Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: খিলজী শাসনামল

দাস রাজবংশের শেষ শাসক মুইজউদ্দীন মুহাম্মদ কায়কোবাদ এর পতনের পর ১২৯০ চূড়ান্তভাবে পতন ঘটে হিন্দুস্তানের দাস শাসনামলের। তবে তাঁর মৃত্যুর পর আবারো সিংহাসন নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। আর এই সিংহাসন জয়ের দৌড়ে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হন খিলজী বংশের জালালউদ্দীন মালিক ফিরোজ খিলজি। তুর্কি, আরব, পারস্য আর ভারতীয় অভিজাত মুসলিমদের সমর্থনে তিনি দিল্লির সিংহাসন অর্জন করতে পেয়েছিলেন। ১২৯০ সালের ১৩ জুন দিল্লির তিনি সুলতান হিসেবে দিল্লির সিংহাসন অধিকার করেন। এ সময় জালালুদ্দীন খিলজীর বয়স ছিলো ৭০ বছর!

শিল্পীর কল্পনায় সিংহাসনে উপবিষ্ট সুলতান জালালউদ্দীন মালিক ফিরোজ খিলজি; সূত্র: wikipedia.org

খিলজি রাজবংশের আদি পরিচয় নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি আছে। পূর্বে মনে করা হতো, এই রাজবংশের উদ্ভব হয়েছে আফগানিস্তান থেকে। কিন্তু আধুনিক মত অনুযায়ী, খিলজিরা মূলত মধ্য এশিয়ার তুর্কিস্তানের অধিবাসী ছিলেন। তুর্কীস্তান থেকে তাঁর পূর্বপুরুষরা আফগানিস্তানে চলে আসেন। তবে তারা দীর্ঘদিন আফগানিস্তানে অবস্থান করায় তাদের আচার আচরণ অনেকটা আফগানদের মতো ছিলো। যে কারণে তাদের আফগানিস্তানের অধিবাসী ভাবা হতো।

জালালউদ্দীন খিলজি ও তাঁর ভাই শিহাবুদ্দীন প্রাথমিক জীবনে দীর্ঘদিন সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের অধীনে কর্মরত ছিলেন। দাস রাজবংশের শেষ সুলতান মুইজউদ্দীন কায়কোবাদের অধীনে জালালউদ্দীন একজন গুরুত্বপূর্ণ অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু সুলতান মুইজউদ্দীন মুহাম্মদ কায়কোবাদ পক্ষাঘাতগ্রস্থ হলে রাজদরবার কায়কোবাদের ৩ বছরের পুত্র কায়ুমারসকে সিংহাসনে বসায়। হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে দরবারের সভাসদরা জালালুদ্দীনকে হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু অন্যান্য অভিজাত সম্প্রদায়ের সমর্থনে জালালউদ্দীন তাদের এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন এবং নিজেই দিল্লি সালতানাতের সিংহাসনে আরোহণ করেন।

জালালউদ্দীন মালিক ফিরোজ খিলজি ক্ষমতায় বসে প্রশাসন পুনর্গঠিত করেন। তিনি তাঁর আস্থাভাজন, বিশ্বস্ত আর দক্ষ লোকদের প্রশাসনে নিয়োগ দেন। তবে সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের প্রশাসনের অনেক অফিসারকেই তিনি তার প্রশাসনে বহাল রেখেছিলেন। এছাড়া, তিনি তার পরিবারের লোকদেরও প্রশাসনে নিয়োগ দেন। তার ভাই ইয়াগরাশ খান ‘আরিজ-ই-মামালিক’ পদে নিয়োগ পান। এই পদটি বর্তমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সমতুল্য। ভ্রাতুষ্পুত্র আহমদকে ‘নায়েব-ই-বারবাক’ পদ পান। নিজের বড় পুত্র মাহমুদকে ‘খান-ই-খানান’ পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়া, আরেক ভ্রাতুষ্পুত্র আলি গারশাপকে ‘আমির-ই-তুজুক’ পদে তিনি নিয়োগ দেন।

জালালউদ্দীন মালিক ফিরোজ খিলজির সময় মঙ্গোলরা ঘন ঘন হিন্দুস্তানে অভিযান চালাতে থাকে। সুলতান মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে লড়াই করে হিন্দুস্তানের নিরাপত্তা বজায় রাখেন। ১২৯২ সালে মঙ্গোলরা হালাগু খানের নাতি আব্দুল্লাহ-এর নেতৃত্বে হিন্দুস্তানের উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে আক্রমণ করে। তবে, ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানীর মতে আবদুল্লাহ হালাগু খানের নাতি ছিলেন। আর ‘তারিক-ই- মুবারক শাহী’র বর্ণনানুযায়ী আবদুল্লাহ খোরাসানের কোনো এক রাজপুত্র ছিলো। এ সময় সামানা, মুলতান আর দিপালপুরের দায়িত্ব ছিলেন জালালউদ্দীনের পুত্র আরকালি খান। কিন্তু জালালউদ্দীন মালিক ফিরোজ খিলজি নিজে মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে অভিযানে এগিয়ে যান। দুই বাহিনীই সিন্ধু নদের তীরবর্তী বাররাম নামক স্থানে মিলিত হয়। যুদ্ধে মঙ্গোলরা পরাজিত হয়। তারা জালালউদ্দীনের সাথে চুক্তি করতে বাধ্য হয়।

এখানে একটা মজার ব্যাপার ঘটে যায়। হালাগু খানের আরেক নাতি, উলঘু খান ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে লখনৌতে বসবাসের অনুমতি লাভ করেন। উলঘু খানের সাথে আরো অনেক মঙ্গোলই ইসলাম গ্রহণ করে হিন্দুস্তানে স্থায়ী হয়ে যায়। হিন্দুস্তানে এসব মুসলিমদের ‘নতুন মুসলিম’ নামে ডাকা হতো।

সুলতান জালালউদ্দীন খিলজির সময়ের মুদ্রা; সূত্র: coinindia.com

সুলতান জালালউদ্দীন খিলজীর সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ন অভিযান হচ্ছে রণথম্বোরে আক্রমণ চালানো। রণথম্বোরের রাজপুত রাজা হামিরা তার নতুন রাজ্যবিস্তার নীতি গ্রহণ করলে দিল্লি সালতানাতের অধিকারে থাকা আজমির আর হরিয়ানা হুমকির মুখে পড়ে। ফলে বাধ্য হয়ে জালালউদ্দীন খিলজি রণথম্বোরে আক্রমণ চালান।

জালালউদ্দীন রেওয়ারি আর নারনাউল হয়ে আলোয়ারে হামলা চালান। প্রায় চার মাস চেষ্টার পর তিনি মান্দাওয়ারের দুর্গগুলো দখল করে নিতে সক্ষম হন। মান্দাওয়ারের অভিযান চলাকালীন সময়েই সুলতান জালালউদ্দীনের পুত্র ‘খান-ই খানান’ মাহমুদ মৃত্যুবরণ করেন। ১২৯১ সালে সুলতান জালালউদ্দীন ঝাইন অবরোধ করেন। এই শহরটি রণথোম্বরের খুব কাছাকাছি অবস্থিত। ঝাইন অবরোধের যুদ্ধে সেনাপতি গারদান সাইনির মৃত্যুর পর ঝাইন দুর্গের চূড়ান্ত পতন ঘটে। ঝাইন দুর্গ অবরোধে প্রায় ১,০০০ চাহামানা সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে দিল্লি সেনাবাহিনীর মাত্র ১ জন তুর্কী সৈন্য নিহত হয়।

ঝাইন দুর্গ দখলের পর জালালউদ্দীন তাঁর সেনাবাহিনীকে রণথম্বোরের দিকে মার্চ করার নির্দেশ দেন। তিনি নিজে এই যুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন। ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানী বলেন, সুলতান একদিন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিজ চোখে দেখার জন্য পরিদর্শনে বের হন। যুদ্ধের প্রস্তুতি দেখার পর তিনি হঠাৎ করে অভিযান পরিত্যাক্ত ঘোষণা করেন। জেনারেলরা হতভম্ভ হয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তর দেন, যুদ্ধটি কঠিন হতে যাচ্ছে। প্রচুর মুসলিম এই যুদ্ধে নিহত হবে। আর এরকম দশটি দুর্গ দখলের জন্য আমি একজন মুসলিমের মাথার একটি চুলও উৎসর্গ করতে রাজী না। এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ভাতিজা আহমেদ এসে জালালউদ্দীনকে বলেন, এই পরিস্থিতিতে এসে অভিযান সমাপ্ত করলে শত্রুরা আরো দুঃসাহসী হয়ে উঠবে। তিনি জালালউদ্দীনকে গজনীর মাহমুদ আর সেলজুক সুলতান আহমেদ সানজার কথা মনে করিয়ে দেন, যারা তাদের মনের সামান্য আবেগকেও প্রশ্রয় না দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কিন্তু তারপরও বৃদ্ধ জালালউদ্দীন নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। দিল্লি সেনাবাহিনীর রণথম্বোর অবরোধ ব্যর্থ হলো।

এমন ঘটনা আরো বেশ কিছুবার ঘটেছিলো। যার ফলে দরবারের সভাসদরা সুলতান জালালউদ্দীন মালিক ফিরোজ খিলজিকে কিছুটা ভীতু হিসেবে চিহ্নিত করলো। আর এই কারণে তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ষড়যন্ত্র হয়েছিলো। এর ভেতরে তাজউদ্দীন কুচি আর সিদি মাওলা অন্যতম। তবে তাদের বিদ্রোহ সফলতার মুখ দেখতে পারে নি। ১২৯৬ সালে আরেকটি বিদ্রোহে তিনি গুপ্তহত্যার শিকার হন। উলুগ খান, মাহমুদ সালীম ও ইখতিইয়ার-উদ-দ্বীনকে এই হত্যাকন্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া, এই তালিকায় সুলতানের ভাজিতা আলী গারশাপ আর নুসরত খান নামক একজন সভাসদের নামও আছে। এ কথা সত্য যে, এই হত্যাকান্ডের পেছনে আলাউদ্দীন খিলজি জড়িত ছিলেন, এই কথা উপেক্ষা করা যায় না। তবে এর কারণও ছিলো। তাঁর স্ত্রী ও শাশুড়ি আলাউদ্দীনের সাথে দুর্ব্যবহার করতেন। সুলতান নিজেও এই ব্যাপারে চুপ থাকতেন। আর তাই এই দূরবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে তিনি তাদের হাত থেকে স্বাধীনতা চাইতেন। আর তা অর্জনের একমাত্র উপায় হলো বৃদ্ধ সুলতান জালালউদ্দীনের মৃত্যু। এর সাথে যুক্ত হয় রাজদরবারের অসন্তোষ! সুতরাং জালালউদ্দীন মালিক ফিরোজ খিলজিকে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হতে হলো।

দিল্লি সালতানাতের খিলজি রাজবংশের প্রথম সুলতান জালালউদ্দীন মালিক ফিরোজ খিলজির মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র আলী গারসাপ ‘আলাউদ্দীন খিলজি’ নাম নিয়ে দিল্লি সালতানাতের সিংহাসনে আরোহণ করলেন। সমসাময়িক ঐতিহাসিক আমির খসরুর বর্ণনানুযায়ী, দিনটি ছিলো ১২৯৬ সালের ১৯ জুলাই। আর ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানীর মতে, দিনটি ছিলো ২০ জুলাই। কিন্তু সমসাময়িক হওয়ায় আমির খসরুর মতটিই বেশি গ্রহণযোগ্য।

১৭ শতকের দিকে অঙ্কিত সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির একটি তৈলচিত্র; সূত্র: wikipedia.org

আলী গারসাপর তথা সুলতান আলাউদ্দীন খিলজি ১২৬৬ সালে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম শিহাব-উদ-দ্বীন খিলজী। শিহাব-উদ-দ্বীন খিলজি সম্পর্কের দিক দিয়ে জালালউদ্দীন খিলজির বড় ভাই। এদিক দিয়ে সুলতান আলাউদ্দীন খিলজি সুলতান জালালুদ্দীন খিলজির ভ্রাতুষ্পুত্র। আবার সুলতান জালালউদ্দীন খিলজী আলী গারশাপের (সুলতান আলাউদ্দীন খিলজি) সাথে নিজ মেয়ের বিয়েও দেন। অর্থাৎ এই দিক বিবেচনায় হিসাব করলে সুলতান আলাউদ্দীন খিলজি ছিলেন একইসাথে সুলতান জালালউদ্দীনের ভ্রাতুষ্পুত্র এবং জামাতা। ১২৯০ সালে সুলতান জালালউদ্দীন খিলজি তাকে ‘আমীর-ই-তুযুক’ পদে নিয়োগ দেন। এর এক বছর পরই, অর্থাৎ ১২৯১ সালে তিনি সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের এক ভ্রাতুষ্পুত্রের বিদ্রোহ দমন করে সফলতা লাভ করলে জালালউদ্দীন খিলজি তাকে ‘আলা-উদ-দ্বীন’ উপাধি দান করেন। এরপরই তিনি কারার গভর্নরের দায়িত্ব পান।

আলাউদ্দীন খিলজি ছোটবেলা থেকেই একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন। তরবারি কিংবা অশ্ব, দুটো চালানোর ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। একাধারে তিনি ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক, চৌকস জেনারেল আর দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। মৌর্য সম্রাট অশোকের পর তাকেই একমাত্র সম্রাট হিসেবে বিবেচিত করা হয়, যিনি গোটা হিন্দুস্তানকে এক সুতোয় গাঁথতে পেরেছিলেন। তিনি এত বেশি পরিমাণ শহর আর নগর জয় করেছিলেন যে, তাকে সিকান্দার সানি বা দ্বিতীয় আলেক্সান্ডার উপাধীও দেয়া হয়েছিলো!

হিন্দুস্তানের ইতিহাসে বিজেতাদের তালিকা করতে গেলে নিঃসন্দেহে তাঁর নাম উপরের দিকেই থাকবে। একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিজেতা হিসেবে তিনি ১২৯৬ সালে ইলখানী রাজ্যের শিয়া শাসক গাজান মাহমুদকে পরাজিত করে সিন্ধ দখল করেন। ১২৯৯ সালে চাগতাই খান দুয়া খানকে পরাজিত করে পাঞ্জাব নিজের দখলে নেন। ১৩০১ সালে রণথম্বোর, ১৩০৩ সালে চিতোর, ১৩০৫ সালে মান্দু সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির পদানত হয়। এছাড়া তাঁর হাতে নাহান, সিরমুর ও জম্মু আর দেবগিরির পতন হলে অন্যান্য রাজপুত রাজারা তীব্র আতঙ্কে ভুগতে থাকেন। মালবের রাজা মাহালক সুলতানকে বাধাদানের চেষ্টা করতে গিয়ে পরাজিত হন। ফলে মালব সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির পদানত হয়। একইসাথে চান্দেরি আর ধারার পতন ঘটে। ১৩০৮ মারওয়ারের রাজা সতল দেবের পরাজয়ের পর মারওয়ার সুলতানের অধীনে চলে যায়। এরপর মালিক কামালউদ্দীনের নেতৃত্বে জয় করা হয় রাজপুত জালোর রাজ্য। ১৩০৬ আর ১৩০৭ সালে রাজা রায় করণ আর তাঁর মিত্র রাজা রায় রামচন্দ্রকে পরাজিত করা হয়। রাজা রায় রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মালিক কাফুর। তবে পরবর্তীতে রাজা রায়চন্দ্রকে ‘রায় রায়হান’ খেতাব দিয়ে পুনরায় তাকে রাজ্য চালনার অনুমতি দেয়া হয়েছিলো। একইসাথে গুজরাটও তাকে দেয়া হয়েছিলো।

১৩০৯ সালে রাজা রায় রামচন্দ্রের সহায়তায় মালিক কাফুরের নেতৃত্বে বারাঙ্গল জয় করা হয়। বারাঙ্গল অভিযানের সময়ই কাকাতিয়া রাজবংশের রাজা প্রতাপ রুদ্রদেব থেকে আলাউদ্দীন খিলজি বিখ্যাত কোহিনূর হীরাটি অর্জন করেন। ১৩১১ সালে হোয়াসালা রাজা বীর বাল্লালার বিরুদ্ধে অভিযান চালালে রাজা বীর বাল্লালা আত্মসমর্পণ করেন।

১৩০৯ সালে সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির বারাঙ্গল অভিযানে কাকাতিয়া রাজবংশ থেকে সুলতানের হাতে ‘কোহ-ই-নূর’ হীরাটি আসে; সূত্র: diamondphotos.blogspot.com

সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য সুলতান আলাউদ্দীন খিলজি সচরাচর যুদ্ধাভিযানে রাজধানী থেকে খুব বেশি দূরে যেতেন না। সত্যিকার অর্থে তাঁর কোনো প্রয়োজনই পড়ে নি কখনো। কারণ তিনি এত কঠোরতার সাথে শাসন করতেন যে অনেক ক্ষেত্রে তাঁর সেনাবাহিনী দেখামাত্রই প্রতিপক্ষ আত্মসমর্পণ করতো। ব্যাপারটা অনেকটা এমন ছিলো যে, তিনি তাঁর প্রাসাদে বসে আদেশ দিতেন, সাথে সাথে তা গোটা সাম্রাজ্যজুড়ে তা পালন করা শুরু হয়ে যেতো। তিনি তাঁর প্রাসাদে বসে কোনো নতুন আইন জারী করতেন, সাথে সাথে তা সাম্রাজ্যের প্রতিটি কোণায় তা পৌছে যেতো। প্রতি বছরই কোনো না কোনো বিজয়বার্তা রাজধানী এসে পৌছাতো আর সাথে সাথে তা ঘোষণা করে শোনানো হতো। রাজধানীবাসী বিজয়বার্তা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো। সুতরাং এমন শাসককে কেন যুদ্ধের জন্য রাজধানী ছেড়ে দূরে যেতে হবে? তবে মেবার আর রণথম্বোর অভিযানে তিনি নিজে বাহিনীর সাথে ছিলেন। রণথম্বোর অভিযান তাঁর কাছে আলাদা গুরুত্ব পায়, কারণ পূর্ববর্তী সুলতান জালালউদ্দীন খিলজির সময় রণথম্বোরের বিরুদ্ধে দুইটি অভিযান ব্যর্থ হয়। ১২৯৮ সালে তিনি নুসরাত খানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী পাঠালে যুদ্ধে নুসরাত খান নিহত হন। এর ফলে সুলতান নিজেই এগিয়ে যান। ১২৯৯ সালে অবরোধের পর ১৩০১ সালে রণথম্বোর বিজিত হয়। ১২৯৯ সালে উলুগ খানের নেতৃত্বে মেবারে অভিযান প্রেরণ করলে রাণা সমর সিংহ বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে সন্ধি করেন। কিন্তু সমর সিংহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রতন সিংহ বিদ্রোহ করলে দিল্লি থেকে একটি অভিযান পাঠান হয়। কিন্তু অভিযানটি ব্যর্থ হলে সুলতান ১৩০২ সালে আবারো রাজধানী থেকে বের হয়ে আসেন। প্রায় ৮ মাসের অবরোধের পর চিতোরের পতন ঘটে।

হিন্দুস্তানের সামরিক ইতিহাসের বর্ননা করতে গেলে অবধারিতভাবেই বর্বর মঙ্গোলদের কথা চলে আসে। বিভিন্ন সময়ে তাঁরা লুটপাটের উদ্দেশ্যে হিন্দুস্তানে অভিযান চালায়। শুধুমাত্র ১২৯৬-১৩০৮ সালের মাঝেই এই বর্বর মঙ্গোলরা মোট ১৬ বার হিন্দুস্তানে অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু প্রতিবারই তারা হিন্দুস্তানের সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির হাতে পরাজিত হয়ে ফেরত যায়। হিন্দুস্তানের প্রতি আলাউদ্দীন খিলজির অন্যতম একটি অবদান হচ্ছে, তিনি মঙ্গোল আক্রমণের হুমকি থেকে হিন্দুস্তানকে চিরতরে রক্ষা করেছিলেন। পূর্বে মঙ্গোলদের দিল্লি সালতানাতের সুলতানরা এতই ভয় পেতেন যে, খাওয়ারিজমের জালালউদ্দীন পরাজিত হয়ে যখন সুলতান ইলতুতমিশের কাছে আশ্রয় চেয়েছিলেন, ইলতুতমিশ তখন তাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন। কিন্তু আলাউদ্দীন খিলজি এই মঙ্গোলদের হুমকি থেকে হিন্দুস্তানকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হন।

১২৯৭ সালে জলন্ধরে সুলতানের বাহিনীর মুখোমুখি হয় একটি মঙ্গোল বাহিনী। সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির সেনাপতি জাফর খান তাদের শোচনীয় ভাবে পরাজিত করেন। মঙ্গোলরা এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পুনরায় হামলা চালিয়ে দিল্লির শিরি দুর্গটি দখল করে নেয়। জাফর খান তাদের পরাজিত করে শিরি দুর্গ পুনরুদ্ধার করেন। সেই সাথে ২ হাজার মঙ্গোল যোদ্ধাকে বন্দী করে নিয়ে আসা হয়। শিরি দুর্গের নামকরণের পেছনে একটি মজার ব্যাপার আছে। এ দুর্গটির প্রকৃত নাম ছিলো দারুল খিলাফত। একবার এই দুর্গে প্রায় ৮ হাজার মোঙ্গল সৈন্যের শিরচ্ছেদ করা হয়, যার ফলে দুর্গটির নামই হয়ে যায় ‘শিরি’।

১২৯৯ সালে মঙ্গোলরা পুনরায় দুয়া খানের পুত্র কুতলুগ খাজার নেতৃত্বে প্রায় ২ লাখ সৈন্য নিয়ে হিন্দুস্তানে অভিযান চালায়। তারা আবারো শিরি দুর্গটি দখল করে নেয়। শিরি দুর্গের দখল নিয়ে তারা দিল্লির দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। মঙ্গোলদের আক্রমণের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা আক্রমণের সময় লুটপাট করতে করতে আসে। কিন্তু আলাউদ্দীন খিলজি লক্ষ্য করলেন এবার আর তারা লুটপাট না করে সরাসরি দিল্লির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাঁর মানে এবার চূড়ান্ত একটি লড়াই হতে যাচ্ছে, কারণ আক্রমণের লক্ষ্য এবার খোদ দিল্লিই! জাফর খানকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে আলাউদ্দীন খিলজি মঙ্গোলদের বাঁধা দিতে এগিয়ে আসেন। দুর্ধর্ষ জাফর খানের হাতে মঙ্গোলরা আরো একবার পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করে পিছু হটতে থাকে। তবে এই যুদ্ধে সেনাপতি জাফর খান নিহত হন।

সুলতান যখন চিতোর দুর্গ অবরোধে ব্যাস্ত ছিলেন, মঙ্গোলরা আরেকবার হিন্দুস্তানে আক্রমণ চালায়। তবে এবার মঙ্গোল সেনাবাহিনীর আকার তুলনামূলকভাবে অনেক ছোট ছিলো। তবে এই আক্রমণের ফলে সুলতান বেশ বিপর্যয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। তাই এরপর তিনি সীমান্তবর্তী অঞ্চলের নিরাপত্তার জোরদার করার জন্য আরো বেশ কয়েকটি দুর্গ নির্মাণ করেন। উন্নত অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন করেন। তবে এরপরও আলী বেগ ও তারতাক খানের নেতৃত্বে আবারো মঙ্গোলরা আক্রমণ চালিয়ে পাঞ্জাব দখলে নিয়ে নেয়। অনেকটা প্রথানুযায়ীই তাদের আবারো পরাজিত করে দিল্লির সেনাবাহিনী পাঞ্জাবের দখল নিয়ে নেয়! অন্যদিকে, ১৩০৬ সালে কাবাক খান আর ১৩০৮ সালে ইকবালের নেতৃত্বে মঙ্গোলরা পুনরায় আক্রমণ চালালে মঙ্গোলদের পুরো সেনাবাহিনীই ধ্বংস করে দেয়া হয়।

১৩০৬ সাল থেকে দিল্লি সেনাবাহিনী একটি বিশেষ কৌশল অবলম্বন করতে থাকে। এসময় থেকে চেষ্টা করা হতো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে একজন মঙ্গোল সেনাও যেন জীবন নিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে। কারণ এই পলাতক যোদ্ধারাই আবার পরবর্তী অভিযানগুলোতে অংশগ্রহণ করতো। আর যুদ্ধে যারা বন্দী হতো, তাদের সোজা হাতির পায়ের নিচে ফেলে পিষ্ট করা হতো। সুলতান মঙ্গোলদের এত কঠোরভাবে দমন করেন যে, এই ১৬টি যুদ্ধে প্রায় ৩ লাখ মঙ্গোল সেনা তাঁর হাতে নিহত হয়! ১৩০৮ সালের পর মঙ্গোলরা ভুলেও আর হিন্দুস্তানের দিকে তাদের বিষাক্ত দৃষ্টিতে তাকাতে সাহস করে নি। তাঁরা হিন্দুস্তানের সুলতান আলাউদ্দীন খিলজিকে এতটাই ভয় পেতো যে, তারিক-ই-ফিরোজশাহীর বর্ণনানুযায়ী, সুলতানের সেনাপতি মালিক গাজী প্রতি শীতকালে মঙ্গোল সীমান্তে গিয়ে তাদের যুদ্ধের জন্য আহবান করতেন। কিন্তু মঙ্গোলরা কখনোই আর হিন্দুস্তান অভিমুখে এগিয়ে আসার ধৃষ্টতা দেখায় নি!

হিন্দুস্তানের ইতিহাসে সুলতান অন্য আরেকটি দিক দিয়েও অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। আর তা হলো সুলতানের ব্যাপক সামরিক সক্ষমতা। তারিক-ই-ফিরোজ শাহীর তথ্যনুযায়ী, সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির অধীনে ৭০ হাজার রিজার্ভ অশ্বসহ প্রায় সাড়ে ৫ লাখ অশ্বারোহী, ৯ লাখ পদাতিক সৈন্য, ৭০ হাজার রণহস্তীর বিশাল এক সেনাবাহিনী ছিলো, যা হিন্দুস্তানের ইতিহাসে অন্য আর যেকোনো শাসকের চেয়ে অনেক বেশিই। তবে তাঁর বিজয়ের পেছনে সেনাবাহিনীর এই বিশাল আকার মুখ্য ছিলো না। বরং দক্ষতাই তাঁর বিজয়ের কারণ ছিলো। জিয়াউদ্দীন বারানীর তথ্যসূত্র থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি মাত্র ৬,০০০ সৈন্য নিয়ে মালব, যাদব, গন্ডয়ানা আর বেরার জয় করে ফেলেন। অথচ যাদব রাজ্য ছিলো বিশাল এক ভূ-খন্ড জুড়ে বিস্তৃত। কেউই এই মাত্র ৬,০০০ সৈন্যর মোকাবেলা করতে পারে নি।

এছাড়া হিন্দুস্তানের প্রতি সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির আরেকটি বৃহৎ অবদান হচ্ছে, দাক্ষিণাত্যকে হিন্দুস্তানের মূল ভূ-খন্ডের সাথে একত্রিত করা। হিন্দুস্তানের মূল ভূ-খন্ড থেকে দাক্ষিণাত্য সবসময়েই আলাদা ছিলো। তবে, গৌড় শাসনামলে দাক্ষিণাত্যের শেষ সীমানা কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত গৌড় শাসন পৌঁছুতে পেরেছিলো। এরপর আর কোনো শাসকই দাক্ষিণাত্য শাসন করতে পারেন নি। কিন্তু সুলতান আলাউদ্দীন খিলজি ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি দাক্ষিণাত্য বিজয় করতে পেরেছিলেন। তবে দাক্ষিণাত্যকে সরাসরি নিজ শাসনে না নিয়ে আগের রাজাদেরই নিজের অধীনে নিয়োগ দেন। ‘তারিক-ই-আলাই’-এর বর্ণনানুযায়ী, এসব রাজারা সুলতান আলাউদ্দীন খিলজিকে নিয়মিত জিজিয়া আর খাজনা আদায় করে নিজ নিজ সিংহাসন অধিকারে রাখার সুযোগ পেয়েছিলেন।

আলাই মিনার। পুরাতন দিল্লীর কুতুব মিনার কমপ্লেক্সে এই মিনারটি অবস্থিত। সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির দাক্ষিণাত্য বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে এই মিনারটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। এর নির্মাণ শুরুর সালটি সঠিকভাবে জানা না গেলেও ধারণা করা হয়, ১৩০০ সালের দিকে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৩১৬ সালে সুলতানের মৃত্যুর সময় মিনারটির মাত্র এক তলা সম্পন্ন হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পরবর্তীতে এর নির্মাণকাজ আর অগ্রসর হয় নি; সূত্র: livehistoryindia.com

মানুষ এবং শাসক- এই দুটি ক্ষেত্রেই সুলতান আলাউদ্দীন খিলজি ছিলেন মিশ্র চরিত্রের। প্রথম জীবনে ভয়াবহ রকমের মদ্যপানে আসক্ত ছিলেন। তাঁর মদ্যপান এমন পর্যায়ে পৌছেছিলো যে, তিনি একবার মাতাল অবস্থায় নতুন একটি ধর্মপ্রচার করতে চেয়েছিলেন। তবে পরে অবশ্য তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং মদ্যপান ত্যাগ করেন। তিনি অনুধাবন করতে পারেন, মদ মানুষকে উদ্ধত করে তোলে, সৎ গুণ নষ্ট করে দেয়। তাই গোটা সাম্রাজ্যে তিনি মদপান নিষিদ্ধ করেন। এমনকি মদ উৎপাদনেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তাঁর সময়ে হিন্দুস্তানে ব্যভিচার আর বিকৃত যৌনাচার ‘সমকামিতা’ নিষিদ্ধ করা হয়।

একজন সুলতানের সুষ্ঠুভাবে শাসন করার জন্য প্রয়োজন হয় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরের বিভিন্ন গোপন তথ্যের। আর এসব তথ্য সংগ্রহ করার জন্য গোটা রাজ্যজুড়ে তিনি অসংখ্য গুপ্তচর ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছিলেন। এ গুপ্তচরেরা রাজ্যে সুলতানের চোখ-কান হিসেবে কাজ করতো। রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থেকে শুরু করে অতি তুচ্ছ তথ্যও মূহুর্তেই সুলতানের কাছে পৌছে যেতো!

হিন্দুস্তানের ইতিহাসে সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির পূর্বে সেনাবাহিনীর সদস্যরা নির্দিষ্ট কোনো বেতন পেতেন না। বরং তাদের জমির জায়গীর দান করা হতো। তিনি এই জায়গীর ব্যবস্থার পরিবর্তন করে সেনাবাহিনীর সদস্যদের নির্দিষ্ট বেতন দেয়ার রীতি শুরু করেন। তাঁর সময়ে একজন অশ্বারোহী সৈন্যের বেতন ছিলো প্রায় ২৩৮ তঙ্কা।

সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির সময়কার একটি রৌপ্য মুদার; সূত্র: coinindia.com

সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির সময়ে সাম্রাজ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছিলো ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ’ করা। এ ব্যবস্থায় নিত্য ব্যবহার্য প্রতিটি পণ্যের মূল্যই রাষ্ট্র থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হতো। শুধু নির্ধারণ করে দিয়েই তিনি তাঁর দায়িত্ব থেকে হাত গুটিয়ে নিলেন না। বরং তাঁর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মানা হচ্ছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করে গুপ্তচররা নিয়মিত সুলতানকে রিপোর্ট করতো। গুপ্তচররা ঘুরে ঘুরে বাজার পর্যবেক্ষণ করতেন। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বাজারমূল্য বেশি হলে বিক্রেতাদের কঠোর শাস্তি প্রদান করা হতো। সেই সময়েও ব্যবসায়ীদের ওজনে কম দেয়ার প্রবণতা ছিলো। তবে এর জন্যও ছিলো কঠোর শাস্তির বিধান। ওজনে কম দিয়ে কোনো ব্যবসায়ী ধরা খেলে যতটুকু ওজন কম দেয়া হয়েছে, ঠিক ততটুকু মাংস তার শরীর থেকে কেটে নেয়া হতো। ফলে ধীরে ধীরে ওজনে কম দেয়ার মতো জঘন্য এই মানসিকতা থেকে ব্যবসায়ীরা সরে আসে। ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানী বলেন, সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এতোটাই কঠোর ছিলো যে, দুর্যোগের সময়ও বাজারমূল্য ওঠানামা করতো না। তবে দুর্যোগ কিংবা অন্য কোনো কারণে বাজারে পণ্য সরবরাহ হ্রাস পেলে যাতে পণ্যমূল্য ওঠানামা না করে, সেজন্য রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে গুদামে পণ্য মজুদ রাখা হতো। সরবরাহ কমে গেলে গুদাম থেকে পণ্য সরবরাহ করে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা হতো। দ্রব্যমূল্য কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও, প্রশাসনের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যে ঘুষের রীতি প্রচলিত ছিলো, তা সুলতান আলাউদ্দীন খিলজি কঠোরহস্তে নির্মূল করেন।

সুলতান আলাউদ্দীন খিলজি প্রায় ২০ বছর প্রচন্ড প্রতাপের সাথে হিন্দুস্তান শাসন করেন। শাসক হলেও তিনি মানুষ ছিলেন। আর মানুষের বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকেই। যেমন: প্রাথমিক জীবনে তিনি ভয়াবহ মাত্রার মদ্যপায়ী ছিলেন। তিনি তাঁর চাচা ও পূর্ববর্তী সুলতান জালালউদ্দীন মালিক ফিরোজ খিলজিকে হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন সূত্রে তাকে নারীদের প্রতি বিশেষ আসক্ত হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁর সময়ে করের হারও কিছুটা বেশি ছিলো। তবে এসব ছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে আরো দুটি গুরুতর অভিযোগ আছে। প্রথমত, তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় যে অভিযোগ, তা হচ্ছে তিনি নাকি একজন সমকামী ছিলেন! এই অভিযোগের আসলে কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। তাছাড়া, গোটা হিন্দুস্তানে যিনি সমকামীতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, সেখানে তিনি নিজে কীভাবে সমকামী হন! আসলে ইউরোপিয়ান সূত্রগুলো তাকে সমকামী হিসেবে উল্লেখ করে। এর কারণও আছে। সুলতানের জীবনে তাঁর সেনাপতি মালিক কাফুরের বেশ ভালো প্রভাব ছিলো। এ থেকে ইউরোপিয়ান সূত্রগুলো ধারণা করে সুলতান সমকামী ছিলেন। কারণ ইউরোপের অনেক শাসকই সমকামী ছিলেন। আর যারা সম্রাটের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বজায় রাখতো, তাদের ভেতরেই কেউ না কেউ তার সঙ্গী হতো। এ থেকে ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ তাকে সমকামী হিসেবে চিহ্নিত করে, যা আসলে একটি জঘন্য মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই না।

দ্বিতীয় অভিযোগ হলো, সুলতান আলাউদ্দীনের সাথে চিতোরের রানী পদ্মাবতীকে যুক্ত করে যে গল্পটি প্রচলিত আছে সেটি। এর ঐতিহাসিক সত্যতা নির্ণয় করা যায় নি। মূলত, ১৫৪০ সালে মালিক মুহাম্মদ জায়সী নামের এক কবির লেখা কবিতা ‘পদুমাবৎ’ এই গল্পটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। এরও এক শতাব্দী পর আরাকান রাজদরবারের সভাসদ কবি আলাওল এই ‘পদুমাবৎ’ এর অনুবাদ করেন! সুতরাং, আলাউদ্দীন খিলজি আর রানী পদ্মাবতীর সম্পর্কটি নিছক গল্প ছাড়া আর কিছুই না।

সুলতান আলাউদ্দীন খিলজি হিন্দুস্তানের উত্তর আর দক্ষিণ ভূ-খন্ড মিলিয়ে বিস্তৃত এক সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন। হিন্দুস্তান শাসনে তাঁর সফলতা এতই বেশি যে, যদি তাকে দিল্লি সালতানাতের শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে অভিহিত করা হয়, তবে তা মোটেই বেশি বলা হয়ে যাবে না। প্রায় ২০ বছর হিন্দুস্তান শাসনের পর ১৩১৬ সালের ৪ জানুয়ারী তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে হিন্দুস্তান যেন তার আরেকটি নক্ষত্র হারালো।

১৩১৬ সালে আলাউদ্দীন খিলজী মৃত্যুবরণ করলে সেনাপতি মালিক কাফুরের সহায়তায় খিলজি সালতানাতের তৃতীয় সুলতান হিসেবে ক্ষমতায় বসেন শিহাব-উদ-দ্বীন ওমর খান খলজি। তবে মালিক কাফুর নিহত হলে তাঁর ভাই কুতুব উদ্দীন মুবারক ১৩১৬-২০ সাল পর্যন্ত দিল্লি সালতানাতে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিলো ২০ বছর। তাঁর শাসনামলে বিশৃংখল অবস্থার তৈরি হয়। তিনি ঘন ঘন প্রশাসনে পরিবর্তন আনতে থাকেন। তিনি খসরু খান নামের একজনকে সভাসদ হিসেবে নিয়োগ দেন। কিন্তু এই খসরু খানের হাতেই ১৩২০ সালে নিহত হন তিনি। আর এর সাথে সাথেই পতন ঘটে হিন্দুস্তানের ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী খিলজি রাজবংশের।

খসরু খান পরবর্তীতে সুলতান নাসরুদ্দীন খসরু শাহ নাম নিয়ে সিংহাসনে বসেন। কিন্তু ১৩২০ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে দিপালপুরের গভর্ণর গাজী মালিকের কাছে পরাজিত হন এবং মস্তক দ্বিখণ্ডিত করে তাঁর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।

তথ্যসূত্র:

১। তারিখ-ই-ফিরোজশাহী (জিয়াউদ্দীন বারানী)

২। তারিখ-ই-আলাই (আমির খসরু)

৩। A Comprehensive History of India: The Delhi Sultanat (A.D. 1206-1526), ed. by Mohammad Habib and Khaliq Ahmad Nizami

৪। ইতিহাসের ইতিহাস- গোলাম আহমেদ মোর্তজা

৫। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়- সাহাদত হোসেন খান

৬। ভারতবর্ষের ইতিহাস- কোকা আন্তোনোভা, গ্রিগোরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি

৭। বিশ্বসভ্যতা- এ. কে. এম. শাহনাওয়াজ

এই সিরিজের আগের পর্ব

১। প্রাক-মুঘল যুগে হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা
২। তরাইনের যুদ্ধ: হিন্দুস্তানের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া দুই যুদ্ধ
৩। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: দাস শাসনামল
৪। রাজিয়া সুলতানা: ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক

ফিচার ইমেজ: mountainsoftravelphotos.com

Related Articles