প্রিয় আবদুল্লাহ (নিয়াজি), আমি এখন মিরপুর ব্রিজে। আপনার প্রতিনিধি পাঠান।
১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর সকালে ঢাকার পাক শিবির চমকে যায় এই চিরকুট পেয়ে। ভারতীয় মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরা নিয়াজিকে এক চিরকুট পাঠান। পরে তারা এক বৈঠকে বসেন। ভারতীয় সেনা কম্যান্ড বার বার পাক সেনাদের মনে করিয়ে দিচ্ছিল মুক্তিবাহিনী বা কাদেরিয়া বাহিনী ঢাকায় ঢুকে পড়লে কী অবস্থা হবে তাদের।
পরের ইতিহাস সবারই জানা। মুক্তিবাহিনীর ভয়ে পাক বাহিনী তড়িঘড়ি করে আত্মসমর্পণ করে। পাক হাই কম্যান্ড যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল তার আগের দিনই। কিন্তু বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বড় এলাকা এবং বিচ্ছিন্নভাবে আরো কিছু পাক ও তাদের অনুগত মিলিশিয়া পজিশন তখনো আত্মসমর্পণ করেনি।
যুদ্ধের শেষদিকে পাকিস্তানিদের যোগাযোগ ভেঙ্গে পড়ায় অনেক জায়গায় উপর মহলের নির্দেশ পৌঁছায়নি। দ্বিতীয়ত অনেক পাক ঘাঁটি ধরে নিয়েছিল এটা হয়তো সাময়িক আত্মসমর্পণ। যুদ্ধের মোড় হয়তো আবার ঘুরবে। যুদ্ধে তারা পরাজিত- এটা অনেকেই মেনে নিতে পারছিল না।
এরকম অনেকগুলো আত্মসমর্পণ না করা অবস্থানের মধ্যে একটা হলো ধানমন্ডি ৩২ নম্বর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি। ২৫শে মার্চ রাতেই বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হবার পর এখানে কড়া পাহারা বসায় পাক বাহিনী। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরকে কেন্দ্র করে কয়েক স্তরে নিরাপত্তা সাজায় তারা। ছাদে বালির বস্তা দিয়ে বাংকারের মতো বানানো হয়। ভেতরে ভারি মেশিনগান। বাড়ির টেরাসেও বাংকার খুঁড়ে তারা। গেটের পাশে বসে ভারি অস্ত্র। আশেপাশেও কয়েকটা মেশিনগান স্থাপন করে। গৃহবন্ধী করা হয় মুজিব পরিবার। গৃহবন্ধী বলা হলেও বাস্তবিক অর্থে তারা ছিল জিম্মি। প্রতি মুহূর্তেই আতংক গ্রাস করে নিত এই পরিবারটিকে।
বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে অবস্থান নেওয়া সেনাদের ওই এলাকার প্রতিরক্ষা ছেড়ে বাইরে যাবার সুযোগ ছিল না। ফলে বাইরের জগতে কী হচ্ছে সে সম্পর্কে তারা ছিল একেবারেই অজ্ঞ। পালা করে কয়েকটা সেনাদল এলাকা টহল দিত কিন্তু কেউই বাইরে যেত না। অন্যান্য সব পাক সেনাদের মতোই জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মের নামে মিথ্যা বুলি ব্যবহার করে তাদের মস্তিষ্ক ধোলাই করা হয়েছিল। কিন্তু অন্যান্য সেনাদের সাথে তফাৎ ছিল এই যে, যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা সেনারা দ্রুতই বুঝে যায় তাদের দিয়ে নিরীহ লোকজনকে হত্যা করা ছাড়া আর কিছুই করানো হচ্ছে না। অন্যদিকে ধানমন্ডিতে অবস্থান নেওয়া সেনা দলটি ছিল একেবারে বিছিন্ন। যার কারণে তারা তাদের আগ্রাসী মনোভাব ধরে রেখেছিল।
১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। ধানমন্ডির সেনা দলের কম্যান্ডিং অফিসার ২/৩ দিন আগে লাপাত্তা হয়ে গেছে। এদিকে বেতার যোগাযোগ না থাকায় তারা আত্মসমর্পণের নির্দেশও পায়নি। এশিয়ার স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠ বাহিনীর সিনিয়র অফিসাররা জুনিয়রদের ফেলেই পালিয়ে গেছে। আতংকের বিষয় ওই সেনাদলের কাছে মুজিব পরিবার বন্দী।
আত্মসমর্পণের নির্দেশ না এলেও ১৬ তারিখ দুপুর থেকে ঢাকায় ঘনঘন ভারতীয় বিমান আর মুক্তিবাহিনীর চলাফেরা দেখে তারা কিছু আঁচ করতে পারছিল। এদিকে মুক্তিবাহিনী ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ঘিরে ফেলে। কিন্তু সামনে আগানোর সাহস পাচ্ছিল না। খুলনায় তখন আত্মসমর্পণ না করা পাকসেনাদের বিরুদ্ধে তীব্র যুদ্ধ চলছে।
আর এখানে ধানমন্ডির হিসাবটা একেবারেই অন্যরকম। অস্ত্র বা বীরত্বের চেয়ে ঠাণ্ডা মাথার দরকার এখানে অনেক বেশি। পাক সেনারাদের মেজাজ সামান্য বিগড়ে গেলেই বা সামান্যতম সন্দেহ পেলেই তারা হত্যা করতে পারে মুজিব পরিবারকে।
ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দর। ১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা এবং প্রশাসনিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ১৪ গার্ড কোম্পানিকে। কোম্পানি কম্যান্ডার তরুণ ভারতীয় অফিসার মেজর অশোক কুমার তারা (পরে কর্নেল)। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে যুদ্ধ করে ফিরেছেন তিনি। সামরিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গঙ্গাসাগর। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এমন কোনো সপ্তাহ নেই যে এখানে যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি। গঙ্গাসাগর যুদ্ধে অবদান রেখে এই তরুণ অফিসার বীর চক্র উপাধি পেয়েছেন। তার ডাক পড়ল আবার।
ব্যাটালিয়নের কমান্ডার বিজয় কুমার চান্নার কাছে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে এক রাজনৈতিক নেতা। মুজিব পরিবার এখনো বন্ধী। পাক সেনাদের আচরণ খুবই হিংস্র। চান্না ডেকে পাঠান অশোক তারাকে। মুজিব পরিবারকে উদ্ধার করতে হবে তাকে। ভেতরে বেগম মুজিব, বঙ্গবন্ধুর পুত্র কন্যারা আটকে আছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর মাত্র ২০ মিনিটের দূরত্ব। সেই রাজনৈতিক নেতা আর ৩ জন সেনা নিয়ে জিপে চেপে বসেন অশোক তারা।
মুক্তিবাহিনী জানালো আগের দিন রাতে ১ জন নারী সহ ৫ জনকে হত্যা করেছে পাক সেনারা। তাদের সীমানা ভেঙে সামনে এগিয়ে যাওয়াতে এক সাংবাদিকের গাড়ি লক্ষ করেও গুলি চালায় পাক বাহিনী। গাড়ির ভেতরেই পড়ে ছিল সেই গুলিতে ঝাঁজরা সাংবাদিকের মরদেহ।
অশোক তারা তার অস্ত্রটি জওয়ানের হাতে তুলে দেন। হাত উঁচু করে রাস্তা পার হতে শুরু করেন। ছাঁদ থেকে হুঁশিয়ার আসে। এক পা এগোলেই গুলি করা হবে। মেশিনগানটা একবার ফায়ার শুরু করলে কভার নেওয়ার কোনো জায়গা পর্যন্ত নেই।
অশোক তারা জোর গলায় জানালেন তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন অফিসার। তিনি বিনা অস্ত্রে এসেছেন। তারপর তিনি বলেন “আমি এখানে অস্ত্র ছাড়া এসেছি কারণ তোমাদের বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। তুমি অফিসারের কাছ থেকে জেনে নাও।” তখনই জানা গেল তাদের অফিসার লাপাত্তা। রেডিও যোগাযোগও নেই। অশোক তারা আকাশে ওড়া ভারতীয় হেলিকপ্টারও দেখেন। তিনি কিন্তু তখনো হাঁটা থামাননি।
এরপর তিনি জানালেন আত্মসমর্পণ করলে তাদের নিরাপদে দেশে যেতে দেয়া হবে। তাদের পরিবার, স্ত্রী সন্তানের মুখ তারা দেখতে পারবে। আত্মসমর্পণ ছাড়া তাদের জীবনের নিশ্চয়তার আর কোনো রাস্তা নেই। উল্লেখ্য পাক সেনাদের ধারণা ছিল মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশনে বর্ণিত নীতিমালা অনুযায়ী আচরণ করা হবে না এবং তাদের হত্যা করা হবে।
একপর্যায়ে হেঁটে হেঁটে গেটের কাছে পৌঁছে যান অশোক তারা। সেন্ট্রি বন্দুকের নল ঠেকিয়ে বসে তার বুকে। চোখ বন্ধ করে গুলির অপেক্ষায় প্রমাদ গুনছিলেন তিনি।
“আপনি যদি আমাদের না বাঁচান তবে ওরা আমাদের নিশ্চিত মেরে ফেলবে।” বাড়ির ভেতর থেকে এক নারী কণ্ঠের চিৎকার! তিনি যেন নতুন এক উদ্যম পেলেন। তার হেরে যাওয়া চলবে না। এই পরিবারকে উদ্ধার করতে হবে।
ছাদের উপর থাকা সেনার সাথে কথা বলতে বলতেই বুক থেকে বন্দুক সরিয়ে ফেলেন তিনি। সেনারাও বুঝতে শুরু করে আত্মসমর্পণই তাদের একমাত্র রাস্তা। মুজিব পরিবারের সামান্য আঁচড় লাগলেও মুক্তিবাহিনী তাদের ছাড়বে না। শেষ পর্যন্ত ১০/১২ জন সেনা আত্মসমর্পণ করে। ব্যারাকে ফেরত পাঠানো হয় তাদের।
বাড়িতে ঢুকতেই বেগম মুজিব তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন “তুমি আমার পোলা বাবা।” তারার বর্ণনা অনুযায়ী বাড়িতে কোনো আসবাবপত্র ছিল না। মেঝেতে ঘুমাতো সবাই। খাবার ছিল শুধু বিস্কুট আর পানি।
বঙ্গবন্ধু মুক্তি পাবার আগেই অশোক তারা মিজোরামে ফেরত যান। পরে বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়ে দেশে আসার পর আবার তিনি বাংলাদেশে এসে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করেন। ২০১২ সালে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর তাকে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সন্মাননা পদক’ প্রদান করে বাংলাদেশ সরকার।
এত ব্যস্ততার মধ্যে যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাকে মনে রেখেছেন তাতে খুবই খুশি এই বীর সেনা। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাদের অবদানের জন্য আয়োজিত সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুলে ধরেন অশোক তারার বীরত্বের গল্প।