জার্মান কামানের গোলার ওজন ছিল নেপোলিয়ন আমলের কামানের ওজনের চেয়েও বেশি। আর সেসব গোলার পাল্লা ছিল ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত। ভয়ঙ্কর এই মারণাস্ত্র আবারও প্রমাণ করে যে, যন্ত্রের সামনে মানুষ কত অসহায়। সেই সাথে জার্মান ইঞ্জিনিয়ারিং কোন পর্যায়ের সেটাও ধারণা করা যায়। এতই শক্তিশালী ছিল এই কামান যে, গোলা ছোড়ার আগে গোলন্দাজকে ৩টি ফুটবল মাঠের সমান দূরে যাওয়া লাগত। শুধু তা-ই না, গোলা ছোড়ার সময় তাদের চোখ, কান আর নাকে তুলা দিয়ে রাখা লাগত, এবং মুখ হা করে থাকা লাগত যাতে তাদের কানের পর্দা ফেটে না যায়।
এই কামানের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করার কোন উপায় বেলজিয়ামের ছিল না। তাদের দুর্গগুলো ভেঙে পড়তে থাকে। জার্মান বাহিনী বেলজিয়ামের প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম হলেও, বেলজিয়ামে তাদের অনেক বড় দুটো ক্ষতি হয়। প্রথমত, বেলজিয়ামের দুর্গগুলোর কারণে জার্মানির ফ্রান্স আক্রমণ বিলম্বিত হয়। আগেই বলা হয়েছে, জার্মানির হাতে সময় কম। পশ্চিমে তাদের যত দেরি হবে, পূর্বে রাশিয়া তত এগিয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, বিশ্ব দরবারে তাদের ভাবমূর্তি ধূলিসাৎ হয়ে যায়। নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বেলজিয়ামে জার্মানি শুধু সামরিক আক্রমণ চালায়নি, বেসামরিক অনেক পুরুষ, নারী, এবং শিশুকে নির্যাতন ও হত্যা করে। জার্মানি এই নির্মম হত্যাকাণ্ড চালায় বেলজিয়ামকে তাদের অসহযোগিতার জন্য শিক্ষা দিতে। যেসব জায়গায় পৌঁছে তারা ব্রিজ বা রাস্তা ভাঙা পায়, সেই জায়গার আশেপাশের গ্রামে তারা তাণ্ডব চালায়। উদ্দেশ্য ছিল যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এই কাজ না করে। এসব হত্যার কাহিনী বিশ্ব মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, অনেক ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিতভাবে। ফলে অনেক নিরপেক্ষ দেশে জার্মানির বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হতে থাকে, যেটা যুদ্ধের শেষের দিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
যুদ্ধের ভয়াবহতা যখন উন্মোচিত হতে শুরু করেছে, তখন যুদ্ধের ময়দানে থাকা জার্মান বাহিনীর মানসিক অবস্থা ভেবে দেখা যাক। দেশের জন্য যুদ্ধ করা বলতে তৎকালীন মানুষের মনে ভেসে আসত— ঘোড়া ছুটিয়ে তরবারি নিয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়া। ইতিহাস যুদ্ধকে একটা রোমান্টিক রূপ দিয়ে এসেছে বহুকাল ধরেই। কিন্তু শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার আগেই মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়ার মধ্যে রোমান্টিকতা কোথায়? বীরত্ব, শক্তি, রণকৌশল, সবকিছুই মূল্যহীন হয়ে পড়ে আধুনিক অস্ত্রের সামনে। আজ যারা বেঁচে গেল তারা বুঝতে পারে, কাল হোক, পরশু হোক, একদিন না একদিন কোনো এক অজানা শত্রুর গুলিতে তাদেরও একই পরিণতি হবে। মৃত্যুর মাঝে বসবাস তাদের, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা।