যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের তথ্যমতে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার আকাশে দেখা যায় চীনের নজরদারি বেলুন। সংস্থাটি আরো জানায়, পৃথিবীর ৪০টি দেশের আকাশে দেখা যায় চীনের নজরদারি বেলুন। চীনের ভাষ্যমতে, বেলুনগুলো আবহাওয়ার কাজে ব্যবহৃত এবং ভুল করে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার আকাশে চলে যায়। স্পাই বেলুন দিয়ে গোয়েন্দা তৎপরতা চালানো কিংবা সামরিক কাজে ব্যবহার নতুন নয়। চলুন স্পাই বেলুনের ইতিহাস নিয়ে কিছু জানা যাক আজ।
স্পাই বেলুন
বিংশ শতকে প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি ঘটে, যার ছোঁয়া লাগে সামরিক কার্যক্রমেও। একে একে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো মহাকাশে ওড়ায় তাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট। এই স্যাটেলাইটগুলো ব্যবহৃত হতো বিভিন্ন কাজে। সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহেও শুরু হয় স্যাটেলাইটের ব্যবহার। আধুনিকায়ন হয় গোয়েন্দা তৎপরতায়। কিন্তু গুপ্তচরবৃত্তি কিংবা যুদ্ধে বোমাবর্ষণের কাজে বহু আগে থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে বেলুন। স্পাই বেলুন মূলত পর্যবেক্ষণের কাজে ব্যবহৃত বিশেষ ধরনের বেলুন যা একটি বায়ুবাহিত প্লাটফর্ম হিসেবে কামান, যুদ্ধরত সেনাদের অবস্থান, এবং তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যবহৃত হয়।
বর্তমান যুগে এসেও পর্যবেক্ষণ বা গোয়েন্দা কাজে বেলুন ব্যবহার করার কারণ, প্রথমত এর কাছাকাছি থেকে ভূখণ্ডের বিস্তীর্ণ অংশ স্ক্যান করার ক্ষমতা। দ্বিতীয়ত, টার্গেট অঞ্চলে দীর্ঘ সময় ব্যয় করার ক্ষমতা, যা স্যাটেলাইটের পক্ষে দুরূহ। তৃতীয়ত, এর জন্য খরচ পড়ে কম। স্যাটেলাইট দিয়ে পর্যবেক্ষণে সময় ও খরচের চেয়ে বেলুন বেশ সাশ্রয়ী।
ইতিহাসের পাতায়
প্রথম কাগজের তৈরি একধরনের গরম বায়ুবেলুন ব্যবহৃত হয় খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে চীনে, যখন চীনে হান রাজবংশের শাসন চলছে। হান রাজবংশের চ্যান্সেলর ও সামরিক কৌশলবিদ ঝুগে লিয়াং তখন উই রাজবংশের জেনারেল সিমা ই কর্তৃক চীনের পিনলো প্রদেশে আবদ্ধ ছিলেন, তখন তিনি শত্রু সৈন্য দ্বারা বেষ্টিত অবস্থায় তার নিজ উদ্ধারকারী বাহিনীকে সংকেত পাঠাতে একটি লণ্ঠনের মতো কাগজের তৈরি বেলুন পাঠান, যার উপর লেখা ছিল একটি বার্তা। আগুনের ফলে সৃষ্ট গরম বাতাসে যা উপরে উঠতে থাকে। ঝুগে লিয়াংয়ের ভিন্ন নাম ছিল কংমিং। বেলুনটি দেখতে লণ্ঠনের মতো এবং আগুন ব্যবহৃত হয় বলে ইতিহাসে কংমিং লণ্ঠন বলেই পরিচিত। অতপর এটি চীনে সামরিক কাজে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়। পরবর্তীতে লগ্ননিকার যুদ্ধে মঙ্গোলিয়ান বাহিনীও এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে। বর্তমানে ঝুগে লিয়াংয়ের স্মরণে চীনে পালিত হয় লণ্ঠন উৎসব, যা চীনা বর্ষপঞ্জীর প্রথম মাসের ১৫ তারিখ পালিত হয়।
ফরাসি যুদ্ধে বেলুন
১৭৯৪ সালে ফ্লুরাসের যুদ্ধে ব্রিটেন-ডাচ-জার্মান কোয়ালিশন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ফরাসি অ্যারোস্ট্যাটিক কর্পস প্রথম কটন ও সিল্ক মিশ্রণে তৈরি বেলুন উড়িয়ে পর্যবেক্ষণ চালায়। যুদ্ধে ফরাসি বাহিনী জয়লাভ করে, যার জন্য পরবর্তীতে ফরাসি অ্যারোস্ট্যাটিক কর্পস ফরাসি সেনাবাহিনীর অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়। যদিও চার বছর পর ১৭৯৯ সালে নেপোলিয়ন দ্বারা সেটি বিলুপ্ত করে দেয়া হয়। নেপোলিয়ান পরবর্তীতে চেয়েছিলেন বেলুনের সাহায্যে ইংল্যান্ড আক্রমণ করতে।
আমেরিকার গৃহযুদ্ধে বেলুন
ফরাসিদের ফ্লুরাসের যুদ্ধের ৬০ বছর পর আবার সামরিক বেলুনের ব্যবহার দেখা যায় আমেরিকার গৃহযুদ্ধে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধে কনফেডারেট এবং ইউনিয়ন উভয় বাহিনী শত্রুসেনাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে টিথারযুক্ত বেলুন ব্যবহার করত। ইউনিয়ন বাহিনীর বেলুন ব্যবহার ছিল কনফেডারেট বাহিনীর চেয়ে বেশি। ইউনিয়ন বাহিনীর হয়ে থাডিউস লো নামের এক বিজ্ঞানী গ্যাসের বেলুন তৈরি করেন যা কনফেডারেটদের পক্ষে ভূপাতিত করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া লো একটি পোর্টেবল হাইড্রোজেন গ্যাস জেনারেটরও আবিষ্কার করেন এটা নিশ্চিত করতে যে তার বেলুনগুলো শহরের গ্যাসের উপর নির্ভরশীল নয়। পরবর্তীতে দু’পক্ষই বেলুন দিয়ে পর্যবেক্ষণ বন্ধ করে দেয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বেলুন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হাইড্রোজেন ভর্তি বেলুনের ব্যাপক ব্যবহার হয়। যুদ্ধে দু’পক্ষ থেকেই বেলুনের ব্যবহার হয়েছিল। শত্রুঘাঁটিতে বোমা হামলা, শত্রুদের অবস্থান জানা ও তাদের পর্যবেক্ষণে বেলুনের ব্যবহার করা হয়েছিল। ইঞ্জিন ও পাখাচালিত বেলুনও প্রথম ব্যবহৃত হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে, যেগুলো মূলত ১,২০০-১,৮০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত উড়তে পারত। এই বেলুন বাতাসের বিপরীতে ইঞ্জিনে চলতো, যার দরুন সেটি দিয়ে ভারী মারণাস্ত্র পাঠানো যেত। তাছাড়া, বেলুনটি চলতো ধীরগতিতে। ফলে নির্দিষ্ট এলাকায় বেশি সময় ধরে অবস্থান করতে পারত এবং পর্যবেক্ষণ সুচারুভাবে সম্পন্ন করা যেত। এই ধরনের বেলুন নির্দিষ্ট সীমানা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা যেত, ক্যামেরার পাশাপাশি বহন করতে পারত মানুষও। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে সাবমেরিনের পর্যবেক্ষণের কাজেও ব্যবহৃত হয় বেলুন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বেলুনের ব্যবহার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বেলুনের ব্যবহার ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে বেশি। যুদ্ধে ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাপান, জার্মানিসহ উভয়পক্ষ ব্যাপক ব্যবহার করে এই বেলুনের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে উন্নত হয় বেলুনের কার্যক্ষমতা, যা উড়তে পারতো ১,৪০০ ফুটের বেশি উপরে। নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাতেও আসে উন্নয়ন, যা ধ্বংস করতে পারত শত্রুবিমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯০০ বেলুন পাঠায়, যাতে ছিল বোমা। ফো-গো নামের এই বেলুন দিয়ে মে ১৯৪৫ সালে তারা হামলা করে যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কল্পনা করতে পারেনি এত বেলুন দিয়ে জাপান আক্রমণ করবে। অবশেষে বিশ্বকেও অবাক করে যুক্তরাষ্ট্র নিউক্লিয়ার বোমা নিক্ষেপ করে জাপানে।
বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সামরিক বেলুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শুরু হয় আদর্শিক দ্বন্দ্বের লড়াই বা স্নায়ুযুদ্ধ। স্নায়ুযুদ্ধকালীন মার্কিন সামরিক বাহিনী পারমাণবিক অস্ত্র শনাক্তকরণ এবং নজরদারির জন্য অত্যধিক উচ্চতাসম্পন্ন বেলুনিং প্রোগ্রাম শুরু করে। ১৯৫৩ সালে প্রজেক্ট মবি ডিকের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নজরদারি শুরু করে। এছাড়াও উন্নত প্রযুক্তির বেলুন তৈরি করতে শুরু করে প্রজেক্ট মোগুল, প্রজেক্ট জেনেট্রিক্স। ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিনীদের তৈরি বেলুন ব্যবহৃত হয়।
সবশেষে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে সামরিক বেলুনের ব্যবহার দেখে বিশ্ব। চীনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বেলুন তৈরি করেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আকাশেও দেখা গেছে চীনের পর্যবেক্ষণ বেলুন, যা নিয়ে বিশ্বজুড়ে তৈরি হয় উত্তেজনা।
ভবিষ্যতে কী হতে পারে?
অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স স্টাডিজের অধ্যাপক ব্লাক্সল্যান্ডের মতে, আপনি একটি বেলনের নিচে কী যুক্ত করতে পারেন তার কোনো সীমা নেই। অর্থাৎ বর্তমান প্রযুক্তির যুগে বেলুনকে বাহন বানিয়ে একজন যা ইচ্ছে আকাশে ওড়াতে পারছে। একদম শুরুর দিকে বেলুন দিয়ে শুধু সংকেত পাঠানো হলেও ধীরে ধীরে তাতে আসে পরিবর্তন। এভাবে ভবিষ্যতে বেলুনে করে উড়ে আসতে পারে ক্ষতিকর পদার্থ, রাসায়নিক দ্রব্য, আধুনিক অস্ত্র, কিংবা ক্ষতিকর মহামারির ভাইরাস, যা ধ্বসের কারণ হতে পারে গোটা একটি জাতির।